তবু আইন একটা আছে পঞ্চাশ বছর ধরে। কিন্তু সত্যিই সেই আইনের কতটা ছাপ পড়েছে সমাজের উপর? পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের অভিজ্ঞতা কি বলে? মেয়েদের কথা বাদ দিন, এমনিতেই ওদের বারোহাত কাপড়ে কাছা জোটে না, তাদের আবার মতামত! তার থেকে ডেটা দেখুন। ডেটা পাওয়া গেছে
http://www.johnstonsarchive.net/.../india/ab-indias.html থেকে। অবশ্য ডেটা ঠিক কিনা তা আমি মিলিয়ে দেখিনি।
এখানে এই যে ১৯৯৩-৯৪ সালে রিপোর্টেড এবরশনের সংখ্যা ৬৪ হাজারের বেশি হল, এমন তো নয় যে সেবার কোন গ্রহ নক্ষত্রের যোগে সংখ্যাটা ওই মাত্রায় পৌঁছাল। বরং প্রশ্ন উঠুক, অন্যান্য বছর এত কম কেন? সত্যিই কি আবর্শনের দরকার পড়েনি ? নাকি দরকার পড়েছে, আর দরকার মেটাতে মেয়েরা বাধ্য হয়েছেন হাতুড়ের কাছে যেতে, বাড়িতে বিভিন্ন উপায় চেষ্টা করতে?
কমিউনিটি মেডিসিনের চার অধ্যাপক ২০১৫-১৬ সালে নক্সালবাড়ি ব্লকে ৪২০ জন ১৫-৪৯ বছরের মহিলার মধ্যে সার্ভে করে জানিয়েছিলেন যে যদিও গড়ে প্রতি মহিলার ১.৩ টি গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে, এর মধ্যে ৪৮.৩%ই আপনাআপনি হয় না, অর্থাৎ কিনা সেগুলো ইনডিউসড এবরশন, ওষুধ দিয়ে বা সার্জিক্যালি করা হয়। আর তার ৫৮% হয় বাড়িতে, হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে ইত্যাদি। অনুমান করছি সেগুলো নিশ্চয় আর কোনভাবে রিপোর্টেড হয়না। ১৭৮টা এবর্শনে ৫০ টা হিসেবের বাইরে থেকে গেল। আরও ৭১ টা হয় বেসরকারি জায়গায় – তারই বা কটা রিপোর্টেড হয় তা কে জানে! এই অবস্থায় প্রথম ছবির ওই পেন্ডুলামের মতন একবার চাগিয়ে উপরে ওঠা আবার ঝপ করে নেমে যাওয়া দেখলে কেমন সন্দেহজনক লাগে না? ( সূত্রঃ
https://www.ijph.in/article.asp?issn=0019-557X;year=2019;volume=63;issue=4;spage=298;epage=304;aulast=Dasgupta )
এটা ২০১০-১১ সালের ডেটা। কলকাতায় যেখানে প্রায় ১৫০০০ এবর্শন, সেখানে বীরভূমে মাত্র ৮২ টা, বাঁকুড়ায় মাত্র ৩২৭ টা। কী জানি হয়ত সেখানকার মানুষের জীবন খুবই সংযমী, কোনও উল্টোপাল্টা পা পড়ে না সেখানকার মানুষের, তবে আমি পাপী তাপী মানুষ আমার কেমন মনে হয় যে আসল কারণটা হয়ত অন্যত্র। রিপোর্ট যতদূরে দেখতে পায়, তার বাইরে হয়ত থেকে যায় অনেকটাই। সেই বাইরে যেটা থেকে যাচ্ছে, তার কতটা সেফ এবর্শন? দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যাঃ …
সরকারি হিসেবে অবশ্য ( memo no H/SFWB/ 215-05-2013/3502) বীরভূম জেলাতেই ১২ টা সরকারি কেন্দ্রে প্রাইভেট এমপ্যানেল্ড ডাক্তারদের এসে এবরশন করানোর কথা। হয়ত সরকারি ডাক্তারের আকাল বলেই। ঠিক জানি না। এবরশন করালে টাকাও পাওয়ার কথা। আসলে কী হয় কে জানে! অবশ্য অত দূর বীরভুমে গিয়ে কি হবে, ঘরের পাশের দক্ষিণ ২৪ পরগনার কথা নিয়ে সৌভিক পাইন আর টি কে এস রবীন্দ্রন লিখেছেন এই পেপার - Availability, Utilization, and Health Providers' Attitudes Towards Safe Abortion Services in Public Health Facilities of a District in West Bengal, India
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC7784791/ দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিয়াল্লিশটা ফেসিলিটির ( দুটি জেলা হাসপাতাল ১ টা স্টেট জেনেরাল হাস্পাতাল ৯ টা গ্রামীণ হাসপাতাল ৬ টা ব্লক প্রাইমারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আর ২৪ টা প্রাইমারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ) মধ্যে মাত্র ১২ টা কেন্দ্রে এমটিপি করা হয়। সার্ভিস প্রোভাইডার দের আটিটুড নিয়ে তাঁরা বলেছেন The patterns depict that providers seemed to be more willing to provide abortion services for reasons of social stigma (pregnancy outside marital relationship), severe degrees of fetal anomaly than for contraceptive failure, first pregnancy within marriage, and mental health concerns of the client. সেই সঙ্গে ওঁরা এও জানিয়েছেন যে We found no association between attitudes towards safe abortion and abortion provisioning by health providers. However, there seem to be subtle ways in which subversion of the services happened. Instead of an outright denial to service provision, there were various forms of gatekeeping to restrict women's access to abortion services through strategies such as provision conditional on acceptance of contraceptive methods, requiring husbands' consent, refusal to unmarried clients, dissuading primigravida women, reluctance to provide in the public facility, and channelizing to their private chambers. হাতের কাছে পরিষেবা পাওয়ার নিরিখে কলকাতার লোকেরা তুলনায় ভাগ্যবান। সরকারি ব্যবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি, আধা সরকারি বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থা মেলে। সার্ভিসের ভাল মন্দ জানিনা, তবে মেরি স্টোপস ক্লিনিক তো আছেই, পরিবার সেবা সংস্থার স্ত্রী ক্লিনিক আছে শহর জুড়ে। কলকাতার বাইরে এই ধরণের সার্ভিসই বা কতটা মেলে?
বিবাহিত মেয়েদেরই হাতের আওতায় এল না সেফ এবর্শন, অবিবাহিত হলে তো কথাই নেই! আইনে অবশ্য এতকাল অবিবাহিতদের সাধারণ মানে ধর্ষণের ক্ষেত্র ব্যতীত গর্ভমোচনের কথা বলাও ছিল না। কত রকম যে কথা শুনতে হয়! একটি এমটিপি করতে আসা মেয়েকে নার্স বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করায় এক বেসরকারি হাসপাতালের (পশ্চিমবঙ্গের বাইরের) ডাক্তার নার্সকে ডেকে কাউন্সেল করেছিলেন, বলেছিলেন এই সব কথা তো তোমার জানার দরকার নেই। ও একটা সার্ভিস নিতে এসেছে আমাদের কাছে, আমরা দেব এইটাই ওর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, বাকিটা ওকে বুঝে নিতে দাও। এই ডাক্তার মহিলাকে অসীম শ্রদ্ধা জানাই। এর পাশে রাখি সেই সব কলকাত্তাই ডাক্তারদের যারা শুধু সিঁদূর দেখতে না পাওয়ার জন্য একটি মেয়েকে কুমারী ধরে নিয়ে মোরাল পিসিমা হয়ে এমটিপি করা নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে চেষ্টা করেছিলেন।
এই সবে ২০২১ সালে,আইন তৈরির পঞ্চাশ বছর পরে, যে বদল হল তাতে সময় সীমা বাড়িয়ে সাধারণ এমটিপির ক্ষেত্রে করা হল ২০ সপ্তাহ আর ধর্ষণজাত ভ্রূণের ক্ষেত্রে দুই ডাক্তারের অনুমতিক্রমে ২৪ সপ্তাহ অবধি গর্ভমোচন করা যাবে। সেই সঙ্গে ব্যাখ্যায় এল বড় বদল। বলা হল সন্তান সংখ্যা সীমিত রাখার উদ্দেশ্যে বা গর্ভধারণ বন্ধের উদ্দেশ্যে কোন মহিলা বা তার সঙ্গীর ব্যবহৃত কোন উপকরণ বা পদ্ধতির ব্যর্থতার ফলে যদি গর্ভধারণ হয়,তাহলে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণের মানসিক যন্ত্রণা গর্ভবতী মহিলার গুরুতর মানসিক ক্ষতি ঘটাবে বলে ধরে নেওয়া যায়। এইটুকুই ভারতের আধুনিকতার অর্জন।
এমনিতেই ভারতের এবর্শন সংক্রান্ত আইন নিয়ে একটা বড় বক্তব্য যে গর্ভ রাখা না রাখা গর্ভবতী জনের ইচ্ছার অধীন না, ডাক্তারের মতামতের দ্বারা পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। সাবালিকা মায়ের ( অথবা নাবালিকার ও মানসিক অসুস্থের ক্ষেত্রে অভিভাবকের ) সম্মতি ছাড়া অবশ্যই গর্ভমোচন করা যায় না। কিন্তু মা চাইলেই হবে না। ডাক্তার ঝুঁকি বুঝলে তবেই গর্ভমোচন হবে। শহরাঞ্চলে শিক্ষিত মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা তেমন সমস্যা না হলেও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থায় ডাক্তার গর্ভবতীর সম্পর্ক এতটা সহজ -সরল থাকে কি? হাসপাতালের ডাক্তার যেখানে মেয়ে রোগীদের বলেন বাড়ির ছেলেদের ছাড়া ওষুধ বুঝিয়ে দেব না, প্রসব হতে আসা মেয়েদের সঙ্গে গরু ছাগলের মতন ব্যবহার করেন, সেখানে মেয়েদের ইচ্ছায় গর্ভপাত হয় কিনা বা হলে কতটা হয় সে সন্দেহ থেকেই যায়। তারউপর পিএনডিটি এক্টের জন্য এখন ডাক্তাররা চাপে থাকেন কি? গর্ভপাত করাতে হেজিটেট করেন? তাহলে কিন্তু আনসেফ এবর্শন বাড়বে বই কমবে না। আরও একটা কথা এই প্রাইড মাসে না তুললে অন্যায় হবে, এই আইন কিন্তু আগাগোড়া মেয়েদের কথাই বলে গেছে শুধু। অন্যদের কি হবে?
তবে এসব তো পরের কথা, এমনকি আইনে যেটুকু আছে, সেটুকুও যে কতটা হয় এই ছবিগুলো তার প্রমাণ। আইন থাকলেই হয় না, আইনকে সবার হাতের আওতায় পৌঁছে দিতে হয়। সেজন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার লাগে, মানুষ লাগে, সদিচ্ছা লাগে। নাহলে হয়ত প্রগতিশীলতার খাতায় অফিসিয়াল টিকটা মারা যায়, কিন্তু আখেরে কাজের কাজ কিছু হয় না। সংবিধানসম্মত অধিকারের আওতায় থাকা ভারত আর আওতার বাইরে থাকা আমেরিকার তফাৎটা তখন ঝাপসা হয়ে যায়।