- এ এ, আর খাস না বে , এরপর বমি করে মরবি...
- চুপ করত বাঁ, এই একটা দিন আমাদের দিন। খাব না মানে ! হুড়িয়ে খাব, ভরপেট্টা খাব...
- সেই তো বমি টমি আমাকে দিয়েই পরিষ্কার করাবি বাঁ...
- বেশ করব, করাব... তুই আমার বউ না !
- ফোট বে, স্লা, ঢপের বউ...
- এ বাঁ, আমার বউকে কিছু বলবি না... আমার বউ খুব ভাল।
বলেই যেখানে বসে ছিল তার পাশেই হড়হড় করে বমি করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল শানু। সেই দেখে একটু নাক টেনে বাদন বলল,
- ওয়াক, থুঃ! স্লা... সেই মাল ঢালল...!
না,শানুর জ্ঞান আছে এখনও । খাঁজা হয়ে যাওয়া বুকের নিচে পেটটা হাপুস হুপুস ঢেউ তুলছে, হাঁপাচ্ছে খানিক, হাতের মদের বোতলটা কিন্তু তখনও ছাড়েনি। সেই অবস্থায় উঠে বসে বোতল থেকে আবার ঢোক দিতে গেল। বাদন এক টান মেরে বোতলটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
- ব্যস ! হয়েছে, আর খেতে হবে না...
শানু বিরক্ত হয়ে মুখটুক কুঁচকে বলল,
- এই যে, মালের বউগিরি শুরু। তোর সাথে থাকি বলে তোর সব কথা শুনতে হবে নাকি বে ?
- হ্যাঁ, শুনতে হবে। কারণ আর আমি বমি পরিষ্কার করতে পারব না।
- দে দে, মাইরি বলছি বেশি খাব না, আর এক ঢোক খাই...
- উউউ, একঢোক, পুরো বোতল গিলে নেবে...
- দে দে, বমি করে নেশাটা নেমে গেল...
- অনেক হয়েছে, এখন আর না...তারপর কাল আবার সকালে উঠবি না, গ্যারেজে ঠিক সময়ে না গেলে টিঙ্কুদা পিটিয়ে লাট করবে তোকে...
- উহু, উহু, টিঙ্কু না, টিঙ্কু না, স্লা টিং-গু...
-ইস্, শুধু নোংরা কথা তোর, খালি মস্তি...
শানু এবার বাদনের গায়ে ঢলে পড়ল,
- চল না, চল না, আজকে একটু মস্তি করি...
- না, চল হাট এখান দিয়ে... শুধু মস্তি...
- মস্তি আর করলাম কোথায়, আজ সারাদিন তো বৃষ্টি, আকাশ ফুটো হয়ে গেছে...
বমি পরিষ্কার করার জন্য বাদন একটা ন্যাকড়া নিয়ে এল। মদ বাদনও খেয়েছে, কিন্তু তার ভালই চেতনা আছে, পা টলে গেলেও চলে ফিরে বেড়াতে পারছে ভালই। বাদন জানে যে মদ খেয়ে একেবারে অচৈতন্য হলে তার চলবে না, তাদের দুজনের এই সংসারের চলবে না। ঝড়ঝাপটার এই গরিবের সংসার। এ সংসার তারা সাধ করে তৈরি করে নি, এ তাদের ঠেকায় পড়ে তৈরি করা সংসার। যদিও এ সংসারের পেছনে শানু তেমন খাটে না, কিন্তু ভাল করেই জানে সে যে ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যে এখন রয়েছে তার পেছনে এ সংসারের ভূমিকা প্রচুর। সংসার সামলায় বাদন, তাই শানু বাদনকে এ সংসারের বউ বলে ডাকে। ওদের এই বর-বউয়ের সম্পর্কের আরও একটি দিক আছে যা উভয়েরই প্রায় একেবারে অদেখা। কাকের খাবার লুকোনোর মত করে ওরা নিজেদের এই সম্পর্ক বয়ে নিয়ে যায়। যদিও বাইরের লোকে ওদের ভাল বন্ধুই ভাবে।
বাদন সুন্দরবনের ছেলে। ঝড় ঝাপটা, খালবিলে, সাপব্যাঙের মধ্যেও কীভাবে টিকে থাকা যায়, কীভাবে সংসার গুছিয়ে রাখতে হয় তা সে জানে। সুন্দরবন ছেড়ে শহরের এই উপকণ্ঠে আসার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বাদনের ছিল না,বাদন তা চাইত-ও না যদি তার খিটখিটে কাকার চায়ের দোকানে চাকরিটা পাকা হয়ে যেত, কিন্তু তা হয় নি। কাকার চায়ের দোকান নেহাৎ ছোট ছিল না, সে এক রমরমা চায়ের দোকান, তাতে চা ছাড়াও ডিম পাউরুটি ঘুঘনি ছিল বিখ্যাত। দুপুরেও সেসব বিক্রি হচ্ছে, সকালে আর বিকেলে তো হতই। দম ফেলার জো ছিল না সে দোকানে। কিন্তু সুখ সহ্য হয়নি বাদনের, মোবাইল কেনার জন্য পাঁচশো টাকা কম পড়েছিল তার, নিয়েছিল কাকার দোকানের টাকার বাক্স থেকে। কে যেন একটা তা দেখে কাকাকে বলে দেয়, ব্যস! আর কি ! চোর বদনাম, ঘাড় ধাক্কা। মা-ও চড়চাপাটি দিয়ে দূরদূর করে দিল, আর করবে নাই বা কেন, তার মা তো এখন কাকার সংসারেই খায়। বাদন শহরে চলে এল, এদিক সেদিক ঘুরে টিঙ্কুদার গ্যারেজে কাজ ধরল। ভেবেছে আরেকটু কাজ শিখে একটা ভাল জায়গায় যাবে, বা একটা টেকনিক্যাল কোর্স করে নেবে। বাদন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, রেজাল্ট খুব একটা ভাল হয় নি। গ্রামের বিশু মাস্টার পরামর্শ দিল, যার নেই কোনও গতি তার আছে বাংলা অনার্স। কথাটা শুনতে খারাপ লেগেছিল বটে, কিন্তু পরীক্ষায় যে নম্বর সে পেয়েছিল তাতে ওই বাংলা অনার্সই সে পেল। বিশু বলেছিল, তিন বছর সেই যখন পড়তেই হবে তাহলে আবার শুধু পাস পড়া কেন, এ তো আর আগের দিন নেই যে পাসকোর্স দুবছর, তুই বরং একটা অনার্স নিয়েই পাশ কর। যাই হোক, চোর বদনাম পাবার পর গ্রাম ও অনার্স দুই-ই ছাড়তে হল বাদনকে। এই যে এখানে এসেছে, মন পড়ে রয়েছে সেই গ্রামে, মায়ের কাছে। ভাল কাজ করে মা কে এখানে নিয়ে এসে রাখবে এই ভাবনা তার।
শানু এখানকারই ছেলে। শানুর দূর সম্পর্কের মাসি পিসি আছে বটে, বাদন শুনেছে, কিন্তু তাদের দেখা পায় নি। শানুর মা বাবার খোঁজ পাওয়া যায় না। বাদনের সাথে শানুর আলাপটাও ওই চুরি দিয়ে। না না, এবার বাদন চুরি করে নি, বাদন আর কখনও চুরিই করেনি, আসলে সেবারও সে ঠিক চুরি করার মতলব করে নি, ভেবেছিল টাকা নিচ্ছে পরে রেখে দেবে। কিন্তু তা আর হয় নি। এবার চুরি করেছে শানু, গ্যারেজে যে গাড়িগুলো রাখা থাকে তার তেল চুরি করে কাটা তেল বিক্রেতা লাল্টুর কাছে বিক্রি করে অতিরিক্ত পয়সা কামায়। টিঙ্কুদা সাক্ষী হিসেবে নতুন ছেলে বাদনকে ডাকল। কিন্তু বাদনও এই একই আঘাতে কাহিল হয়েছিল আগে, সে জানে গাড়ির সামান্য তেল বিক্রি করে আর ক'টা টাকাই বা পাওয়া যায়। গরিব মানুষের এই ছুটকো চুরিকে বাদন চুরি হিসেবেই দেখে না, এর থেকে অনেক বেশি শ্রম বড়লোকরা তাদের কাছ থেকে চুরি করে নেয়।টিঙ্কুদা এসব নিয়ে যেন একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে। কিন্তু টিঙ্কুদারই বা দোষ কীসের ! এসব না দেখলে গ্যারেজের বদনাম হবে। তাই সাতপাঁচ ভাবার পরেও বাদনের সাক্ষ্য শানুর অনুকূলে গেল। সাক্ষ্য শেষে বাদনকে আড়ালে ডেকে শানু বলল,
- আমি তো তোর উপর পুরো ফিদা, তুই থাকিস চুপচাপ, কিন্তু পুরো তৈরি জিনিস...
- শোনো, আমি মিথ্যে বলেছি তোমায় বাঁচাতে, সেটা ঠিক। কিন্তু বারবার এই কাজ কোরো না, এরপর কিন্তু আমার আর কিছু করার থাকবে না।
সেই শুরু। বাদন একটু একটু করে শানুকে গুছিয়েছে। তুমি থেকে তুই হয়ে একে অপরের আলাপ চলতি গালাগালিতে এসেছে। শানু সব দেখে শুনে বুঝেছে যে বাদনের মধ্যে একেবারে গ্যারেজের ছেলের ভাবটা নেই। বাদনের সামান্য শিক্ষা, গ্রামীণ স্নেহবোধ এই জীবন ঘষটে চলা যান্ত্রিক গ্যারেজ একেবারে মুছে দিতে পারে নি। তারপর খরচ কমানো আর শরীর রাখার তাগিদে তারা একসাথে এই খাল পাড়ের ঘরে থাকে, তাদের সংসার করে। শুধু সংসার নয়, বলা কওয়া ছাড়া এমনিতেই আরও অনেককিছু তাদের মধ্যে অঘোষিত নীতির মত সমাধান হয়ে গেছে। কখনও হয়ত তারা সেসব ক্ষণিকের আনন্দ হিসেবে নিয়েছে, কিন্তু কখনও হয়ত সে আনন্দের রেশ সপ্তাহব্যাপী মনে রয়ে গেছে, এসব অবশ্য কেউ ঠিক করে বলতে পারে না।
বমি পরিষ্কার করার পর টলমল পায়েই এবার খাবার আয়োজনের পালা। চৌকির পায়ায় পিঠ ঠ্যাকনা দিয়েই শানু বলল,
- ধুর ! রোজ রোজ এই নখরা পোষায় না। এবার আমি বিয়ে করে নেব...
- তা নে না, ঠেকাচ্ছে কে?
- তুই রাজি তো?
- আমি রাজি থাকার কী আছে ! যারা বিয়ে করবে তারা রাজি হলেই হবে।
- নেকু মাল পুরো, আমার বিয়েটা কার সাথে হবে শুনি ? তোর সাথেই তো হবে...
- পাগলে গেছিস...
- বিয়ে তো নস্যি, পুরো ফুলশয্যা হয়ে গেল, এখন ছেলের বিয়ে করতে নজ্জা !
- তুই চুপ কর্, মাল পেটে গেলেই বড্ড ফালতু বকিস তুই...
- চুপ কর্, বললাম না বমির পর নেশা কেটে গেছে... এখন আমি পুরো টনটন জ্ঞান নিয়ে কথা বলছি।
- আচ্ছা...
- কী? তাহলে তুই রাজি?
- বিয়েটা ছেলেখেলা নয় রে, ছেলেতে ছেলেতে বিয়ে হয় না, তুই একটা মেয়ে খোঁজ।
- ওরে আমার ভদ্র মাল রে ! হ্যাঁ রে... তাই রে, হুহ ! ছেলেতে ছেলেতে চুটিয়ে শোওয়াশুয়ি করা যায় আর বিয়েটাই করা যায় না ! বাঃ রে ! নিয়মের নিকুচি করেছি ! আর তুই মনে হয় নিজের জন্য মেয়ে খুঁজে রেখেছিস ! খবরদার ! ভুলেও সে কাজ করিস না। আমায় ফেলে রেখে যদি তুই মেয়ের সাথে যাস, সেই মেয়েকে গিয়ে আমি বলে দেব যে তোর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
- সেই ! আর সেই মেয়ে কত বিশ্বাস করবে, হুহ!
- তখন সব বলে দেব...
- কী বলবি?
- তোর শরীরের কোথায় কী আছে, বেশি করে বলব যে তোর ওইখানে তিল আছে...
- স্লা, নোংরা ছেলে...
বাদন এবার প্রায় চুপ করে খাবার বানানোর কাজ করছে। শানুর এই বকবকানি নতুন নয়, এর আগেও বহুবার এসব বলেছে। পেটে লালজল পড়লেই এসব কাহিনি মোচড় দিয়ে দিয়ে তার মুখ থেকে বেরোয়। এসব বাদনের কাছে একরকম গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে এই বিয়ের কথাটথা যেন শানু একটু বেশিই বলে এখন। কে জানে, শানুর হয়ত বিয়ের ফুল ফুটেছে। একেকটা সময় আসে যখন ছেলে মেয়ে বিয়ে পাগল হয়ে যায়। শরীরের সুখ যেসব ছেলে মেয়েরা পায়নি তাদের ক্ষেত্রে না হয় এই বিয়েপাগল ভাবটার কথা তবু কিছুটা বোঝা যায়। কিন্তু শানুর তো আর তা নয়, বাদনের গায়ের আর কোনও জায়গা তার অচেনা নয়। তবু এত একসাথে থেকেও কেন যে শানু শুধু বিয়ের কথা বলে তা বাদন বুঝতে পারে না। তাই জিজ্ঞেস করে বসল,
- তুই খালি বিয়ের কথা বলিস কেন রে?
- ওমা, সংসার করচি, আর বিয়ে করব না?
- না, মানে এই আমার সাথে বাড়তি বিয়েটুকু করে করবি টা কী ? মানে সবই তো চলছে !
- তোর উপর আমার একটা বর-বর দাবি হবে... তখন আর তুই আমায় এত নখরা দেখাতে পারবি না...
- ও ! তাই বল, দাসী খাটাবি... লাথ মেরে চলে যাব যদি বেশি বরগিরি ফলাস...
- ও, তার মানে তুই রাজি ?... কেন রে রাগ করিস? আমি কি তোর খেয়াল রাখি না?... তাহলে ফাইনাল, কালকেই বিশ্বকর্মা ঠাকুরের সামনে তোকে বিয়ে করব।
- আবার ভুলভাল কথা, বিশ্বকর্মা কি বিয়ের ঠাকুর নাকি?
-হুর! হুর! বিয়ের কোনও ঠাকুর আছে নাকি? দেখেছিস কখনও বিয়েতে কোনও ঠাকুরকে?
- তা দেখিনি, কিন্তু শিবের সামনে, কালীর সামনে সিনেমায় বিয়ে হতে দেখেছি... বিশ্বকর্মার সামনে দেখি নি।
- আরে, বিশ্বকর্মাই আমাদের শিব, বিশ্বকর্মাই আমাদের কালী... কোন দেব দেবীর কাছে আমরা যেতে পারি রে? দুগ্গা, সে তো পাড়ার মেয়ে আর মায়েদের। গণেশ ব্যবসায়ীদের। লক্ষ্মী, সে হল এয়োদের। সরস্বতী, ইস্কুলের ছেলে মেয়েদের। আমাদের কাছে যে ঠাকুর আছে আমরা তো তাদের সামনেই বিয়ে করব নাকি আবার একটা আলাদা ঠাকুর খুঁজতে যাব?
শানুর এসব কথা আর শেষ হয় না। এসব আংরা-বাংরা কথা শুনে বাদন একপ্রকার বিরক্ত হয়ে বলল,
- যা তো যা, তোর যা ইচ্ছে হয় তাই কর গিয়ে, আমায় জ্বালাস না। পেট ভরে মদ গিলবি, তারপর এইসব ভূতের কেত্তন শুরু করবি...
-সবই তো তোমার জন্য ডার্লিং...
বাদন বিরক্ত হচ্ছে বটে কিন্তু মনে যেন কীসের আশা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। সেই ভাব হয়তো দীর্ঘদিন ধরে গোপন। মহাকালের লীলা খেলাতেই হয়তো আজ বাদন আর শানু যেটুকু একসাথে থাকে, নইলে কোথায় ওদের প্রেম ভেসে ভেসে বেড়াত কে জানে !
বাদন কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করল,
- বিয়েটা হবে কী করে শুনি?
- ঠাকুরের সামনে সিনেমার মত সিঁদুর পরিয়ে দিলেই হল। কেউ তো আর দেখতে যাচ্ছে না যে তোকে কী ভেবে সিঁদুর পরালাম, সে আমি আর তুই জানলেই হবে...
এ কথা শুনে বাদন ব্যঙ্গ করে উঠল,
- হুহ ! বিয়ে হবে, বিয়ে হবে, ছাই হবে, শুধু সিঁদুর পরালেই যেন বিয়ে হয় ! আর কিছু লাগে না...
- আর কী লাগে?
- সাত পাক ঘোরা নেই, মালাবদল নেই, মা বাবার আশীর্বাদ নেই...
- ও বিশ্বকর্মাই আমাদের মা, বাবা, শ্বশুর শাশুড়ি, সব কিছু। গ্যারেজের ছেলেদের আর কে থাকে রে ? আর শোন, ছেলেদের বিয়ের আগে এত কিছু ভাবতে নেই, আমরা কী মেয়ে নাকি ! ছেলেদের শুধু মন ঠিক করে বিয়ে করে ফেলতে হয়... আর... সাতপাক ! ও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ঠিক।
-হুহ, দেখব দেখব।
- এবার আয়, বিয়ের আগে একটা পার্টি করি, আমায় মদ খাওয়া...
- আমি জানি তো... শুধু মদ খাবার তাল...
- আরে আমি মাতাল নাকি? বচ্ছরে ক'বার খাই? আজকের দিনে যদি একটু মস্তিই না করি তবে কি চলে? কাল আমাদের বিয়ে বলে কথা...
- তা কী মস্তি করবি শুনি ?
- মুখে মুখে মদ খাব...
- ইস, আবার সেই... এসব আমি পারব না।
- পারতেই হবে... একঢোক মদ মুখে নে, তারপর আমার মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে আমায় খায়িয়ে দে...
- ইস, কী নোংরা ছেলে রে বাবা...!
সকালে ওদের নেশা কেটে গেছে। আজ পুজো। প্যান্টের উপরে পাঞ্জাবি পরেছে দুজনেই, বিশ্বকর্মা নয় যেন দুই কার্ত্তিক ঠাকুর বেরোবে এখন। বাদনের কানে এসে শানু ফিসফিস করে বলে গেল,
- আমি কিন্তু সত্যি বলছিলাম কাল, আজ আমাদের বিয়ে। ভাবিস না কাল নেশা করে ভুংভাং বকেছি।
বাদন মুচকি হাসল। তারপর একটু গম্ভীর মুখে বলল,
- ঠাকুর মশাইকে একবার জিজ্ঞেস করে নিলে হয় না ?
- মাথা গেছে নাকি তোর যে ঠাকুর মশাইকে গিয়ে বলবি আমরা বিয়ে করব?
- না, না, তা বলব না। জিজ্ঞেস করব যে বিশ্বকর্মার কাছে বিয়ে করা যায় কি না?
- কাকে জিজ্ঞেস করবি? সেই ক্ষ্যাপা চক্কোত্তি কে? সে ব্যাটা আদ্দেক কিছু জানে না...
- জানে জানে...
- বললাম, বিশ্বকর্মার কাছে বিয়ে হবে, শুনলি না, যা, আমি পারব না এসব জিজ্ঞেস করতে...
- উফ ! তোর জিজ্ঞেস করতে হবে না, আমি জিজ্ঞেস করব। তুই চুপ করে শুনিস...
- হুহ ! শেষে বিয়েটাই না পণ্ড হয় ! আমার এতদিনের সাধ!
- আরে হবে না পণ্ড, বিশ্বকর্মার কাছে বিয়ে না হলে অন্য ঠাকুরের কাছে বিয়ে করে নেব। শিব কালীর কাছে তো হয়ই।
পুজো হল। এমনিতেই পুজোর কাছে গ্যারেজের ছেলেপিলে থাকে না, তারপর আবার শেষ পুজোতে তো আরোই ফাঁকা। এবার দেদার মদ খাওয়া শুরু হবে। আগের দিন, পুজোর দিন আর যদি ভাসানের একটা দিন বেশি পাওয়া যায় তবে সেদিন, এই তিনদিন মদের ফোয়ারা বইবে, হুল্লোড় গ্যারেজে। মদের সাথে কতলোকের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, ঝগড়া-ঝামেলা, মারামারি-মাথাফাটাফাটি, বন্ধুত্ব-ইয়ারি হয়ে যায়। এই ফাঁকা পূজা মন্ডপে চক্কোত্তি বাবু চাল, কলা, মূলো গোছাচ্ছেন। বাদন সামনে গিয়ে প্রণাম ঠুকল, চক্কোত্তি বললেন,
- ঠাকুরের সামনে প্রণাম করতে নেই। তা কিছু বলবে মনে হচ্ছে...
- আজ্ঞে হ্যাঁ।
- বল?
- এই বিশ্বকর্মার ব্যাপারে জানতে চাইছিলাম...
- তা ভাল, পুজোর শেষে গ্যারেজের ছোকরা মদ না খেয়ে বিশ্বকর্মার সম্পর্কে জানতে চাইছে, হাহাহা... কিন্তু, আমার তো হাতে এখন এত সময় নেই, সেসব অনেক কথা...
- আজ্ঞে, কম করে বললেও হবে...
- তা বটে ! কিন্তু ঠিক কী জানতে চাইছ, সে যদি তবু জানা যেত... তবে বিশ্বকর্মার পিতামাতা থেকেই শুরু করি...
- আজ্ঞে, আসলে... জানতে চাইছিলাম যে বিশ্বকর্মার কাছে বিয়ে করা যায় কি না ?
- অ্যাঁ ! বিয়ে ! হো হো হো... বুঝলুম... তা কে করবে বিয়ে? তুমি নাকি তোমার বন্ধু?
শানু একটু চটেই গেল, বলে উঠল,
- আজ্ঞে, দুজনেই যদি করি, আপত্তি আছে কি?
- না, তা আপত্তি নেই, জোড়া বিয়ে, সে তো ভাল কথা।
চক্কোত্তি এবার তার নস্যির কৌটোটা বের করলেন। এই ছেলে দুটির এ প্রশ্ন শুনে তাঁর যেমন কৌতুক হয়েছে তেমনি কৌতূহলও কিছু কম নয় । দুটো টোকা দিয়ে এক চিমটে নস্যি নাকে ভরে বললেন,
- শোনো তবে, এখন যে বিশ্বকর্মা আমরা দেখতে পাই, এ অনেক সংক্ষেপিত রূপ। ঋগ্বেদে বিশ্বকর্মার প্রাচীন রূপের বর্ণনা আছে। তিনি শুধু সৃষ্টির কারিগর নন, তিনি আদি দেবতা ব্রহ্মা। এইবার, বিবাহ কে সংঘটিত করায় সে জান তো?... বিবাহ দেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। তাই হিসেবমত বিশ্বকর্মার কাছে বিয়ের কোনও সমস্যা নেই।
- এমন বিয়ে কী করে করা যায়?
- বিয়ে তো বিয়েই। তার আবার এমন তেমন কী? গুচ্ছের লোক শুধু মালাবদল করেই একযুগ সংসার করে ফেলল !
- আজ্ঞে, নিয়ম টিয়ম...
- আচ্ছা, নিয়মের কথা বলছ? শাস্ত্র? তা শাস্ত্রে কি পুজোর আগে পরে মদ খাবার নিয়ম আছে ? এখন তো আর কেউ পুজো করে না, মদ্যপানের ছুঁতো খোঁজে। কালীপুজো, মা দুগ্গার পুজো দেখো, পাড়ায় পাড়ায় মদ্যপানের আসর। সেভাবে দেখলে শাস্ত্র আর এখন কে মেনে চলে ? অ্যাঁ ! আজকাল মূল্য ধরে দিলেই আদ্যশ্রাদ্ধ হয়ে যায়, কী আর বলবে !... আর বিবাহ তো দুই আত্মার মিলন, এ তো ভীষণ ভাল কাজ, শুভ কাজ, শুভ কাজে কোনও বাধা নেই, অতো নিয়ম দেখতে নেই, মনে বিয়ে এলে করে নিতে হয়। বেদে দুই আত্মার মিলনকেই জগতের শ্রেষ্ঠ ঘটনা বলে ব্যাখ্যা করা আছে... অবিশ্যি নিয়মের আমি এত বলছিই বা কী ! আমার গুরু শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ আচার্য্য মহাশয়, ভক্তিভরে এমন কালীপুজো করতেন যে পাঁচগ্রামের লোক একডাকে সাড়া দিত। তা সেই তিনি পূজার মাঝখানে ধূমপান করতেন, কই কেউ তো কিছু বলে নি ! এই যে আমি নস্যি নিই পুজোর মধ্যেই, দোক্তাপান খাই পুজোর পর, এও তো নেশা। তবু কি জগৎ চলে না ? চলে তো ! এসবই মহাকালের ইচ্ছা, আমরা তো পীপিলিকা সদৃশ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সামান্য জীবমাত্র। শোনো, নিয়ম তৈরি করাই হয় ভাঙার জন্য, হা হা হা, দেবতারা কি নিয়ম ভাঙেন না? ঈশ্বর নিয়মে নন, ভক্তি আর বিশ্বাসে তুষ্ট হন। মন ভরে তাকে ডাকো। নিয়ম ভেঙে আমরা সব অশুদ্ধ হয়ে বসে আছি। আমরা কেউ শুদ্ধ নই। শুধু একমাত্র শুদ্ধ কে জানো ?
শানু কানখাড়া করে শুনছে। বাদন অস্ফূটে বলে উঠল,
- কে?
চক্কোত্তি বাদনের মুখের উপর একটু ঝুঁকে পড়ে, নস্যি লেগে থাকা আঙুল বাদনের বুকের উপর ছুঁয়িয়ে বললেন ,
- আত্মা, এই তোমার মন।
বাদনের বুকের উপর পাঞ্জাবিতে চক্কোত্তির আঙুলে লেগে থাকা নস্যি লেগে গেল। বাদন একটু ঢোক গিলে নিয়ে সেই মোক্ষম প্রশ্নটা এবার করেই ফেলল,
- আচ্ছা, এমনি করে কি ছেলে ছেলে বিয়ে করা যাবে ঠাকুরমশাই ?
চক্কোত্তি এবার বাদনের মুখের উপর চোখ রেখে একদৃষ্টে দেখলেন। বাদনের গলা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, যেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পরীক্ষার পাশ-ফেলের রেজাল্ট বেরুবে। চক্কোত্তি এবার ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠলেন,
- তাই বলি ! গ্যারেজের ছোকরাদের মতি গতি ফিরল কী করে ! ভাবলাম ঈশ্বরপ্রীতি হয়েছে, এখন দেখছি সেসব তো নয়ই বরং... মশকরা করছ আমার সাথে? বৃদ্ধ পুরোহিত কে ক্ষ্যাপাচ্ছ? সক্কাল বেলাতেই আকণ্ঠ মাল টেনে এসেছ দেখি... দূর হও এখান থেকে, ম্লেচ্ছ...!
বাদন অবাক হয়ে গেল। শানু তো ক্ষেপে গিয়ে কিছু একটা বলে দিতেই গিয়েছিল, বাদন শান্ত করে তাকে পূজাস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে এল। বাদন কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না যে একটু আগেই ঠাকুরমশাই বিয়ে নিয়ে, নিয়ম নিয়ে এই যে একটা উদারভাব দেখাল, ছেলে ছেলে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই সেসব কর্পূরের মত উবে গেল কোথায় ! পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুল না । শানু হাতের নখ দাঁত দিয়ে কুটকুট করে কাটতে কাটতে চক্কোত্তিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
- ব্যাটা কিস্যু জানে না... আসলে ব্যাটা দুমুখো। আমি প্রথমেই বলেছিলাম...
বাদন মুখ বেজার করে বলল,
- আমার কেমন ভয় ভয় লাগছে...!
- কীসের ভয়? আমরা তো কারও ক্ষতি করছি না, খুন-জখম, ডাকাতি করছি না!
- তবুও...
শানু দন্তবিকশিত করে বলল,
- ও কিছু নয়, বিয়ের আগে ওরম একটু আধটু করে। এটা ভাল লক্ষণ...
পরদিন বিসর্জনের সময় শানু চালাকি করে পুকুরের ধারে বিশ্বকর্মার সামনেই ঘট থেকে সিঁদুর নিয়ে বাদনের কপালে রাঙিয়ে দিল, শানু মনে হয় বাদনের সিঁথি খুঁজে পায়নি তখন। বিশ্বকর্মার ঘট নিয়ে পুকুরের জলে সেদিন শানুই নেমেছিল। কিন্তু সে ঘট পুকুর থেকে যে কোথায় গিয়েছিল তার খবর কেউ জানে না, গ্যারেজের মালিক, শ্রমিক কেউ-ই আর সেদিকে খেয়াল রাখেনি, সবাই তখন মদ খেয়ে চুর।
মদ খায়নি শুধু বাদন আর শানু। আজ ওদের বিয়ের দিন। বিসর্জনের পর বিশ্বকর্মার পুজোর ঘট নিয়ে পুকুরের জলে ডুব দিয়ে সেই ঘট চুরি করে নিজের পাঞ্জাবির তলায় লুকিয়ে তাদের ভাঙা ঘরে নিয়ে এসেছে শানু। ঘটে তখনও পুকুরের জলভর্তি, গায়ে সিঁদুর লেপ্টে গেছে। ঘটখানি ঘরের মাঝখানে মেঝেতে রেখে বাদনকে সাথে নিয়ে ঘটের সাতপাক দিল শানু। বাদন বলল,
- অগ্নিসাক্ষী হয় তো, এ তো জল সাক্ষী হয়ে গেল ! আমাদের বিয়েটা টিকবে তো?
সদ্য বিবাহিত শানুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল,
- টিকবে, আমাদের বিয়েটা না হয় অন্যরকম হল। শুনলি না ঠাকুরমশাই কী বলল ! শুধু আত্মা শুদ্ধ।
- হুম... কিন্তু দেখ, বিয়ে করলি তাও সেই ঠাকুরের ঘট চুরি করে !
- ঠাকুরের জিনিস আবার চুরি কীসের রে ? ঠাকুর তো সব জিনিস সবার মধ্যেই বিলিয়ে দিয়েছে। আর এ এমন কিছু দামী জিনিস নয়। এককোণে পড়ে থাকত, তাও আমাদের বিয়ের কাজে লাগল !
- উচ্ছিষ্ট !
- কী! কী বললি?
- কেমন যেন ফেলনা... বাড়তি মত আমাদের জীবন... লুকিয়ে চুরিয়ে করতে হয় সব কিছু...
- ও, তাই বল। এই পড়াশুনো করে মাঝে মাঝে যা সব শব্দ বলিস তুই, বুঝি না। বাড়তি তো হবেই ! আমাদের মত লোকেদের পুরো জীবনটাই তো বাড়তি। সুখটাও আমাদের চুরি করেই নিতে হয়, গরিবদের আনন্দ দেখাতে নেই। তবে তুই চিন্তা করিস না, এই অভাবের মধ্যেই আমরা সুখ খুঁজে নেব।
- হুম...
বাদন নিজের মাথা এলিয়ে দিল শানুর কাঁধে। ওদের গলায় গাঁদাফুলের মালা, কপালে সিঁদুর। সম্মুখে মেঝেতে ঘট, বিবাহের একমাত্র সাক্ষী। শানু দুষ্টু হেসে বলে উঠল,
- আজ কিন্তু আর নখরা চলবে না, এখন কিন্তু আমি তোর বিয়ে করা বর...
- ইস ! পাগলা...
রাত হয়ে গেছে। শানু যখন বাদনের বুকের কাছে ঘন হয়ে এসেছে, ঠিক তখনই বাদন বলে উঠল,
- হ্যাঁ রে, বিয়ে তো নয় যেন একটা লড়াই হল, তাই না?
- কীসের লড়াই? কার সাথে?
- কারো সাথেই নয়, আবার হয়তো সকলের সাথেই। কত বাধা, সমস্যা, সংশয় ছিল । শুধু কেউ জানল না বলে... আমাদের বিয়েতে বিশ্বকর্মার আকাশি ঘুড়িটা ভো-কাট্টা হয়ে গেল না তো ?
- কেন? ঠাকুরের সাথে প্যাঁচ খেলেছি নাকি? খেলা যায় না।
- না, তা খেলিনি। তবু যদি ঠাকুর রাগ করে?
- রাগ করবে না। অন্যায় কিছু করিনি। ভালো বাসাবাসি করেছি।
- ঘুড়িটা যেন চোখের সামনে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে, আর একটু করে স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছে, আশা জাগাচ্ছে। সুতোয় টান থাকলে তার দেখা কি আর পেতাম? এমন হেলেদুলে ভেসে বেড়াত না, যেন কোলে এসে খেলা করছে...
- আমারও...
- কী?
- কে যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
বাদন ফিসফিস করে বলল,
- বললাম না, এই সেই মায়াবী আকাশি ঘুড়ি... ঘুড়িটা কি কেটে গিয়েই আমাদের কাছে এল?
শানু ওর আঙুল দিয়ে বাদনের ঠোঁটে দুটো টোকা মেরে বলল,
- বিশ্বকর্মা হল ঠাকুর, ঠাকুরের ঘুড়ি কখনও ভো-কাট্টা হয় না। সুতোয় ঢিল দিয়েছে মনে হয় ...
( সমাপ্ত)