ভগবানের সঙ্গে যা হয়েছিল তা স্পষ্ট আমার মনে নেই। খাটো হাতের এমনই মহিমা। মুহূর্তে মুহূর্তে জীবনের ছবি বদল হয়। জীবন বদল হয়। কত রকম তার ছবি। ভগবান হুজুর আমাকে বলেছিল। জগতে সব কিছু মনে রাখা যায় না। কেউ কেউ কিছু ভুলে যায় না। আমিও তাই। আমি মনে রেখেছি নিজের মতো করে। আসলে আমি চিরকাল ভিখিরি। বাবা ভিখিরি ছিল, তার বাবা ভিখিরি হয়ে গিয়েছিল। ঠাকুরদার বাবা জমি রেখে গিয়েছিল অনেকটা। বন কেটে বসত। অনাবাদী পতিত জমি আবাদী করেছিল। লোকটা খুব খাটতে পারত। আমার ঠাকুরদাও নদীর চর দখল করে চাষাবাদ বাড়িয়েছিল। বাবার আমলে সেই জমি থেকে উচ্ছেদ করতে আমাদের ঘর পুড়িয়ে, অল্প বয়সী মেয়েকে লুট করে তাড়িয়ে দিতে আমরা ভিখিরি। আমি পথের ধারে বসে হাত পেতে ভিক্ষে করি। আমার বউ ছিল। সে ভিখিরির সঙ্গে থাকবে না বলে আর একজনের সঙ্গে সংসার বেঁধেছে। তার দ্বিতীয় পক্ষ রিকশা চালায়। গ্রামে জমি আছে দুবিঘে। চাষের সময় যায়। ধান কাটার সময় যায়। রাস্তার ধারে ঝুপড়ি বেঁধে থাকে। মেয়েকে নাকি ইস্কুলে দিয়েছে। সবই শোনা কথা। সাতবাড়ি কাজ করা আমার বউ আমাকে দেখলে রাস্তা পার হয়ে অন্য ফুটপাথে চলে যায়। আমি বসে বসে খিস্তি দিই তাকে। একদিন একটা লম্বা দুধ শাদা গাড়ি রাস্তা দিয়ে যেতে আচমকা থেমে গেল, আমি আমার লম্বা হাত নিয়ে এগিয়ে গেছি, ভগবান আপনার ভাল করবেন, কিছু দিয়ে যাবেন বাবু।
হাত সরা হাত সরা। ধমকে উঠে লোকটা বলল, ভিক্ষে করতে করতে তোর হাত খুব লম্বা হয়ে গেছে শুয়ার, গাড়ির ভিতরে ঢুকে আসে, তুই এইখেনে থাকিস ?
জি হুজুর, ইয়েস স্যার।
উফ, কী গন্ধ এখেনে। নাকে রুমাল দিয়ে লোকটা গাড়ির ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল , এইরকম একজনকে খুঁজছিলাম, তোকে আর ভিক্ষে করতে হবে না, থুহ, কী পচা গন্ধ তোর গায়ে।
না স্যার, ইঁদুর মরেছে, পচা ইঁদুরের গন্ধ।
ওয়াক! বমি এসে যাচ্ছে, আমার লোক আসবে তোকে নিয়ে যেতে।
লোকটার ধবধবে পায়জামা পাঞ্জাবি। মাথায় গেরুয়া হলুদ পাগড়ি। গালে ছাঁটা দাড়ি, শাদা কালো মিশানো। চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু চিনতে পারি না। একটু পিছিয়ে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনার নাম?
আমি কে ডি ভি। দূরে দাঁড়িয়ে নাকে রুমাল দিয়ে লোকটা বলল, ম্যায় কেডিভি হুঁ।
স্যার আপনি ভগবান।
ইয়েস ম্যায় ভগোয়ান হুঁ, আমার লোক এসে তোকে আমার প্যালেসে নিয়ে যাবে। বলতে বলতে গাড়ি হুস করে চলে গেল। রাস্তায় একটা সোনার টাকা। লম্বা হাত বাড়িয়ে আমি তুলে নিলাম। চাইতে চাইতে হাত সত্যিই লম্বা হয়ে গেছে, সোনার টাকা হলো সোনালি দশ টাকার কয়েন।
সকালে উঠে জোড়া শালিক দেখিনি। নিঃসঙ্গ এক দাঁড় কাক দেখেছিলাম সবদিনের মতো। আর একটি বড় সাইজের মরা ইঁদুর। রক্তপুঁজ মাখা ইঁদুরটিকে ঠোকরাচ্ছিল কাক। জমাদার এসে বেলচা ঠেলে ইঁদুরটিকে সরিয়ে দিয়েছে রাস্তার ধারে। গম্ভীর দাঁড় কাক ডানা ভাসিয়ে একবার চাদ্দিক ঘুরে এসে কদম ডালে বসে নিরীক্ষণ করছিল ইঁদুরের শব। কয়েকটা পাতি কাক হামলে পড়ছিল পচা ইঁদুরের উপর। লোকটা যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখানেই ইঁদুরটা ছিল। গন্ধটা কি মুছে গেছে? লোকটা ছিল খুব ফর্শা, যাকে বলে দুধে আলতায়। মাথায় চুল কম, তা পাগড়ি খুললে পরে বুঝেছিলাম। বেশ গায়ে গতরে মানুষ। দুধ ঘি মাখন, মাছ, মাংস খাওয়া শরীর। যাই হোক কিছুক্ষণ বাদে তার লোক চলে এল। আমি তখন আশা ছেড়ে দিয়েছি। মনে মনে গাইছি,
বল হরি, হরিবোল
মরা ইঁদুর খাটে তোল।
মা গঙ্গা তারে নে
ঘাট-কীত্তন হবে নে।
হ্যাঁ, দু ঘন্টা বাদেই ভগবানের লোক এসে আমাকে নিয়ে গেল। আমার বউয়ের দ্বিতীয় পক্ষের রিকশায় তুলল আমাকে, আর নিজে সেই ভগবানের বাহন আর এক রিকশায় চেপে আগে আগে চলল। বউয়ের দ্বিতীয় পক্ষর নাম মজিদ। মজিদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে একশো টাকা। মজিদ তো অবাক। আমি ভিখিরি, একশো টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে চলেছি কোথায় কোন অজানায় ? মজিদ জিজ্ঞেস করল, যাও কোথায় ?
গেলেই বুঝবি। আমি ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ তুলে বললাম।
তোমার বউরে তুমি নিয়ে যেতে পারতে।
কেন তোর রস শুকিয়ে গেল ?
মজিদ বলল, মেয়ে ইস্কুল যাবে, দ্যাখোদিনি কম জ্বালা, তোমার বউয়ের খাঁই অনেক, মেয়ে কম্পিটার শেকবে, তারও টাকা চাই, রিকশা ভাড়া নিয়ে রোজ বাবুদের সঙ্গে গোলমাল, বলে বেশি চাই আমি, দু’টাকা হলেও কম দেবে।
ঐ বউয়ের মুখই দ্যাখব না আমি, আর নেবই না, দরকারে নোতন বে করব, আমার কপাল খুলে যাচ্ছে। বলতে বলতে দেখতে পেলাম মস্ত এক শ্বেত প্রাসাদ। শ্বেত পাথরে রোদ ঝলকাচ্ছে। রামধনুকের মতো হিজিবিজি রঙ ফেটে পড়ছে। মজিদ সেই প্রাসাদ দেখে কাঁদতে লাগল, ওরে আমার স্যাঙাতরে, তুই এখেনে থাকপি রে, আমার কী হবে রে, আমার কথা বলে দ্যাখরে।
ভগবানের লোক বলল, এই থাম, ফোট এখেন থেকে, শালা বেজন্মার বাচ্চা।
মজিদ বলল, যা বলো ক্ষতি নেই, কিন্তু আমারে একটা সুযোগ দিও কত্তা, আমি এই বাড়ি ধুয়ামুছা করতে পারব, বাগানে ফুল ফুটাতে পারব, পাখিদের দানা দিতি পারব......।
মজিদ বলতে লাগল আমি ভিতরে ঢুকতে লাগলাম। ভগবান হুজুরের যে লোক তার প্রাসাদে আমাকে নিয়ে এল, রুমাল নাকে দিয়ে সে বলল, শ্যাম্পু কর চুলে, সাবান মাখ গায়ে, পরিস্কার জামা কাপড় পরে স্যারের সামনে আয়, কী নোংরা তুই, কাকে খুঁটে খুঁটে খায় না কেন তোকে হারামির বাচ্চা, বমি আসছে তোর গন্ধে ?
আঁজ্ঞে কত্তা বিয়ের পর কদিন সাবাং মেখেছিলাম, আর সাবাং মাখিনি কোনো কালে, তবে মাঝে মধ্যি মাটি দিয়ে গা ঘষি খুব।
যা বাথরুমে ঢোক, সাবান সোডা দিয়ে গরম জলে সেদ্ধ করলেও, তোর গায়ের ময়লা যাবে না।
নোংরা না বাবু, পথের ধুলো, দ্যাখেন আমার মাথায় হাত দিয়ে, ধুলো আর পোড়া মোবিলের তেল-কালি, পথের ধারে থাকি কি না।
কথা বলিসনে, যা পস্কার হয়ে আয়।
উফ, এরে বলে চানঘর! আমি চান ঘরে গিয়ে নিজের গায়ের গন্ধ শুঁকতে লাগলাম। হুঁ, পচা ইঁদুরের গন্ধ লেপ্টে গেছে গায়ে। এই গন্ধ কি যাবার? গঙ্গায় ডুব দিলে হয়তো যেত। নাকি আমাদের গাঙ মাতলায়? আমি জল ঢালতে লাগলাম। সাবাং ঘষতে লাগলাম। শ্যাম্পু দিলাম মাথায়। কিন্তু গন্ধ যেন যায়ই না। বুঝতে পারলাম গা থেকে তারা বেরিয়েও নাকের কাছ থেকে সরছে না। চানঘরে মরা ইঁদুরের গন্ধ ভেসে বেড়াতে লাগল। তার মানে আমার গা থেকে তারা মুক্তি পেয়ে চানঘরে ভাসছে। জলে গুলে যাচ্ছে। বাতাসে মিশে যাচ্ছে। শেষ অবধি আমাকে বেরতে হলো। দরজায় ধাক্কা মারছিল হুজুরের চেলা। আমার চান হলো। খোলতাই হয়ে বেরিয়ে এলাম। দুটো সাবাং গায়ে ঘষে ঘষে শেষ করে দিয়েছি। শ্যাম্পুর শিশি উপুড় করে মাথায় ঢেলে চুলের জট ছাড়িয়েছি। বাইরে কাচা জামা কাপড় ছিল। পরে নিলাম। ভগবানের বাহন বাবু এসে গায়ে সেন্ট ঢেলে দিতে দিতে বলল, তোর গা দিয়ে এখনো পচা গন্ধ বেরোচ্ছে।
তাই, আমি যে টের পাচ্ছিনে, মনে হয় চানঘরের বাতাসে।
হারামি বাথরুমটা অশুদ্ধ করে দিল, গঙ্গাপানি ক’ঘড়া লাগবে কে জানে। বাবু বলল।
এক ফোঁটা দিলেই হয়ে যাবে স্যার।
বাবু বিড়বিড় করছিল, গন্ধ আমার গায়ে না লেগে যায়।
গো-চোনা আর গোবর ছড়িয়ে দেবেন কত্তা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
দূর ভিখিরির বাচ্চা, তুই যেন পায়খানা পেচ্ছাপ করে এসেছিস বাথরুমে। ভগবানের বাহন বলল, তারপর আমাকে নিয়ে চলল ভগবানের কাছে। কত ঘর পেরিয়ে, কত বারান্দা, কত জানালা পেরিয়ে আমি পৌঁছে গেলাম তাঁর কাছে। তিনি ডাকলেন, আও বেটা আও।
হুজুর! আমার মনে হলো আমি স্বপ্ন দেখছি। আমি এখানে আসতে পারব এ আমার পরম সৌভাগ্য। মরা ইঁদুরের মুখ দেখলে এই হয়।
তিনি বললেন, বেটা তুই ভগবানের আশীর্বাদ পেয়ে এখানে এসেছিস।
হুঁজুর মা-বাপ।
তোকে আমার মনে ধরেছে।
হুঁজুর মা-বাপ।
ভিক্ষে করতে হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে এত লম্বা হাত হয়ে গেছে তোর, ওই হাত কত কাজ করতে পারে। তিনি বললেন।
হুজুর মা-বাপ। আমি দেখলাম না চেয়ে চেয়ে সব পেয়ে পেয়ে তাঁর হাত প্রায় টিভির রিমোট কন্ট্রোলের সাইজে খাটো হয়ে গেছে।
তোর জন্য কত কাজ পড়ে আছে। খাটো হাত নাড়িয়ে তিনি বললেন।
আহা, চোখে জল এসে গেল। মরা ইঁদুর আর জ্যান্ত দাঁড় কাককে আমি মনে মনে প্রণাম করলাম।
শ্যাম্পু সাবান মেখে চান করে এসেছিস তো?
আমি ঘাড় কাত করলাম।
তোর গা দিয়ে এখন পরম বিশুদ্ধ গোবরের গন্ধ ছাড়ছে, ছাড়ুক, গরিব মানুষের এইটা চিহ্ন। বলতে বলতে তিনি তাঁর রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রের মতো খাটো হাত আমার দিকে তাক করলেন বন্দুকের মতো। চোখে ধাঁধা লেগে গেল, রিমোট না স্যারের খাটো হাত। খাটো হাত না রিমোট? খাটো হাত নাড়িয়ে তিনি সুইচ দিলেন। মুখখানি আমার ঠান্ডা বাতাসে ভরে গেল। বাতাস না, তিনি বললেন, গঙ্গা পানি, আর গন্ধ থাকবে না।
আশ্চর্য গঙ্গা পানি, পানি কই ? রিমোটে গন্ধ নাকি চলে গেল। আমি অবশ্য জানি না, তিনি বললেন, আর গন্ধ নেই। গঙ্গা পানিতে সব শুদ্ধ।
আপনার হাতে গঙ্গা পানি থাকলে তবে তা হয় হুজুর, গরিব কোনোদিন আপনাদের মতো হবে না স্যার, পায়ের তলায় থাকবে, আপনি গঙ্গা পানি দিয়ে শুদ্ধ করে নেবেন।
হবে হবে, অপেক্ষা কর বেটা।
আমি তো হতে পারব না আপনার মতো, আমি ছোটলোক হুজুর, আমার জমি নিয়েছে বাবুরা, আমার পিসিকে লুট করেছিল বাবুরা, হুজুর মা বাপ, ইস্কুলে পড়ে আমার মেয়ে, তারেও লুট করবে কেউ নেশ্চয়, আর দু-তিন বছরে ডাগর হয়ে উঠবে। আমি বললাম।
সব ভুলে যা বেটা, এবার তুইই করতে পারবি লুটতরাজ, পিটিয়ে মারতে পারবি ছোটলোক, ছোটলোকের ভি বহুত কাজ আছে বেটা।
কেমন করে হবো?
ভগবান বলল, প্রথমে ডিরেস বদল কর বেটা।
বদল তো করে এসেছি স্যার।
আবার বদল করতে হবে বেটা।
আহা, মনে কত আনন্দ হলো যে বলার নয়। আবার পোশাক বদল। আমি তো একসময় প্রায় ল্যাংটো হয়ে পড়ে ছিলাম পথের ধারে। যা পরি তা দিয়ে আব্রু ঢাকে না। মাথা ঠুকলাম হুজুরের পায়ে, বিড়বিড় করলাম, হুঁজুর মা বাপ, আপনার আদেশে ধুয়ে গেল সব পাপ।
তিনি বললেন, এখানে যে ইউনিফরম পরে সবাই।
ইস্কুলে যেমন পরে ?
হ্যাঁ, তাই, বাঘছাল পিন্ধে সাধনা করবি তুই।
বাঘেরছালের মতো জামা কাপড়?
হাঁ, টাইগার স্কিন, তোকে বাঘ করে দেব বেটা।
তখন বাঘের মতো খাব, মাংস, গরু ছাগল মানুষ?
আরে ছ্যা ছ্যা, ঘি মাখন, সব্জি, প্রাণী হত্যা পাপ, লেকিন তুই পাবি, কেউ জানবে না।
তাইই হলো। আমি ভিখিরির অধম। খাওয়া জোটে না। মাথার উপর ছাদ বলতে কিছু নেই। হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে পেট চালিয়েছি। আমি এটা পারি। নিরিমিষ আমিষ, যা দেবে তাই খাব। আঁস্তাকুড় ঘেঁটে খাওয়ার অভ্যেস আমার, যা দেবে তাই খাব। যদি আমিষ না দেয়, সবদিকে হাওয়া উঠেছে প্রাণী হত্যা মহাপাপ, ছোটলোকের নেই কো মাপ। তবুও ইচ্ছে হলো, পেটপুরে শেষবারের মতো চিকেন, মাটন, বিরিয়ানি মোগলাই খাই। স্যার ভগবান বললেন, হবে হবে। নিরিমিষ মানে কি শুধুই নিরিমিষ, পাবি বেটা, তাগদ করতে হবে তো। তবু আমি এসেছি যে ডেরায়, সেখানে মাছ মাংস নিষেধ। আমি ভগবান হুজুরের কথায় পরে নিলাম বাঘ ছাল। জামা পায়জামা। পরা মাত্তর জামাটা কালো হয়ে গেল। ব্ল্যাক শার্ট । স্যার বলল, রিমোটে হলো, ব্ল্যাক শারটে জোস হবে বেটা।
হচ্ছে হুজুর। আমি বললাম। সত্যিই হচ্ছিল তাই। মনে হচ্ছিল কিছু একটা করে ফেলি। ছোটলোক নিকেশ করি বাইরে গিয়ে। শুয়ারের বাচ্চা মজিদ, আমার বউ নিয়েছিস, আমি ছাড়ব না, মুসলমানে বউ নিয়েছে, বউ তার বিবি হয়েছে, এমনি কেন ছাড়ব, ধরব আর মারব।
হাউ ডু ইউ ফিল বেটা?
বহুত আচ্ছা জি, ভিতরে এমন হচ্ছে যে ?
কেমন হচ্ছে ?
বুঝতে পারছি না স্যার, বডি পার্টস সব ভালো হয়ে গেছে মনে হচ্ছে, হাঁটুতে জোর এসেছে, রেপ মার্ডারের জোস এসেছে।
ভগবান স্যার বলল, তুমি আমাদের অ্যাপ্লিকেশনের ভিতরে এসে গেছ, এবার তোমার ভিতরের প্রবৃত্তিগুলো জাগাতে হবে।
আচ্ছা স্যার।
কিছু ফিল করছ ? স্যার হুজুর জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ, স্যার। আমি উত্তর দিলাম।
কী মনে হচ্ছে ?
ইচ্ছে হচ্ছে কিছু একটা করে ফেলি, মজিদকে আমি পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দেব।
আরে ওয়া, আর কী মনে হচ্ছে ? হুজুর ঝুঁকে পড়ল আমার উপর।
রক্ত স্যার, রক্ত দর্শনের ইচ্ছে হচ্ছে। আমি বললাম গরগর করে।
ভগবান হুজুর বলল, বাহ রে বেটা, তোর প্রোগ্রেস খুব ভালো, আমাদের কাজ মানুষের ভিতরের বাঘ জাগিয়ে তোলা, হিংসা জাগিয়ে তোলা।
আমার হবে স্যার ? জিজ্ঞেস করলাম হুজুরের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে।
হবে, ধ্যানে বসতে হবে, নিজের ভিতরের ভয়ানক রক্ততৃষা জাগিয়ে তুলতে হবে।
সাতদিন ধরে চলল ট্রেনিং। সামনে নিরিমিষ, গোপনে মাংস। মাংস খেয়ে না শরীর মজবুত করতে হবে। হুজুর বলল, তুমি দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত, তোমাকে সেই রকম হতে হবে, তুমি মাংস খাবে, না খেলে পারবে না মাংসাশী প্রাণী আর মানুষ মারতে।
আচ্ছা স্যার, আমার ভিতরে কেমন যেন হচ্ছে।
সাহস আসছে মনে? হুজুর জিজ্ঞেস করল।
ইয়েস স্যার। আমি বুক চিতিয়ে বললাম।
রেপ করতে পারবে ?
ইয়েস স্যার, রেপ করে ছিঁড়ে ফেলব দুই পা, মেয়েছেলে দেখিয়ে দিন।
রক্ত মাখতে পারবে মানুষের ?
ইয়েস স্যার।
সামনে এস। স্যার ডাকতে আমি তার কাছে গিয়ে বসি।
যা বেটা , বাঘের মতো ঝাপিয়ে পড়, মনে মনে বল খুন চাহিয়ে, খুন, মার্ডার, মার্ডার, মার্ডার……...।
আমি বুঝতে পারছিলাম এত বয়স পর্যন্ত আমার বিকাশ ছিল অসম্পূর্ণ। নখ আর শ্বদন্ত লুকিয়ে ছিল যা বেরিয়ে এসেছে। মনের ভিতরে আগুন জন্মেছে। এই দিনটার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। ছাড়ব না। একবার আমায় পিটিয়ে মেরেছিল তা মনে আছে। মরা ইঁদুরের মতো পথে পড়েছিলাম। আমার বন আমার পাহাড়, আমার ক্ষেত আমার খামার, আমার নদী, আমার আকাশ, আমার মেঘ…...সব নিয়ে নিল, মনে আছে সব। সা’জ্জন্মেও ভুলব না। ভুলিনি। মুখ চিনে রেখেছি। এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। আমাকে দিয়েই আমার সর্বস্ব লুট করেছিল তারা। শোধ নিতে আমি স্যার হুজুরের উপরই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, অনেক মাংস ওর গায়ে, অনেক রক্ত ওর শরীরে। কিন্তু সেই যে খাটো হাত রিমোট, তা নাচিয়ে সুইচ টিপে স্যার আমাকে আবার ভিখিরি করে দিল। যা বেটা, ভিখিরির জাত, আবার ভিখিরি হয়ে যা, সুযোগ দিলাম, সিনান করালাম কিন্তু কিছুই ভুলিসনি, পচা গন্ধ লুকিয়ে রেখেছিস, যা হারামি, ছোটলোকের বাচ্চা যা, ভাগ।
মজিদ মজিদ শুনছিস মজিদ ? ফিরে আমি মজিদের কাছে গেলাম।
মজিদ শুনতে লাগল, আমি বলতে লাগলাম। মজিদের বিবি এল। আমার বউ এল। শুনতে লাগল। আমি বলতে লাগলাম। আমাদের মেয়ে এল, শুনতে লাগল, আমি বলতে লাগলাম। দাঁড় কাক এল। আমি বলতে লাগলাম। সে শুনতে লাগল। আরো কারা এল, শুনতে লাগল, আমি বলতে লাগলাম। গ্রাম গঞ্জ ভেঙে লোক আসতে লাগল। তারা কেউ কেউ দল পাকিয়ে মেরেছে। আবার মরেছেও। তারা তাদের কথা বলতে লাগল। আমি এবার শুনতে লাগলাম। বলতে লাগলাম। লম্বা হাত বলতে লাগল খাটো হাতের কথা।