-পুজো, তুমি কার? আমি টুনির মালার উজ্জ্বল উচ্ছ্বলতার। ঢাকের উদ্দাম বোলের। উদ্দাম ধুনুচি নাচের। প্যান্ডেল আলো করে বসে থাকা, অকারণ হাসিতে একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়া কচিকাঁচাদের।
-তাহলে ওই যে বালিকা মিলিয়ে যাচ্ছে আশ্বিনের কুয়াশায়, আলোর পরিধির বাইরে, তুমি কি তবে তাকে পরিত্যাগ করলে?
-সে কি কথা, আমার দরজা খোলা সবার জন্যে – কিন্তু যে নিজে আমার বাড়ানো হাতটি আলগোছে ছাড়িয়ে হারিয়ে যেতে চায়, তাকে আমি বেঁধে রাখি কেমন করে?
সব আলো-হাসি-গান পেছনে পড়ে থাকে। দ্রুত বাড়ির দিকে ছোটে বালিকা কিসের টানে? অক্ষর ডেকেছে তাকে। সপ্তমী থেকে দশমী। এই মাত্র চারদিনই সময়। স্কুলের ছুটি। সিলেবাসের পড়ারও ছুটি। এই তো সময় সিলেবাসের বাইরের রসসাগরে ডুব দেওয়ার। রসদও জোগাড় হয়ে আছে। শরতের বিকেলে কাকুর ঝোলা থেকে বেরিয়েছে পুজোর উপহার। একেক বছর একেক রকম বই। ভিতরে আদর জড়ানো লেখা, “To our naughty… ” –সাত রাজার ধন মানিক হাতে পাওয়ার আনন্দ। তাছাড়াও বাবার হাতে হাতে এসেছে ব্রাউন কাগজে মোড়ানো, সুতলিতে বাঁধা শারদীয়া। পাতা উলটিয়ে দেখার সময়টুকুই হয়েছে মাত্র। পাতার ফাঁকে মাথা ঝুঁকিয়ে রসে ডুব দেওয়ার জন্য চাই নিরলস অবসর। পঞ্জিকামতে, সপ্তমী থেকে দশমীই সে কাজের জন্য প্রশস্ত সময়।
কি বই পড়ত সে? সন্দেশ, আনন্দমেলা। সেসব ফুরালে জোগাড় হত দেব সাহিত্য কুটিরের পুজোসংখ্যা, পরের দিকে শুকতারা। গল্পের মায়ায় ভেসে যেত - নবনীতা দেবসেনের ম্যাজিক কলমের রূপকথা। আশাপূর্ণা দেবীর গল্প। নলিনী দাশের গন্ডালু। অজয় হোম। রেবন্ত গোস্বামী। সমরেশ বসুর গোগোলের রহস্যকাহিনী। বিমল করের কিকিরা। সন্তু-কাকাবাবু। ডোডো-তাতাই। আরও কত কত গল্প। শুধু তো পড়া নয়, হাঁ করে ছবি দেখাও। সন্দেশের সাদা-কালো ছবির পাশে পাশে আনন্দমেলার রংচংএ গোলুমোলু বাচ্চাদের ছবি – জাদুজগতের হাতছানি! সেই সঙ্গে পড়ত কাবুল -টাবুলের গল্প, বগলামামা বা সাধু কালাচাঁদের গল্পও। পড়ত আর ভাবত, এইসব দুষ্টুমির একটু খানি অংশও যদি সে সত্যি সত্যি করত, তাহলে কি হত! ওরে বাবারে! সোজা সাত দিনের ফাঁসি আর এক সপ্তাহের জেল!
শিশুপাঠ্যের দুনিয়ায় ঘূর্ণিপাক খেতে খেতে কবে যেন সে হুউশ করে এসে পড়ল বড়দের জগতে। অধিকার মিলল দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা ছোঁয়ার। কৈশোরও ছোঁয় নি তখন। ভাগ্যিস কন্যাটির বাড়িতে বইপড়া নিয়ে বিশেষ বাধানিষেধ ছিল না। অনুমতি পাওয়ার পরে অবশ্য আর পূজোর জন্য অপেক্ষা করেনি সে। গ্রীষ্মের অলস মধ্যাহ্নে বাড়িতে জমানো পুরোন পূজাবার্ষিকীর পাঁজা নিয়ে বসা। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা উল্টে উল্টে পড়া অজস্র গল্প-উপন্যাস। তার মধ্যে একটি উপন্যাসের স্মৃতি আজও মনে সজীব। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “তোমার তুলনা তুমি”। সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। সমস্ত দেহ-মন-বোধ-বুদ্ধিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া রোমাঞ্চ। এরপর আর চোখ পাকিয়ে “বড়দের বই, মোটে হাত দেবে না” বলে সরিয়ে রাখা যাবে না তাকে।
শুরুতে সম্বল শুধু দেশ আর আনন্দবাজার পত্রিকা। মেইনস্ট্রীমের সাহিত্য পত্রিকা ভিন্ন আর কিছু জানা নেই। সারা বছর ধরে সে সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকবে পুজোর সময়ের অক্ষর-ম্যাজিকের জন্য। এক কল্পনার দুনিয়া তাকে ঘিরে রাখবে পুজোর ক’দিন। তার হাসি-কান্না ভাল থাকা- মন্দ থাকার চাবিকাঠি জমা থাকবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, রমাপদ চৌধুরী, সমরেশ বসু, বাণী বসু, জয়া মিত্র প্রমুখের হাতে। শুধু তো উপন্যাস নয়, ছোট গল্পের বিপুল সমুদ্রে হাবুডুবু খাবে সে – কাকে ছেড়ে কাকে ধরে!
তার পরের কবছরে শারদীয়া সংখ্যার লিস্টিটার ধীরে ধীরে দৈর্ঘ্যবৃদ্ধি ঘটে। ভাগ্যিস! নইলে আবাপ গোষ্ঠীর বাইরেও যে শারদীয় সাহিত্য হয় সেটা আর জানাই হত না। বর্তমান, আজকাল, দ্য স্টেটসম্যান… লিস্টটাতে ক্রমশ নাম জুড়তে থাকে, নাম কাটা হয় খুব কম। বাণিজ্যিক মিডিয়া হাউসের আনুকুল্যের বাইরে যে অপার সাহিত্য জগত তার সন্ধান পেতে অবশ্য আরও অনেক দিন লাগবে। পড়তে পড়তে একটু একটু বোধ জন্মায় যে কলকাতার চৌহদ্দির বাইরেও একটা বঙ্গভূমি আছে। আর নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের বাইরেও জীবন আছে। সেই বৃহত্তর জীবনের সন্ধান পেতে, কলকাতার বাইরের লেখকদের লেখা পড়তে উৎসুক হয়। পায় খুব কম যদিও। এতো সেই গত শতকের গল্প, তখনও তথ্য ততখানি সহজলভ্য নয়। বিশেষত যে নিজের মেলামেশার দুনিয়াটা বড় করবেই না বলে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে, তার কাছে খবর এসে পৌছানো খুব কঠিন। তাও খবর যদি বা মেলে, এইবার সে বুঝবে কলকাতায় বসে পয়সা ফেললে বাঘের দুধ যদিও বা পাওয়া যায়, সব ধরণের শারদীয়া পত্রিকা মোটেই তেমন সহজলভ্য নয়। ফুটো পাঠকের পক্ষে একমাত্র সেই পাঠই বিধেয় যে পত্রিকা কমিশন বাবদ স্থানীয় দোকানীর হাতে মোটা নগদনারায়ণ তুলে দেয়।
তারপর নদী দিয়ে অনেক জল গড়ায়। জীবন বয় বিবিধ খাতে। তবু পড়ার নেশা কমে না। ততটা দীক্ষিত, বিদগ্ধ পাঠক সে হয়ে ঊঠবে না কোনদিনই। বরং চিরকালই সে রয়ে যাবে বুভুক্ষু পাঠকের দলে। বহুপাঠ যাদের ক্লান্ত করে না। বরং একশটা বাজে লেখার ভিড়ে একটা ভাল লেখা পেলেই তার তৃপ্তি। খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর। আর সে বিশ্বাস করে বই শুধু নিজে পড়েই বোঝা যায়, সে বই ভাল কি খারাপ। অন্যের মুখে ঝাল খেয়ে বইএর ভালমন্দ বোঝা যায় না। কাজেই পড়া, আরও পড়া ছাড়া গতি নেই।
ইতিমধ্যে অবশ্য একটা সুখের ব্যাপার ঘটে যায়। দেশে আসে ডিজিট্যাল বিপ্লব। তার হাত ধরে বিপ্লব আসে বাংলা সাহিত্য জগতে। সহজ ডেটা প্যাক আর সামান্য হোস্টিং ফিকে অস্ত্র করে সাহিত্য পত্রিকারা ঠাঁই করে নেয় নেট-দুনিয়াতে। ফল হয় অভূতপূর্ব! কলকাতা-টু- ঢাকা ভায়া পুরুলিয়া, মালদহ, জলপাইগুড়ি সব জায়গার লেখা এসে যায় উৎসুক পাঠকের হাতের নাগালে। সারাবছরের পাঠ একটা নতুন মাত্রা পায়। পুজোর পড়াও সেই ছোঁয়ার থেকে বাদ গেলনা। এত কাল অপেক্ষা ছিল শুধু ছাপা বই এর। এবার শুরু হয় সোস্যাল মিডিয়াতেও চোখ-কান সজাগ রাখা - কবে পুজোসংখ্যা মুখ দেখাবে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে বা লিঙ্ক মিলবে শারদীয়া ডাউনলোডের। সেই সঙ্গে একটি একটি করে সংগ্রহে আসতে থাকে শারদীয়া পত্রিকা। সারা শহর ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে পুজো এখনও আগের মতনই আসে। হয়ত আগের থেকে অনেক বেশিই সমারোহে। লেডলাইটের আলো ঝলকানো রাতের রাজপথ অনায়াসে শরতের আলো ঝলমলে সকালের দিকে উদ্ধত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। অ্যাপার্টমেন্টের পুজোয় সবার জন্য অবারিত দ্বার। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, বিভিন্ন ইভেন্ট সব মিলিয়ে জমজমাট কমিউনিটি জীবন। তবু কে যেন সব এড়িয়ে একা হতে চায়। নির্জন করিডোর পেরিয়ে, দরজার লক খুলে দ্রুত পদে এসে বসে জানলার পাশটিতে। অস্থির হাতে খুলে বসে শারদীয়া সংখ্যাটা, ঠিক কোনখানে যেন ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল – মুহুর্তের মধ্যে ফিরে যায় অক্ষরের জগতে। একের পর এক পাতা উল্টোতে থাকে। এক একটা চরিত্র চোখের সামনে টপ করে ভেসে উঠতে থাকে। সব ভুলে শব্দ দিয়ে বোনা অলীক জগতে ডুব দেয় সে। পর্দার ফাঁকে উছলানো আলো, হঠাৎ হাওয়ার ঝলক কোনকিছুই মনোযোগ কাড়তে পারে না তার। অক্ষরেরা ঘিরে রাখে তাকে।
খোলা জানলা দিয়ে একটা হলুদ রঙের প্রজাপতি এসে উড়োউড়ি করতে থাকে তার আশেপাশে। এক গল্প থেকে আরেক গল্পে যাওয়ার মাঝখানে সে আনমনে মুখ তুলে তাকায় সেদিকে। আর তখনই আবার প্রশ্নটা ভেসে আসে বহুযুগের ওপার থেকে – পুজো তুমি কার? সে নিজের মনেই বলে ওঠে, পুজো কি ঘরের কোণের একলা পাঠকেরও নয়? নাহলে কার জন্য সেজে ওঠে এত এত শারদীয়ার সম্ভার? আর তখনই হাওয়ায় দুলে ওঠে মানিপ্ল্যান্টের গাছটা। যেন মাথা নাড়িয়ে বলে ঠিক, ঠিক।