বাড়ি ফেরার তাগিদ থাকত একসময়ে। মৃগনয়নী। টিভি সিরিয়াল। অমল পালেকর। সুপ্রিয়া পাঠক। সিরিয়ালও শেষ। টিভির নেশাও ফুড়ুৎ। এখন অবশ্য ল্যাবের চাপ। কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল শেষ। আটটা –সাড়ে আটটা। বাড়ি ফিরেই আগে স্নান। দিনের ক্লান্তি ধুয়ে যায় চন্দন সাবানে। গল্পের বই হাতে ওঠে। খাওয়ার আগে অবধি। কোন অ্যাসাইনমেন্ট ডিউ থাকলে অন্য কথা।
খাওয়ার টেবিলে যেটুকু কথা হয়। টুকটাক। অন্য সময় তো তিনজন একসঙ্গে হওয়া ভার। খেয়ে দেয়ে উঠে বাবা তালা লাগান। সদর দরজায়। রাত্রের নিরাপত্তা। পিছনের দরজায়ও। তালা টেনেটুনে দেখেন। রু রান্নাঘরে জল ভরে। প্লাস্টিকের বোতলে। রাতের রসদ। দোতলায় ওঠে। ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়। পোস্টারের মেয়েটার মুখোমুখি। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো। ঘাড় সোজা। কি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ! গড়িয়াহাটের থেকে কেনা। দারুণ পছন্দের ! এরকম যদি সোজা দাঁড়াতে পারত! উপরে লেখা, Rules to observe in this room. ভারী পছন্দের নিয়মগুলো। এমন স্পষ্ট কথা যদি বলতে পারত! মেয়েটাকে একটু জিভ ভেঙ্গিয়ে দেয়। নিজের না-পারার ঝালটা মেটায়।
এই ঘরটা রু’র। অবশ্য ঘর মানে একটা খাট। একটা আলমারি। গোদরেজের। পাল্লায় আয়না লাগান। ব্যস। না আরও একটা জিনিস আছে। একটা ইলেকট্রিক হিটার। আর কফি তৈরির সরঞ্জাম। এসব রু’র জবরদখল সম্পত্তি। রাত জেগে পড়ার বাহানায়। পড়ার মাঝে একটা জম্পেশ করে কফি না খেলে হয়!
আর আছে একটা বইএর তাক। নীচেটা কাঠের পাল্লা দেওয়া। ট্রেজার আইল্যান্ড। রুবিকস কিউব। আধ-ছেঁড়া পালক। অভ্র-মাখানো পাথর। রাংতার টুকরো। রাশি রাশি গ্রিটিংস কার্ড। আধ-শুকনো পোস্টার কালার। অ্যালার্ম ক্লক। ডাইরি। খুচরো কয়েন। বন্ধুদের দেওয়া সুতোর রাখী। অজস্র চিঠি। ত্যাড়া-বেঁকা হরফের। পোস্টকার্ড। ইনল্যান্ড। খাম। পেন্সিল। ইরেজার। সবেধন নীলমণি একটা প্লাস্টিকের পেন্সিল বক্স। কাগজের ভাঁজে ভাঁজে শুকনো পাতা। কিসের ফল। শুকনো গোলাপ ফুল। স্কুলের ফেয়ারওয়েলের। স্যাটিনের রিবনও। অরিগ্যামি। ভাঙ্গাচোরা বাঁশি। কোনদিন সুর-না তোলা হারমোনিকা। সাত রাজার ধন মানিক। এসবে বাড়ির লোকের হাত দেওয়া স্ট্রিক্টলি মানা।
এছাড়া দরজার পিছনে একটা হুকের সেট। ব্যাগ, ওড়না ঝোলানোর জন্য। সেখানে আছে আর একটা জিনিসও। উপছে পড়া ব্যাগের, ওড়নার পিছনে। দেখা যায় না এমনিতে।
রু বইখাতা ছড়িয়ে পড়তে বসে। চারদিকের আলো একে একে নিভে আসে। মা-বাবাও ঘুমিয়ে পড়েছেন। কুকুরের ডাক ভেসে আসে। অনেক দূরের থেকে। কেঁঊ কেঁউ কেঁউ। থেমে গেলেই আবার দ্বিগুণ নিস্তব্ধতা। গা-শিরশির করে। দূরের থেকে স্কুটারের শব্দ শোনা যায়। কাছে আসে। কাছে আসে। পাশের বাড়ীর দরজায় এসে থামে। ইঞ্জিনের গরগর শোনা যায়। থামার পরেও অনেকক্ষণ। রাতের শেষ শব্দ। এরপর অনেক রাতে অবশ্য আসবে আরেক শব্দ। ঠক ঠক ঠক ঠক। লাঠি ঠোকার শব্দ। পাহারাওয়ালা। এইবার ঘুমানোর সময়। বইখাতা গুছিয়ে তুলে বাথরুমে যায়। ফিরে এসে আলো নেভায়। বালিশে মাথা দিয়ে আগডুম- বাগডুম ভাবে। মাঝে মাঝে দুম দাম শব্দ হয়। রু কেঁপে ওঠে। বোম কি? মাঝে মাঝেই ডাকাতির খবর পড়ে কাগজে। এই তো ক'বছর আগে একটা বাড়িতে হানা দিয়ে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে তারপর মেরে রেখে গিয়েছিল। এইখানেই কোথায় যেন! পাশের ঘরে মেয়েটার বাবা-মাকে আটকে রেখেছিল। এটা মনে পড়লেই রু'র খুব ভয় করে। ধর্ষনের ভয় বেশি, নাকি মরার ভয়? কিন্তু এমনি মরতে তো ভয় পায় না রু। কেন যে বাবা এখানে বাড়ি করল! এ পাড়াটা কেমন একটেরে। নির্জন। ওরে বাবারে! ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা। তাড়াতাড়ি চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলে। পাক্কা উটপাখি সিনড্রোম।
একটু দূরেই রেললাইন। মাঝে মাঝে ট্রেন আসে। রোজ না। মাঝে মাঝে। মাল গাড়ী। অন্ধকার চিরে। ট্রেনের হেডলাইটের আলোয় অন্ধকার ছিঁড়েফুঁড়ে যায়। আলোর বিস্ফোরণের। বাড়ী কাঁপতে থাকে। ঝম ঝম ঝম ঝম। তালে তালে আলো আসে। চলে যায়। এই আলো, এই আঁধার। জানলা পেরিয়ে এসে পড়ে ঘরের মেঝেয়। তার সঙ্গে মেশে পর্দার ছায়া। যেন নাটকের আলোকসজ্জা। শুধু কুশীলবের অপেক্ষা। গ্রীণরুমের থেকে মঞ্চে আসার। এই সব দিনে পড়া এগোয় না। মন বসাতে পারে না। অনেক চেষ্টা করেও না। ধুস। বইখাতা গুটিয়ে উঠে পড়ে। দরজা বন্ধ করে। বই-এর তাকের পেছন হাঁটকায়। বেরোয় চিঠি লেখার প্যাড। অনেক চিঠি এসে জমা হয়েছে। দূরের বন্ধু অনেক। উত্তর লেখা বাকী। তবে এরাত তাদের নয়। এই রাত বিরহী যক্ষের। খাটের ছত্রিতে হেলান দিয়ে বসে। হাঁটুর উপর রাইটিং প্যাড। পাতার পর পাতা ভর্তি হতে থাকে। কলেজে কি হয়েছে। ক্লাসে কি হয়েছে। বাড়িতে কি হয়েছে। রাস্তায় কি হয়েছে। সব, স-অ-অ-অ-ব। ঢেলে দেয় হাসি, কান্না, আনন্দ, আহ্লাদ, ক্ষোভ, দুঃখ, যা কিছু আছে। শুধু লেখা হয় না একটা কথাই। ভরসা আছে, সে সেটা জানে। বোঝে। দরজার পিছনের ওড়নাগুলো ঝোড়ো হাওয়ায় ওড়ে। লুকিয়ে-রাখা পোস্টারটা দেখা যায়। হাতে বানানো। চার্ট পেপারে। তুলি দিয়ে লেখা। Love begins when the needs of someone else becomes more important than your own. দুই পোস্টার। রু মনের দুই সীমানা।
***
কলেজ থাকলে শান্তি। ঘুম থেকে উঠেই স্নান। আগে অবশ্য মাথায় তেল মাখা। বিশুদ্ধ নারিকেল তৈল। তারপর চুল শুকানোর অপেক্ষা। টেনে উলটে বাঁধা চুল। টাইট বিনুনি। কলেজে পড়ার গোটা কতক সালওয়ার-কামিজ আছে। তারই একটা গলিয়ে দেওয়া। বিশেষ বাছাবাছি নেই। যা পাওয়া যায় হাতের কাছে। নিজেকে আকর্ষনীয় লাগানোর একটা ঝোঁক ছিল। কিছুদিন আগেও। খুব সাজতে ভালবাসত। ম্যাগাজিন ঢুঁড়ে মেকআপ স্টাইল শিখত। এখন সেটা কমছে। বন্ধুরা বলে, বিরহের ফল। যেমত যোগিনী পারা। রু হেসে ফেলে। কিছুটা সত্যি। আবার কিছুটা নিজের বদলও। সৌন্দর্যের ধারণার বদল। পটসুন্দরীদের সুন্দরী লাগছে না আর। বরং আকর্ষণ জাগছে ব্যক্তিত্বের প্রতি। নিজের জামা রু নিজে ডিজাইন করে। ফ্রিল দেওয়া হাতা, লেস দেওয়া কলার, ফুলেল প্রিন্ট, নরম নরম, তুলতুলে। সেখানেও পছন্দের বদল। ওগুলো আর পরতে ইচ্ছে করে না। ওড়না ব্যাপারটা বাহুল্য মনে হয়। খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসে চেকার্ড কাপড়, শক্তপোক্ত, নরমের যম। বা খাদির কাপড়। নো-ননসেন্স। বাসে-ট্রেনে যাতায়াত-উপযোগী।
তবু কোন কোন দিন অন্য রকম হয়। সকালের রোদটা আলো আলো। সে আসিছে, আমার মন বলে। বহুদুর থেকে। সেদিন আলমারির পিছন থেকে বেরোয় নেটের জামা। স্নানের সময় শ্যাম্পুর শিশির খোঁজ পরে । বিনুনিতে জড়ায় অতিরিক্ত মায়া। এখানে ওখানে হাঁটকায় রু। অবশেষে মেলে টিপের পাতা। অব্যবহারে ধুলো-পরা। দুই ভ্রুর মাঝে সযত্নে বসায়। আয়না হেসে ওঠে। বলে, এই না সেদিন গান গাইছিলে, রূপে তোমায় ভোলাব না… রু লজ্জা পায়। চোখ নামিয়ে নিতে নিতেও নিজেকে একবার দেখে নেয়। পছন্দ হবে তো?
বয়স, সব বয়সের দোষ।
(ক্রমশঃ )
(সমতট বর্ষ ৫১ সংখ্যা ৩ ও ৪ এ পুর্ব প্রকাশিত )
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।