এযে সেই সীতারাম, বুঝতে আমার একটু সময় লাগল। প্রথম কুফরি এসেছিলাম বছর তিনেক আগে। সিমলা থেকে পরিবারের ছ’জনে গাড়ি নিয়ে সাইট সিয়িংএ কুফরি ও ফাগু। গাড়ির ড্রাইভার লোকাল এজেন্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সে ভদ্রলোকই সীতারামকে মিলিয়ে দেয়। কুফরি থেকে হর্স রাইডিংএ ফাগু যাওয়ার সময় সীতারামের ঘোড়া ভাড়া নেওয়া হলো। ছ'টার মধ্যে একটি ঘোড়ী ছিল। প্রাণী ক'টার চেহারা কেমন দুবলা মতো, দেখলে মায়া হয়।
ঘোড়ী ছিল সামনে, সীতারাম আমায় প্রথম উঠতে বলে। ঘোড়ীটার সওয়ার হতে হল আমাকেই। ঘোড়ীকে সামনে রেখে তার সঙ্গে বাকি ঘোড়াদের রশি বেঁধে দিল পর পর। ঘোড়া ও তাদের সওয়ারিরা থাকল একের পিছনে অন্যজন – এইভাবে। ঘোড়ীর লাগাম হাতে সীতারাম আগে আগে চলে।
কুফরি থেকে ফাগু দুই বা সওয়া দুই কিলোমিটার রাস্তা ঘোড়া চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট। বোধহয় পৃথিবীর নিকৃষ্টতম রাস্তা এটা! পুরো রাস্তা এক – দু বিঘৎ পরিমাণ পাথরে ভরা। উঁচু-নিচু আঁকা-বাঁকা ছয় সাড়ে ছয় ফুট চওড়া রাস্তার দুধারে কোথাও কোথাও পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কিছুটা রাস্তা গেলে দেখা গেল পাঁচিল আর নেই, তবে সে জায়গায় রাস্তা বলেও কিছু নেই। পাথরের চাঙর ভর্তি ঢালু ভূমি,আর পাইনের জঙ্গল। রাস্তা কর্দমময়। বেশ খানিকটায় ঘোড়ার পুরীষ আর কাদা মেশানো ঢলঢলে একটা স্তরে প্রায় হাঁটু ডুবে যায়। সীতারামের হাঁটু তক গামবুট থাকলেও সওয়ারিদের পায়ে সেই কাদা ছিটকে আসে। প্রতি মুহূর্তে ভয়। একটি ঘোড়া পড়লে সওয়ারীসহ বাকিগুলোও সেই কাদার নালায় পপাত ধরণীতল হবার সমূহ সম্ভাবনা ষোলো আনা। রাস্তায় অজস্র ঘোড়া। সওয়ারি নিয়ে যাচ্ছে আসছে – হেঁটে আসছে তাদের সহিস।
ঘোড়ার গায়ের গন্ধ - কাদা-পুরীষের গন্ধ, খুরের সঙ্গে পাথরের ঘর্ষণে খটখট শব্দ। সঙ্গে সওয়ারিদের ‘উঃ আঃ', ‘পড়ে যাবো', ‘গির যাউঙ্গি' ইত্যাদি নানাবিধ রইরই নিয়ে পুরো রাস্তা সরগরম। একসময় মনে হতে লাগল, এক্ষুণি পরিত্রাণ চাই। নেমে যেতে হবে। কিন্তু তারও উপায় নেই। দ্বিতীয় কোনো রাস্তা নেই, ফিরতে হলেও এই রাস্তাই ভরসা। হয়তো এই ব্যবসাটার স্বার্থেই এমন অবস্থা!
খেয়াল করলাম, সীতারাম আর তার ঘোড়াগুলো ঠাট্টার জিনিস। সবাই ডেকে যায়, “আরে ও সীতারাম – চলো চলো-”! কেউ বলে “সীতারামকা ঘোড়ী যা রাহি হ্যায়…. হুট হুট হুট-”। সে কিন্তু নির্বিকার। কখনও বা সহজ সুরে সাড়া দেয়।
ওই ভয়ানক রাস্তায় একটা ঘোড়া সারা দিনে অনেকসময়, ট্যুরিস্ট পেলে আট -দশ বার যাওয়া-আসাও করে। অন্য সময় খুব সংকীর্ণ টানেল মতো জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে বিশ্রামে থাকে।
এক-একটা রাইড শেষ হয়, অপেক্ষা থাকে কিছুটা সময়। দেখতে দেখতে আবার নতুন ট্যুরিস্ট পার্টি এসে যায়। সারাদিন পর কাজকাম শেষে ঘোড়া ও খিদমতগার ফেরে আস্তাবলে।
আমার ঘোড়ী যেতে যেতে কেবলই দাঁড়িয়ে পড়তে লাগল।
“ইসকি তবিয়ত ঠিক নেহি হ্যায় ক্যায়া, সীতারাম ভাইয়া?
“হাঁ জি! থোড়ি থোড়ি…. “
দাঁড়িয়ে গেলেই সীতারাম হাতের লাগাম দিয়ে তার মুখে, গায়ে আঘাত করে। আমার কষ্ট হয়। একসময় বুঝতে পারলাম ঘোড়ী গর্ভবতী। মানুষ আর মনুষ্যেতর প্রাণীতে তফাত আছে জানি, তবু নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধি আজ স্মরণ হল। আর ঘোড়ীর প্রতি মায়া আর একটু বাড়ল। কিন্তু কিছু করার নেই। উঠেছি যখন যেতে হবে, ফিরতেও হবে একইভাবে। আমি ঘোড়ীর কাঁধে গলায় টাল সামলে হাত বুলিয়ে আদর করি।
ফাগু ও ফাগুকে কেন্দ্র করে অসাধারণ সব দৃশ্য নাকি ভ্রমণার্থীদের মুগ্ধ করার জন্য অপেক্ষায় আছে। কুয়াশা সরে গেলে সেখান থেকে হিমালয়ের কিছু শৃঙ্গ স্বমহিমায় বিরাজিত – দেখা যায়। সুতরাং রাস্তার দুর্গমতা কারও কছে বাধা হতে পারে না। তাছাড়া বাড়ি ফিরে লোকেরা গপ্প করার এমন একটা মোক্ষম সুযোগ ছাড়বে কেন?
যখন অন্য সহিসরা সীতারাম ও তার ঘোড়াদের নিয়ো ঠাট্টা করে, আমার রাগ হতে থাকে। বেঁটে খাটো, চওড়া ধরণের আঁটোসাটো চেহারার সেই সীতারামের সঙ্গে সেদিন কুফরি থেকে ফেরার আগে আবার দেখা। আমরা ফাগু থেকে চলে এসেছি বেশ খানিকটা আগে। এবার সিমলা রওনা দেব। গাড়ীতে ওঠার আগে চা খেতে যাচ্ছি, দেখি সীতারাম আসছে সওয়ারি নামিয়ে। তাকে ডাকি, সীতারাম ভাইয়া, চায়ে পিয়োগে? “পিলায়েঙ্গে? চলিয়ে –“ খুশী মনেই ও আসে।
এলাচ দেওয়া ঘন দুধের চায়ে চুমুকের সঙ্গে সীতারাম নিজেকে মেলে ধরে। সশব্দে ছোট ছোট চুমুক দেয় বেশ আমেজে, যেন এখুনি শেষ না হয়ে যায়! বলতে থাকে, “একদিন হাম জরুর মালিক বনুঙ্গা। দশ, বিশ ঘোড়েকা মালিক।”
আমরা তাকে উৎসাহিত করি, ”কিঁউ নেহি! আপ জরুর মালিক বন সকতে –”। কিন্তু অপরের কোনো কথায় তার মন নেই। নিজের স্বপ্নে সে বুঁদ হয়ে থাকে। যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছে। তার কথা ঠান্ডা -ঠান্ডা হাওয়ার সাথে – কুয়াশার সাথে ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ে পাহাড়ে, চিনার আর দেবদারু গাছের পাতায় পাতায়।…
“মেরা বেটা পয়দা হোনে কে বাদ, হাম দোনো মিলকর বহুত মেহনত করুঙ্গা। “…. সে তার স্বপ্ন-লাটাইএর সুতো ছাড়তে থাকে ধীরে ধীরে ।… “ আমাদের একটা আস্তাবল থাকবে, সেখানে ঘোড়াগুলো দিনের শেষে বিশ্রাম নেবে। আমি আর আমার বেটা বাড়ি ফিরলে বিবি আমাদের গরম পানি আর চা দেবে। আমরা সাফসুতরো হয়ে চা খেতে খেতে আরাম করব। বিবি ঘোড়াগুলোর খিদমত করবে। “
আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “ওই ঘোড়ীটার বাচ্চা হবে, বহেনজি। বাচ্চাটা মালিককে চাইব। যদি দিয়ে দেয় – তো হো গ্যায়া! তারপর ওটা বড়ো হলে ওকে ব্যবসায় খাটাব। মেরা কিসমত খুল যায়েগা।”
একে একে গাড়িগুলো ফেরার পথ ধরেছে। হঠাৎ ঠান্ডা একটু বেশি লাগতে শুরু করল। আমরা কেউ কেউ শীতের বাড়তি পোশাক গায়ে জড়াই। আমাদের থেকে অল্প দূরত্ব রেখে বসেছিল সে। ঠান্ডা বাড়লে লোহার শীতল বেঞ্চে আরও একটু গুটিয়ে বসে সে। কালচে দাঁতে হাসে একটু। তার চোখ বোঁচা নাকের দুদিকে কোটরে ঢুকে যায়। তার বয়স আন্দাজ করতে পারি না। হতে পারে চল্লিশ বা পঁয়তাল্লিশ ।
আমি জিগ্যেস করি, তোমার ঘর কোথায়, সীতারাম ভাইয়া?
দূরে পাইন গাছের মাথার উপর দিয়ে চলে যায় তার দৃষ্টি। তারপর ফিরে আসে চোখজোড়া। বলে, এখন তো এখানেই ঘর। পনের বছর বয়সে মুলুক ছেড়ে এসেছি। কাঠমান্ডুর কালভৈরব মন্দিরের কাছাকাছি বস্তিতে থাকতাম। আর মন্দিরের কাছে হোটেলে বয়ের কাজ করতাম। একজন ছিল, তাকে আমি ওস্তাদজি বলে ডাকতাম। সে আমাকে সিমলা আনে। সিমলায় নানা দুখধান্দা করতে করতে এইসব ঘোড়ার মালিকের সঙ্গে আলাপ। তখন ওর অবস্থা এত ভালো ছিল না। তার ঘোড়ার দেখভালের জন্য আছি তখন থেকেই এই কুফরিতে। সওয়ারিদের ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে যাই ফাগু। একটু দম নিয়ে বলে, “মালিক বহুত ডাঁটতা হ্যায় মুঝে। লেকিন ম্যায়ভি মালিক বনুঙ্গা একদিন।”
আমাদের ফিরতে দেরী হচ্ছিল। তাই সীতারামকে একা রেখেই আমরা উঠে পড়ি। সেবার আমার শরীর খারাপ হল হঠাৎ। সিমলায় তাই আমি একাই থেকে গেলাম। অন্যেরা ঘুরেটুরে এসেছিল। আমারও ইচ্ছা ছিল লাদাখ পর্যন্ত যাবার। লাদাখের প্যাঙগঙ লেক যাবার কথা ভেবেছিলাম। সেই লেক, যার জলে বিগতযৌবনা পরীরা স্নান করতে আসে নবযৌবন লাভের আশায়। আমাদের সংসারের স্যাঁতস্যাঁতে চৌহদ্দিতে সম্পর্ককে নবযৌবন দেব বলে না-এর বলয় কাটিয়ে ঘুরতে এসেছিলাম। কিন্তু বহুদূরে পড়ে রইল প্যাঙগঙ লেক, তার নীল জলের স্পর্শ পেলাম না।
দুই
******
এবার আমি একাই এসেছি। আগামীকাল রওনা দেব মানালির উদ্দ্যেশ্যে। সেখান থেকে লাদাখ যাবার ইচ্ছা ত্যাগ করিনি। শেষ চেষ্টা একবার করবই। পরাবাস্তব বাস্তবকে বদলে দিতে পারে কিনা যাচাই করে নেব। মৃতপ্রায় সংসারটা যৌবনপ্রাপ্ত না হোক, অন্তত বেঁচে উঠতে পারবে কিনা!
আজ এমনিই ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি কুফরি। ফাগু যাবার ইচ্ছে নেই। এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে যাব সিমলায়। ঘোড়া চলাচলের টানেলের মুখে এসে দাঁড়ালাম। এই জায়গায় মিশ্র একটা বোঁটকা গন্ধ বাতসে ভেসে থাকে। গতবার যেমনটা পেয়েছিলাম। হঠাৎই সীতারামকে দেখতে পাই। তাকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গেলাম।
“সীতারাম ভাইয়া -! ”
তাকাল। কিন্তু চিনতে পেরেছে বলে মনে হল না।কত কত ট্যুরিস্ট আসছে যাচ্ছে প্রতিদিন, আলাদা করে কাউকে মনে রাখা সবসময় সম্ভব নয়। তাই হয়ত চিনতে পারেনি।
মাত্র দু-এক বছরেই জবুথবু চেহারা হয়ে গেছে যেন! একটা চাদর গায়ে ভালোমতো জড়ানো। মাথায় টুপি। পায়ে গামবুট আছে, কিন্তু ঘোড়া নিয়ে গেলে কাদায় ডুবে থাকার যে চেহারা হওয়া উচিত, জুতোয় তার চিহ্ন নেই। কাদার ছিটের শুকনো দাগ লেগে আছে শুধু খসখসে পুরনো রাবারের গামবুটে।
আমি কথা বলতে থাকি। তখনই “এ সীতারাম” বলতে বলতে অল্পবয়সী একটি ছেলে এগিয়ে আসে। সীতারামের হাতে তার ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধা লাগামটা ধরিয়ে দেয়। আমি ভাবি এবার হয়ত সওয়ারি নিয়ে সে সেই কাদাজলের রাস্তায় নেমে যাবে ফাগুর উদ্দেশ্যে। কিন্তু উল্টো দিকের রাস্তা ধরে সে ঘোড়া নিয়ে চলে যেতে থাকে।
আমি ছেলেটির দিকে এগিয়ে যাই। সে তখন সওয়ারি নিয়ে খুব ব্যস্ত। তবু জিগ্যেস করি, সীতারাম ভাইয়ার কী হয়েছে?
সে হাসতে থাকে। বলে, আরে, ওটা পাগল আছে। ও তিনটে রোগা দুবলা ঘোড়া আর একটা মাদী ঘোড়ার সহিস ছিলো। ঘোড়ীটার মরা বাচ্চা হবার পর পাগল হয়ে গেল যেন। মালিক ঘোড়ীটা তখন বেচে দেয়। সীতারামের বৌভি মালিকের সাথে ভেগে গেল। বরবাদ হয়ে গেল সীতারাম।
কথাগুলো আমায় পাথরের মতো আঘাত করে। জানতে চাইলাম, এখন সীতারাম কী করে?
এখন সে আমাদের সবার ঘোড়া আস্তাবলে নিয়ে যায় আর এনে দেয়, সবার ফাইফরমাস খাটে। তবে কথা বলে না। ইচ্ছা হলে কাজ করে , নাহলে করে না। আমরা সেটা মেনে নিয়েছি। পাগল লোক, যাবে কোথায়!’
কুফরিতে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। ফিরে আসতে থাকি। পাহাড়ে আজ একটুও কুয়াশা নেই। উজ্জ্বল রোদ্দুর ছড়িয়ে আছে। চিনার গাছের পাতাগুলোতে কুয়াশার কোনো রহস্য, কোনো স্বপ্নের কণামাত্রও লেগে নেই।