পৃথিবীর দীর্ঘতম বাস-রুট কোনটা ছিল জানেন? কলকাতা থেকে লন্ডন। না, ইয়ার্কি না, সত্যিই সেই এক বাস ছিল ৬০-এর দশকে, তার নাম অ্যালবার্ট। লন্ডন থেকে বেলজিয়াম, তারপর ওয়েস্ট জর্মনি, যুগোস্লাভিয়া হয়ে ইরান, টার্কি, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে, যাকে বলে পুরো হিপি ট্রেইল কভার করে, প্রায় ১৩২ দিন ধরে ২০,৩০০ মাইল পেরিয়ে, সে এসে ঢুকত ভারতে। তারপর ভারতের ঐদিকটায় দিল্লী-আগ্রা-এলাহাবাদ-বেনারস হয়ে শেষ স্টপেজ কলকাতা। নয় নয় করেও ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৬ অবধি প্রায় দুই-দশক চলেছে সেই বাস, শেষটায় আমাদের সাথে প্রতিবেশিদের কোঁদল আর তার-ও ঐদিকের দেশগুলোতে গন্ডগোল শুরু হতে হতে বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু সে তো যাকে বলে ‘অতীতের পাতা থেকে’। এখন সে অ্যালবার্ট-ও নাই, সে হিপি ট্রেইলে বাস-ও আসে না কল্লোলিনীতে, তাহলে এখন দীর্ঘতম রুট কোনটা? খুব সোজা উত্তর। সপ্তমীর দিন সন্ধ্যেবেলায় বেলঘরিয়া থেকে গলফগ্রিন-গামী একটি ২৩৪ নম্বর বাস। গিনেসের বাবুরা পুজোয় কলকেতাও আসেন না, আর এলেও ঐ ক’টা দিন এই অঞ্চলে সময় মোটেই সরলরেখায় যায় না, না হলে আমার স্থির বিশ্বাস – শুধু বিশ্বাস কেন, রীতিমত নিজের অভিজ্ঞতায় দেখা – এই রুটটিই দীর্ঘতম। ইন ফ্যাক্ট, সেই বাসের পা-দানিতে যে এক অভিশপ্ত সপ্তমীর সন্ধ্যেবেলায় পা রেখেছিলাম এইটুকু স্পষ্ট মনে পড়ে; আদৌ নেমেছি কিনা, সে আর জানা নেই।
সত্যি বলতে অবশ্য পুজোর ভিড় জিনিসটা আমার অত্যন্ত বিরক্তিকর লাগে। ঐ প্যাচপেচে গরমে আর ঘামের গন্ধে মিশেমিশে পিষেপিষে, আর দড়ির ওঠানামার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, জীবনের মূল্যবান কয়েকটি ঘণ্টা গাধার ইসেতে দিয়ে, শেষে দেখা যাবে একটা ত্রিশ ফুট উঁচু কিংকং, কি চল্লিশ ফুট উঁচু নকল ইমারত, না হলে ট্রেন ভেঙে পড়ার মতন ভয়ানক ট্র্যাজিক ঘটনার প্যান্ডেলবাচক আর্ট। আর এইসব অলীক ঘটনার ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখা যাবে, অনির্বচনীয় হুন্ডির মত কিছু লোকের হাতে আছে যাদুদণ্ডের মতন একটি করে ভি-আই-পি পাস। ঐ মহম্মদ আলি পার্কের দড়িতে আটকা রৌরব নরকের পাশ দিয়ে তারা অক্ষত আইশ্যাডো আর অহংকার নিয়ে ঢুকে যাচ্ছেন প্যান্ডেলের সাইড-লেন দিয়ে। সেই সময় সমবেত দীর্ঘশ্বাস আর চাপা খিস্তি শুনলে বুঝতে দেরি হয় না – আমাদের দেশে একটা নোবেল-টোবেল পাওয়ার থেকে লেবুবাগানের ভি-আই-পি পাসের ইজ্জত অনেক বেশি। আর এ-ও বোঝা যায়, ঐ পুজোর ভিড় আসলে জীবনের-ই একটা ছোট্টো টিজার-ট্রেইলার – প্রথমত, যতই ভাবুন আপনি নিশ্চেষ্ট-নিশ্চল, ভিড় কিন্তু আপনাকে ঠেলে নিয়ে যাবেই যাবে সেই অব্যর্থ সিংহের মুখে, মাতালকে যেমতি অদৃষ্ট নিয়ে যায় ঠেকের দিকে। আর দ্বিতীয়ত, ভাগ্যের দড়ি কখন কার জন্য উঠবে – সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনো ঢের বাকি আছে।
উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম দিবসে বাবার হাত ধরে আমিও যেতাম সেই সব রোমহর্ষক সংগ্রামে। তখন-ও ‘দিনেরাতে মুলে রাখে কান’ মোবাইল ছিল না পকেটে-পকেটে, তবুও ঘাবড়াইনি কোনোদিন, জানতাম রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে পকেটে একটা নাম-ঠিকানা লেখা চিরকুট থাকলেই চলে, হারিয়ে গেলেও কেউ খুঁজে পেয়ে আমাকে ক্যুরিয়ার করে দেবেন। তবে কি না, ছোটোবেলায় হারাইনি কোনোদিন-ই, ইচ্ছে ছিল একবার অন্তত হারিয়ে গিয়ে বাবার নাম ধরে মনের আনন্দে চ্যাঁচাবো, সেই গোপালের ছেলে যেমন চিল্লিয়েছিল “অ্যাই গোপাল, গোপাল”! কিন্তু সে শখ আর পূর্ণ হল না কোনোদিন।
তবে হারিয়ে একবার গেছিলাম, তাও আবার আধদামড়া, হিজল-দাগড়া বয়সে। সে-ও সেই অভিশপ্ত সপ্তমীর দিনটাতেই। সেই গল্প বলছি।
সেদিন গেছিলাম বোধহয় বালিগঞ্জের দিকে, যদিও “আমি গেছিলাম” বললে যেমন কর্তৃবাচ্য বোঝায়, তেমন আমার জীবনের কোনো দুর্ঘটনাই নয়। বলা ভালো, আমার-ও যাওয়া হয়েছিল। জোয়ারের বিষ্ঠা কিংবা প্রেমের সিনেমায় ম্যাপল গাছের পাতা যেমন এমনি হেসে ভেসে যায়, তেমনি। তবে উদ্দেশ্য ছিল বোধহয় কোনো এক বন্ধুদের দলে মিশে ঘুরতে যাওয়া, যে দলে সেই প্রাণাধিকাও আসবেন, অন্তত সেইরকম-ই কথা হয়ে আছে। কিন্তু তখনও শিপিয়েমের সূর্য মধ্যগগনে, অতএব বিধিও অভ্যেসবশেই কট্টর বাম। কাজেই মফস্বলের গল্পের নায়ক বুট-টুট পালিশ করে, জামাটামা গুঁজে, বগলে পাউডার মেখে ম্যাডক্সে পৌঁছে দেখে – ওরেব্বাবা সে এক অবাক পৃথিবী। পৃথিবীর তাবৎ স্মার্ট ও ঝকঝকে ছেলেমেয়েরা মাঠে বসে গিটার বাজাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে, গান গাইছে, তাদের আশেপাশে ঝলমল করছে তাদের ততোধিক স্মার্ট বন্ধু ও বান্ধবীরা, সেই ভিড়েই মিশে আছেন আমার ডি-মাইনর। আর সে আলোর ঝলকানির থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে হিংসের গন্ধে ম-ম করছি আমরা, বান্ধবহীন-প্রেমহীন বাকি সবাই। বুঝলাম আপাতত অর্ধেক রাজত্ব বা রাজকন্যে কোনোটাই এই বোকা মানুষের কপালে নেই, যদিও মনে মনে বললাম “যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্”?
ফেরার পথে মেট্রোর মাস-এক্সোডাসের কাছাকাছিও যেতে সাহসে কুলোলো না, ভাবলাম বরং এই একা একা বাড়ি ফেরার রাতে একটা ‘শ্যামবাজার’ লেখা বাস দেখেই উঠে পড়ি। পড়লাম-ও, এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, বসতেও পারলাম সেই আড়াআড়ি কোনো একটা সিটে। তারপর সে বাস চলল তো চলল, বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে বহু দেশ ঘুরে চলল। মাঝে কিছু লোক বিরক্ত হয়ে নেমে গিয়ে বাসের সমান্তরালে হাঁটতে শুরু করে দিলেন, কিছু প্রতিভাবান তবলাবাদক আটকে থাকা বাসের খোল পেটাতে আরম্ভ করেও একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। মাঝে কোনো এক বিদ্রোহী কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, “এটা কি চলছেটা কি শুনি?”, ভিড়ের মধ্যে থেকে মৃদু উত্তর এল, “বাস”। আমার একবার মনে হল দাদু এইরকম বাসে চেপে গেলে নিশ্চয়ই লিখতেন, ‘সে চলে যাবো বলেও, গেল না, ও সে কোথায় যাবে, স্টপেজ এল না’।
আমিও একসময় বাসের সিটেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে হয়, এবং কখন কোথায় সে ঘুম ভেঙেছিল, বা আদৌ সে ঘুম ভেঙেছে কি না, সে আমার মনে নেই, মনে নেই। তবে শেষরাতে হাতিবাগানের কূলে জেগে উঠলাম, আর ‘জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়’। নেমেই সভয়ে দেখলাম ফুটপাতের উপর রোলের দোকানের পাশে আমার দিকেই বিস্ফারিত চক্ষে তাকিয়ে আছে এক দিদি, যাকে কথা দিয়েছিলাম কলকাতায় এলেই তাকে এস-এম-এসে জানাবো, এবং জানাইনি। সে অবশ্য ভালো দিদি, একটাও ঠাকুর দেখিনি শুনে আমাকে বগলদাবা করে নিয়ে চলল ভিড় থেকে ভিড়ান্তরে, বলল এবার শোভাবাজার, তারপর আহিরীটোলা সার্বজনীন করে সো-ও-জা কুমোরটুলি। কিন্তু স্নেহ ভারী ও বিষম বস্তু, বিশেষ করে না চাইতেই পাওয়া গেলে। মনে হল, এ তো ভারি উৎপাত হল, আর তক্কে তক্কে রইলাম একটু ভিড়টিড় পেলেই হাল্কা করে পিছিয়ে পড়বো আর ঐ তো বাঁশ উঠেছে, পাল ছুটেছে করে আমিও মিলিয়ে যাবো, যেমন গ্রুপ-ফটোর সেপিয়া ব্যাকগ্রাউন্ডে মিলিয়ে গেছি জীবনভর।
উদ্দেশ্য প্রায় সফল হয়েছিল, প্রায় পালিয়ে নেতাজীর ঘোড়ার দিকে ছুট দেবো কি দেবো না করছিলাম, হঠাৎ শুনি মাইকে ভেসে আসছে আমার-ই নাম, “সেন্টার সিঁথি থেকে এসেছেন যদুবাবু, আপনি যেখানেই থাকুন, সত্ত্বর আমাদের অনুসন্ধান অফিসে যোগাযোগ করুন”। চোখের সামনে দেখলাম – ঐ প্রায়-ভোরের আলো-আঁধারিতে আমার নামটাও দিকে-দিগন্তরে ছড়িয়ে গেল হোয়্যাটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ডের মতন। আবার কুস্তোকুস্তি করে অকুস্থলে পৌঁছে দেখি, ব্যাগ আঁকড়ে ধরে একা একা বসে আছে সেই দিদি, চিন্তায় তার মুখের রঙ নিভে গেছে সেই রাতের মত, নিজেকে এক কষে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে হয়েছিল সেদিন।
সেই, সেইটাই আমার শেষ পুজো। বয়েস বেড়ে বেড়ে বার্ধক্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম, বন্ধু বান্ধবরাও কে কোথায় – আর কলকাতা তো এখন দীর্ঘশ্বাসের নামান্তর! এখনকার পুজোর অ্যালবামে তাই আটচল্লিশ ফুটের প্রতিমার ছবিও থাকে না, সপ্তমীর দিন ম্যাডক্সের কথা ভেবে হাসিও পায় না সপ্তাহখানেক পরে, আর নাঃ – পুজোয় নতুন জামার ইচ্ছে এতদিন একটা ধুলোয় ঢাকা চিঠি হয়ে কোথায় চলে গেছে কে জানে! এই সাত সমুদ্র তেরো নদীর পরে মা তার ছানাপোনাদের নিয়ে ফি-বচ্ছর এগজিবিশন দিতে অবশ্যি আসেন, সাধারণত হপ্তাখানেক আগে-পরে সুবিধেমতন কোনো একটা উইক-এন্ডে। না-বিশ্বাসীদের ধারণা মহিলা ও তার বৃহৎ আনপ্ল্যানড ফ্যামিলি সেই গঙ্গায় ডুব মারেন আর এই অতলান্তিকের কোথাও ভেসে ওঠেন, তবে তারা এসব কথা প্রকাশ্যে বলেন না, এবং এই বিশাল জার্নির ধকলেই হোক বা অন্য কোনো কারণে, এখানে তাঁর জৌলুশ পোস্ট-ইলেকশন সিপিএমের ন্যায় – দেশান্তরী রোম্যান্টিক বাঙালি ছাড়া তাঁর কদর করার লোক মেলা ভার। তবুও এই বয়সেও বেশ ইচ্ছে হয় জানেন, উইক-এন্ডের ছোট্ট পুজোর পর, দিনের শেষে ঐ ইউ-হলের গাড়িটা থেকে নামিয়ে, গ্যারাজের জঞ্জালের স্তূপটাকে একটু সরিয়ে, দুর্গাঠাকুরকে রেখে চলে আসতে আসতে একবার টুক করে একটা প্রণাম করতে।
আর ইচ্ছে হয়, অনুসন্ধান অফিস থেকে অর্ধেক পৃথিবী-পেরোনো মাইকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকুক আরেকবার, “সেন্টার সিঁথি থেকে এসেছেন যদুবাবু। আপনি যেখানেই থাকুন, ফিরে আসুন, আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন আপনার বন্ধুরা”।
এইবারে আর পালাবো না, প্রমিস!