জীবন বয়ে যায়। চারুলতারা লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখে। আলোর প্রতিফলন হয়। বদল হয় রংএরও। কখনো গোলাপি, কখনো সবুজ, কখনো ধুসর, কখনো অন্য কোন রং। সব চারুলতারাই কি এক রং দেখে? না, দেখে না। রং-এর ঠিকানা খোপের গায়ে লেখা! খোপও কি আর এক আধটা। শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছোটব্যবসায়ী-বড়ব্যবসায়ী-চাকুরীজীবি-শ্রমজীবি, বনেদী-উঠতিধনী-মধ্যবিত্ত-ধনহীন, উঁচুজাত-নিচুজাত, ঘটি-বাঙ্গাল – আরও কত কি! বহুতলীয় ক্ষেত্র – কত যে অ্যাক্সিস কে জানে! এর মধ্যে এক একটি বিন্দুতে এক এক চারুলতার আসনটি পাতা। আসনটি নড়লে চড়লে বদলে যায় দেখার রং। স্ট্যান্ডপয়েন্ট থিওরী। নামটা জেনেছে বুড়ো হয়ে।
স্ট্যান্ডপয়েন্ট। বা মানুষের অবস্থানবিন্দু। মানুষের স্বপ্নেরও নিয়ন্ত্রা। রু জানে সেটা। ইতিমধ্যে খেলাচ্ছলে একটা চাকরীর পরীক্ষা দিয়েছিল। পেয়েও ছিল চাকরীটা। তখনও গ্রাজ্যুয়েশনও শেষ হয় নি। কাজেই নেয় নি চাকরীটা। তাতে কিছু গুরুজনের ভ্রুকুঞ্চন। এই বাজারে কেউ চাকরী পেয়ে ছাড়ে? আরও পড়বে? কেন? পড়াশোনা তো চাকরী পাওয়ার জন্যেই।
শুধু চাকরীর জন্য পড়া? নিজের জন্যও না? সেই দিকটা ঝাপসা। পড়া এনটারটেইনমেন্ট। “দুপুরবেলা সবার খাওয়া হলে বসবে তুমি মহাভারত হাতে”। কিন্তু আত্মবিকাশের জন্য পড়া? উত্তর নেই। তুমুল তর্ক বাধে। ছোটবেলায় রচনা লিখেছিল। “বড় হয়ে স্কুলশিক্ষক হতে চাই”। বড় হতে হতে সব বদলে গেছে। শিক্ষকতায় ঘোর এলার্জী জন্মেছে রু’র। ৮০’র দশকের শিক্ষকদের দেখা চারপাশে। অর্থচিন্তা, সংসারচিন্তাতেই দিন যায়। দিনগত পাপক্ষয়। বৃত্তে ঘুরে বেড়ায় জীবন। বদ্ধ। পড়ানোতেই শেষ। সেখানটায় অনেকেই খুব পোক্ত। তবু সিলেবাসের বাইরের জীবনে? নিজের শেখার ক্ষেত্রটি সংকীর্ণ। ব্যতিক্রম নেই তা নয়। তাঁরা ব্যতিক্রম হিসেবেই পরিচিত। বই-এর স্তূপে ডুবে থাকা আপনভোলা জ্ঞানী পন্ডিতের ছবি অধরাই থাকে। রু’র ফেভারিট। ছবির পিছনে আঁকা নিশ্চিন্ত, উদ্বেগহীন বিত্তস্থিতু জীবন। অদৃশ্য কালিতে। রু তখনও পড়তে শেখে নি। রু ছটফটিয়ে ওঠে। বছরের পর বছর স্কুলের এক ক্লাসে এক জিনিস পড়িয়ে যেতে হবে! অসম্ভব!
উত্তর আসে, মেয়েদের জন্য স্কুলের চাকরীই ভালো। সময়বাঁধা। বছরে দুটো বড় ছুটি। রু তেলেবেগুণে জ্বলে যায়! মেয়েদের জন্য মানে? ছেলে-মেয়ে মানুষ করতে হবে না? থমকে যায় রু। এর উত্তর তখনো জানা নেই। বিয়ে, সন্তান। জীবন মানে তেমনই জানে তখনো। তবু কোথায় যেন জ্বালা ধরে। “মেয়েদের জন্য” মানে ছেলে হলে স্বপ্নটা অন্য হত? আরও রাগ, কারণ কথাটা মেয়েদের থেকেই আসে। বাপ-কাকাদের চোখে বরং ছক-ভাঙ্গার প্রশ্রয়। অবশ্য তাঁরাই আবার কদিন পরে বলেন, “মেয়েদের জন্য” আর্কিটেকচার-ই ভালো। “মেয়ে” বলেই বহু-আকাঙ্খিত ইভনিং-কোর্সের অ্যাডমিশনের লিস্টের প্রথমদিকে নাম উঠলেও ভর্তি করা হয় না। ছেলেরা রাতবিরেতে বাড়ি ফিরতে পারে। মেয়েরা কি তাই পারে নাকি! ভালো-মন্দ কিছু হয়ে গেলে! মেয়ে, মেয়ে, মেয়ে।
তবে সে পরের কথা। স্কুলজীবনে রু সেসব শোনে নি তখনও। শুধু প্রশ্রয়টুকুই চিনেছে। মহানগর-দেখা আর শঙ্কর-পড়া বিদ্যে সম্বল। ছিটকে উঠে রু বলে, সওদাগরী অফিসের বড়বাবুর সেক্রেটারি হব তাও ভালো, স্কুলে পড়াব না। নিস্তব্ধতা নামে। ক্রোধ ছিটকে ওঠে। অনেক পরে ব্যঙ্গের স্বর শোনে। কথাটা আজ ডাইরিতে লিখে রাখিস। দশ বছর পরে মিলিয়ে দেখিস। শব্দ শুনে রু’র সন্দেহ হয়। তাহলে কি ‘ডিগনিটি অফ লেবার’ কথাটা ভুল? তবু জেদ জন্মায়। বেসরকারি অফিসেই চাকরী চাই। সেখানে চাইলে আকাশ সীমানা। ... বহু, বহু পরে রু’র অবশ্য আপসোস হয়। পড়ানোও কত রকমের। অনেকখানেই পড়ানো আর নিজের শেখার কোন বিরোধ নেই। সেটা বোঝেই নি সেই বয়সে! জব স্যাটিসফ্যাকশনের বিভিন্ন দিকও জানত না। জানত না চাকরীর ক্ষেত্রে কর্তব্যের সীমানাও অজর নয়। ব্যক্তিত্ব নির্ভর। কেউ সীমানার সীমাবদ্ধতা দেখে। কেউ দেখে সম্ভাবনা। এত বোকা কেন ছিল! কেউ বলেও নি এসব। মিসটেক। মিসটেক।
সেই এক কথা। এইবার কলেজেও শোনে রু। আর একটু সাজান-গোছান ভাবে। মেয়েদের জন্য আকাডেমিক লাইন ভালো। থার্ড ইয়ারের দ্বিতীয় সেমেস্টার হল ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং। একটা গোটা সেমেস্টার। কোথায় করবে? জানা নেই। পরিচিতর জগতটা নেহাত ক্ষুদ্র। বেসরকারী অফিস, তায় কম্পিউটার-ওলা বেসরকারী অফিসের কাউকেই চেনে না। মামার-শালার-কাকার-পিসের-খুড়তুতো ভাইদের কাছে চিঠি নিয়ে ছোটে। আধা ভরসা জোটে, কিন্তু পুরো ভরসা মেলে না। শিক্ষকেরা ভরসা দেন, বার্ক বা আইএসআইতে হয়ে যাবে। অত চিন্তার কিছু নেই। আর না হলে ডিপার্টমেন্টেই করবে। পরে অ্যাকাডেমিক লাইনে যেতে গেলে সেটাই ভালো। রু’র মুখ কালো হয়ে যায়। আবার! স্যারের মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। মুখ নিচু করে শোনে। আর খোঁজের মাত্রাটা বাড়িয়ে দেয়। সারা কলকাতা ঢুঁড়ে বেড়ায়। যেখানে যা সন্ধান পায়! অন্য স্যারদের মায়া হয়। তাঁরা এখানে ওখানে পাঠান। সেই সুত্রে প্রথম পা ফেলা। সেক্টর ফাইভ। ১৯৯৩ সাল। এসডিএফ বিল্ডিং ।
করুণাময়ী থেকে যাত্রা। ধূ ধূ মাঠ। তেরচা পেরোয় মাঠ। মেঠো পথ। ওই দূরে দেখা যায় এসডিএফ বাড়ী। আরও এখানে ওখানে মাটি খোঁড়া চলছে। বাড়ী উঠবে। মাঠের মাঝে বাঁদিকে একটা বাড়ি। অদ্ভুত নীল রং এর। আইবিএম ব্লু। রং দেখেই চিনে ফেলে রু। এই তাহলে RS Software. গল্প শুনেছে অনেক। মাঠের শেষ প্রান্তে এসডিএফ বিল্ডিং। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ফ্যাক্টরি। সরকারী ইনফ্রাস্ট্রাকচার। বেসরকারী উদ্যোগ। জনহীন প্রান্তর। পাশেই আদিগন্ত জল। একদফা ইন্টারভিউ হল। রু কে বলা হল দ্বিতীয় দফার জন্য অপেক্ষা করতে। ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। অনেক সময়। একটু চারপাশ ঘুরে দেখে আসা যাক। এসডিএফের বাইরেটা। রাস্তা তখন এসডিএফেই শেষ। সামনে মাটি ফেলা। বোধহয় রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। পায়ে চলা রাস্তা। জলের ধার দিয়ে । চাপ-বাঁধা নির্জনতা। খানিকপরে একটু ভয়-ভয়ই লাগল। মানে মানে ফিরে চলল রু।
স্যারদের সাহায্যে বায়োডেটা পাঠায় আরও কিছু জায়গায়। ইন্টারভিউ-এর ডাক আসে। ক্যামাক স্ট্রীটের এক অফিস থেকে। রু’দের এক শিক্ষক দায়িত্ব নিয়েছেন সেখানে। ইন্টারভিউ-এর পরে বলা হয়, দুদিন পরে ফোন করো। দুদিন পরে, ক্লাসের শেষে, একটা পিসিও তে যায়। জীবনে প্রথম টেলিফোন করা। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, হ্যালো! পিসিও থেকে বেরিয়ে মনে হয়, মাটির দুহাত উপর দিয়ে হাঁটছে। অবশেষে! বেসরকারী অফিসের ভিতরে ঢোকার অফিসিয়াল ছাড়পত্র মুঠিতে। এসডিএফের অফিসটা থেকেও ডাক আসে। মনে মনে স্যারদের কৃতজ্ঞতা জানায়। একটা হার্ডল পেরোল। পরের হার্ডল চাকরী।
(ক্রমশঃ )
(সমতট বর্ষ ৫১ সংখ্যা ৩ ও ৪ এ পুর্ব প্রকাশিত )
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।