কামদেব বাইরের রাজ্যে কাজ নিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছে। বাইরে কাজে ট্যাকা আছে। যেতে কষ্ট হলেও বৌকে সুখে রাখতে গেলে এটা করতে হবে! চাষের কাজ করে তা জমানো সম্ভব নয়। তার অনেক ট্যাকা দরকার । এক কাঠা জমি কিনতেই হবে তাকে, নাহলে সে গৃহনির্মাণ যোজনায় বাড়ি তৈরীর আবেদনই করতে পারবে না।
বড়দা-মেজদা ঘর করার ট্যাকা পেয়ে ঘর বানিয়ে নিয়েছে। তার কুঁড়েটুকু কোনোমতে রয়েছে একটেরে। ওই ছিটেখানেক জায়গায় ঘর হয়তো কোনোমতে উঠবে, তবে তাতে হাত নুরকুতে কুলোবে না। বৌকে এত করণকস্যির মদ্যি রাখতে চায় না সে। তার বৌটার ঘরের সঙ্গে একটুন বারান্ডা চাই। বারান্ডার নীচে একখান জবাডালও কি পুঁততে পারবে না?
এসব বায়না তার বৌএর নয়। কিন্তু সে মনে মনে ছকে নিয়েছে। – বাড়ির একপাশে একটা ঝুপড়িতে দু-একটা ছাগল বাঁধা থাকবে। গোটাকতক হাঁস-মুরগির হুদড়ো। আর একটা গোপন বাসনা তার। বারান্ডা জুড়ে ছুটোছুটি করবে দুটো বাচ্চা, কুয়াশার ভেতর দে সে যেন এই দৃশ্যটা দেখতে পায়। ভাবতে তার নিজের মনেই কেমন লজ্জা লাগে, গালে লাল ছিটেও লাগে হয়তো। তাদের বিয়ে হয়েছে বছরখানেক হলো। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই চায়নি বলে এখনও কোনো বাচ্চাকাচ্চার আগমন ঘটেনি সংসারে। বৌ তার উপরপড়া নয়। কামদেব যেভাবে চায় সেভাবে তাকে উজাড় করে দেয়।
শিবু দিগের ছিলো তিন ছেলের বাপ। সে বেঁচে থাকতে তার এক কাঠা জমিতে তিন খানা কুঁড়ে। বড় দুই ছেলে তাদের বৌ-ছেলে নিয়ে দুই কুঁড়েতে । আর একটা তার আর ছোটব্যাটার।
চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়েস মানে তাদের সমাজে অনেকখানা বয়েস। কামদেবের ছড়ানো, পেটাই চেহারা। এমন যুবক কিনা বিয়ে করতে চাইত না! জোর জবরদস্তি করেও বাপ তাকে টলাতে পারেনি। খুব বলতো, সোমসার কর! তোকে সোমসারী দেখলে তবেই আমি নিশ্চিন্দি হয়ে মরতে পারি। কামদেবের মা আগেই গত হয়েছে। ইচ্ছাপূরণ না হতেই বাপও চলে গেলো বছর পাঁচেক আগে।
দাদারা তাকে অত গেরাহ্যি করত না। বরং বাপ মরতে বাউন্ডুলে কামদেবকে বিয়েসাদি করার জন্যে পাড়ার লোক উদ্ব্যাস্ত করে তুলত। সে বলত, আমি তো দিব্যি আছি গো! কাজকাম করছি, খাচ্চি-দাচ্চি – শান্তিতে আছি! যখন যেখানে মন হচ্ছে তখন সেখানে চলে যাচ্ছি। তোমাদের মতো দিনরাত ক্যাওম্যাও না করলে বুঝি চলছে না? বলত আর হা-হা করে হাসত। পাড়ার লোক শেষটায় বিরক্ত হয়ে বলত, ঢং –! তখন সে আরও জোরে হেসে উঠত।
এ হেন কামদেবও বিয়েয় বসল।
কোয়োরের পাশের গ্রাম কেষ্টপুর। দুই গাঁয়ের পাশ দিয়ে চলে গেছে মোরাম রাস্তা। সে রাস্তা গিয়ে ঠেকেছে শাশপুরে। তারওর সেখান থেকে বোঁয়াইচন্ডী যাবার রাস্তার সঙ্গে মিশে গেছে। কোয়োর কেষ্টপুরের পাশে সেই রাস্তার গায়ে বড় দিঘি।
দিঘির উত্তর পাড়ে বাঁধানো সিঁড়ি। তার শেষ ধাপে জলের কাছে ঝুঁকে বসেছিল একটি মেয়ে। সে মনে মনে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল। চেষ্টা করছিল জলে ভেসে ওঠা তার মুখের পাশে তার মরা মায়ের মুখটাও দেখা যায় কিনা।
তখন বেলা প্রায় ঢলে পড়েছে। রোদের রঙ কমলালেবুর দানার মতো। কামদেব গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ফিরছিল কোথাও থেকে।
হঠাৎ মনে হলো দিঘির ঘাটে কে একটা বসে যেন? পিঠে ছড়ানো চুল। ঝুঁকে বসে থাকায় তার মাথায় চুলে কমলা রোদ এসে পড়েছে। শাড়ি পরনে। কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছে না। কে রে বাবা! এমন জলের কাছে ঝুঁকে বসে আছেই বা কেন? মতলবটা কী? মরতে-টরতে এসেছে নাকি? রাস্তায় তো একটা জনমনিষ্যি নেই।
”কে গো, এমন করে বসে আছো?” – কোনো সাড়া নেই।
এবার ধমকে ওঠে, “কে গো তুমি? যেই হও, উঠে এসো বলছি!”
সে মনিষ্যি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। উল্টোদিকে আলো থাকায় মুখটা স্পষ্ট দেখা যায় না, শুধু কালো একটা মুখের ধাঁচা, সিলুয়েট ছবির মতন। এমন চমৎকার কনে দেখা আলোটা মাঠে মারা গেলো গা!
সামান্য পরে উঠে এলো। হাপ্পাগলাটে একটা মেয়ে! হয়তো কুড়ি -একুশ, কিংবা বাইশ-তেইশ। ঠিক বুঝতে পারে না। মাঝারি উচ্চতা। কালো, আঁটোসাটো কিন্তু মোলায়েম চেহারায় স্বভাবের অন্যমনস্কতা একটা মাধুর্য দিয়েছে। চোখদুটোয় সারল্য। মার্বেল যেমন ঢাল পেয়ে গড়িয়ে গিয়ে গর্তে পড়ে কামদেবের মনও তেমনি করে বাঁধা পড়ে গেল তার কাছে।
গলা খাঁকারি দিয়ে কামদেব জিগ্যেস করল, তোমার নাম কি? আশ্চর্য! নিজের কাছেই নিজের গলা কেমন নরম লাগল তার।
মেয়ের গলাও বড়ো মৃদু, উত্তর দিল, আমি হংসেশ্বরী। নাম আর গলা শুনে কামদেব একেবারে গলে গেল!
পাশাপাশি গাঁ হলেও কামদেব ওকে আগে কখনও দেখেনি। অথচ ও প্রায়দিন দিঘির ঘাটে এভাবেই বসে থাকে।
মেয়েটার মা ছিল গাছের মতো। সে মারা গেল যখন দশ-এগারো বছরের চারা গাছটখানা। গাছ-মা শামুক গুগলি হিঞ্চে ডুমুর নানা শাকপাত জোগাড় করে বেচতে চলে যেত সেহারা বাজার। বাজার ছাড়িয়ে এক-একদিন সেহারার গাঁ ভেতরে, নয়তো শ্রীকৃষ্ণ ঢাল বা লায়কা বাজারের দিকে। বর্ধমান-আরামবাগ রোডের দুদিকে যত বড় বড় গেটওলা বাড়ি আছে সেসব বাড়িতেও চলে যেত গাছটা। হিঞ্চে থানকুনি কুলেখাড়া ডুমুর এসব নিয়ে। সেহারা বাজারে পয়সা ঢাললেও এসব পাওয়া যায় না। গাছ আদাড়বাদাড়, জলা জায়গা থেকে ঢুঁড়ে আনতো অনেক মেহনত করে।
কোনো কোনোদিন জোর করে সেও ভিড়ে যেত। গাছ যেতে নিষেধ করতো। - তুই ঘরে থাক, মা! ট্যাঙোশ ট্যাঙোশ করে হেঁটে তোকে অদ্ধুরের রাস্তা যেতে হবে না। তরপর তো রাতে বলবি, মা, পায়ে ব্যথা করছে!
ও মানা শুনত না। আবোলতাবোল বকতে বকতে মাথা দোলাতে দোলাতে সঙ্গে যেতো যেন উৎফুল্ল বাতাসটি। উসকোখুসকো চুলে তার ছোট্ট বেনী – এদিক ওদিক দুলছে। যত না হাঁটা, তার থেকে লাফানি বেশি। বাতাসের পাগলামিতে নরম ধুলোর ডানা আকাশমুখো।
সাহস আছে বলতে হবে! গেটওলা বিশাল বাড়িগুলোতে ঢুকতে এতটুকু বুক কাঁপত না বাপু মা-গাছটার! কিংবা কে জানে, হয়ত কাঁপত, কিন্তু চারাটির কাছে দুর্বলতা দেখাত না। কোনো কোনো বাড়ির ভেতর থেকে কুকুরের এমন ডাক ভেসে আসত, তাতেই তো গায়ের রক্ত জল হয়ে যাবার কথা। মা-গাছ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পাকা ফেরিকরদের মতন বলত, কুলেখাড়া, হিঞ্চি, ডুমুর, থানকুনি আছে। একটু থেমে যোগ করতো, গুগলি আছে, কাঁকড়া আছে, নেবেন বাবু?
দিঘি থেকে পদ্মফুলের মরশুমে মা-গাছ পদ্মফুলও তুলে বিক্রি করতে নিয়ে যেতো।
–“ নাও না গো, মা! ঠাকুরকে দেবে। এই দ্যাখো, আলাদা প্যাকেটে এনিচি। কোনো ছোঁয়াছুঁয়ি নেই। টাটকা তুলে এনিচি, মা ”! পদ্মফুল বিকোনোর জন্যি মা বড্ড হ্যাঁয়ব্যাকুলি করত। তবে নিয়েও নিতো খদ্দেররা।
দিঘির গহীর জল কালচেপানা হয়ে আছে। তাতে কত লতা – দাম, সেগুলো থাকে পদ্মপাতা আর ফুলের নীচে, জলের নীচে আধ ডোবাভাসা। দিঘির পাড় থেকে সেসব ততো ঠাহর হয় না। জলে নেমে দিঘির যত দক্ষিণ দিকে যাওয়া যাবে তত টের পাওয়া যাবে কত কত বছরের পুরনো জলজ লতার ঠাসবুনোটের মোটা চাদর। পাঁক মাটিতে পা লাগবে না। জলের একেবারে তলায় পাঁক থেকে উঠে এসেছে অনন্তনাগের বিশাল বপু, জলের উপর ফনার রাজকীয় ।
গাছ বলত, “আমার জ্বর এলে তুই আর তোর যখন ঘরের সব কাঁথা আর ভোটকম্বল দুটো এনে গায়ে চাপ্যে দিয়ে ঠেসে ধরিস, তখন যেমন ধারা ভারী আর ভরাট লাগে, ওই দিঘির দামের জটও সেরমই ভারী - ভরাট। এমন একটা বিছ্না হলে তাতে শোয়াও খুব আরামের হবে।” পদ্মবনে নাকি পদ্মগোকরো থাকে! বড়ো একটা পদ্মপাতার উবড়ি বসে সে ফণা মেলে রোদ পোয়ায়। মাগো! ভাবলি গা-শিশ্শির করে! ফিকে গোলাপি বন্ন ফুলগুলোও যত জড়ানো মরানো লতা দামের ফাঁক দেজলের উবড়ি মাথা তুলে ফুটে থাকে। সেও যেন ফণা মেলা গোখরো! আকাশের পানে তাক্যে হাসচে।কখনও মনে হতো কোয়োরের কোনো উকিল বা ডাক্তারবাড়ির ফরসা গোলগাল চেয়ারার বৌ।
তা ফুলের ছোবল নয় তো কী?
হুঁ হুঁ বাবা! সুন্দর জিনিসের আশেপাশে বিপদ ওৎ পেতে থাকবেই। কথায় বলে কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। গাছটা কম কষ্ট করতো না। দিঘির পশ্চিম পাড় বা দখনো পাড় থেকে নেমে যেতো। তারপর সবধানে দেখেশুনে কয়েকটা পদ্মফুল তুলে নে আসত। পদ্মের ডাঁটি তুলতে পারতো না। কেবল ফুল টুকুনি ডাঁটা থে কেটে নিতো। কখনও বা কয়েকটা পাতাও কেটে আনত, বিক্কিরি হলে হতো, নাহলে তারা তিন জনে তাতে ভাত খেতো।
পদ্মপাতায় ভাত খেতে তার কী ভালোই না লাগত! কেমন একটা বাস! বাপ বৈষ্ণবদাদুদের বাড়ি একবার রাসের সময় এরম পদ্মপাতায় ভাত খেয়েছিলো। সেবছর ওরা রাস উজ্জাপন করলে। কী ভালো সব রান্না হয়েছিল। ওরা গাছদুটো খাবার জায়গা সাফ করার জন্যে গিয়েছিল। এঁটো পাতা ফেলা মোছা – এসব তারা মা-বেটি আর ক্ষেত্রপালদের একটা বৌ করছিল। সে শুধু সঙ্গে ছিল, যদি কোনো দরকারে লাগে।
সবার পরে যখন তারা খেতে বসেছিল বুড়ো দাদু নিজে এসে বলছিল, খাও মা, পেট ভরে খাও! – অত লম্বা বোঁটা শুদ্ধ বেগুন ভাজা আগে কোনোদিন ও খায়নি।
একটু বেলা পড়ার দিকে পদ্মপাতায় খাবার সময় ও জোরে জোরে নাক টানত, আর বলত, আঃ! কী সুন্দর গন্ধ গো বাবা! যেন ভোজ খাচ্ছি। অথচ গাছ কীই বা রাঁধতো তার পাতায়? আওতার গাছ, যতটুকু রোদ-জল রুক্ষ মাটি থেকে টেনে নিতে পারে, তা বইতো নয়? সেই তো শাক ডাঁটা, বিড়ির ডাল। বড্ড জোর চুনোমাছের চটচটে করে ঝাল। কোথাও জল ছিঁচে, নাহলে জাল টেনে ধরা। বিক্কিরি করার পর বাকিটা রান্না। বড্ড ভালো রান্না করতো। পদ্মপাতায় খেলে মনে হবেই ভোজবাড়িতে খাচ্ছো। ও আঙুল চেটে চেটে খেতো। পাত আঙুলের ডগায় পরিষ্কার হয়ে যেত। ওর খাওয়া দেখে ওরা দুজনে কী খুশিই না হতো! হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকত ওর দিকে। তারপর তিনজনে একসঙ্গে হেসে উঠত।
বড় সুন্দর ছিলো সেসব দিন।
মা-গাছ কখন যেন দিঘিতে নেমেছিল। সারাদিন পেরোল, সে বাড়ি ফিরল না। রাত গেলো। ছায়া দুটো অস্থির। গেলো কোথায়? বাপ চরণও তার ছায়ায় থাকে। একটু দুর্বল ধরনের। রাগে কখনও বা খিস্তি করছিল। রাগের থেকে দুশ্চিন্তাই ছিলো বেশি। তার যাবার জায়গা আছেটা কোথায়? না বলে কয়ে সে কোথায় গেলো? রাতে ছায়াদুটো ফ্যাকাসে। খাওয়া ঘুম ঠিক করে হলো না। মনকে বুঝ দিতে লাগলো নিশ্চয় সকালে ফিরবে।
পরের দিন জলখাবার বেলায় কেউ দরকারে নেমেছিলো ঘাটে। প্রায় মাঝ দিঘিতে একটা কাপড় ভাসতে দেখা গেলো। একটু পরে চারধারে জড়ো হলো প্রচুর লোক। ছায়াদুটোও এলো। উৎসাহী ও ডাকাবুকো কটা লোক নেমে গেলো দিঘিতে।
চিৎকার ভেসে এলো – একটা লাশ। মেয়েমানুষের।
অজস্র লতা আর দাম তার পা আর শরীর কঠিন করে বেঁধে রেখেছে। সে বাঁধন যতো খুলতে চেয়েছে, ততো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়েছে। কয়েক গোছা পদ্মফুল পড়ে আছে আশেপাশে।
তারপর থেকে মাঝে মাঝেই চারাগাছ বসে থাকতো দিঘির পাড়ে। মনে মনে কথা বলতো গাছের সঙ্গে, রাগারাগি চলত। ঘরে আরাম পেলে না বলে, তুমি কি পদ্মবনের দামের গদিতে ঘুমোতে গিয়েছিলে?
গাছের মতো সে গাঁয়ে-ঘরে হিঞ্চে শামুক শুশনি ডুমুর - এইসব বিক্রি করতে শুরু করল। খদ্দেররা তার কথা জিগ্যেস করলে নির্লিপ্তভাবে বলতো, গাছটা হারিয়ে গেছে। সবাই তাই শুনে আহাউহু করতো আর ঝাঁক ঝাঁক প্রশ্ন। কদিন পর অবশ্য সবাই ভুলে গেলো গাছকে। তবু কখনও কখনও কবর খোঁড়ার মতো কেউ কেউ তুলত তার কথা। কোনো কোনো দিন চারা গাছ চলে যায় সেহারা বাজার, সেহারা গ্রাম, শ্রীকৃষ্ণ, বা শ্রীধরের দিকে বড়ো গাছের মতো। তেমনি সুর করে জিনিস বিক্রি করে। তার বাপ তাকে যেতে দিতে চায় না। সে শুনলে তো!
তার ঢিলেঢালা বাপ বিয়ের ব্যবস্থা করতেই পারেনি। মা-গাছ ছিলো গুছুনি। সে থাকলে কবে তাদের মেয়ে সংসারী হয়ে ছেলেমেয়ের মা হয়ে যেত। তবে ওই কনেদেখা আলোটা পুরোপুরি মাঠে মারা যায়নি। বাউন্ডুলে সংসারী হবার তাড়নায় নিজেই ঘটক হলো।
হংসেশ্বরীর জন্যে বড্ড মায়া কামদেবের। তার সব ব্যাপারে খেয়াল রাখে। কিন্তুন একটাই খেদ, শাকপাত বেচতে যাওয়া থেকে তাকে বিরত করতে পারে না। বারণ করলে বলে, “তুমি একা কত খাটবে? একার রোজগারে কি সংসার চলে?” কামদেবকে সে গোপন করেনি যে, তার বাপকে সে কিছু কিছু সাহায্য করে। তারও তাতে আপত্তি নেই।
কিন্তু তাকে রোজগার বাড়াতে হবে। বৌএর কোনো ত্রুটি সে হতে দেবে না। তার ইচ্ছা শ্বশুরকে তার কাছে এনে রাখে। ঘর নেই বলে সম্ভব হচ্ছে না। ঘর করার টাকা সে আবেদন করলে পাবে। তার আগে জায়গা কিনতে হবে। সরকারী একটা ঘরের সঙ্গে আর একখানা ঘর নিজের টাকায় তুলতে হবে।
একদিন রাতে বৌকে আদর করতে করতে কথাটা তুলল। – বুঝলে, ভাবছি কেরল যাবো।
বৌ স্থির হয়ে যায়। সে কল্পনাও করতে পারে না, ঘরের পুরুষটা কোন্ এক দূরের দেশে চলে যাবে। সে অনেক দূরের দেশ যে, সেকথা সে শুনেছে, নিজের কোনো ধারণাই নেই। বর্ধমান আর কলকাতাই তার কাছে অনেক দূরের দেশ। তবে কলকাতা একদিনেই গিয়ে ফিরে আাসা যায়, কেরল যেতে নাকি তিনদিন লাগে। ট্রেনে চেপে যেতে হয়। কামদেব চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে ফিরতে পারবে না। চলে গেলে সে টিকবে কীকরে? দ্বিতীয় গাছটার ছায়ায় সে নিশ্চিন্ত থাকে। এক গাছ চলে গেছে, নিরাশ্রয় হয়ে সে ঠিক মতো বেড়ে উঠতে পারেনি। সে কোনোদিন নিজে গাছ হয়ে উঠতে পারবে না। এই গাছটা সরে গেলে বুড়ো বাপের দায়িত্ব সামলাবে কীকরে?
এ কথাগুলোই বলল তাকে। তারপর তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দিলো। মনে মনে বলল, তোমাকে ছাড়া আমি টিকতেই পারবো না। তোমাকে না দেখে থাকবো কীকরে? মুখে না বললেও কাম ঠিকই বোঝে। সে না থাকলে পাগলী-বৌটা মহা আতান্তরে পড়বে। তার পাশে থাকার কেউ নেই।
সে জেলের ছেলে। বাপ-ঠাকদ্দার পেশা ছিলো মাছ মারা। কামদেব পেশাটা ধরে রাখতে পারেনি। তবে জলের টান ষোলো আনা। এখানে পুকুর ডোবা কমে গেছে। নদীনালাও এই অঞ্চলে নেই। আগের মতো মাছ কোথায়? কটা পুকুর আর লিজ দেওয়া হয়! সব মিলিয়ে খুবই হতাশার ছবি। তাই জমিতে মুনিশ খাটা, আর জব কার্ডের কাজ। এ করে সংসারের বলার মতো উন্নতি করা যায় না।
চেনাশোনা অনেকেই কেরল গুজরাট বম্বে চলে গেছে নানান ধরনের কাজ নিয়ে। কেউ সোনারুপোর, কেউ রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে, কেউ জরির কাজে। তাদের গাঁয়ের বসন কেরলে কোন কারখানায় কাজ করে। সে বলছিলো, সমুদ্রে নদীতে মাছ ধরতে যাবার কাজও আছে। নীল বন্ন গহীন জলের টান নাকি সাংঘাতিক। সে টানও যতো, মাছও ততো। চুক্তিমতো পয়সা। তার সঙ্গে চেনা -পরিচয় হওয়া নদীয়া মুর্শিদাবাদ বা মালদা জেলা থেকে যাওয়া জোয়ান যে ছেলেগুলো মাছ ধরার পেশায় আছে তারাই সেসব গল্প করেছে। সে গল্প বসনের কাছ থেকে শুনেছে আমাদের কামদেব।
দুপুরে খেয়েদেয়ে দুজনে কথা বলছিল। অল্প পরেই বৌ কেমন নিশ্চিন্দি হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘুমকাতর সরল মুখখানার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তারও কেমন তন্দ্রা এসে গেলো।
বেশিক্ষণ ঘুমোয়নি। বৌ ডাকল। বসন এসচে। একজনের কাছে নিয়ে যেতে, কাছাকাছি কোন্ গ্রামে যেন। কাজের ব্যাপারে কথা আছে।
যাদের কাছে নিয়ে গেল তারা স্বামী-স্ত্রী নাকি দুবাইতে থাকে। সেখানে বিভিন্ন কাজে লোক জোগান দেয়। কাজে প্রচুর পয়সা। স্বামী-স্ত্রী দুজনে গেলে ডবল পয়সা। কামদেবের জায়গা কেনা, ঘর করার কথা শুনে বলল, ও টাকাটা রোজগার কোনো ব্যাপার নয়। এক বছরেই তার থেকে অনেক বেশি টাকা রোজগার হয়ে যাবে।
শুনে হাতে চাঁদ পাবার মতো লাফিয়ে উঠল কামদেব। জিগ্যেস করল, “আমরা স্বামী-স্ত্রী থাকবো কোথায়? ঘর ভাড়া পাওয়া যায় তো? তাছাড়া যাবার তো নিশ্চয় অনেক খরচ।“
শুনে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল আধ বুড়ি মেয়ে মানুষটা। – “তুমি কি ভেবেছ, বৌ-ছেলে নে সংসার করতে যাচ্ছ? সেখানে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকা চলবে নাকো। তবে যাবার খরচ কোম্পানি দেবে। পরে কাজ করে শোধ করে দিলেই হবে।“
শেষের কথাটা শুনে তো প্রায় পায়ে গলে পড়ে আর কি। কিন্তু প্রথম অংশটায় বুকে খোঁচা লেগেছে। তারপর শুনল অন্তত দু-বচ্ছর বাড়ি ফেরা যাবে না। প্রথম কথা, বৌএর সঙ্গে থাকা যাবে না। দ্বিতীয় কথা, তাকে দেখতে পাবে না অতদিন। বুড়ো শ্বশুরটার কী গতি হবে? দূর ছাই! তবে আর সংসার কীসের, আর কাদের জন্যেই বা রোজগারে যাওয়া?
কামদেবের কেমন যেন লাগে। ব্যাপারটা সন্দজনক কিনা ভাবতে যাবার আগেই ও সমুদ্রকেই বেছে নিলো। জলের গোপন টানে সাড়া দেবে সে। ট্রলার ধরে চলে যাবে মাঝনদীতে, নয়তো সমুদ্রের ভেতর দিকে। হয়তো পেত্থম পেত্থম ভয় লাগবে, তারপর নিশ্চিত সড়গড় হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে বৌকে বললো, “কাজ ঠিক করে ফেললাম, বৌ। বাইরে কাজ করতে যাবো।”
– কেথায় কাজ? কলকাতায়? – সে যে তাকে ফেলে আরও দূরে কাজে যেতে পারে, একথা সে ভাবেনি। তাই যখন জানালো যে সে কেরল যাবে বৌএর মুখে বেদনার ছায়া ঘনালো। মুখের ভাব সে আড়াল করতে শেখেনি।
হংসেশ্বরী তর্ক জুড়ে দেয়, বাঁকুড়া থেকে এত লোক বর্ধমানে চাষের কাজ করতে আসে। চাষের কাজে পয়সা আছে বলেই তো? সিজেন শেষে তারা থোক টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরে না ? তবে ফি বছর বাঁকুড়া থেকে ট্রেন বাস ভর্তি করে লোক আসে কেন ? তার সরল যুক্তি।
– “তুই বড্ড অবুঝ! আমার যে আরও ট্যাকা দরকার”। কামদেবের অসহায় লাগে।
কেন আরও ট্যাকা দরকার, সে কত ট্যাকা অত বোঝাতে পারবে না। বোঝানোর দরকারও নেই। তার বৌটা সবই জানে। আসল কথা তো ওকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। কিন্তু হংসেশ্বরীকে না কাঁদিয়ে তার উপায় নাই।
যাবার ব্যবস্থা চলতে লাগলো। বসনের সঙ্গে জগা আর সে যাবে তাদের গাঁ থেকে। যাবার খরচ জোটাতে তাকে বেশি বেশি কাজ করতে হচ্ছে। কিছু টাকা হংসেশ্বরীর খরচ-খরচার জন্য রেখেও যেতে হবে। তবু যে তার অসুবিধা হবে তা জানা কথা। মাঠের কাজ সে জসনে না। জব কার্ডের কাজ সবসময় থাকে না। দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার। বাপ-বেটির অসহায়তা সে টের পাচ্ছে। তবে যেতে তাকে হবেই। ভবিষ্যতে ভালো থাকার জন্য বর্তমানে তাদের ত্যাগস্বীকার না করে উপায় নেই। তাছাড়া ঘুমিয়ে থাকা বাউন্ডুলেটা সমুদ্রের নীল হাতছানি দেখতে পেয়েছে। তাকে উপেক্ষা করতে পারবে না সে।
সে যাবেই এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে সেদিন রাতে হংসেশ্বরীকে সত্যিই কাঁদালো। অনেক মান-অভিমান চলল। চোখের জলে ভেসে যাওয়া মুখ মোছাতে মোছাতে কামদেব তার ঠোঁটের ভেতর বৌএর ঠোঁট নিয়ে চুষতে শুরু করে। তার অথৈ শরীরে ডুব দেয় সে। বৌ একেবারে স্বভাবছাড়া দূরন্ত হয়ে উঠল।
ট্রলার নিয়ে মাছের সন্ধানে গিয়ে কাম যেন গভীর সমুদ্রে হারিয়ে গেছে। নিটোল যৌবনা হংসেশ্বরী কঠিন বাঁধনে বেঁধে তাকে নিয়ে চলেছে সেই অতলে যেখানে পুরুষ মাছের সমস্ত ঔরস মেয়ে মাছটি গর্ভে ধারণ করবে। কিংবা শীতল জলের নীচে জলজ লতার বিছানায় শুয়ে শুয়ে তারা আজীবনের কথা বলবে জেগে থেকে। অনেকদিন আগে একটা গাছের মতো জীবনের গল্প অসম্পূর্ণ রেখে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়বে না।
জড়ানো গলায় কামদেব বলে, তবে তাই হোক। তোর পেটে ডিমটা রেখে যাচ্ছি।
হংসেশ্বরী বলে, “ডিমের মায়া কাটিয়ে যেতে পারো কিনা দ্যাখো!” তবে কথাগুলো সে মনে মনে বলে, মুখে উচ্চারণ না করে নিজেকে আরও উন্মুখ করে তোলে সে।