রমজান মাস হল সমগ্র মুসলিমদের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। এই মাসের অন্যতম উদ্দেশ্য হল মানুষের মধ্যে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি করা। পুরো মাস ধরে কঠোর রোজা বা উপবাস পালন এবং কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে মুসলিমদের হৃদয় পবিত্র হয়। এই মাসেই তারা শিক্ষা নেয় কীভাবে সারা বছর ধরে সৎ কাজ করবে, সত্য পথে চলবে, কীভাবে দানধ্যান করবে, কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, অসহায় মানুষদের বিপদে তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে, পাশে দাঁড়াবে। রমজানের আরও একটি বড় উদ্দেশ্য হল সম্পদশালী মানুষেরা দরিদ্র এবং অভুক্ত মানুষদের ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠায় তারা যেন অংশ নিতে পারে সেই শিক্ষা দেওয়া।
ইসলামে রমজানের উপবাস মানুষের উপর নিষ্ঠুরভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। শয্যাশায়ী, নিরাময় অযোগ্য রোগী, গর্ভবতী মহিলা, সফরকারী মানুষকে রোজা পালন করা থেকে সাময়িক ছাড় দেওয়া হয়েছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাদের প্রতিকূল অবস্থা দূর হলে তখন তাদের সেই রোজাগুলি করে নিতে হবে। কোন ব্যক্তি উপবাস করে ভুলবসত পেট ভরে খেয়ে নিলেও তার উপবাস ভঙ্গ হয় না। কিন্ত কেউ যদি ইচ্ছাকৃত একটি দানাও খেয়ে থাকে তবে তার উপবাস ভঙ্গ হয়ে যায়। রমজান মাস হল দানের মাস। এই মাসে দুস্থ অসহায় মানুষদেরকে প্রচুর দান করা হয়। রমজান মাসেই ইসলাম ধর্মের ৫টি স্তম্ভের অন্যতম একটি ‘জাকাত’ প্রদান করা হয়।
মহান আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, জাকাত দাও এবং রাসুলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ-ভাজন হতে পার।’’ (সুরা নুর-৫৬) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘হে মু’আজ! তুমি জানিয়ে দাও আল্লাহ তাদের সম্পদের উপর জাকাত ফরজ করেছেন, যা ধনী ব্যক্তিদের থেকে নিয়ে দরিদ্র ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করা হবে।’’ (বুখারি, মুসলিম ও তিরমিজি)। জাকাত সমস্ত সম্পদশালী মুসলিমদের জন্য অলংঘনীয়।
জাকাত হিসেবে সম্পদশালী মুসলিম ব্যক্তিদের এক বছরের সঞ্চিত মোট সম্পদ থেকে মাত্র আড়াই শতাংশ নেওয়া হয়। এই সমস্ত অর্থ অভাবী দরিদ্র অসহায় ব্যক্তিদের মাঝে বণ্ঠন করে দেওয়া হয়। এছাড়াও রমজান মাসে রোজা বা উপবাসে কোনো ভুলত্রুটি হয়ে গেলে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ‘ফিতরা’ বা কিছু নির্দিষ্ট অর্থ প্রদান করার নিয়ম। এই অর্থও বণ্টন করা হয় সহায় সম্বলহীন মানুষদের মধ্যে। জাকাত এবং ফিতরার উদ্দেশ্যে হল অর্থের অভাবে যেন ইদের উদযাপন থেকে কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে। রমজান মাসকে বলা হয় মানবজাতির জন্য বরকতের মাস। এই মাসে কেউ যদি পবিত্র মনে ১ টাকা দান করে তবে সে ৭০ টাকা দান করার পুণ্য অর্জন করবে এমন কথা ইসলামে বলা হয়েছে।
পুরো রমজান মাস শেষে আসে পবিত্র ইদের দিন। আরবি শব্দ ‘ইদ’-এর অর্থ ‘খুশি’। ইদ বিশ্বের সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব। ইদ বছরে দুটি। একটি ‘ইদ–উল-ফিতর’ বা দানের ইদ। এবং অপরটি ‘ইদ-উল-আজহা’ বা ত্যাগের ইদ।
‘ইদ-উল-ফিতর’ উদযাপিত হয় প্রতি বছর আরবি রমজান মাসের শেষে সাওয়াল মাসের প্রথম দিনে।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মতো মুর্শিদাবাদ জেলাতেও ইদ পালিত হয়ে আসছে প্রায় কয়েশো বছর ধরে। বাংলার অন্যান্য প্রান্তের ইদের থেকে মুর্শিদাবাদের ইদ কিছুটা হলেও বিভিন্নতার দাবি রাখে। কারণ মুঘল আমলে এই মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী। ফলে নবাবদের পৃষ্টপোষকতায় এখানকার ইদ এক অন্য মাত্রা পেত। সমগ্র রমজান মাস জুড়েই রাজধানী নগরী খুশিতে মেতে উঠত। চারিদিক আলোয় সাজত। সন্ধ্যাবেলায় মসজিদে মসজিদে হত ইফতারির আয়োজন। নাজাফি বংশীয় নবাবদের আমলে রমজান মাসে সন্ধ্যা থেকেই মুর্শিদাবাদের চক মসজিদ সেজে উঠত রঙিন আলোয়। মসজিদে ইফতারিতে থাকত নানান রকমের সরবত, ফলের রস, কাবাব, বিভিন্ন রকমের রুটি এবং নানান মিষ্টান্ন-সহ বহু রকমের ফল। রমজানের বিশেষ দিনগুলিতে থাকত শাহি পোলাওয়ের আয়োজন। সেইসব দিনগুলিতে নবাবরাও সামিল হতেন ইফতারে।
ইদের দিন মুর্শিদাবাদের কেল্লা নিজামত মেতে উঠত খুশিতে। নাজাফি বংশের শাসন আমলে নবাব-সহ নিজামত পরিবারের সদস্যরা ইদের দিন সকাল বেলায় স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে গায়ে শাহি আতর লাগিয়ে জুলুস (মিছিল) সহযোগে বেরতেন চক মসজিদে ইদের নামাজের উদ্দেশ্যে। নবাব বসতেন হাতির পিঠে হাওদাতে। বাকিরা ঘোড়ায়। জুলুসের সামনে একদল বাদ্যকার নিজামত ব্যান্ড বাজাতে বাজতে এগিয়ে চলত। জুলুসে নবাবের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরাও নবাবের সহযাত্রী হতেন, বহু সশস্ত্র সৈন্য নবাবের পাহারায় নিযুক্ত থাকত। যাত্রাপথে নবাব হাতির পিঠে বসে রাস্তার দুই পাশের অগণিত প্রজাদের মাঝে টাকা ছিটিয়ে এগিয়ে যেতেন মসজিদের দিকে।
ইদের দিনে নিজামত পরিবারের বাবুর্চিখানায় রান্না হত নানান শাহি পদ। নবাব প্রাসাদে ইদ উপলক্ষ্যে বহু ইংরেজ আধিকারিদের নিমন্ত্রণ করা হত। তারা সপরিবারে সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে উপস্থিত হতেন নবাবের প্রাসাদে এবং কবজি ডুবিয়ে খেতেন। ইদের দিন রাজধানী মুর্শিদাবাদে দরিদ্র জনসাধারনের জন্যও সরকারি উদ্যোগে খোলা হত বেশ কিছু লঙ্গরখানা। সেখান থেকে পোলাও, রুটি, কাবাব-সহ মাংসের আরও নানান পদ পরিবেশন করা হত।
আজ মুর্শিদাবাদে নবাব থাকলেও নবাবি আমলের সেই জৌলুস নেই। আজও ইদ উপলক্ষ্যে চক মসজিদ সেজে ওঠে। সেখানে মুর্শিদাবাদের বর্তমান নবাব বাহাদুর-সহ নিজামত পরিবারের সমস্ত সদস্যরা নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে মজমুয়া, খস, গুলাব, হিনা, বেলি, চামনবাহার-সহ আরও নানান আতর মেখে মসজিদে যায় ইদের নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে। নিজামত পরিবারের মহিলা সদস্যরাও পৃথকভাবে ইদের নামাজ পড়ে। এখনও ইদ উপলক্ষে মুর্শিদাবাদ শহরে ভ্রাম্যমাণ মেলা বসে।
শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদ শহরেই নয়, সমগ্র জেলা জুড়েই ইদ পালিত হয় আড়ম্বরে। ২৬তম রমজান থেকেই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়ে যায় ইদের খুশি। তবে ইদের কেনাকাটা অবশ্য শুরু হয় প্রায় ১৫ রমজান থেকেই।
ইদের আগের রাতকে বলা হয় চাঁদরাত। এই রাতে ইদের দিনের সমস্ত পরিকল্পনা করা হয়। মেয়েরা হাতে মেহেদি লাগায়, ছেলেরা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরোয়। এই রাতেই মসজিদ কিম্বা ইদগাহ সাজানো হয় রঙিন কাগজ এবং নানান রঙের ফুল দিয়ে। ইদ উপলক্ষ্যে প্রায় সমস্ত বাড়িগুলিতেও আলো দিয়ে সাজানো হয়। এক্ষেত্রে কোথাও সাজানো হয় টুনি বাল্বের আলোয় আবার কোথাও সাজানো হয় প্রদীপ কিংবা মোমবাতি দিয়ে। ইদের দিন সবাই ঘুম থেকে খুব দ্রুত উঠে পড়ে। মেয়েরা বাড়ির রান্নার কাজে হাত লাগায়। তৈরি হয় সেমাই, লাচ্ছা, লুচি, পরোটা কিংবা রুটি, বুদিয়া, হালওয়া-সহ নানান মিষ্টান্ন।
এরপর একটু বেলা হলে সবাই স্নান করে নতুন পোশাক পরে তাতে আতর লাগিয়ে, চোখে সুরমা পরে নামাজ পড়তে যায়। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও সম্মিলিতভাবে ইদের নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে আসে কোলাকুলির পর্ব। এই আলিঙ্গনের ফলে সমস্ত ভেদাভেদ দূর হয়ে যায়। সম্পর্ক হয়ে ওঠে মধুময়। এরপর বাড়ি ফিরে শুরু হয় বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়ি যাওয়া-আসা। দুপুরে অধিকাংশ বাড়িতেই রান্না হয় পোলাও, বিরিয়ানি কিংবা খিচুড়ি। আবার কোথাও সাদা ভাত, সাথে মাংসের নানান পদ।
ইদের বিকেলে বিভিন্ন এলাকায় মেলা বসে। সেই মেলায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ ইদকে সর্বজনীন করে তোলে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১) সৈয়দ আব্বাস আলি মির্জা (মুর্শিদাবাদের বর্তমান নবাব বাহাদুর)
২) সৈয়দ রেজা আলি মির্জা (নিজামত পরিবারের প্রবীণ সদস্য)
৩) ডঃ সৈয়দ রেজা আলি খান (নবাব পরিবারের সদস্য, শিক্ষক, গবেষক)
৪) ডঃ আব্দুল হাই (চিকিৎসক, ইসলামিক গবেষক)
৫) নাফিসা নিসা নাসির (নিজামত পরিবারের সদস্যা)
৬) সৈয়দ আতাহার আলি (নিজামত ইমামবাড়ায় কর্মরত)
এছাড়াও...
১) নিলুফা হক
২) লাবণী হোসেন
৩) তামান্না বিন্দু
৪) আওয়াল সেখ
৫) রবিউল সেখ
৬) মুস্তাক হোসেন