আমাদের কৈশোরকালে গ্রাম্য সোঁদা গন্ধের মানুষের কাছে রমজানের চাঁদ দেখা গেলেই রেডিওতে ঘোষণা হত কলকাতার নাখোদা মসজিদ থেকে রোজা শুরুর আহ্বান। ভোরের সেহরি খাওয়ার জন্য ভোররাতের আগেই রান্নার ব্যস্ততার মধ্যে আজানের আগেই খাওয়া শেষে ওজুর পরেই ফজরের নামাজ, তখনকার মানুষের এত গ্যাস-অম্বল, সুগার, প্রেসার, কোলেস্টেরল, থাইরয়েডের ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হত না; কায়িক পরিশ্রমে অভ্যস্ত গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের লাইফ স্টাইলে রোগ প্রায় ছিলই না। সারাদিন নির্জলা উপবাসের পর সামান্য খেজুর, আদা-শশা, সরবত দিয়েই ইফতার হত, এখনকার মতো রংবাহারি রসালো ফলের দেখা মিলত না বা হা-ভাতে হা-ঘরের দরিদ্র মোমিন মানুষরা মুখে পানি দিয়ে রোজা খুলে মাগরিবের নামাজ পড়েই অল্প ভাত খেয়ে নিয়ে আল্লাহর কাছে শোকর গুজার করত।
এখনকার মতো সরু চালের ধবধবে সাদা ভাত, মাছ-মাংসের সম্ভার ছিল না; মেটে চালের লাল ছিটের ফাটা ভাতের ঘ্রাণেই মানুষ সন্তুষ্টি আদায় করত সৃষ্টিকর্তার দরবারে। অনেক সময় দহলিজে খাঁ সাহেবেদের রোজার ব্যবস্থা থাকত অবস্থাপন্নের যৎসামান্য ইফতার দেওয়ার মাধ্যমে। এইভাবেই চলত মাসভর। শেষ রোজায় গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরলে পাড়াতে একসাথে ইফতারের মজলিসে তাদের আনা শহুরে নানা ফলের ডালি খানচায় নিয়ে দোওয়ার মজলিসে সমবেত হত, সব বাড়ির ছোট ছেলেদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মজাই ছিল আলাদা। সেদিনে হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশুনা করার অলিখিত ছুটি মঞ্জুর হতো দু-তিন দিন।
বর্তমান প্রজন্মের চাঁদ রাতের আলোকসজ্জার চেয়ে আমাদের নিজেদের সাজসজ্জা ছিল খুবই মলিন। তাছাড়া প্রাক্-স্বাধীনতার (১৯৪৬)-এর গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং, স্বাধীনতার সময় ১৯৪৭-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত শহুরে ও গ্রামীণ সংখ্যালঘু এলিট শ্রেণির মুসলমান মানুষ কেউ ভয়ে, আতঙ্কে বা ভালো চাকরি, ভালো সুযোগ-সুবিধার জন্য বাপ-দাদার চোদ্দ পুরুষের ভিটে-মাটি, আবাদ জমি ছেড়ে বিদেশের মাটিতে পাড়ি দিয়েছিল বা দিতে বাধ্য হয়েছিল। তার ফলে চাষি-মুটে -মজুর শ্রেণির মুসলমান এই দেশে পড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিল বা বাপ-দাদার ভিটেকে, দেশকে ভালবেসে থেকে গিয়েছিল রাষ্ট্রনেতাদের সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ কথায় বিশ্বাস করে। আর আজ সেই সব নিম্ন মেধা, নিম্ন আয়ের মুসলমান মানুষদের প্রতি পদক্ষেপে দেশপ্রেমিক প্রমাণের ব্যর্থ প্রয়াসের প্রচেষ্টা চালাতে হচ্ছে দেশদ্রোহী বা পাকিস্তানের চর দেগে দেওয়ার ভয়ে; কিম্বা ‘আরবান নকশাল’ হিসাবে।
আমাদের আটের দশকে; যাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা একটু স্বচ্ছল ছিল; তাদের ছেলেদের লুঙ্গি, পাঞ্জাবি বা সুতির প্যান্ট-শার্ট, টুপি আর মেয়েদের শাড়ি, ছোটদের ফ্রক-জামা হত ইদ উৎসবে। এখনকার মতো সিনেমার নামে সালোয়ার-লেহাঙ্গার চল ছিল না। সবচেয়ে করুণ ছিল যাদের খুশির ইদে নতুন জামা-কাপড় হত না, তাদের অব্যক্ত যন্ত্রণার মোচড় আজ অন্তত কিছুটা অনুভব করতে পারি। তবে ব্যক্তিগতভাবে হীনমন্যতায়, হতাশায়, আতঙ্কগ্রস্ত ও ডিপ্রেশনে ডুবে যেতাম যখন ইদের আগের দিন বা পরের দিনে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা থাকত। তখন নিজেকে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ধিক্কার দিতাম – সংখ্যালঘু ইতর শ্রেণির প্রাণী হিসেবে।
তবে সামান্য কিছু পেয়েই আমরা চাঁদরাতের চাঁদকে হাতের মুঠোয় পেয়ে জ্যোৎস্নাকে সামলে রাখতে বলতাম মনে মনে...। এখন মুসলিম মহল্লায় চাঁদ রাতে আলোর রসনায়, কখনও কখনও শরিয়তি বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করেই হয় আলোকসজ্জা। আবার ভাল দিকও দেখা যায় দান খয়রাত, বস্ত্র বিতরণের মাধ্যমে বা রক্তদানের মতো মহৎ কাজে সেবাব্রতী হতে। এতদিন যাই হোক করে কেটে যাচ্ছিল ইদের আনন্দ; গত দু’বছর ধরে জুনোটিক ভাইরাস স্পাইক প্রোটিন বদলে কোভিড -১৯ অসুর রূপে পৃথিবীর বুকে মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে চতুর্থ ফেজের প্রস্তুতি নিয়ে। আর আমাদের রাষ্ট্রিক নেতারা ঘণ্টা কাঁসর, মোমবাতি, প্রদীপ, জ্বালিয়ে জিহাদ ঘোষনা করেছে ব্যর্থ প্রতিরোধের প্রয়াসে। ফলে মুসলিম জনগণ সমবেত ইদের জামাত পালনে পিছিয়ে থেকেছে কোভিডের গতিকে প্রতিহত করতে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ-সহ সব রকম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে অনিবার্যভাবে। অপরদিকে ভ্রষ্টাচারী শাসক আগুনখেকো ভাষায় রক্তপাতহীন সন্ত্রাসের আবহে তবলিগ জামাতকে দোষারোপ করছে ‘মন্থনে’ জারিত হয়ে ‘হার্ড হিন্দুত্ব’-র দর্শনে।
ইদের দিন খুব সকালে বাড়ির বড়রা ব্যস্ত থাকত ফিতরা, জাকাত বিতরণের দিনি প্রথায়। ইদের দিনে সকাল-সকাল গোসল করে কানে আতর ভেজানো তুলো দিয়ে ইদগাহে সমবেত হতাম দু’রাকাত ওয়াজেবের নামাজ আদায়ে, শেষে ইদ মোবারকের শুভেচ্ছা জানিয়ে চোখে চোখ, হাতে হাত, বুকে বুকে কোলাকুলি করে আনন্দের ফল্গুধারায় নিজেরা স্পন্দিত হতাম – সেই কোলাকুলির আনন্দ অনুভূতি হত বেহেস্তের সুবাস মিশ্রিত। ইদের নামাজের পরেই লাচ্চা-সিমাইয়ের ম ম ঘ্রাণে যুক্ত হত স্কুলের বন্ধুদের সাথে সম্প্রীতির ধারা। বড়দের স্নেহ মিশ্রিত নিষেধ সত্ত্বেও আমরা ছোটরা রোজার ক্লেশ মাথায় পেতে নিতাম স্বেচ্ছায়, তখনই অনুভব করেছি একবেলা না খেতে পাওয়ার কষ্ট – দরিদ্রের হাভাতের কষ্টের। গলা শুকনো কাঠ হয়ে গেলেও রোজা রাখার আনন্দে মশগুল হয়ে থাকতাম আল্লাহর সন্তুষ্টিতে।
এখন বুঝেছি কেবল না খেয়ে থাকাটাই রোজা নয়, ইমানদারির সাথে সকল ইন্দ্রিয়ের কৃচ্ছ সাধনের মাধ্যমেই রোজার সার্বিক কল্যাণকর দিকটা সার্থক হয়। এবং বুঝেছি ইসলামিক জীবন ব্যবস্থায় মুসলিম কওমের শরিয়তি শিক্ষার সাথে সাথে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দুনিয়াবি জ্ঞান সম্পৃক্ত হলে তবেই পূর্ণাঙ্গ মনুষ্যত্বের অধিকারি হতে পারবে পিছিয়ে পড়া ইমানহারা মুসলমান। শান্তির ধর্মীয় ঘরঘরনায় হিসেবি জাকাত প্রদান মুসলিম সমাজকে বেশ কিছুটা সমৃদ্ধ করে দাতা ও গ্রহীতার আবেশকে, যেটা এই ইদুল ফিতরেই একমাত্র সম্ভব। শিক্ষা ছাড়া ধার্মিক-ইমানাদার মানুষ হওয়া যায় না আর ইমানদার না হলে মানব জীবনের কোনো সার্থকতা নেই, পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা মনুষ্যত্ব বিকাশের সহায়ক হবে একমাত্র জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই।
বর্তমান মানুষের আর্থ-সামাজিক কাঠামোয়, শিক্ষা-দীক্ষায় কিছুটা পরিবর্তন হলেও নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে কংক্রিটের জঙ্গলে মানুষে মানুষে আত্মিক মেলবন্ধনের গাঁথুনিতে ফাঁক থেকে গিয়ে শুভবুদ্ধির অবক্ষয় হচ্ছে, যেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। পারস্পরিক সৌহার্দ্যের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহাওয়া বিরাজ করুক গোটা দেশে, তবেই খুশির ইদের মাহাত্ম্য বোঝা যাবে ।