সাদা কালো চৌখুপি চৌখুপি। লম্বায় কালো টাইলস বারো, আড়ে গুনলে আট। লম্বা দিকে তৃতীয়টাতে কেমন সবুজ জাল জাল। তক্তপোষ থেকে পা নামলে সাদা। তাতে তামাটে ছাপ।দুটো। একটা ছোট একটা একটু বড়। তার পাশে জাপানি পুতুল ঘুমোচ্ছে। এখনো পুতুল পুতুল। সবাই বলতো ওকে। ফরসা টুকটুকে, সরু সরু চোখ, নাক, ফুলের মতো ঠোঁট। কালো সোজা চুল। রোগা টিঙটিঙে। বুক নেই। কণ্ঠার হাড় বার করা। ওঠা-নামা গজদাঁত। ছোট্ট ছোট্ট পা। পাশে তার পা- কোদাল কোদাল। ছড়ানো আঙ্গুল। ভোঁতা নখ। শাড়ি একটু ওঠা। পায়ের পিছনে দেওয়াল, একটু দূরে -- তাতে প্রায় হলুদ হয়ে যাওয়া ছবি, একটা আলতা পা -- মরা ঠাকুমার। আর একটা মরা ঠাকুরদার। মুখটা প্রায় ফ্যাক্যাশে হয়ে গাছে। দেওয়ালের গায়ে সার সার করে সাজানো ট্রাঙ্ক। একটার ওপর একটা। ডানদিকের ওপর থেকে তৃতীয়টা তার। আচ্ছা একদম নীচেরটা কার? কে জানে। তার ট্রাঙ্ক খুললে ওপরে নীল তোয়ালে, বেশ তুলতুলে নরম। তার নীচে তার শাড়ি। হলদে পেপার সিল্ক, নীল আর গোলাপি পিওর সিল্ক, বড়দির বিয়েতে পাওয়া মাইসোর সিল্ক, পুতুল পরবেনা তাই ছাই-ছাই রঙের শিফন, মেরুন টাঙ্গাইল, দুটো কোটা, তার সবচেয়ে প্রিয় গোলাপি অর্গানজা - বেশ ফুলে থাকে। সিল্ক পড়লে বড্ডো রোগা লাগে; পাশের বাড়ির বুলুকাকিমা বলতো পাছার হাড় দেখা যায়। সে দীঘে জাপানি পুতুলের চেয়ে লম্বা, কালো, মাথায় কোঁকড়ানো চুল। কাকিমার মা আর দিদি বলতো অপর্ণার মুখটা কি সুন্দর। হাসিটা। শুধু রংটাই যা একটু ময়লা।
কোমরের কাছটা চুলকোচ্ছে। পাশ ফিরে সায়ার কষিটার আলগা করে একটু চুলকুলো। বাইরের ঘড়ঘড়ে করে প্রথম ট্রাম তাদের বৌবাজার স্ট্রিটে বাঁক নেবার সময়ে ঘটাং ঘটাং, ক্যাঁচক্যাঁচ করে আওয়াজ। হর্ন মারতে মারতে টেম্পো। সবজির, ফলের। বেলা বাড়বে। শিয়ালদার দিক থেকে লোকজন স্রোতের মতো হাঁটবে দুই দিকের ফুটপাথ ধরে, ডালহৌসি অফিসপাড়ার দিকে। মেঝেতে বিছানা করে পিসিমা। শীত -গ্রীষ্ম চাদর মুড়ি দিয়ে শোয়; পাশ দিয়ে বেশি পাকা সাথে প্রায় তামাটে হয়ে যাওয়া চুলের গোছা দেখা যাচ্ছে। ফুর ফুর করে নাক ডাকছে। আগে আগে মা পিসিমা উঠে বাথরুম না গেলে সে যেতে পারতো না, তাদের জলের অভাব। সে নাকি জল নষ্ট করে। এরা পায়খানা, বাসি কাপড় পাল্টে নিলে তারপর তার যাওয়া। সে যেতে যেতে জল চলে যাবে। বাথরুম গিয়ে হিসি করে আগে ভালো করে নোংরা বাঁ-হাত ধুতে হয়। অন্ততঃ তিন মগ জল। তারপর ডান হাতেও তিন মগ ... তারপর মুখে চার মগ,..তারপর টুথব্রাশটা সাবান দিয়ে ধুয়ে তারপর তো দাঁত মাজা। শেষে মগটা ঘষে ঘষে ধুতে হতো, কেননা ওই রংচটা মগটা দেখলে তার ঘেন্না করতো .. শেষে বেরোনোর আগে দরজার কাছে এসে ডলে ডলে পা ধোয়া। পিসিমা অনেকসময় পাখির খাঁচা রাত্তিরে বাথরুমে ধুতো. বাথরুমের মেঝেতে পাখির গু, আধখাওয়া ছোলা ছড়ানো থাকতো। আর কারোর না হয় ঘেন্না পিত্তি কম, সে পারতো না। বাইরে বেরিয়ে ন্যাকড়াতে পা মুছেই এক লাফে পাপোষে। ঠিক তারপরেই মার চিল্লানি -
“একবারে চান করে এলি না কোনো? আবার কাপড় কাচতে, চান করতে দু বালতি জল খরচ করবি? একটা উপকার নেই..যখন দ্যাখো শাড়ি পাট করছে নয়তো বাথরুমে গিয়ে জল খরচ করছে”।
তো কি করতো সে? তিনঘরের এই বাড়িতে সাতজন থাকা। ঘরজোড়া পুরোনো তক্তপোষ। তার ওপর ডাঁই করা বিছানা। শীতকালে লেপতোষক মিলে সে আরো জবরজং। দেওয়ালের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঝোলানো দড়িতে কতকালের জামা, চাদর, তোয়ালে গামছা। ভাঁজ করা অবস্থাতেই ধুলো জমা। তক্তপোশের আর একদিকে রান্নাঘর থেকে রান্না করে এনে পর পর সাজানো। দুপুরে, রাতে এ ঘরের মেঝেতেই আসন পেতে খাবার ব্যবস্থা। ঘরগুলো জোড়া মান্ধাতা আমলের আলমারি দেরাজ, ঝুল ময়লা, কবেকার পুরোনো ক্যালেন্ডার ভরা দেওয়াল, ভাঙা টব, পাখির খাঁচা ভরা বারান্দা - তার মধ্যে কাপড় শুকোতে দেওয়া। বেশির ভাগ জিনিস দেখলে তার ঘেন্না লাগে কিন্তু নড়ানোর উপায় নেই। সবাই হাঁ হাঁ করে ছুটে আসবে। তাই সে নিজের জিনিস গোছায়। তবে ঘরের কাজ করে না নাকি? বাবা বাজার করে আনলেই তো গুচ্ছ চিচিঙ্গে, বরবটি, নটেশাক, আলু বেগুন দিয়ে বসিয়ে দিতো। বাটি, গামলা করে জল বসিয়ে দেবে চারপাশে পিসিমা। তা সে তরকারি খুব ভালো কাটতে পারে। নিখুঁত। অনেকক্ষণ ধরে তার তরকারি কাটার সাথে চলতে থাকতো মা পিসিমার পুজো, কথা চালাচালি, কখনো তর্ক। বাবা বিছানা জুড়ে বসতো খবরের কাগজ নিয়ে। ঝিরিঝিরি করে কাটা হতে থাকে লাউ, ডুমো ডুমো করে আলু, ফালাফালা করে বেগুন, পাতলা পাতলা খোসায় চিচিঙ্গে। জাপানি পুতুল সেসময় মুখ ধুয়ে চা পাঁউরুটি খেতে খেতে কাগজে বা নিজের বইখাতায় মুখ ডুবিয়ে। তারপর বিনুনি পিঠে ফেলে, পাটপাট শাড়ি প্লিট করে, ফর্সা মুখে একটু পাউডার মেখে সকালের টিউশানি। কোনো কোনো দিন তার সামনে দাঁড়িয়ে পায়ের দিকের উঠে যাওয়া পাড় ঠিক করে দিতে বলতো। নতুন ছাপা, কোটা বা তাঁত হলে। হাত আঁচলে মুছে সে ঠিক করতো শাড়ি। তারপর মাথায় চাঁটি দিয়ে "গাঁঠিয়া খাবি? আনবো?" সকাল-সন্ধ্যে দুবেলা পুতুলের অংকের টিউশনি। অংকে এম-এস-সি তে ভর্তি হয়ে চালাতে পারলো না, জন্ডিস হয়ে প্রায় যায় যায়, তিন বছর প্রায় বাড়িতে ছিলো। না খেয়ে না খেয়ে ফ্যাকাশে হয়ে বিছানায় মিশে গেছিলো। চাকরির চেষ্টা আর করেনি। শুধু টিউশনি। দুপুরে বসে ক্যালকুলাস করতো বা বাড়িতে কেউ এলে বকবক। আর পুতুলের বিয়ের ইচ্ছে ছিল খুব।
হলোও তো বিয়ে। সাঁইথিয়ায়। বর ইস্কুল টিচার। ফিজিক্স। মস্ত বাড়ি জয়েন্ট ফ্যামিলি। জমি, পুকুর। বিয়ের পর-পর ও দুদিন ওখানে ছিলো, পুতুলের নতুন শ্বশুরবাড়িতে। মস্ত দালান। লাল মেঝে। ডাবল কালো বর্ডার। ওই বর্ডার টানা সিঁড়িতেও। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলে ভেঙে গেছে, আবার চলেছে। তারপর ডানে বাঁয়ে দুদিকে চলে গেছে নীচের দালান ধরে, উঠোনে।উঠোনের শেষে বাথরুম। জল আছে। অনেক। মগ গুনতে হচ্চিল না। তার চান করতে দেরি হচ্ছিলো। বেরিয়ে দরজার বাইরে পুতুল। মাথায় একগাদা সিঁদুর ।
“কিরে এতগুলো লোক বাড়িতে, তোর আক্কেল হবে কবে”?
আর যায়নি কখনো সে সাঁইথিয়া।
পুতুলও আর ফেরেনি।
পুতুল তাকে কম জ্বালাতো?
যখন ও গুনে গুনে পাখিকে ছোলা দিতো। পঁচিশ অব্দি গুনে গুলিয়ে যেতে পেছনে নিঃশব্দ পুতুল, চিকচিকে চোখ।
“আবার তুই গুনে ছোলা দিচ্ছিস”?
“কতবার ঝাড়লি গামছাটা মেলার আগে”?
“আয়নার বাঁদিকে কটা মেরুন টিপ্ আছে বল তো? "
আবার কখনো সখনো ...
“দে না অপু প্রাইভেটে হায়ার সেকেন্ডারিটা। ঠিক পাস্ করতে পারবি”। তবে সেও অনেককাল আগে। তার হাসপাতালে ভর্তির আগে। ওইসময় হাত ধোয়াটা বন্ধ করতে পারতো না, ধুয়েই যেত,বাথরুম থেকে বেরোতো না..অনেকক্ষণ। সবাই বললো তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাবা কাকা মিলে ডাক্তার দেখালো। ডাক্তার বললো কিছুদিন হাসপাতালে দিতে। ইলেকট্রিক শকে চুলগুলো অকালে পেকে গেলো ভেতর ভেতর। পড়াশোনা আর এগোলো না।
তবে পুতুলকেও ছাড়তো না সে। দুপুরে লেপ ঢেকে শুয়েছে, সে একদম ঘাড়ে চেপে বসতো।
“আমার আকাশি ব্লাউজ কই ”?
কোনো লজ্জা নেই পুতুলের। এবার খেবড়ো দাঁত বের করে হাসছে।
“আমার চৈত্র সেলের শাড়িটার সাথে ব্লাউজ কেনা হয় নি তো। এতদিনে পরলাম। তোর আকাশিটারটা খুব ম্যাচিং। সেলাই করেছিলাম, খোলা হয়নি”।
“কিনিসনি কেন ব্লাউজ নিজে? রোজ বেরোস শুধু আমারটায় চোখ “?
তবু হাসি।
“ছাড় ছাড় লাগছে দিয়ে দেব, সেলাই খুলে”.
নির্লজ্জ মেয়ে । পরের দিনই,
“'ভালোবাসা ভালোবাসা' এসেছে ছবিঘরে, ম্যাটিনিতে যাবি অপু, রোববার”?
“মাংস করবো, মশলা করে দে”?
“আলুকাবলিটা তুই মাখ”?
চারটে করে সানসিল্কের প্যাকেট আনতো।
“চারখানা শ্যাম্পু কি হবে”?
“তোর তিনটে”।
“নিজের লিকলিকে বিনুনি দেখিয়ে, আমার একটা”।
তারপর খুব হাসতো ।
কেউ জানেনা, অনেককাল আগে সবার আদরের জাপানি পুতুল কাঁদতো। হেদুয়া পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেছিলো তাকে, উল্টোদিকেই পুতুলের কলেজ। বেঞ্চিতে বসে ডাইভিং দেখছিলো সে। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে একের পর এক কস্টিউম-পরা মেয়ে একতলা দুতলা পেরিয়ে তিনতলায় উঠে তারপর ওপর থেকে জলে ঝাঁপ দিচ্ছে। সবুজ, গোলাপি লাল, লাল, বেগুনি ছাই। বিয়াল্লিশটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিলো। রঙগুলো পরপর আসছিলো না, গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছিলো। পুতুল কিছুদূরে একটা লম্বা ছেলের সাথে কথা বলছিলো। অনেকক্ষণ। তারপর পাশে এসে বসলো। পুতুলের চোখ থেকে জল পড়ছিলো। নাক লাল। সে দেখেছে।
“কে ছেলেটা? তোর লাভার”?
ও তার দিকে তাকালো। তারপর হেসে ফেললো।
“নিরুপম। লাভ নেই, ওরা মন্ডল”।
“গোলাপীকে দেখতে পাচ্ছি না”.
“কি?”
“গোলাপি কস্টিউমটাকে দেখতে পাচ্ছি না। খালি লাইন ভাঙছে। কোথায় গেল”?
পুতুল তার দিকে তাকিয়ে। চোখ চিকচিক।
“ফুচকা খাবি”?
“হ্যাঁ”।
"তুই না” বলে চুলটা একটু ঘেঁটে দিয়েছিলো। শুধু পুতুলই করতো মাঝে মাঝে।
ভীষণ জোর হর্ন দিতে দিতে দুটো বাস হুড়মুড় করে চলে গেল উঠতে হবে ... ট্রাঙ্কগুলোর দিকে তাকালো। সামনের দেওয়ালের ছবি দুটোর দিকে। শুধু জানে পাশের নতুন ছবির দেওয়ালের দিকে তাকানো যাবে না। তাই এক ঝটকায় উঠে সামনের দেওয়ালের ফাটা দাগটার দিকে তাকিয়ে উঠতে হবে। সব পাল্টে গেছে। এখন আর তরকারি কাটে না সে ... বাথরুমে জল নষ্ট করা নিয়ে কেউ বকাবকি করে না। বাথরুমে থাকেনা সে অতটা সময়। পিসিমার টিয়াটা মরে গেছে। আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে পিসিমা তরকারি কাটে, রান্না করে। কোনোরকমে পুজো সারে। সে আজকাল সন্ধ্যেবেলা গিয়ে বাজার করে আনতে পারে। খুব তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে সে কাজে লেগে যায়। পাশের ঘরের বিছানা থেকে আস্তে আস্তে ওঠায় মাকে। একটা নীল গামলায় জল দিয়ে মায়ের মুখ ধুয়ে দেয়। দাঁত মাজিয়ে দেয়। মায়ের মুখ থেকে গোঁ-গোঁ করে আওয়াজ হতে থাকে। বেলায় আবার গা মোছানো। তোয়ালে জলে চিপে একদিক করে হাত, পা বুক সব মুছিয়ে দেয়। সব তিন বার করে। তারপর শুকনো গামছায় মুছিয়ে দেওয়া। তারপর পাউডার দেওয়া। পিঠের দিকে গুনে গুনে চারবার। নয়তো ঘা। ডাক্তার বলেছেন । সে কাজ করে যায়। দিনভর।কাউকে কিচ্ছু বলতে হয় না। কাপড় ধোয়। কাপড় মেলে। মাকে চামচ দিয়ে গলাভাত খাইয়ে দেওয়া। বেডপ্যান দেয়। ঘর গোছায়। দোকান যায়। গুনে গুনে জিনিষ কিনে আনে। সারাদিন খবর কাগজ নিয়ে শুয়ে থাকা বাবাকে খেতে দেয়। জাপানি পুতুলকে বিছানায় বসিয়ে রাখে মনে মনে, ও অঙ্ক করে। বারান্দায় কাপড় মেলতে মেলতে ঝট করে একবার নীচে তাকিয়ে দেখে, যদি দেখা যায় পুতুলের কোটার শাড়ির আঁচল ক্রিম কালো ছাপ ছাপ। কোনো কোনো দুপুরে, বারান্দায় ভাঙা খালি খাঁচার দিকে তাকিয়ে গুনতে থাকে বাইশ তেইশ, পিছন থেকে ফিসফিসে আওয়াজ আসে,
“হিহিহি ! ছাব্বিশটা হয়ে গেছে আবার গোন!”
সে রাস্তার মোড়ের নতুন সিনেমাটার হোর্ডিঙের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। গরম হাওয়ায় তার মুখ পুড়ে যায়। সে নড়ে না।
গত বুধবার খুড়তুতো বোন এসেছিলো। মাকে দেখতে। ফল, মিষ্টি, হরলিক্স,টাকা মার্ জন্য, তার জন্য নাইস বিস্কুট, নাইটি। সে চা করলো।কাজের মেয়েটাকে দিয়ে সিঙ্গারা আনালো।পিসিমার সাথে কথা বলে বোন, মার পাশে একটু বসে রইলো। পুতুল গল্প করতে পারতো। ও বোঝে না কি বলবে। ওই দেওয়ালের নতুন ছবিটার সামনে বোনটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো; ওর চোখ থেকে সমানে জল পড়ছিলো। তারপর হঠাত তার হাত জড়িয়ে ধরলো। ও বোনের চোখ থেকে সোজা মাটির দিকে।
ছবি নয়, ছবি নয় ... কিছুতে ছবির দিকে নয়। পায়ের তলার টাইলসটাতে চিড় ধরে গেছে। একটা দাগ থেকে দুটো দাগ বেরিয়েছে। এক দিকের দাগটা থেকে আবার ডালপালার মতো ছড়িয়ে গেছে চিড়টা । ওর পায়ে নখের জন্য নেলপালিশ কিনলে হয়. কতদিন পরেনি সে নেলপালিশ?
ছবি দেখা যাবে না।
রাত্রে মার দুধ-পাঁউরুটির বাটিটা নিয়ে এক চামচ এক চামচ করে খাওয়ানোর সময় মার একটা চোখ থেকে জল পড়ে, খুব সাবধানে মুখটা ধরে খাওয়াতে হয়, একটা দিক বেঁকে গেছে। সে খাওয়ায় আর কান পেতে থাকে। রাস্তার অনেক আওয়াজের মধ্যেও যদি টিউশনি ফেরত পুতুলের চটি খোলার আওয়াজ হয়। বাথরুম থেকে পা ধোবার আওয়াজ? তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে কটকী পাড় ঢাকা পা দুটো থেমে যাবে?
“রোল এনেছি। আয়”
রাত্রে ঘুমোনোর আগে আলমারির ওপর রাখা একটা কৌটো খুলে ও গোনে, দুটো সানসিল্কের পাউচ থেকে একটা করে কেটে সে জমিয়ে রেখেছে। একচল্লিশটা। কৌটোটার মধ্যে একটা চেনা গন্ধ।
রাত্রে বিছানায় শুয়ে অন্ধকারে সে পাশে জাপানি পুতুলকে শুইয়ে রাখে। তার ছড়ানো কোদালে পায়ের পাশে ওর ছোট্ট ছোট্ট পা। ঘটাং ঘটাং শব্দ করে লরি যায়। বন্ধ খড়খড়ি দিয়ে চুইয়ে আসে আলো।
ও ভাবে কোনোভাবে নতুন ছবিওয়ালা দেওয়ালটার দিকে না তাকালে, কালকের দিনটাও ঠিক পেরিয়ে যেতে পারবে।