- বই পড়তে ভালবাসো তো বুঝলাম, কিন্তু কেন?
- ভালোবাসি, ভালোবাসি? ভালোবাসার আবার কারণ হয় নাকি?
- হয় বৈকি, দেখ ঐ অহৈতুকী প্রেম ট্রেম বোঝাতে এসো না। দুনিয়ায় অহৈতুকী বলে কিছু হয় না, তোমার বুদ্ধির সীমানায় কারণ ধরা পড়ছে না বলেই নেই, এমন তো হয় না। চেতনে অচেতনে কারণ আছেই।
- এত বকো না। বই তো ছোটবেলা থেকেই পড়তে শিখেছি। বই পড়লে মনে বিকাশ ঘটে টটে কিসব বলত না ছোটবেলায়। সেই থেকেই তো অভ্যাস।
- আচ্ছা। এই তো কারণ এল। তাহলে মনের বিকাশ ই কারণ।
- হ্যাঁ মনে আছে সেই তোমার আর আমার ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরির থেকে খুঁজে খুঁজে সৈয়দ মুজতবা আলীর বই বার করা ? তার আগে অবধি ইউরোপ বলতে শুধু আলেকজান্ডার ডুমা থেকে নুট হ্যামসুন এর উপন্যাসের অনুবাদ, আবছা চেনা ইউরোপ কেমন এক ঝটকায় জ্যান্ত হয়ে উথল আলী সাহেবের লেখাতে? বই ছাড়া কে চেনাত এই অচেনাকে?
- এই তো আরও কারণ বেরোচ্ছে। আর সাহিত্য গুণ ভালবাস না? শব্দের মজা, জাদুর খেলা, এক লহমায় তোমার চেনা চারপাশটা কে ভাষার দাপটে বদলে তোমাকে এক অন্য সময়ে অন্য পরিবেশে অন্য পরিস্থিতির দর্শক বানিয়ে দেওয়া এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তৈরি করে দেওয়ার ক্ষমতার স্বাদ নিতে ভাল লাগে না?
- আহা সে আর বলতে! আসলে কি জানো এই দুনিয়ায় মানুষ কতরকম করে কতকিছু ভাবছে আর। সেটাকে কত বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ করছে এটাই কেমন আশ্চর্য না?
- নিশ্চয় অবাক করা ব্যাপার! কিন্তু একটা কথা বল এই প্রকাশ কি শুধু লিখে করা যায়? আর কোন ভাবে হয় না? একটা ভাল ছবি একটা সুর একটা নাচের সিকোয়েন্স, একটা ভাল ফটোগ্রাফি, একটা সিনেমা, একটা নাটক এগুলোও কি ফর্ম of expression নয়?
- নিশ্চয় ফর্ম of expression। কিন্তু একথা কেন?
- দাঁড়াও বলছি, তার আগে বল এগুলোর মধ্যে দিয়ে মানুষের ভাবনার জগৎ কে ছোঁয়া যায় না?
- হ্যাঁ নিশ্চয় যায়, যদি তুমি ওই আর্ট ফর্ম টা বুঝতে শেখ। সবারই একটা নিজস্ব ব্যাকরণ থাকে । সেইটা একবার বুঝে নিলেই হল।
- সে তো একশবার সত্যি। ব্যাকরণ তো বুঝতেই হবে। ভাষার ব্যাকরণ আমরা স্কুলেই শিখি বলে বই পড়ার ক্ষেত্রে সেই জানাটা নিয়ে আর আলাদা করে ভাবতে হয় না, এই যা। কিন্তু তাহলে বল, সেদিন পেরেন্ট টিচার মিটিং থেকে ফিরে মেয়ের উপর এমন মোবাইল ব্যবহার নিয়ে খড়গহস্ত হয়ে উঠলে কেন ? ঝগড়া ঝাঁটি চেঁচামেচি কান্না কাটি মন কষা কষি এসব কেন হল?
- করব না? ওদের প্রিন্সিপাল ম্যাম কি বললেন জানো? ছেলে মেয়ে রা নাকি ছুটির দিনে সারাদিন শুধু মোবাইল নিয়ে বসে থাকে, আর শুধু মোবাইলে স্ক্রলিং করে যায়, কিছুতে এনগেজ অবধি করে না, আর খালি একে অপরকে মেসেজ করে hey dude, hey bro, what are you doing? এর বেশি কিছু আলোচনা নেই, কোন কিছু ভাবনা চিন্তাও নেই। ক্লাস নাইন টেন ইলেভেনের স্টুডেন্ট রা একটা নাকি সেন্টেন্স ঠিক করে লিখতে পারে না, একটা বানিয়ে বানিয়ে কিছু লেখার ক্ষমতা নেই, খালি just time pass করাই একমাত্র গোল। এই সব এইটুকু টুকু বাচ্চাদের থেকে সহ্য করা যায়? তুমি একটাও কথা বলবে না, ওই মেয়ের হাতে আমি আর মোবাইল দেব না।
- আচ্ছা মেয়ের কথা থাক। কিন্তু তুমিই বলতে না যে ছোটবেলায় যখন তোমার ঠাকুমার হয়ে চিঠি লিখে দিতে , তখন ঠাকুমা কেমন জনে জনে সবার নাম ধরে সে কেমন আছে জানতে চাইতেন আর নিজেদের বাড়ির সকলের সুস্থ থাকার খবর দিতেন। গোটা চিঠিতে আর কিছু লেখার থাকত না বলে তুমি বোর হয়ে গিয়ে সেই চিঠিতে " আজ এখানে আকাশ ঝকঝকে, কিন্তু রোদের তেজ নেই। মিঠে আলোয় চারদিক ভরে আছে।" এইসব জুড়ে দিতে আর সবাই সেগুলো পাগলামি ভেবে হাসাহাসি করত।
- হ্যাঁ বলেছি তো। এতো আমারই অভিজ্ঞতা। বেশ কয়েকবার এই সব নিয়ে আমার লেগপুলিং হওয়ার পরে আমি চিঠি লিখে দেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ওই "তোমাদের ওই কালী গরুটা কেমন দুধ দিল" গোছের আলোচনা ছাড়া ওরা আর কিছু নিয়ে কথা বলতে শেখেনি। কিন্তু সেকথা এখন কেন?
- না বলছিলাম কি যে ভেবে দেখেছ যে যারা সারা দিন ধরে hey dude, hey bro করে যায় তাদের সঙ্গে তোমার ঠাকুমার কতটা মিল ? ওরাও বলার মত কথা পায় না, উনিও পেতেন না। কিম্বা অন্য কোন কথা বললে যাকে বলা তারা সেটা বুঝবে কিনা ভেবে পায় না। তুমিই বলতে যে তোমার বাড়িতে বাবা বা মায়ের যে বন্ধুরা আসতেন তারা বই নাটক ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতেন। তুমি তাদের দেখে প্রথম শিখেছিলে যে খাওয়া পরা ঘুমোন আর রমণের বাইরেও একটা জীবন হয়। আমি damn sure যে তোমার ঠাকুমা কোনদিন এই exposure টা পান নি। সেটা যে কারণেই হোক। তোমার কি মনে হয়?
- হুম ঠিকই বলেছ তুমি। ঠাকুমার কোন exposure ই ছিল না। নাহলে ঠাকুমা বেশ intelligent ছিলেন।
- দ্যাখো শুধু exposure পেলেই হয় না, ইনসেনটিভ ও লাগে। ওই যে তোমাকে নিয়ে বাড়িতে ঠাট্টা হত, শুধু যদি তুমি সেটাই পেতে, তোমাদের বাড়িতে আসা পারিবারিক বন্ধুদের থেকে উৎসাহ না পেতে, বাবা মা ও যদি তোমার বই পড়া বা লেখা নিয়ে নিত্য অশান্তি করতেন, তাহলে কি আর তুমিও বই এর জগতে আসতে?
- না সে তো বটেই। তাহলে হয়ত আমিও কদিন পরে শুধু কুশল জানিয়েই চিঠি লেখাটাকে ই নিয়ম বলে জানতাম।
- ভেবে দেখ তো এই বাচ্চারা সেই exposure এবং ইনসেনটিভ দুই ই পাচ্ছে কিনা? আমরা শুধু মোবাইল কেড়ে নিয়েই কি বাবা মা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি? তার সঙ্গে কতটা মীনিংফুল কাজে তাকে এনগেজড করার চেষ্টা করেছি ছোটবেলা থেকে? নিজেরা example হিসেবে তার সামনে কতটা মিনিংফুল কাজ করেছি? ছ ত্তি রিশ বার শোলে বা বাহান্ন বার দাদার কীর্তি দেখাটা কী খুব meaningful কাজ? তোমার নিজের যদি সন্ধ্যেবেলা শাস বহু সিরিয়াল দেখাটাই একমাত্র কাজ হয়, তোমার মেয়ের থেকে তুমি কি আশা কর তাহলে ?
- দেখ মেয়ের হয়ে সাফাই গেয়ো না। সারাদিন মোবাইল মুখে বসে আছে । কোনমতে স্কুলের পড়া টুকু করছে, তারপরই মোবাইল। আর আমি সিরিয়াল দেখি না মোটে। কাজেই আমাকে ফালতু জ্ঞান দিও না। নিজে যে গোটা বছর ধরে রাত জেগে জেগে ফুটবল খেলা দেখ, অথচ জীবনে কখনো ভুলেও একটা বলে লাথি মারতে দেখিনা, তার বেলা? খুব meaningful কাজ তাই না?
- আহা সবারই একটা entertainment লাগে তো। আর তুমি সিরিয়াল দেখ না জানি। ওটা তোমাকে খ্যাপানোর জন্য বললাম। কিন্তু তোমার মেয়ে যে মোবাইল মুখে বসে থাকে, সে কি করে সারাদিন মোবাইল নিয়ে সেটা খোঁজ নিয়েছ?
- হ্যাঁ জানব না কেন ? সে অবশ্য আমার কপাল ভাল যে মেয়ে কোনদিন ব্লু হোয়েল ও খেলতে যায়নি বা ঢিসুম ঢিসুম শুট আউট করা গেমস ও খেলতে যায়নি। কিন্তু তাই বলে সারাদিন ওই রাজ্যের ডকুমেন্টারি দেখবে? দিন নেই রাত নেই কোথায় পেঙ্গুইন রে কোথায় লাদাখের মানুষ কেমন করে জীবন কাটায় রে তাই দেখে যাবে? আর কি সিনেমা দেখার নেশা হয়েছে! একটা ডিরেক্টর এর নাম করার জো নেই, তার আগা পাশ তোলা চৌদ্দ গুষ্টি র ইতিহাস বলে দিচ্ছে! এত নেশা কিসের!
- ক্ষতি কি ? তোমার বই পড়ার নেশা নিয়েও ছোটবেলায় শুনেছ না , যে দিনরাত বই মুখে বসে থাকতে নেই? শুনেছিলে সে কথা ? বরং যেটা ভাব যে যা করছে তাতে মনের বিকাশ হচ্ছে কি হচ্ছে না ? শুধুই কি তিনটে তথ্য শিখছে নাকি সেগুলো অন্তঃস্থ করে নিজের মত করে ভাবতে শিখছে? এইটা না করতে শিখলে কিন্তু হাজার টা বই পড়েও লাভ নেই। আর সেটা যদি ঠিক ঠিক হয় তাহলে ক্ষতি কি? তোমার না হয় আমাকে নিয়ে রাগ আমি লক্ষবার শোলে দেখেছি বলে, ও তো আর সেটাও করছে না। সব ভাল ভাল সিনেমাই তো দেখে।
- হুম হ্যাঁ সেটা নিয়ে কিছু বলার নেই, তবু ভয় করে জান তো। যদি কোন ট্র্যাপ এ পড়ে, যদি ভুলভাল সাইটে ঘোরাফেরা শুরু করে, আজ খেলছে না কাল যদি কোন উল্টো পাল্টা গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ে! কত রকমের ই না কান্ড হয় শুনি! গেমস খেলতে গিয়ে বাবা মার একাউন্ট থেকে লোকে টাকা অবধি চুরি করছে, সেসব হলে কি হবে?
- দেখ প্রত্যেকে নিজের নিজের লিমিট স্থির করে নিজের মূল্যবোধের ভিত্তিতে। বাবা মা হিসেবে ওই মূল্যবোধ টুকুই গড়ার চেষ্টা করতে পারি আমরা। তার বেশি কিছু পারি কি ? সেই সঙ্গে হালকা নজর রাখা কার সঙ্গে মিশছে, কী ধরণের কথা আলোচনা হচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে, সেই বুঝে গাইডেন্স দেওয়া এই টুকুই পারি আমরা। তারপরে কি করবে সেই সিদ্ধান্ত তো ওর ই। বাকীটা তো ধুকপুকানি নিয়েই বাঁচতে হবে। মেয়েকে তো ছাড়তেই হবে, তার ওঠা বসা চলা ফেরা যদি কন্ট্রোল করতে চাও সে কি পারবে নাকি? এর পর কি বলবে নাকি যে আঠেরো বছরের পরে মেয়ে কাকে ভোট দেবে সেটাও তুমি ঠিক করে দেবে?
- ধ্যাত তা কেন! কিন্তু হঠাৎ রবিবারের ভরা বিকেলে এত বউ এর সঙ্গে কথা বলার শখ হল কেন? এমনিতে তো ছুটির দিন মানেই তুমি নিজেও মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকো! বুঝতেই পারছি, মেয়ে দূত হিসেবে পাঠিয়েছে। কিন্তু ঘুষ টা কি দিল?
- আরে ঘুষ কেন হবে! ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর সবসক্রিপশন এর পাসওয়ার্ড টা বেটা বদলেছে আর এখন বলছে, নিজের মোবাইল না পেলে আর নতুন পাসওয়ার্ড টা আমাকে দেবে না। আজ ছুটির দিন , আজ না পড়তে পেলে হয় ? দাও দাও প্লিজ ওর মোবাইল ওকে ফেরত দাও।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।