ঠাকুমার বাপের বাড়ির জ্ঞাতিগুষ্টি অপার বাঙ্গলার পূর্ব দিকে আজও রয়েছেন। তাঁর জীবিতকালে দুমাসে ছমাসে চিঠি পত্র আসতো দুই বাঙলার মাঝের কাঁটাতারের বেড়া জব্দ করে ।
ইস্কুল থেকে ফেরার সময় বাড়ির ডাকবাক্স খুলতাম আমি। আমার নজর থাকতো পোষ্টকার্ডের উপর সেঁটে থাকা বিদেশী ডাকটিকিটগুলোর ওপর। কত বুদ্ধি খাটিয়ে, চিঠির ক্ষতি না করে, সন্তর্পণে সেই টিকিট খুলে নিতাম। সেই বয়সে আমার আপ্ত সহায়ক ছিল -- কানাই। আমাদের পাচকঠাকুর রামবিলাস মিশিরের ভাগ্নে। বছর বারো বয়েস। ভাত -ডাল উনুনে বসিয়ে গাছে ওঠা, পাখির ছানা ধরা, নিখুঁত টিপে "পিট্টু"র দুর্গ উড়িয়ে দেওয়া -- এবং ইত্যবসরে ভাত-ডাল পুড়িয়ে ঝামা করা --- এমন কয়েক সের গুণের আধার ... কানাই।
পোষ্টকার্ড থেকে ডাকটিকিট খুলে নেওয়ার এক মোক্ষম উপায় বের করে ছিল সে।
কেটলি থেকে ফেলে দেওয়া চা-পাতার (গরম হলে কিন্তু চিত্তির -- ঝর্ণা কলমের লেখায় পাগলা ঝোরার ধারা প্রাপ্তি ঘটবে) একটা পুঁটুলি বানিয়ে, অতি সাবধানে টিকিটের ধার বরাবর খানিক ঘসলেই -- অবধারিত ভাবে সেটি খুলে আসতো। আসতোই। কানাই সর্বজ্ঞের মতো হাসত আর বলতো- " ই সব চিজ হাম বড়কা জানত রে! লে... তু টিকিস চিপকা কিতাব মে।"
★
ঠাম্মার কাছে চিঠি লিখত প্রধানতঃ তার ভাইঝি, বোনঝিরা .... কালেভদ্রে তার ভাইয়েরা। চিঠিগুলোও হতো খুবই একঘেয়ে। প্রণাম সম্ভাষণের পর গ্রামের কিছু খাস খবর --- কার বিয়ে ঠিক হয়েছে... পাত্র কী করে ... মেলা আর পার্বণের সারাংশ ... কোন শোকসংবাদ (অত্যন্ত সাবধানে পেশ করা)। ব্যস।তবে প্রায়ই উল্লেখ থাকত "গৌরী মায়ের বিল" নামক এক বস্তুর। সেটি যে একটি বড়সড় জলাশয় জাতীয় কিছু আন্দাজ করতাম -- কিন্তু আরেকটু জানার কৌতুহল রয়েই যেত।
ঠাকুমা দুপুরের সব কাজ সাঙ্গ করে বিকেল বিকেল আমাদের আড়াইতলার ফুলবাগানের ছাদে রাখা জলচৌকির উপর এসে বসতেন। নাকের ডগায় পাতলা সেলুলয়েড ফ্রেমের চশমা সেঁটে চিঠিতে মন দিতেন। আনমনে হাসতেন ... তারপর একসময় উন্মনা হয়ে সন্ধ্যামণি কিংবা কাঠচাঁপা গাছের দিকে খানিক তাকিয়ে অজানা কারও উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করে উঠে পড়তেন।
★
এক বিকেলে, ঠাকুমা এসে বেলফুলের দঙ্গলের পাশে বসেছেন ... হাতে তিন চার বার পড়া একটি চিঠি.... শ্যামাপিসি তাঁর একঢাল চুল যশোরের চিরুনি দিয়ে বশে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন --- আমি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেই ফেললাম।
-- "ঠামা , গৌরী-মা'র বিলের গল্প বল।"
পোস্টকার্ডটির ওপর হাত বুলোতে বুলোতে ঠাকুমা বললেন -- "সেই গল্প শুনতে বইলে আজ কিন্তু আর তোমার খেলতে যাওন হইবো না! হেইডা তো শুধু বিল নয়, বড়ুই -কড়ুই আছে, পরীর নৌকা আছে, আমরা পাঁচ বোন আছি....। কি কও শ্যামা?"
-- " শ্যামা পিসি কী বলবে ? শুনবো তো আমি। তুমি বল না, ঠামা।"
★
ঠাকুমারা ছিলেন চার ... না,না ... পাঁচ বোন। তারপর দুই ভাই।
ঠাকুমা --সন্ধ্যামালতি। অন্য চার বোনের ডাক নাম শুনতে মিষ্টি হলেও প্রেক্ষাপট ছিল অনেকাংশে তেতো ।
টুনটুনি - টুক্কুনি -- সানতু -- লানছু।
শেষ দুজনের ডাকনাম ছিল পর্যায়ক্রমে কন্যা সন্তানের জন্মে অতিষ্ঠ পরিবারের মনোভাবজাত ভালোনামের সংক্ষিপ্তসার। স্বান্তনা আর লাঞ্ছনা। সানতু আর লানছু !
অথচ লানছু ঠাকুমা নাকি ছিলেন সবার সেরা -- রূপে ...সাঁতারে .. .আলপনা দেওয়ায় ... এমনকি জেদেও।
★
ঠাকুমারও তো একদিন ছোটবেলা ছিল ।
মেয়েদের ছোটবেলা মানেই মা বা ঠাকুমার শাড়ি! মাথায় গামছা বা ওড়না দিয়ে লম্বা চুল কিংবা খোঁপা বানিয়ে পুতুলের মা সাজা কিংবা দিদিমণি সাজা।
-- "আমাগো ঠাকুমা থান পরতো তাই তার শাড়ি পরতে দিতো না। এই শাড়ি পরাটাই ছিলো খুব একখান ব্যাপার ! তার জন্যই তো অনেকে সন্ধ্যে দিত, বোড়ই-কড়ইয়ের ব্রত করতে ভালোবাসতো।
আজকালকার ছেমড়িগো মতন ছিলাম না আমরা। আজকাল শাড়িরা বন্দী ন্যাপথলিনে। সেই ব্রতের পাঁচালিও পাওয়া যায়না।"
কার্তিক মাসের পয়লা থেকে বোড়ই-কোড়ই পুজো করতে হতো। টানা একমাস পুজো করে মাসের শেষ দিনে ভোরবেলা ভেলা জলে ভাসিয়ে চান করতে হতো। তবে একবার করলে পরপর তিনবছর বা পাঁচবছর করতেই হতো -- নাহলে নাকি বোড়ই ব্রতের সুফল সব গাছের পাতাতেই রয়ে যেত।
পুজোর জন্যে রোজ তিনটে করে প্রদীপ, ফুল, কুলপাতা (আরে, পূব বাঙলায় কুল-কে ই যে বোড়ই বলে, গো! ), দূর্বা লাগতো। একমাস রোজ বিকেলে ঘুরে ঘুরে সবার বাগান থেকে ফুল তোলাটা তখন একটা জরুরি কাজ বলে গণ্য করা হতো। এই পুজোয় কুলপাতা অবশ্যই দিতে হতো।
--" বাড়ির কাছের কুলগাছ বলতে তখন চ্যাটাতিগো কুলগাছ। কেউ কেউ বোড়ই পাতা তুলতে গিয়া চ্যাটাতি দাদুর বকাও খাইতো। যারা দুষ্টামি কইরা গাছে লাঠির বাড়ি দিয়ে অনেক পাতা ঝড়াইয়ায় দিতো, দাদু লাঠি নিয়া ধাওয়া দিত তাগো। "
বোড়ই পাতা লাগতো বলেই মনে হয় এর নাম বোড়ই ব্রত ।
ফুলটাও মোটামুটি চুরি করে, লুকিয়েই জোগাড় করতে হতো। কে কতটা ফুল তুলে তার সাজি আগে আগে ভরিয়ে ফেলতে পারে, সেটা নিয়ে একটা গুপ্ত প্রতিযোগিতা আর সুপ্ত আনন্দ সবার মুখেই ফুটে উঠতো। ফুল তোলার সময়ে তো অনেকে গামছাকে শাড়ির মতো করে পরতো।
প্রদীপ সবাই কাদামাটি দিয়ে বানিয়ে শুকিয়ে নিতো। গঞ্জের বাজার থেকে কিনতো না। কিনলেও ওই শেষ দিনের জন্যে কিনতো। একমাসের প্রদীপ কে কত আগে বানিয়ে নিতে পারে তাই নিয়েও ছিলো একটা উত্তেজনা। একে অপরকে জিজ্ঞেস করতো -
-- " কি লো, তোর কয়টা প্রদীপ হইছে? আমার তো এত্তোগুলান ! শুকাইয়াও গেছে সব।”
বলার মধ্যে বেশ একটা গর্ব থাকতো। জিততে পারলে তো আনন্দের শেষ নেই।
--- "আর এই হক্কলটাতেই এক্কেবারে প্রথম হইতো আমাগো লানছু -- লাঞ্চনা ।
কি যে পরিপাটি ছিল তার হাতের কামকাজ--কি কমু ! "
★
দুর্গাপূজার আগে আগে মিস্ত্রী আনা হতো ধান রাখার কড়োই তৈরি করার জন্য।
তাদের পাণ্ডা ছিল শীতল কাকা।
তারা এসে অনেকদিন থাকতো, খেতো, আর কড়োই বুনতো। এই কাজটা সবাই পারে না। একটা কড়োই বুনতে অনেকদিন সময় লাগতো। মড়াই বোনা বরং অনেক সহজ। মড়াইটা খড় পাকিয়ে বিচালি তৈরি করে বুনতে হতো, আর কড়োই বাঁশের বাতা দিয়ে। মড়াই নিয়মমতো ছোট-বড় করা যেতো। কড়োই একবার তৈরি হয়ে গেলে আর কিচ্ছুটি করা যেত না ।
-- " বুঝলা দাদুভাই, ষাট মণ, আশি মণ, নানা মাপের কড়োই হইতো। যতো বড় পরিবার, যতো সম্পন্ন গিরস্থি -- তত বড় কড়োই। "
প্রথমে মাটিতে বাতা পুঁতে পুঁতে গোল করে পানের ডাবরের মতো একটা ফ্রেম বানানো হতো। তারপর তারমধ্যে আরো সরু সরু বাতা দিয়ে দিয়ে সুন্দর ডিজাইন করে কড়োই বোনা হতো। ঝুরি, চুপড়ি, ধামা বানানোর মতোই একটা পদ্ধতি। কড়োইয়ের ফ্রেম এতো বড় তাই দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাওয়া যেতো না। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ি হলে, দড়ি দিয়ে বেঁধে পাঁচিল টপকে অনেক কষ্ট করে ভিতরে নিয়ে যেতে হতো। অনেক লোকও লাগতো তার জন্যে। এইসব কঠিন কঠিন কাজ করার সময় তারা মুখে নানা আওয়াজ করতো। গান করতো।
শীতলকাকা যখন কাঠের কাজ করতে আসতো, ঠাকুমারা চুপ করে তার কাজ দেখতেন। জল থেকে কাঠ বা তালগাছের কাঁড়ি তুলে এনে সেগুলো ‘বাইশ’ দিয়ে কি সুন্দর মসৃণ করে ছুলে ছুলে দরজা জানলার ফ্রেম বানিয়ে ফেলতো। যন্ত্রগুলোর নামও শেখাতো শীতলকাকা। বাটালি, বাইশ, করাত, ছেনি, হাতুরি আরো অনেককিছু থাকতো তার ব্যাগে।
-- "একটাই প্রশ্ন শীতলকাকা প্রত্যেকবার আমাগো জিগাইতো। “আচ্ছা কওতো, একটা ব্যাগে একশোটা যন্ত্র আছে, তা থেকে ‘বাইশ’টা তুইলা নিলে কটা থাকব ?”
বাইশ বিয়োগ কইরাই উত্তর দিতাম। কাকা ঘাড় নাড়াইয়া কইতো, “উহুঁ হয় নাই , হয় নাই। ভালো করে ভাবো।” আমরাও চিৎকার কইরা কইতাম, “নিশ্চয়ই হইসে, তুমি ভুল কইতাসো।”
সে বলতো, “না রে বোকা নিরানব্বইটা হইব। একটা যন্ত্রের নামই তো ‘বাইশ’।”
প্রত্যেকবার এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হতেই হতো। অন্যেরা ঠিক বললেও, লানছু ঠাকুমা প্রতিবার গল্পটা শোনার জন্য, ভুল উত্তর দিতেন।
কাকা ছিলেন তার নামের মতোই শান্ত শীতল।
★
রোজ সন্ধ্যেবেলা তুলসী তলায় পুজো করতে হতো। তুলসী মঞ্চ হতো কড়োইয়ের ঠিক সামনে।
পূজোর আবার ছিল অনেক আলাদা আলাদা মন্ত্র। জল তোলার, প্রদীপ জ্বালানোর, পুজোর, গাছের গোড়ায় জল দেওয়ার আর শাঁখ বাজানোর। এতোগুলো ধাপে পুজো শেষ হতো।
তুলসীর বেদীতে প্রথমে তিনটে কুলপাতা, তার ওপর তিনটে দূর্বা দিয়ে তিনটে প্রদীপ তেল সলতে দিয়ে সাজিয়ে বসাতে হতো। তারপর একটা একটা করে তুলে মন্ত্র বলে জ্বালাতে হতো।
প্রথমে পুকুর ঘাট থেকে জল আনতে হতো। তারও ছিল অন্য মন্ত্র।
---" সেই মন্ত্র শোনাও না, ঠামা। "
--- " তোমাগো কি সেই সব ভালো লাগবো? আচ্ছা, শুনাই খানিকটা। কি কও শ্যামা?"
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম --
" আবার শ্যামাপিসি? শুনছি আমি... আর তুমি কেবল 'কি কও শ্যামা' বলছো বারবার !"
--" তাইলে শোনো।
জল নেওয়ার মন্ত্র --