ধর্মকে একটা বৈজ্ঞানিক জীবন যাপনের উপায় হিসেবে দেখেছেন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক বলে পরিচিত হজরত মহম্মদ। এক ঈশ্বর ছাড়া বিশ্বাস ছাড়া বাকি বহু কাজে ও কর্মপন্থায় বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও জীবনচর্যার প্রতিফলন মেলে। স্বেচ্ছায় নিজ আয়ের ২.৫% জাকাত দান, মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার ( খোলা), দাসমুক্তি, প্রতিহিংসা চরিতার্থ না করা, মেয়েদের ধর্মাচরণ বা নামাজের কাতারে সামিল হওয়ার অধিকার, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে খলিফা নির্বাচন, বংশ বা আত্মীয়তার ভিত্তিতে উত্তরাধিকারী ঠিক করে না যাওয়া, উত্তরাধিকারী আলোচনায় নারীর অংশগ্রহণ, স্বাধীনা নারীকে বিবাহ উত্তম ঘোষণা করা, একজন মুক্ত ক্রীতদাস, হজরত বিলালকে দিয়ে প্রথম আজান দেওয়ানো--তাঁর অন্যতম।
কোনো মানুষের অলৌকিক ক্ষমতা আছে হজরত মহম্মদ বিশ্বাস করেন নি। নিজের একমাত্র পুত্র ইব্রাহিমের মৃত্যুকেও বৈজ্ঞানিক ভাবেই দেখেছেন। দিনে অন্ধকার নেমে আসায় পাশে থাকা মানুষরা আল্লাহ শোক জানিয়েছেন বলায় আপত্তি জানিয়েছেন।
বলেছেন, মৃত্যু হয়েছে প্রাকৃতিক নিয়মে। কিন্তু এখন তো পিরের ছড়াছড়ি। ফুঁ, জলপড়া, পানিপড়া, তাবিজ কবজ মাদুলির রাজত্ব।
হজরত মহম্মদ সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী ছিলেন। অগ্নিপূজক পারসিকদের সমান সম্মানের সঙ্গে উপাসনার অধিকার দিয়েছেন। আর এখন কিছু মৌলবাদী অন্য ধর্মের উপাসনায় বাধা সৃষ্টি করে বাংলাদেশে।
তিনি মনে করতেন, তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি। কিন্তু যিশু মুসাদের বলা হতো ঈশ্বরের পুত্র। আদম থেকে যিশু পর্যন্ত সব 'মহাপুরুষ'-কে তিনি নবি বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে স্বীকার করেছেন। এবং বলেছেন, তিনিই ঈশ্বরের শেষ প্রতিনিধি।
ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের যা কিছু ভালো তা নিয়েছেন। গ্রহণ করেছেন আরব বেদুইনদের কাব্যিক ভাষা। কোরান পৃথিবীর প্রথম লিখিত গদ্যগ্রন্থ। এবং তা অসম্ভব কাব্যিক ও তত্ত্বচেতনাময়। তবে অন্ধরা সব কোরানে আছে বলে বিপত্তি বাড়ান। যেমন একদল বলেন, সব বেদে আছে।
ইহুদিরা পালন করেন সিয়াম। ইহুদিদের এই প্রথা নিয়েছেন হজরত মহম্মদ। সিয়াম মানে সংযম। উপবাস তার একটা প্রকাশ । আসল কথা আত্মসংযম। সর্ব অর্থে। মিথ্যা কথা না বলা, অন্যের অনিষ্ট চিন্তা না করা, খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো, পরচর্চা পরনিন্দা কোনো সময়েই না করা, উপবাস অবস্থায় যৌন সম্পর্কে বিরত থাকা, অসূয়া বিদ্বেষ পোষণ না করা, সুদ না খাওয়া, নেশা না করা ইত্যাদি।
নবিজি বলেছেন, এর একটাও যদি মানতে না পারো তবে রোজা রেখো না।
অর্থাৎ শুধু উপবাস করাই রোজা নয়।
সম্পূর্ণ আত্মসংযমের নাম রোজা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মোঃ আতাউর রহমান মিয়াজি বিবিসি বাংলাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, হিজরি দ্বিতীয় সনে ইদের প্রবর্তন করা হয়েছিল।
'হিজরি প্রথম বছরের অষ্টম মাস অর্থাৎ শাবান মাসে রোজা বাধ্যতামূলক করার আয়াত নাজিল হয়, এবং তখন নবম মাস অর্থাৎ রমজান মাসে একমাস সিয়াম সাধনাকে ফরজ করা হয়। জানাচ্ছেন অধ্যাপক মিয়াজি।
এরপর হিজরি দ্বিতীয় সালে এসে বিধান দেওয়া হয় রমজান মাস -- চাঁদের হিসাবে যা কখনো ২৯ দিনেও শেষ হতে পারে বা কখনো ৩০ দিনেও -- শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ইদ উদযাপন করা হবে।
'ইদের সামাজিকতা ওই সময় থেকে শুরু হয়' বলে জানান ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক।
এ-বিষয়ে আনাস নামে হজরত মহম্মদের একজন সাহাবা বা সাথীর বর্ণনা করা একটি হাদিসের উদ্ধৃতি অনুসারে বলা হয়, মদিনায় যাওয়ার পর নবিজি দেখলেন, সেখানকার মানুষ বছরে দুটি বড় উৎসব পালন করে।
নওরোজ এবং মিহিরজান নামে দুটি উৎসব । সেখানকার বাসিন্দাদের ধর্ম এবং গোত্রের রীতি অনুযায়ী একটি বসন্তকালে অন্যটি শরৎকালে উদযাপিত হত।
ওই দুটি উৎসবের আদলে মুসলমানদের জন্য বছরে দুইটি ধর্মীয়, সামাজিক এবং জাতীয় উৎসব পালনের রীতি প্রবর্তন করা হয়েছে।
একটি ২৯ বা ৩০ দিন উপবাসের শেষে ইদ উল ফিতর। আরেকটি ইদ উল আজহা। দ্বিতীয়টি কুরবানি ইদ নামে বেশি প্রচলিত।
ইদের দিন শুধু নামাজ পড়লেই হবে না নিজের রোজগারের ২.৫% দান করতে হবে। যার নাম জাকাত। এটি স্বেচ্ছায় করতে হবে। এবং সেই দান এমন হবে যেন, ডান হাতের ডান বাম হাত জানতে না পারে।
হারাম এবং হালাল কথাটি এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। হারাম মানে অবৈধভাবে রোজগারে ইদ পালন দান ধ্যানে কোনো পুণ্য বা নেকি নাই। যতই উপবাস করো।
বৈধভাবে সৎপথে উপার্জিত অর্থই কেবল আল্লাহর পছন্দ। অকারণ বৈভব দেখানো জাঁকজমক করা, তোরণ করা, আলোকসজ্জা ইসলামের আদর্শবিরোধী।
আসল কথা দান ধ্যান আত্মসংযম ও আত্মউন্মোচন।
কিন্তু অনেকেই রোজা রাখেন, সিয়াম বা সংযম পালন করেন কতজন?
উপবাস বা রোজা চালুর পিছনে শরীররক্ষার প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও আছে উপবাসী বা ক্ষুধার্তের যন্ত্রণা অনুভব করানোর ইচ্ছা।
উপনিষদের গল্পে আছে--অন্নই ব্রহ্ম।
ব্রহ্ম কী? গুরুর জিজ্ঞাসার উত্তরে শিষ্য বলেন, জ্ঞানই ব্রহ্ম। তখন তাঁকে খাদ্য দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক সপ্তাহ পরে গুরু আবার জিজ্ঞেস করলেন, ব্রহ্ম কী? শিষ্য কষ্ট পেলেও বললেন, জ্ঞানই ব্রহ্ম। তখন দুধ দেওয়া বন্ধ করা হল। তার এক সপ্তাহ পরে আবার গেলেন গুরু। ব্রহ্ম কী? চিঁচিঁ করে শিষ্যের উত্তর, জ্ঞানই ব্রহ্ম। এবার আদেশ হল জল বন্ধের । এবার একদিন পর গেলেন গুরু। ব্রহ্ম কী?
শিষ্য ক্ষীণস্বরে কাতর কন্ঠে জবাব দিলেন, আপনিই ঠিক। অন্নই ব্রহ্ম।
তর্ক হয়েছিল জ্ঞান না অন্ন --ব্রহ্ম আসলে কী?
অন্ন বা খাদ্য অভাবে মানুষ কত কী করে? আত্মসমর্পণ করে, আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেয়, দাস বনে যায়।
সে-কারণে ক্ষুধার যন্ত্রণা বোঝাতে রমজান মাসে সিয়াম বা আত্মসংযম বা রোজার নির্দেশ।
এখানে রোজা রাখার পর মালিক ও শ্রমিক বা কর্মচারী সবাই সমান। একসঙ্গে খেতে বসতে হয়। সমান খাবার। খাবার বা খাবার আসন বা পাত্র আলাদা হলে রোজা রাখা সফল হলো না।
একসঙ্গে খাওয়া মিলে মিশে থাকার শিক্ষা রমজানের।
ইদের পর কোলাকুলি আলিঙ্গন সমতার ভিত্তিতে গঠিত। যা পরে বিজয়ায় এসেছে। পায়ে হাত দিয়ে সালাম ইসলামে নিষিদ্ধ।
কারণ কেউ বড় নয় কেউ ছোট নয়, সবাই সমান। যদিও ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে সালাম চালু হয়েছে।
পায়ে হাত দিয়ে সালাম।
কোরান অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী আদম এবং হাওয়া। বলা হয়, 'আল্লাহ বলেন, কুলনাহ বিতু মিনহা জামিআ'। তোমরা সবাই আমার জান্নাত থেকে নেমে যাও। আমার পক্ষ থেকে কোনো হেদায়াত পেলে যদি তা তোমরা অনুসরণ করো, তাহলে তোমাদের কোনো ভয় কিংবা চিন্তা করতে হবে না'। ইসলামে বিশ্বাসীদের মতে পৃথিবীর প্রথম নবি হজরত
আদম। আদমে শুরু নবুয়তি ধারা। শেষ নবি হজরত মহম্মদ।
মোট পঁচিশ জন নবির নাম কোরানে উল্লেখ রয়েছে।
১. হজরত আদমকে বলা হয়, ইসলামি মতে, পৃথিবীর প্রথম মানুষ এবং প্রথম নবি। কোরানের মোট ২৫ জায়গায় তাঁর নাম। মুসলমানদের বিশ্বাস, পিতা আদম এবং হাওয়া বেহেস্তে ছিলেন। পরে আল্লাহর আদেশে দুনিয়ায় বসবাস শুরু করেন। একই কথা আছে, বাইবেলে। সেখানে আদম এবং ইভ। গল্পটা মোটামুটি এক।
২. হজরত ইদ্রিসের নাম কোরানের দুটি আয়াতে আছে। বলা হয়, হজরত ইদ্রিসই প্রথম কলম আবিষ্কার করেন এবং লিখিত জ্ঞানের সূচনা হয় পৃথিবীতে। এ ছাড়াও মুসলিমদের মতে, পোশাক সেলাইয়ের পদ্ধতিও তিনি আবিষ্কার করেন।
৩. হজরত নুহ-র নাম কোরানে ৪৩ বার উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি সাড়ে নয়শত বছর ধরে চেষ্টা করে মাত্র আশি জন নারী পুরুষকে ঈশ্বরের পথে আনতে পারেন। পৃথিবীতে 'আজাব' হিসেবে মহাপ্লাবনের ঘটনা ঘটে। খ্রিস্টান ধর্মে নুহ-র নাম নোয়া বা নোহা।
৪. হজরত হুদ-এর নাম মোট সাতটি আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে কোরানে। ইসলামি মতে, তিনি আদ জাতির কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন। আদ জাতি খুবই উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ জাতি ছিলো। আল্লাহ নাকি তাঁদের বাড়াবাড়ির জন্য ধ্বংস করে দেন।
৫. হজরত সালেহ-র নাম কোরানের মোট নটি জায়গায় এসেছে। তিনি সামুদ জাতির কাছে প্রেরিত। সামুদ জাতিও উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী ছিল। ইসলামি শাস্ত্রে বলা হয়েছে, আল্লাহকে অমান্য করার কারণে তাঁরাও নাকি ধ্বংস হয়ে যায়।
৬. হজরত ইব্রাহিমের নাম পবিত্র কোরআনে ৬৯ বার উল্লেখ হয়েছে। ইরাকে তাঁর জন্ম এবং ফিলিস্তিনে বা প্যালেস্টাইনে বসতি স্থাপন করেন। তাঁকে 'মুসলিম মিল্লাতের পিতা' বলে কোরানে উল্লেখ করা হয়। ইসলামি মতে, তিনি কাবা ঘরের নির্মাতা।
৭. হজরত লুতের কথা ২৭ বার উল্লেখ করা হয়েছে কোরানে। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা সমকামিতায় বিশ্বাসী ছিল। মুসলিমরা মনে করেন, সেজন্য আল্লাহ তাঁদের কঠোর শাস্তি দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেন। সমকামিতা যে সমাজে নতুন কিছু নয়, ছিল, (থাকবেও) -- এর নিদর্শন মেলে এই ঘটনার উল্লেখে।
৮. হজরত ইসমাইল হজরত ইব্রাহিম এর ছেলে। কোরানে মোট ১২টি আয়াতে উল্লিখিত তিনি। পরম ধৈর্যের প্রতীক ইসমাইলের নাম কোরবানি ও হজের সঙ্গে জড়িত। এই ইব্রাহিমকে অনেকে আব্রাহাম বলেন। বকরিদে প্রিয়তম জিনিস উপহার দেওয়ার কথায় ইব্রাহিম ইসমাইলকে কুরবানি দিতে যান।
খ্রিস্টানদের ভাষায় ইব্রাহিম আব্রাহাম।
৯. হজরত ইসহাকের নাম কোরানে ১৭ বার আলোচিত। তিনি ও ইসমাইল সম্পর্কে ভাই ছিলেন। হজরত ইসহাক অন্যতম মর্যাদাবান নবি।
১০. হজরত ইয়াকুবের নাম মোট ১৬টি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর অপর নাম নাম ইসরাইল। তিনি হজরত ইউসুফের পিতা।
১১. হজরত ইউসুফের নাম ২৭টি আয়াতে উল্লেখিত। তাঁর বাবার নাম ইয়াকুব তাঁর দাদার নাম ইসহাক ও প্রপিতামহ ইব্রাহিমও নবি হিসেবে পরিচিত।
১২. হজরত শোয়াইবের নাম ১১টি আয়াতে আছে। মুসলমানদের ধারণা, ওজনে কম দেওয়ার অপরাধে আল্লাহর অভিশাপে শোয়াইব যে সম্প্রদায়ে আবির্ভূত হন সেই সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে যায়।
১৩. হজরত আইয়ুবের নাম কোরানের চার জায়গায় বিদ্যমান। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন।
১৪. হজরত জুলকিফলের নাম খুব আলোচনার দাবি রাখে। কোরানে দুই জায়গায় তাঁর নাম।
মুসলিমদের একা্ংশ মনে করেন, ইনি আসলে বুদ্ধদেব। মানে গৌতম বুদ্ধ। আরবি তে প নেই। ফ দিয়ে প-র কাজ চলে। জুল মানে জন্ম। কিফল আসলে কপিল বা কপিলাবস্তু। কপিলাবস্তুর জাতক বুদ্ধ হয়ে গেছেন জুলকিফল।
১৫. হজরত মুসার নাম পবিত্র কোরানে সবচেয়ে বেশি বার উল্লেখিত। মোট ১৩৭ বার এসেছে। ইহুদি ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত। তাঁকে ইহুদিরা বলেন মোজেস।
১৬. হজরত হারুন (আ.)র নাম আছে ২০টি আয়াতে । তিনি হজরত মুসা-র ভাই । অসাধারণ কথা শিল্পী।
১৭. হজরত দাউদ আছেন কোরানের ১৬টি আয়াতে। তাঁকে 'জাবুর কিতাব' প্রদান করা হয় বলে ইসলামি বিশ্বাস। তিনি একদিন রোজা রাখতেন, আরেকদিন রাখতেন না। তিনি সুরেলা কন্ঠের অধিকারী ছিলেন । খ্রিস্টানরা ডেভিড বলেন তাঁকে।
১৮. হজরত সোলায়মান ১৭ বার উল্লেখিত কোরানে। তিনি হজরত দাউদ (আ.) এর ছেলে।
১৯. হজরত ইলিয়াসের নাম কোরানে আছে তিনবার।
২০. হজরত ইয়াসার নাম কোরানে দু-বার।
২১. হজরত ইউনুসের নাম মোট দুটি আয়াতে আছে। তাঁকে মাছে গিলে ফেলেছিল। একটি দোয়া করে মুক্তি পান। এটি 'দোয়া বা দুয়া ইউনুস' নামে পরিচিত।
২২. হজরত জাকারিয়া ছিলেন পেশায় কাঠুরে। কোরানে সাতবার আছে তাঁর নাম।
২৩. হজরত ইয়াহিয়ার নাম পাঁচটি আয়াতে। হজরত জাকারিয়ার পুত্র।
২৪. হজরত ইশা বা ইসা (আ.)রং নাম মোট ২৫ বার উল্লেখ হয়েছে কোরানে। ইসলামি মতে, তিনি বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের সর্বশেষ নবী। তাঁর অপর নাম মসিহ।
খ্রিস্টানদের কাছে তিনিই যীশু।
এরপর এলেন হজরত মহম্মদ (সা:)।
২৫. হজরত মহম্মদের নাম সরাসরি মাত্র চার বার আছে কোরানে। তবে নবি সম্বোধিত হয়েছেন ৪৫০টি আয়াতে।
হজরত মহম্মদ সিয়াম অনুসরণ করে রোজা বা রমজান চালু করেন। ২৯ বা ৩০ দিনে মাস।
৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে চলে যান হজরত মহম্মদ (সা:)। মক্কা তাঁকে ছাড়তে হয় প্রাণ বাঁচাতে এবং তাঁর সঙ্গীদের জীবনরক্ষার প্রয়োজনে। সেখানে দেখেন স্থানীয় অধিবাসীরা দুটি উৎসব উদযাপন করেন খুব বড় আকারে। নওরোজ ও মিহি জামিন।
নওরোজ বসন্তে। মিহি জামিন শরতে।
এর অনুসরণে এল ইদ ও বকরিদ। ইদ উল ফিতর এবং ইদ উল আজহা।
বাংলায় বলে অনেক সময় বড় ইদ ও বকরিদ।
২৯/৩০ দিন রোজা রাখার পর ইদ তথা বড় ইদ। আর পরে বকরিদ। বকরিদে পশু কুরবানি দেওয়া হয়। ইদে নয়। ইদে সাধারণত বাংলায় লাচ্ছা নানা রকমের সিমুই মিষ্টি খাওয়া হয়। গ্রাম বাংলায় দুপুর বেলায় সাদা ভাত বড়জোর পোলাওয়ের সঙ্গে নানারকম মাংস। বিরিয়ানি ছিল না। এখনো খুব কম। এ-নিয়ে কাদামাটির হাফলাইফ-এ বিস্তৃত লিখছি। আগ্রহীরা পড়তে পারেন।
সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা:.একবার জনকের সভায় যাজ্ঞবল্ক্য এসে দাঁড়াতে জনক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী মনে করে ঠাকুর– ব্রহ্মবিদ্যা না গোধন, কোনটা লাভ করবার জন্যে আসা?’ যাজ্ঞবল্ক্য নিঃসংকোচে অন্নানবিদনে বললেন, ‘দুটোর জন্যেই, রাজা।’ অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যাতে অন্নাভাব মেটে না। ব্রহ্মজ্ঞান থেকে অন্নলাভ হয় এ কথা আক্ষরিক অর্থে সত্য নয়, তবে ব্রহ্মজ্ঞানী পণ্ডিতরা রাজদ্বারে যে সম্মান পেতেন, রাজপ্রসাদে সেটা সহজেই সম্পত্তিতে ও অন্নে রূপান্তরিত হত। অন্ন থেকে প্ৰাণ লাভ বা রক্ষা হয়। এ তো সহজেই বোঝা যায়। প্রাণ রক্ষা পেলে তবেই মন কাজ করে এবং তখন মানুষ যে কর্ম করে সেটা ব্রহ্মসন্ধান, ব্রহ্মোদ্যে অংশগ্রহণ, ব্রহ্ম সম্বন্ধে আলোচনা– যাতে সিদ্ধি লাভ করলে অমৃত অর্থাৎ অমরত্ব লাভ হয়, অর্থাৎ পুনর্জন্ম– উপনিষদে যাকে প্রথমে পুনৰ্ম্মত্যু বলা হয়েছে, তা থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। মৃত্যু থেকে পরিত্রাণই অমৃত। এই তত্ত্বের দিকে পরিপূর্ণ সংহতি আছে, কিন্তু এই কার্যকারণ পরম্পরার মধ্যে প্রথমটিই একটু বিস্ময়কর: ব্রহ্মা থেকে অন্নলাভ। এর দুটি তাৎপর্য: ব্রহ্মজ্ঞান ঐহিক প্রয়োজন মেটাতে সমর্থ, অন্নসংস্থান করে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, এ যুগের যা সবচেয়ে কাম্য প্রাপ্তি– মোক্ষ, তার পথও ব্রহ্মজ্ঞানেই নিহিত আছে। তথাপি, তার পরেও নেহাতই স্থূল ঐহিক প্রয়োজন অন্নসংস্থান, সেটিও উপেক্ষিত নয়, বরং ব্রহ্মা থেকে সর্বপ্রথম প্ৰাপ্তিই অন্ন। বাকিটা বারবার উচ্চারিত হয়েছে, অন্ন জীবন বা প্ৰাণ রক্ষা করে। শরীরেই মনের আধার, সেই মন সজীব থাকে, দেহ তার প্রয়োজনীয় অন্ন পেলে। সক্রিয় মনই সত্যসন্ধান করে এবং এই সন্ধানের শেষ প্রাস্তেই আছে অমৃত।
অন্নলাভ, এই উপনিষদের যুগেও সহজ ছিল না। ঐতরেয় উপনিষদে পড়ি প্রজাপতির বিষয়ে বলছে, তিনি দেখলেন এই সব লোকগুলি ও লোকপালদের। ‘এদের জন্যে অন্ন সৃষ্টি করি’। তিনি জলরাশিকে তপস্যায় অভিতপ্ত করলেন। সেই জলরাশি তপ্ত হলে তাদের থেকে মুর্তি জাত হল, অন্নই হল সেই মূর্তি– স ঈক্ষতেমে নু লোকাশচ লোকপালাশ্চ। অন্নমেভ্যঃ সূজা ইতি। সোহপোহভ্যতপহ। তাভ্যোহভিত্তপ্তাভো মূর্তিরজািয়ত। যা বৈ সা মূর্তিরজায়তান্নং বৈ তৎ’ (ঐ/উ ১:৩:১)। অন্যত্র অন্নকে সৃষ্টির পর স্রষ্টার খেয়াল হল, ‘এরা খাবে কী?’ তখন তিনি জলকে তপ্ত করলেন, সেই তপ্ত জলের অভ্যন্তরে মূর্তির জন্ম হল; সে মূর্তি অন্ন। বিজ্ঞানও বলে জলে তাপ সংযোগ হলে তার মধ্যে উদ্ভিদের জন্ম হয়। সেই উদ্ভিদই প্রাণীর প্রথম খাদ্য। এর মধ্যে লক্ষণীয় শব্দটি হল ‘তাপ’। ‘তপস্যা’। এই শব্দেরই সজন্ম; প্রজাপতি কোথাও তপস্যা করে খাদ্য সৃষ্টি করছেন, কোথাও-বা জলকে তপ্ত করে তার থেকে প্রথম শৈবাল বা উদ্ভিদ সৃষ্টি করছেন যা প্ৰাণী আহার করতে পারে। অন্নের সংস্থান করা সৃষ্টিকতাঁর দায়, তা না হলে তো তাঁর সৃষ্টি অকালে বিনষ্ট হবে, খাদ্যাভাবে মৃত্যু ঘটবে তাঁর সৃষ্ট প্রাণীর। তাই জীবসৃষ্টির অনতিকাল পরেই তিনি জীবনের অবলম্বন, জীবাতু বা জীবনদায়ী অন্ন সৃষ্টি করেন যাতে তাঁর জীবসৃষ্টি ব্যর্থনা হয়।
এত মহিমা যে-অন্নেরা তার সম্বন্ধে উপনিষদ বলে:
অন্নের নিন্দ কোরো না। তা (জীবনধারণের উপায়) ব্রত। প্ৰাণই অন্ন, শরীর অন্নভোজী… অন্নকে কখনও প্রত্যাখ্যান কোরো না, তা ব্রত। (অর্থাৎ জীবনধারণের উপায়)। অন্নকে বহুল করে তুলো। পৃথিবী অন্ন, আকাহ অন্নভোজী-অন্নং ন নিন্দ্যাৎ। তদব্রতম। প্ৰাণো বা অন্নম। শরীরমান্নাদম। …অন্নং ন প্রত্যাচঙ্গীত। তদ ব্রতম। অন্নং বহু কুবীত। পৃথিবী বা অন্নম। আকাশোহান্নাদঃ। (তৈ/উ ৩:৭-৩:৯)
এখানে অন্নের প্রতি যথাবিধি সমাদর প্রদর্শন করার কথা আছে। অন্নের নিন্দা করার কথাই ওঠে না। বিশেষত, যখন সমাজে ব্যাপক অন্নাভাব, তখন মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই জানে প্রাণই অন্ন, কারণ অন্ন বিনা প্ৰাণ ধারণ করা অসম্ভব, অনাহারের অর্থই মৃত্যু। এই সমাজে যেখানে ক্ষুধার অনুপাতে খাদ্য উৎপন্ন হচ্ছে না, সর্বদাই ক্ষুধা ও অন্নের পরিমাণের মধ্যে বেশ বড়, দুরতিক্রম্য একটি ব্যবধান রয়ে যাচ্ছে, সেখানে বেঁচে থাকার জন্যে সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য হল ওই ব্যবধানটি ঘোচাবার চেষ্টা করা। এর উপায় হল প্রচুর পরিমাণে অন্ন উৎপাদন করা। অন্নকে বহুগুণিত করা। ক্ষুধার অন্ন যে চেহারাতেই আসুক না কেন, তাকে প্রত্যাখ্যান না করা। তখন মানুষ জপ করবে, ‘আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্ন; আমি অন্নভোজী, আমি অন্নভোজী, আমি অন্নভোজী-অহমন্নমহমন্নমহমন্নম। অহমন্নাদোহহমস্নাদোহহমান্নাদঃ।’ (তৈ/উ৩:১০:৬)