স্ত্রী পরীবানুকে নিয়ে বলেশ্বর নদে চিংড়ি পোনা ধরছিল মিলন জেলে। কখন যে নদের অনেক ভেতরে প্রায় কোমর পানিতে চলে এসেছে বুঝতে পারেনি সে। থেকে থেকে পায়ে এসে লাগছে নদ তলভূমির ঠান্ডা পানির মিহিন ছোঁয়া। পা ধরে হাঁটু ছুঁয়েই সরে যাচ্ছে। আবার আসছে। ছুঁয়ে যাচ্ছে। চলেও যাচ্ছে। মিলনের মনে হল বলেশ্বর যেন মিনতি করছে, মাঝি ও মরার মাঝি--আয় না ফিইরা-- ফের মাছ ধরবিয়ানে- -মোর বুকের ভেত্রে যে ব্যাবাক মাছ খলবলাচ্ছে—জাউলারে ও জাউলার পোলা মিলন জাউলা- আয়-- আয় না – জাল ফেলাইয়ে ধরগে নে যা সব মাছ।
জাল হাতে থমকে যায় মিলন। প্রায় দুমাসের বেশী সময় পার হয়ে গেছে, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাচ্ছে না মিলন। কি যে হয়েছে সমুদ্রের। আজকাল অচেনা লাগে চিরচেনা সাগর। কে জানে উপর আল্লার সঙ্গে কি সব শলা পরামর্শ করেছে আকাশ বাতাস সমুদ্র আর মাটি। গেল কয়েক বছর ধরে যখন তখন ঝড় শুরু হয়ে যায়। আকাশ ফেটে ঠাটা পড়ে মনের সুখে। মানুষ মরে ধোঁয়া বের হয়। ঝড়ের সে কী উথালি পাথালি খ্যাপামি । আকাশে বিদ্যুৎ চমকায় তো মাটি বুক পেতে দেয়। সাগর ফুলে ওঠে আর ঝোড়ো বাতাস উন্মত্ত খেয়ালে জেলেদের ট্রলার ভাসিয়ে নিয়ে যায় মহা অজানার স্রোতে। ট্রলারের জেলেরা তখন আল্লাহ রসূল ভগবানকে ডাকে আর মিলনকে মিনতি করে, ভাইডি ও ভাইডি, শক্ত করি ধরি ধরি চালাও দেহি টোলাররখান। উমন রাইহো গো মাঝি টোলারখান য্যান ভাসি না যায় সাত সমুন্দরের ওপার মরণ সাগরের ফান্দে। মোগো জান বাঁচাইয়া ঘরে ফিরাইয়া নিয়া যাও গো সোনা ভাইডি আমগোর।
বলেশ্বরের ছোঁয়া পেয়ে মিলনের কাঁদন আসে। এক হাতে জাল ধরে অন্য হাতটি মেলে দেয় বলেশ্বরের স্রোত কম্পিত বুকে। যেন কথা দেয়, আসপানি রে বলেশ্বর। আমার জান পরান সে তো তোর কাছ বান্ধা রে পাগল। তোরে ছাড়ে আর কত তফাৎ থাকবার পারি।
কূলের কিনার থেকে ডাক দেয় পরীবানু। মাঝির মতিগতি যেন কেমন কেমন লাগছে। এত কি কথা বলেশ্বরের সঙ্গে ! বাসুকীর মা মাসীমা এসেছিল গেল কাল সন্ধ্যায়। রোজা থেকে থেকে মিলনের মুখের রুচি চলে গেছে, খেতে স্বাদ পাচ্ছে না শুনে কলাপাতায় মুড়ে কতগুলো পুরনো টক তেঁতুল দিয়ে গেছে শরবত বানানোর জন্য। চোত বোশোখ মাসে রোজা করা মানে জাহান্নামের আগুনে সেদ্ধ হওয়ার সমান। জিভ শুকিয়ে খড়ি হয়ে যায়। খা খা করে শরীর। যাওয়ার সময় মাসী চুপিচুপি বলে গেছে, মাইয়েরে মাইয়ে, চক্ষু দুইহান চেতায়ে রাহিস। রোজার ধকল তাও সয়, সাগরের ডাক কিন্তুক মানানো যায় না রে মাইয়ে।
ঢনঢন করে ওঠে পরীবানুর বুক। রাগে দুঃখে গাল পাড়ে, ঢ্যামনা বলেশ্বর। মাইয়ে পোলাপানগো লাগান ছেনাল হইছিস হারামাজাদা তুই।
বলেশ্বর ঢেউ তুলে কতগুলো কচুরীপানা ভাসিয়ে দেয় কূলের কিনারে। মিলনের পেছনে দপদপিয়ে হেঁটে আসা পরীবানু কি বুঝে কে জানে। নিজের প্রৌঢ় চোখকে বিশ্বাস করতে না পেরে বার বার পেছনে তাকায়। কুলকুল করে হাসছে বলেশ্বর ! পানি ছিটোচ্ছে ওদের ফেলে আসা পদচিহ্নমাখা পথে। এ কি সখ্যরস ? নাকি কামাসাক্ত তরুণের উন্মত্ত শৃঙ্গার ?
মিলন গভীর সমুদ্রে মাছধরা ট্রলারের দ্বিতীয় মাঝি। প্রথম মাঝি সাদ্দাম মন্ডল। সিডরে বউ ছেলেমেয়ে হারিয়ে একাই থাকে। নতুন করে আর ঘর তোলেনি নিজের ভিটেতে। নতুন কোন নারীও বেছে নেয় নি জীবনে। সরকারী সাহায্য পেয়েছিল। এগিয়ে এসেছিল কিছু বিদেশী এনজিও। সাদ্দামের উচাটন ভাব দেখে ওর ভাইরা নতুন ভিটে করে মেহগনি গাছের ঠ্যাকা বানিয়ে ছোট্ট একটি টিনের ঘর তুলে দিয়েছিল। সাদ্দাম একদিনের জন্যেও সে করে পা রাখেনি। জন্মকুণ্ডলীতে টান পড়লে মাঝে মাঝে চলে আসে। ভাইপো ভাইঝিরা ঘিরে ধরে, ভাবীরা ছুটে এসে পিঁড়ি পেতে দেয়। কাঁঠাল কাঠের পিঁড়িতে বসে কি বসে না ! অদ্ভুত অচেনা চোখে নিজের ভিটেতে গলগলিয়ে উঠা উর্ধ্ব মরিচের গাছগুলো দেখে চমকে যায় সাদ্দাম, এ কারা তাকিয়ে আছে তরতাজা আকুল চোখে ? কারা ওরা ? তারপর কি যে হয়। আঁচলে চোখ মুছে বড়ভাবী এক গ্লাস শরবত বানাতে ছুটে গেলেই ও বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। ওর পেছনে কিছুদূর পর্যন্ত চলে আসে ভাইপো ভাইঝিরা। ভাইঝিদের কেউ কেউ হাত ধরে কেঁদে ফেলে, কাগা ও কাগা—সোনা দুদু গো বাড়িতে আয়েন---আয়েন গো কাগা--
সাদ্দাম ফিরে আসে না। কারও দিকে তাকায় না। ও তখন নদী থেকে সাগর হয়ে গেছে। ওর মন থেকে গলে গলে পড়ছে স্নেহ আর স্মৃতি--- স্রোত হয়ে তারা মিশে যেতে চাইছে পায়রা, সুগন্ধা বিষখালীর বুক ছাড়িয়ে বঙ্গোপোসাগরের কোলে।
কাজের মরসুমে মন চাইলে কাজ করে সাদ্দাম। ওর মতো দক্ষ মাঝি এ তল্লাটে খুব একটা দেখা যায় না। আর কাজ হারা দিনগুলোতে নতুন জাগা বিহঙ্গের চরে চলে যায় গান শুনিয়ে সাগরকে মন্থন করবে বলে। অনেকেই দেখেছে দন্ডে দন্ডে সাগরের ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সাদ্দামের লুঙ্গি। ন্যাংটো সাদ্দাম দেবে বসে আছে ভেজা বালুচরে। ওর চারপাশে নির্ভয়ে চরে বেরাচ্ছে সাগরের পাখী। কোন কোন পাখী সুরের বিভঙ্গে মুগ্ধ হয়ে একপাশে মাথা হেলিয়ে নিবিষ্ট চোখে সাদ্দামকে দেখে নিচ্ছে। ছোট বড় কাঁকড়াগুলো দাঁড় উঁচিয়ে ছুটছে, দৌঁড়ুচ্ছে, খেলতে খেলতে লুকিয়ে পড়ছে নিজেদের গর্তে। এ সবের কিছুই দেখে না সাদ্দাম। জানেও না। একমনে শুধু গেয়ে যায়, আল্লা কে বুঝে তোমার অপার লীলে—নিরাকারে তুমি নুরী ছিলে ডিম্ব অবতারী--- আল্লা কে বুঝে ---
মাছ ধরার মরসুমে মিলনের উপর ভরসা রেখে ট্রলারের দায়িত্ব ছেড়ে দেয় সাদ্দাম। বসে বসে নদ নদীর গতিবিধি দেখে তীক্ষ্ণ চোখে। মিলনকে নির্দেশ দেয় নিরাপদ স্রোতধারা ধরে যেতে। সমুদ্র শান্ত দেখলে কোনদিন কখনও নেমে যায় অজায়গায়। নিজের বানানো যন্ত্র কাঁধে নিয়ে বলে যায়, মহাজনরে সালাম। টাকা তোগের। কোন কোন দিন আবার যন্ত্র বাজিয়ে গান ধরে সাদ্দাম, হলুদিয়া পাখি সোনারও বরণ পাখিটি ছাড়িল কে--
মহাসাগরের অতল জলরাশির উপর ভাসমান ট্রলারে বসে এই গান শুনে হুহু করে ওঠে মিলনের বুক। শব্দ না করে ও নীরবে কেঁদে যায়। সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে ওরও সাত বছরের ছেলে আরমান হারিয়ে গেছে। ঝড় যখন প্রবল ঘন হয়ে ওঠে, ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে ছেয়ে যায় গ্রাম, আজান যখন আর শোনা যায় না, শঙ্খ বাজানো আর থালা পেটানোর শব্দও বন্ধ হয়ে যায় – ওরা তখন বুঝে যায়, আর রক্ষা নাই। ক্ষেপে উঠেছে আকাশ বাতাস সমুদ্র আর নদী। ভেসে যাওয়ার আগে কেউ কেউ দেখেছে নদীগুলো উঠে দাঁড়িয়েছে। আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে তাদের পানিয়াল মাথা। হাত বাড়িয়ে গিলে নিচ্ছে যা পাচ্ছে সবকিছু। চৌকির নীচে পরীবানুর বুকের সঙ্গে শাড়ির আঁচল দিয়ে বাঁধা ছিল গেঁদা মেয়েটি। আরমানও ছিল ওর মায়ের সঙ্গে। কিন্তু তুফানের দাপটে যখন টিনের চাল ঢেউয়ের মতো কেঁপে কেঁপে ফুলে উঠছিল বাপকে সাহায্য করবে বলে ও বেরিয়ে এসেছিল। কচি হাতে মিলনের সঙ্গে মিলে কাঁচা ঘরের বাতা শক্ত করে ধরে রেখেছিল। ওদিকে অজানা আশঙ্কায় দাদীআম্মা ঘরের খামের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে আরমানকে ডেকে চলছিল, দাদা, ও দাদাভাই, তুমি আইসো দেহি মোর কাছে। ও মিলন—মিলন রে এ তুফান য্যান কেমুন কেমুন ঠেয়াচ্ছে রে বাপজান। আল্লা রে, ও মোর আল্লা, এয়া তো যে সে তুফান দেও নাই তুমি। এয়া যে কিয়ামত নামায়ে দেছো। দুন্যিয়াডা যে এক্কেরে চ্যাতায়া হ্যালাইছে মরার তুফান।
দাদীআম্মার কথা শেষ না হতেই এক আলুথালু ঝোড়ো বাতাস চালসুদ্ধ উড়িয়ে নিয়ে যায় মিলন আর আরমানকে। মিয়াদের বরনা গাছে গুঁতা খেয়ে টুপ করে উত্তাল বাঁশবনে ঝরে পড়ে মিলন। কিন্তু আরমানকে আর পাওয়া যায় না। ঝড়ের শেষে নিহত আহতদের মধ্যে অনেক খুঁজেছে মিলন। নদীতে নদীতে লাশের ভাসানেও খুঁজে দেখেছে। শুনেছিল, ঝোড়ো বাতাস কিছু কিছু বাচ্চাকে উড়িয়েপুড়িয়ে ফেলে এসেছে ইন্ডিয়ার সুন্দরবন অঞ্চলে। সেখানেও গেছিল মিলন। কোথাও আরমান নাই। উবে গেছে আরমান। নাতি হারানোর শোক নিতে পারেনি বুড়ি দাদিআম্মা। মরার আগে কেবলই প্রলাপ বকে গেছে, লাশডাও যদি ফিরাইয়া দিতা রে আল্লা। ও মোর আল্লা ইডা তুমি কি অরলা গো আল্লা।
শোকে কাতর হয়ে মারা গেছে সে বুড়ি। পরীবানুও কেমন পাগল পাগল হয়ে গেছিল। হয়ত মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে সুস্থ হয়ে গেছে। সেই থেকে ঝড়কালে মিলন আর সাগরে যায় না। পরীবানু যেতে দেয় না। কিন্তু যত গরীব হোক, ওদেরও তো পেট আছে। সে না হয় এক থালা ভাত খানিক মাছ তরিকারী না জুটলে মরিচ রসুনবাটা খাওয়া পেট। আর কে না জানে পেট থাকলেই খিদে বাজে। খিদের চোটে নাড়িভুঁড়ি পাক খায়। মাথা গুলোয়। চোখে পানি জমে। হাত পা বিনবিন করে কাঁপে। বাবলার ফুলের মতো শুকনো শরীর ঝরে পড়তে চায় ধূলামাটিতে।
উপায় না দেখে ছেষট্টি শতাংশ জমি এক বছরের জন্যে ভাড়া নিয়েছিল মিলন। কুড়ি হাজার টাকা দিতে হয়েছিল জমির মালিককে। কিন্তু আমন রুয়ে যে আশা করেছিল মিলন সে গুড়ে লবন মিশিয়ে দিয়েছে নোনা পানির ঢল। গাছ মরে ছড়ে মাত্র দশ মন ধান পেয়েছিল সে। লোকসান সামলাতে ঋণ নিতে হয়েছে এনজিও অফিস থেকে। এখন বলেশ্বর নদে গলদা বাগদার পোনা ধরে স্বামী স্ত্রী মিলে। মেয়েটা বি,কম পড়ে। অবসরে গরীবগুর্বো পোলাপানদের পড়ায়। ফলমূল, দুধ, কুমড়ো, আলু তরিতরকারী দেয় কেউ কেউ। কেউ আবার উপকূলের ছিন্ন ঘরগুলোতে যখন সুদিন আসে কিছু টাকাপয়সাও তুলে দেয়।
সুগন্ধা, পায়রা আর হরিণঘাটা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এই ভূখন্ডটি হচ্ছে মিলন পরীর প্রিয় জন্মভূমি বরগুণা। এক সময় সমস্ত ভূখন্ডটি ছিল সুন্দরবনের অংশ। প্রায় দেড় শতাব্দী আগে আশেপাশের কিছু মানুষ এসেছিল এখানে বসত করতে। ছিল আদিবাসী রাখাইনরা। এরপর উজিয়ে এসেছে মানুষ। কেটে ছেঁটে সুন্দরবনকে ঠেলে দিয়েছে দূরে। সুন্দরবনও অভিমানে সরে গেছে । কিন্তু বিশাল বিশাল ঝড়ের থাবা যখন এই উপকূলে আছড়ে পড়ে ডুবিয়ে দিতে চায় মনুষ্য জাতিকে। কি এক মায়ায় বুক চিতিয়ে দেয় সুন্দরবন। নিজে ভেঙ্গেচুরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে লড়াই করে ঝড়ের সঙ্গে। ঝড় শেষে দেখা যায় ক্লান্ত বিধ্বস্ত সুন্দরবন নুয়ে আছে।
উপকূলের এই বরগুণা এখন লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রিয় জন্মভূমি। অথচ কৃষি আর মাছ ধরা ছাড়া এখানে আর কোন আয়ের উৎস নেই। এনজিও কর্মর্তা শিশির মির্যা গেল তিন বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে এখানে। কাজের সময় ছাড়াও ঘুরে ঘুরে বরগুণা দেখে শিশির। দেখে উপকূলের গরীব মানুষদের মরণপণ অবস্থা। এরা নগদ টাকা হাতে পায় খুবই কম। টাকার অভাবে দোকান থেকে বাকীতে কেনাকাটা করে। তাতে হিসাবের খাতায় দাম বেড়ে যায় অনেক বেশী। প্রতিতি ঘর ঋণগ্রস্ত। মহাজনের গদিতে ঘটি বাটি বাঁধা এদের। বলেশ্বর নদের বাঁধ ধরে চলতে চলতে ও দেখেছে, কাজের অভাবে অলস বসে আছে জেলেরা। রামচন্দ্র, নেহাল, সুখন, সুবল, মিরণ, রফিক সবার মুখেই কর্মহীন অবসন্নতার ছাপ। শিশির জানে, এদের সবার ঘরে আজকাল এক ধরণের জাউ রান্না করা হয়। ক্ষেত জমি থেকে টুকানো শাকসব্জি বা বাড়ির হালটে লাগানো কুমড়ো লাউ মরিচ রসুন বাটা দিয়ে তেল ছাড়া এক আশ্চর্য জাউ রাঁধে এদের বাড়ীর মহিলারা। থালার পাশে দেয় তেঁতুল পোড়া বা টোম্যাটোর ভর্তা। খেয়ে দেখেছে শিশির। অমৃতের মতো লাগে এই আঠালো জাউভাত। মাঝে মাঝে হাত জাল, গামছা বা শাড়ির আঁচল দিয়ে মাছ ধরে এক দু ফোঁটা ভেন্নার তেলে ভেজে দেয়। কিন্তু এই খেয়ে তো মানুষ সুস্থভাবে বাঁচতে পারে না। বাঁচতে হলে অনেকগুলো ভিটামিন লাগে মানব শরীরে। শিশিরের এনজিও চায়, এরা কতটুকু প্রোটিন খেল, কতখানি ওমেগা, পটাশিয়াম, ওয়েল পেলো, পরিস্কার শৌচালয় ব্যবহার করে কিনা, পিউরি ওয়াটার খেলো কিনা, সাবান দিয়ে কিভাবে কতবার হাত পরিষ্কার করল এ সবের হিসাব। চর লাঠিমারা বেড়ি বাঁধের ভাঙ্গন আটকাতে সিমেন্টের বস্তা ফেলা হয়েছিল কোন বর্ষা মরসুমে। তার উপর বসে প্রজাপতির ছবি তুলছিল শিশির। আশ্চর্য এই প্রজাপতি দল। ঠিক হেলিকপ্টারের মত দাঁড়িয়ে থাকে পানির উপর। কখনও দল বেঁধে ঘুনঘুন করে ঘুরে বেড়ায়। নুনিয়া শাক, কাঁটা নটে, হেলেঞ্চা মালঞ্চ, কলমি তুলতে তুলতে এদিকে আসছিল ফাতেমা বেগম। ওকে দেখে বসে পড়ে, শিশির ভাইজান গো, মোগো লাগি কুনো কামটাম খুঁজে দেন না গো। এম্নে কি বাঁচন যায় ! কাম ছাড়া মোরা পয়সা পামু কেম্বে ? কি লইয়া বাঁচমু, খামু কী, পোলাপানগোরে খাওয়ামু কী আপনে কন তো দেহি ভাইজান !
বোকার মত হেসে শিশির এক পিস ওয়েফার বের করে দিয়েছিল। অভাবী মুখে সলজ্জ হেসে ফাতেমা বেগম হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলেছিল, ও ভাইজান ইয়া খালে কি প্যাট ভরবেয়ানে ? তয় আরেকখান দেন দিনি---
এর আগের দিন শিশির আমতলী উপজেলার গুলশেখালি, কুকুয়া, হলদিয়া, চাওড়া, আমতলী এবং আড়পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের গ্রামগুলো ঘুরে এসেছে। মানুষের দুর্দশা দেখে বেজায় মন খারাপ হয়েছে ওর। চার মাস ধরে জাটকা আহরণ বন্ধ থাকায় অভাবে পড়েছে জেলে পাড়ার মানুষরা। এ চারটি মাস প্রতিটি জেলে পরিবারের জন্য আশি কেজি করে চাল বরাদ্দ করেছে সরকার। অথচ পরিবার পিছু পাচ্ছে চৌষট্টি কেজি চাল। চেয়ারম্যান নিজে্র মুখেই হতাশা জানিয়ে বলেছে, মুই কি অরমু কন তো দেহি শিশির সাহেব। বরাদ্দের চাইতে জাউলাগোর সংখ্যা বেশি। মুই ত এক্কেরে চুক্কাবুক্কা হইয়ে গেছি রে ভাইজান। চেয়ারম্যান কথা শেষ করে বিরস মুখে চলে যেতেই, রমলামাসি, জয়গুন বেওয়া, অমিতা, সাজেদারা শিশিরের কাছে এসে বসে, হুনলে তো এঞ্জি ভাইজান, এহন তলি মোগো বেডাগো কুনো কামকাজের ইশারা নাই। মোগো সংসার ক্যাম্বে চালামু কিডা জানে। এই নিদানে বড় ঠ্যাহা ঠেহি গেছি গো মোরা।
পাথরঘাটার বিস্তীর্ণ জলভূমির দিকে তাকিয়ে শিশির ভাবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিডর, আয়লা, মহাসেন, ফণী, আম্ফানসহ ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্রাসে ভেসে গেছে গ্রামগুলো। কৃষকদের জমি , মাছের ঘেরে ঢুকে পড়েছে নোনাপানি। ফসল নষ্ট হয়ে খার হয়ে গেছে। মাছ গেছে ভেসে। কিছু মাছ মরে পেট ঢোল হয়ে ভেসে থাকে জলাবদ্ধ জলাশয়ে। দুর্গন্ধে টেকা দায়। উপকূল অঞ্চলে আজকাল মিঠা পানির বড় আকাল দেখা দিচ্ছে। বৃষ্টি হলে তবু রক্ষে। তখন পানির নোনতা ভাব কিছুটা কমে। শিশির নিজের বুদ্ধিতে ফিল্ড পরিদর্শকদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য মাটির বড় বড় মটকা, জালা, কলস ইত্যাদির পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। এমনই পোড়া কপাল এদের, অনাবৃষ্টির ফলেও ফসল পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আগে কিছু অঞ্চলে মুগ আর তরমুজের ভাল ফলন হত। এখন চাষ ভালো হচ্ছে না। ওদিকে সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় জেলেরা ক্ষুধার মুখে টিকতে না পেরে অনেকেই গ্রাম ছাড়ছে। ঋণগ্রস্ত অনেকেই ঘরবাড়ী ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে। মহাজনী দাদন নেওয়ার মতো নিকৃষ্ট প্রথার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। ক্ষুধা আর দেনার দায়ে স্থানান্তরিত হচ্ছে অন্য জেলায়। কেউ কেউ ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি পুননির্মাণের টাকা খেয়ে ফেলে কাজের খোঁজে নিরুপায় হয়ে চলে যাচ্ছে বরিশাল বা ঢাকা শহরে। হিন্দু জেলেরা গোপনে দেশ ছাড়ছে। মাছ ধরা আর কৃষিকাজ ছাড়া আর কোন কাজ নেই এখানে। ফলে জীবিকার জন্য বাড়ছে হাহাকার। শিশিরকে দেখলে সবাই কাজ চায়। নয়াবাঙ্গালী গ্রামের পনেরো কুড়িজন নারী পুরুষ সেদিন এনজিও অফিসে এসেছিল কাজ চাইতে। করুণ মুখে তারা বলে গেছে, বাপধনরা মোগে কাম দ্যান। জমি খাল বিল পুহুর খাইছে নুনে। ঘের ভরি গেছে নুনা পানিতে। হুনতে আছি ব্যাবাকে কয় মোগো নাহি আয় বাড়িয়াছে। মোরা উন্নত হইছি। হেরা কি জানে আডে বাজারে আইয়া মোরা কি কি কেনাকাডা করি। কি খাই।
এনজিও বাড়ীর সর্বত্র বিদেশি পয়সার স্বচ্ছলতা। বিদেশী নিয়মে আটটা বাজলে ডিনার সার্ভ করে হায়দার। ডিনার শেষ হলে রোজ রাতে দুটি প্যাকেট নিয়ে নীচে চলে যায়। দারোয়ানকে দিয়ে আসে। একটিতে থাকে সারাদিনের কেটেকুটে রাখা তরিতরকারীর খোসা, দু একটি আলু পটল, পেঁপের অংশ, খানিকটা নষ্ট পেঁয়াজ মরিচ অন্যটিতে কিছু বাড়তি ভাত, ফেলে ছেড়ে আধখানা খাওয়া মাছ মাংসের অবশিষ্ট। খেতে বসে অনেকেই ভাত নষ্ট করে। বিশেষ করে কিছু ছেলেমেয়ে আছে, যারা মনে করে শুধু ডলার কামানোর উদ্দেশ্যে তারা এনজিওতে কাজ করতে এসেছে। তারা যতটুকু খেতে পারে তারচে বেশি খাবার প্লেটে নিয়ে নষ্ট করে। হায়দার সেগুলো ধুয়ে সুন্দর করে প্যাকেটে ভরে দিয়ে আসে দেলোয়ারকে। দেলোয়ারের বউ সেগুলো আবার ঠিকঠাক করে দুটি ছেলেমেয়েকে খেতে দেয়। ইশকুলের উঁচু ক্লাশে পড়ে ওরা। মাঝে মাঝে দেখা হলে চোখে চোখ পড়তে দেয় না। সালাম দিয়ে দ্রুত সরে যায় ছেলেমেয়ে দুটি।
শিশির আসার কিছুদিন পর এক রাতে হায়দার এসেছিল শিশিরের কাছে, স্যার আমাদের তো অনেক খাবার থেকে যায়। স্যার আপারা সব খাবার খেয়ে শেষ করতে পারে না। আপনি অনুমতি দিলে---
শিশির না করেনি। শুধু জানতে চেয়েছিল, দেলোয়ার কি চেয়েছে ? নাকি ও তোমার কোন আত্মীয় হয় ? হায়দারের দু চোখে বিব্রত আলোর জোনাক জ্বলে উঠেছিল। দ্রুত মাথা নীচু করে বলেছিল, না স্যার ওরা আমার কেউ হয় না।
কি ভেবে আবার মাথা উঁচু করে বলেছিল, আবার কিছু হয়ও স্যার।
মানে ?
শিশিরকে চমকে দিয়ে হায়দার জানিয়েছিল, যেমন আপনি এখানকার সবার আপনজন। আপনি আসবেন বলে সারাদিন দুজন বুড়িমা বসে থাকে ডৌয়াতলা বেড়িবাঁধের উপর। আমি জানি স্যার ওরা কেন ওখানে থাকে।
শিশির বোঝে বড় ছোট মনের কাজ হয়ে গেল। এভাবে হায়দারকে প্রশ্ন করা উচিত হয়নি ওর। অভাব অনটনে এইচএসসিতে ঝরে যাওয়া হায়দার মানুষ হিসেবে অনেক বড়। মানবিক মানুষ হতে সর্বোচ্চ ডিগ্রীর কোন প্রয়োজন হয় না। হায়দারের চোখে সে জল দেখেছে। সিডরে মা বাবা ভাইবোন হারানো হায়দার সুন্দরবনের কোনো আধাজাগা চর থেকে বিষখালী নদী হয়ে ভেসে এসেছিল কাকচিড়া ইউনিয়নে দেলোয়ারদের গ্রামে। সাত আট বছরের সর্বস্ব হারানো বালক হায়দারকে দেলোয়ারের আব্বা মা আর কোথাও যেতে দেয়নি। সিডর উড়িয়ে নিয়েছে অনেক কিছু কিন্তু মনুষ্যত্বকে পরাজিত করতে পারেনি। আর কে না জানে মনুষ্যত্ব হচ্ছে রিলে রেসের মত মায়াময় আত্মার দৌঁড়। প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে যা প্রবাহিত হয়ে জেগে থাকে মানুষের অন্তর্গত রক্তধারার মধ্যে।
ঈদের রাতে তনুকে এসএমএস করে শিশির। লম্বা এসএমএস। ছবি পাঠায়। কথা বলতে ইচ্ছে করে না ওর। জীবনের সব অনুভূতি কি কথায় প্রকাশ করা যায়। তনু খুব সংবেদনশীল মেয়ে। শিশিরকে সহজেই বুঝতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়ার এক আধা শহরে থাকা তনু শিউরে ওঠে শিশিরের পাঠানো ছবি দেখে। বামনা উপজেলার ডৌয়াতলার মালতীদাদু আর আমেনা বেওয়াকে দেখে চোখে পানি চলে আসে ওর। ন্যাতাকানির মত শাড়ি জড়িয়ে আছে শরীরে। চোখগুলো যেন মরা নদীর বালুতে চাপা পড়া বদ্ধ জলটুকুন। চুপসানো বেলুনের মতো ঝুলে পড়েছে স্তন। তাতে অজস্র বলিরেখার বহুবিধ রেখায়ণ। শিশির লিখেছে, তনু এ যেন স্তন নয়, বিষখালী, বুড়িশ্বর, পায়রা, বলেশ্বর, হরিণঘাটা, টিয়াখালী, আন্ধারমানিক নদীর উৎস মুখ। আমি প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছি। ডুবে যাচ্ছি। ইলিশ প্রজননের সময় বাইশ দিন পুরুষরা থাকে কর্মহীন। এখানে অন্য কোন কাজ নেই যে ওরা করবে। সরকারের দেওয়া তিরিশ কেজি চালে সংসারের পাঁচজন মানুষের মুখে কতদিন ভাত দেওয়া চলে বলতে পারিস তুই ! এই চাল দেওয়া নিয়ে এদেরকে আবার ঠকানোও হয়। একজন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান তো বলেই বসেছে, কুড়ি কেজি চাল দেই এইডা তো হেগো ভাইগ্য। আগে কি খাইত হেরা ? জাউলাগো আবার প্যাট আর চ্যাট।
জানিস তনু এ এক অদ্ভুত ভূখন্ড। তিনটি নদীর মাতৃ স্নেহরসে গড়ে উঠেছে এ ভূখন্ডটি। পাথরঘাটা উপজেলাটি ত মুখ ডুবিয়ে আছে বঙ্গোপোসাগরের বুকে। আর দুটি হাত ছড়িয়ে দিয়েছে বিষখালী এবং বলেশ্বর নদীর কোলে। এ ভূখন্ডটিকে প্রকৃতি কেবলই ডুবিয়ে নিতে চায় তার বিশাল জলরাশির স্নেহতলে। অহরহ বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্রাসের সঙ্গে আরও আছে বাড়তি যন্ত্রণা, অতিরিক্ত কুয়াশায় তাপমাত্রার ঘন ঘন পাগলাটে পরিবর্তন। ভাঙ্গছে নদী তীর, নামছে অতি বৃষ্টি। এ জেলাটিতে জলাবদ্ধতা এখন সারা বছরের জন্য স্থায়ী হয়ে গেছে। আর আছে কেবল বাঁধ আর বেড়িবাঁধ। লতাবাড়িয়া, বুড়ির চর, পোটকাখালী, আয়লা-পাতাকাটা, জাঙ্গালিয়া কত যে বাঁধ আর বেড়িবাঁধ। সবগুলো বাঁধ জোড়াতালি দিয়ে কোন রকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। কোন কোন ঝড় জলোছ্রাসে আট ফুটের উপর ধেয়ে আসে পানি। বাঁধ ভেঙ্গে ঘর জমিন পুকুর ঘের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। দুর্ভাগ্যকে সঙ্গী করে এই সব দুর্বল বাঁধের উপর গরু ছাগল, হাঁস মুরগি, সাপ ব্যাঙ্গের সাথে শিশু এবং বৃদ্ধবৃদ্ধাদের নিয়ে কয়েকদিন কাটাতে হয় এ উপকূলের মানুষদের। অথচ ক্ষমতার মানুষদের কেউ এক ইঞ্চি মাটি দেয় না বাঁধগুলোতে। সংস্কারের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছুটা জোড়াতালি মেরে চলে যায়। গেল ইয়াসে বেতাগী শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে পড়েছিল। স্থানীয় একজন বৃদ্ধ দুঃখ করে বলছিল, হুনছি বইন্না নাহি এহনো আয়ে নাই। হেইতেই এত পানি। জানিনা বইন্না আইলে মোগোর কফালে কি নাচতেয়াছে।
দুটি ছাগশিশু বুকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল হালিমা বেওয়া। করুণ হেসে বলেছিল, আমাগোর বাপদাদারা পানিতে ভাইসছে, মোরাও ভাসতেয়াছি, মোগো ছায়ালপানরাও ভাসবেয়ানে। পানি পানিই আমাগো কফাল গো এঞ্জি দাদাভাইজান।
ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া জীবন এদের। প্রতিবছর কোন না কোন স্বজন হারিয়ে যাচ্ছে ঘুর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্রাসের তান্ডবে। জমি, ইশকুল ঘর, বসতবাটি চলে যাচ্ছে নদীগর্ভে। উপকূল জুড়ে প্রকৃতির নৈবদ্য নেওয়ার এই নিষ্ঠুর পলিসি যদি একবার দেখতিস !
বেতাগী উপজেলার মাহফুজা বেওয়ারা রোজা করছে শুধু পান্তা ভাত খেয়ে। ইফতারেও অই একই অবস্থা। আমি জানি না তনু, কাদের জন্য রোজা ফরয। তুই যে রোজা করিস, বুঝতে পারিস গরীবদের অনাহারে থাকার কষ্টটাকে ? একবার ভেবে দেখ আমাদের সেহরি আর ইফতারের আইটেমগুলো। পবিত্র লাইলাতুল কদরের বিকেলে যে মানুষগুলো টাকার অভাবে টিসিবির চাল ডাল তেল কিনতে পারে না তারা ঈদের দাওয়াত করে বলে গেছে, আইসেন গো এঞ্জি দাদাভাইজান। নাহোইল দিয়ে মিডা আর মুরহার লগে পোম্বার সালুন রানবয়ানে। বলেন দাওয়াত কবুল !
আমি এখানে এদের সঙ্গে কাজ করি তনু। এই উপদ্রুত উপকূলে এসে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। আব্বুআম্মুকে বলে দিয়েছি, লালদিয়ার শ্বাসমূলীয় বনভূমিতে বেঁচে থাকার জন্য বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আসা আমি আমার পূর্বপুরুষের লড়াই দেখতে পেয়েছি। লালদিয়ার বন বুক পেতে রক্ষা করে এ উপকূলীয় জেলাটিকে। আমিও কিছু করতে চাই। তাই এখানেই থাকব আমি। মাঝে মাঝে আসিস। তোর পেশেন্টের অভাব হবে না। ভালোবাসার ঈদ হোক তনু। ভালো থাকিস।