ঈদ উপলক্ষে টানা চারদিন ‘স্ট্রিট লাফটার শো’ করছে বিটিএন বাংলা, হাতিরঝিলে। অনুষ্ঠানটা ভালোই সাড়া ফেলেছে। প্রতিদিন তিনটা পরিবার অংশ নেয়। প্রতিটা পরিবারে দুজন করে সদস্য থাকে—একজন নারী, একজন পুরুষ। শোতে তেমন কিছু করতে হয় না। হাসতে হয়। কারণ অকারণে হাসতে হয়। একটা করে হাসির কৌতুকও বলতে হয় অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোকে। ওদের কাজ হয় পাল্লা দিয়ে হাসা এবং একই সঙ্গে অন্যদের হাসানো। উপস্থিত দর্শক থেকে জনা বিশেক সামনে বসানো হয়। তারাও হাসে এবং চূড়ান্ত জয়ী পরিবার নির্বাচন করে। জয়ী পরিবার পায় সর্বোচ্চ তিনজন সদস্য দু’দিন দু’রাত গাজীপুরে একটি রিসর্টে ফ্রি থাকা-খাওয়ার সুবিধা। অথবা রিসর্ট কর্তৃপক্ষ থেকে নগদ বিশ হাজার টাকা।
মেয়েকে নিয়ে টানা দু’দিন চেষ্টার পর তৃতীয় দিনে এসে সুযোগটা পেল সুবহান মিয়া। প্রথমে সুবহান রাজি হয়নি। ভদ্রলোকের শোতে ওদের মতো সহায় সম্বলহীন মানুষকে নেবে কেন! কিন্তু খুব কষ্ট করে সুবহানের বউ লতা রাজি করিয়েছে। কিছুদিন হলো লতা কাজ হারিয়েছে। একজনের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করত। যে বিছানাগত বৃদ্ধের দেখভালের জন্য ওকে রাখা হয়েছিল তিনি মারা গেছেন। এরপর আর কোথাও কাজ পাচ্ছে না। নীমতলি ট্র্যাজেডিতে মুখের অর্ধেকটা পুড়ে যাওয়ার পর থেকে কোন বাসা বাড়িতে কাজ জোটে না।
যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে, দেখো! লতা বলে।
বউয়ের কথা শুনে সুবহান ঝিম ধরে বসে থাকে। রিকশাটা চুরি হওয়ার পর থেকে সে নিজেও কাজকর্মহীন। এখনই কটা টাকা না পেলে না খেয়ে থাকতে হবে।
মেয়ে মালা মায়ের সঙ্গে তাল দেয়। বলে, বাবা তুমি তো মেলা হাসো। আমিও তোমার সঙ্গে হাসব। এই দেখো আমিও ক্যামন হাসতে শিখেছি, বলে দশ বছর বয়সী মেয়েটি হিহি করে হাসতে থাকে। মালা একটা পথস্কুলে পড়ত। পড়তে গেলে একবেলা খেতে দিত। এখন সে সব বন্ধ। দেশ উন্নত হয়েছে বলে এনজিওটা ফান্ডের অভাবে গুটিয়ে গেছে। বিকাল বেলা রাস্তায় টুকে বেড়াত, গত মাসে গণ-ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর থেকে আর সাহস পাচ্ছে না।
অবশেষে সুবহান রাজি হয় মা মেয়ের চাপাচাপিতে।
কিন্তু অংশ নিতে চাইলেই তো হয় না। কত পরিবার এসে লাইন ধরে তার কী হিসেব আছে! প্রতিদিন অনুষ্ঠান শুরুর আগে লটারির মাধ্যমে তিনটি পরিবার নির্বাচন করা হয়। তৃতীয় দিন নির্বাচিত হয়েছে সুবহান আর মালা। ওদের সঙ্গে একটা ব্যবসায়ী আর একটা সরকারি চাকরিজীবী পরিবার আছে। বাকি দুই পরিবার থেকে অংশ নিয়েছে স্বামী-স্ত্রী।
আজকের পর্বটা ভালোই জমে উঠেছে। বিজ্ঞাপনসহ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের শো। প্রথম দুই পর্ব এরই মধ্যে শেষ। সুবহান আর লতা পাল্লা দিয়ে হেসেছে। সুবহান এমনিতেই খুব হাসতে পারে। এটা ওদের পারিবারিক রোগ। সুবহানের বাবা মাটিকাটার কাজ করত। অভাব অনটনের মধ্যেও লোকটা এত হাসত যে পাগলের মতো দেখাত। যেদিন ওর মা ইটভাটায় জ্বালানির সঙ্গে জ্বলেপুড়ে কয়লা হলো, সেদিন বিকালেও হেসেছে। তাও খুব সামান্য কারণে, একটা ছাগলের ছা লাফাতে গিয়ে দড়িতে বেঁধে উপুড় হয়ে পড়ে গেছে, তাতেই সে কী হাসি! শেষ পর্যন্ত পাগল বলে সকলে এক প্রকার মেনে নেয়। সুবহানের বাবারও মানতে অসুবিধা হয়নি। আশেপাশে কেউ পাগল বলে ডাকলেই দাঁত কেলিয়ে উত্তর নিত। আর পাগল বলেই কিনা দুজনের কাজ করে অর্ধেক মজুরি পেত। সেই থেকে সুবহানের ধারণা হাসাটা ওদের অসুখ। মেয়েকেও সেই অসুখে পেয়েছে দেখে সুবহানের কষ্ট হয়। আবার ভাবে জেতার জন্যই তো হাসছে! বাপ তো হেসেই হেরেছে, আজ প্রথম ওরা জেতার জন্য হাসছে।
বিজ্ঞাপন বিরতির পর কৌতুক-পর্ব শুরু হয়েছে। প্রথমেই ব্যবসায়ী পরিবারের পুরুষ লোকটি কৌতুক পর্বে বলল: ধর্ষণের দায়ে এক লোককে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত লোকটি পুলিশকে বলল, আমাকে কেনো গ্রেফতার করা হলো বুঝতে পারছি না, মেয়েটি তো একবারও বলেনি যে সে রেপ হয়েছে। পুলিশ রেগে গিয়ে বলল, বলেনি কারণ ও বোবা। লোকটি তখন উল্টো রাগ দেখিয়ে বলে, সেটা আমি কি করে বুঝব? মেয়েটি তো তখন একবারও বলেনি যে সে বোবা!
ব্যবসায়ীর এই কৌতুক শুনে সরকারি চাকরিজীবী পরিবার হো হো করে হেসে উঠল। কৌতুকটা ঠিক মতো বোঝেনি সুবহান ও লতা। ওরা শুধু বুঝেছে কৌতুকটা রেপ নিয়ে। রেপের কথা মনে হতেই ওদের মুখটা ভার হয়ে ওঠে। কিন্তু এই খেলায় মুখ ভার হলেই পয়েন্ট কাটা। জিততে হলে ওদের হাসতে হবে। বোঝা না বোঝা বিষয় না। সুবহান ভেবেছে আমরা পাগলের জাত, হাসলে অসুবিধা কোথায়! সুবহান পাল্লা দিয়ে হেসেছে। মেয়েটার জরায়ুর ঘা এখনো শুকায়নি। তাও যা হেসেছে তা কল্পনার বাইরে।
এরপর সরকারি চাকুরীজীবীর পালা। তিনি বললেন: এক ভদ্রলোক গাড়ি থেকে দেখলেন, রাস্তার পাশে একটা লোক তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঘাস খাচ্ছে। ভদ্রলোক গাড়ির কাঁচ নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি করো তোমরা? ওরা বলল, স্যার আমরা তিন দিন ধরে কিছু খাইনি। তাই ঘাস খাচ্ছি। ভদ্রলোক বলল, ঠিক আছে, আমার গাড়িতে উঠে আসো। রাস্তার ওসব নোংরা ঘাস খেলে পেট খারাপ করবে। লোকটি আনন্দে তার মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় বলল, স্যার আমার বউও তিন দিন ধরে কিছু খায়নি। ওকেও ডাকি? ভদ্রলোক খুশি মনে বলল, ডাকো। ওরা তিনজন আনন্দে ভদ্রলোকের গাড়িতে উঠে বসল। বলল, স্যার আপনি ফেরেশতা! ভদ্রলোকের বিশাল বড় বাড়ির ভেতর গাড়িটি থামল। ওরা নামল। ওদের মুখে হাসি। এত বড়লোকের বাড়ির খাবার ওরা আগে কখনো খায়নি। ভদ্রলোক বাড়ির পেছনে বড় বড় ঘাস দেখিয়ে বলল, অনেকদিন কাটা হয়নি। যাও। পরিষ্কার আছে।
শুনে সকলে হাসিতে ফেটে পড়ল। সুবহান হাসতে হাসতে জান বের করে ফেলেছে।
এবার সুবহানের পালা। সে বলল: এক বড়লোকের ছেলে তার বন্ধুকে বলছে, জানিস আজ ম্যানিব্যাগ আর ফোনটা রাস্তার এক ছোকরাকে দিয়ে দিলাম। খুব শান্তি শান্তি লাগছে। সেই বন্ধু তখন বিস্মিত হয়ে বলল, তুই তো এক টাকাও দেওয়ার মানুষ না; দিলি কেন? বড়লোকের ছেলে তখন বলে, ওই কিছু না, ছেলেটার চাকুটা চকচক করছিল, দিয়ে দিলাম! এখন খুব আনন্দ লাগছে। বন্ধু তখন জানতে চায়, বাধ্য হয়ে দিলি, এতে আনন্দ পাওয়ার কি আছে? বড়লোকের ছেলে তখন হাতের আইফোনটা নাচাতে নাচাতে বলে, আছে বন্ধু, আছে…! তুই তো জানোস, এই থানায় আমার আঙ্কেল আছে। বলে দিয়েছি, দশ হাজার টাকাসহ ম্যানিব্যাগ আর আইফোনটা গেছে! এখন ছিনতাইকারী ব্যাটা খালি ম্যানিবাগ আর সস্তা ফোন নেওয়ার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাবে!
সুবহান শেষ করতে না করতেই হাসতে শুরু করে দেয়। মেয়ে লতাও সময় নেয় না যোগ দিতে। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও হাসতে থাকে পাল্লা দিয়ে। এতটা সময় ধরে হাসার পর সকলেই কিছুটা ক্লান্ত। কিন্তু সেই ক্লান্তি প্রকাশ করার সময় এটা না। সকলে সেটা বোঝে, বোঝে বলেই হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় কারো কারো। সুবহান তো একবার চেয়ার থেকে পড়েই গেল।
তিন পর্বই শেষ। এখন ফলাফলের পালা।
শুধু হাসলে হয় না বুঝলি, ঢঙ জানা লাগে। বাড়ি ফেরার সময় সুবহান ওর মেয়েকে বলে।
মেয়েটা তখন বুদ্ধি করে উত্তর দেয়, আজ আমাদের টিভিতে অনেক লোক দেখছে, তাই না আব্বা?
হুম, আমাদের হাসতে দেখছে! বলে সুবহান মুখটা ভার করে। এখন আর মুখ ভার করে থাকলে কেউ নম্বর কাটতে যাবে না।
‘ঈদ লাফটার শো’ শীর্ষক এই গল্পটা নির্বাচিত হলো চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার জন্য। ‘লাইট-ন্যায়ের আলো প্রেজেন্ট জীবনের গল্প’ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় গল্পটি জমা দিয়েছিল মইদুল। ‘দৈনিক ন্যায়ের আলো’ আর আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থা ‘লাইট’ যৌথভাবে পুরস্কারটি দিচ্ছে। অর্থমূল্য এক লক্ষ টাকা। গল্পের প্রধান চরিত্র হতে হবে দরিদ্র অসহায় মানুষ। জীবনমরণ সংকট থাকতে হবে। সমাজের অসঙ্গতি ফুটে উঠবে তবে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বিদ্বেষমূলক কোনো বক্তব্য থাকবে না। অবহেলিত বঞ্চিত জনমানুষের কথা উঠে আসবে কিন্তু কারো অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যাবে না। এরকম কিছু শর্ত বিজ্ঞপ্তিতে আগে থেকেই উল্লেখ করা ছিল। মইদুল প্রতিটা পয়েন্ট মাথায় রেখে গল্পটি লেখে। ওর টাকাটার খুব দরকার। স্ত্রীর ওভারিতে বড়সড় টিউমার হয়েছে। অনেকদিন থেকে ভুগছে। পরিবারে ক্যান্সারের হিস্ট্রি আছে। টাকার অভাবে অপারেশনটা করাতে পারছে না। ছেলেটা কানে খুব কম শোনে। ডাক্তার বলেছে, মাস দুয়েকের মধ্যে হিয়ারিং এইড না দিলে যা শুনছে তাও শুনবে না। এজন্য কম করে হলেও ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার প্রয়োজন। একটা পত্রিকায় চাকরি করে মইদুল। বেতন কোনো মাসে হয়, কোনো মাসে হয় না।
মইদুলের গল্পের সঙ্গে আরেকটা গল্প টিকে আছে প্রতিযোগিতায়। ‘বিনিময়’ শীর্ষক এই গল্পের প্রেক্ষাপট মেক্সিকো-আমেরিকা বর্ডার। একটা সিরীয় পরিবার মেক্সিকো সীমান্ত হয়ে চোরাপথে আমেরিকায় প্রবেশ করবে। দালালদের সঙ্গে দরকষাকষি হচ্ছে। মেয়েটাকে রেখে গেলে তিনজন প্রবেশ করতে পারবে। ছেলেটাকে রেখে গেলে দুজন। পরিবারটির মোট সদস্য চারজন। বাবা-মা, বারো বছরের এক মেয়ে আর নয় বছর বয়সী ছেলেটা। মার বয়স হয়েছে, তার কোনো বিনিময় মূল্য নেই এই মানব পাচারের বাজারে। অবশ্য পর্যাপ্ত টাকা থাকলে কাউকেই রেখে যেতে হত না।
পরিবারটি চুপ করে বসে থাকে। ওরা কাঁদতে ভুলে গেছে সেই কবেই। এখন ওরা যোগ-বিয়োগের হিসাব কষে। গেল বছর আমেরিকার ভুল টার্গেটে বোমাটা পড়ল ওদের ঘরে, ভবনটা ধসে পড়ল। বৃদ্ধ বাবা-মা আর বড় ছেলেটা মরল। আট জনে বেঁচে থাকল পাঁচ। কদিন পর আইএস এসে ধরে নিয়ে গেল বড় মেয়েটাকে। পরিবারকে রক্ষা করার জন্য নগদ কিছু অর্থ নিয়ে বাবা নিজেই তুলে দিয়েছে ওদের হাতে। পরিবারে আরো একজন কমল। এই হলো পরিবারটির সর্বশেষ হিসাব। এর আগে বংশের কতজন যে গেছে তার কী আর হিসাব করার সময় পেয়েছে কখনো! আর যাতে না কমে সেই ভেবেই এতটা পথ অর্ধাহারে অনাহারে পাড়ি দিয়েছে ওরা।
দালালকে সঙ্গে নিয়ে দোভাষী আসে, বলে, আঠার ঘণ্টা হয়ে গেল, আর কত সময় নেবে? এরপর তো তোমরা না খেতে পেয়ে এখানেই মরবে। এখনই সিদ্ধান্ত না নিলে পরের চালানের জন্য ফের আটচল্লিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। বলো কি করবে?
সিদ্ধান্ত ওরা আগেই নিয়েছে, কিন্তু যাকে রেখে যাবে তার সঙ্গে আরো কিছুটা সময় কাটাতে চাচ্ছে। অবশেষে পরিবারটি ছেলেসহ আমেরিকার পথ ধরে। মা কেবল বিড়বিড় করে বলে, আয়েশা যদি ফিরে আসে। পালিয়ে আসে বাড়িতে। আয়েশা ওদের বড় মেয়ে। ছোট মেয়েটার কথা যাতে আর না মনে পড়ে এজন্য মা তখন আয়েশা আয়েশা করে বিলাপ করে।
আমরা কাউকে রেখে যাচ্ছি না। ওরা এখন মৃত। বাবা বলে।
আমরা আমাদের মেয়েদের হত্যা করে পালিয়ে যাচ্ছি। মা বলে।
আমরা কাউকে হত্যা করিনি। ওদের জন্মই হয়েছে এভাবে ঝরে পড়ার জন্য। আমরা কেবল ওদের জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। ওরা আর বেঁচে নেই।
আমার মেয়েদের আত্মা খেলা করছে স্বর্গে। মা বলে।
পানি খাব। পানি খাব। ছেলেটি বলে।
সামান্য পানি দিয়ে মাইলের পর মাইল মরুভূমির মতো খাঁখাঁ প্রান্তর পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। পথে কেউ কাউকে সাহায্য করতে আসবে না।
এখনো অনেক পথ যেতে হবে। আরেকটু পরেই দিচ্ছি। বাবা ছেলেকে বলে।
হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটি ক্লান্ত হয়ে পড়ে যায়। বাবা পিঠে তোলে। মা চাদর দিয়ে বেঁধে দেয়। ছেলেটি ঘুমিয়ে যায় বাবার পিঠে। বাবা হাঁটতে থাকে শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে। হাঁটতে হাঁটতে মানিয়ে নেয় অতিরিক্ত ভারটুকু—মনে হয় শরীরের এই ভার তার আজন্ম।
আমেরিকার সীমান্ত দেখা যায়। বাবা নির্বিকার কণ্ঠে বলে।
যারা ঘর উজাড় করল, তাদের কাছেই ঘর ভিক্ষা চাইতে হচ্ছে। হায় খোদা! মা কাঁদে।
আমেরিকায় পা রাখার আগে শেষ বারের মতো জিরিয়ে নিচ্ছে ওরা। মাটির নিচ দিয়ে তৈরি করা সুড়ঙ্গপথ ধরে আরো কিছুটা হাঁটতে হবে। ক্লান্ত বাবা ছেলেকে পিঠ থেকে নামিয়ে মুখে পানি দিতে গিয়ে দেখে, ছেলে তখনও ঘুমিয়ে। ঘুম আর ভাঙে না।
মোটামুটি এই হলো দ্বিতীয় গল্পের প্লট। বিচারকরা বসে আছেন দুটি গল্প নিয়ে। যে কোন একটির নাম আগামীকাল রাতে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করা হবে।
বিচারক কমিটির প্যানেলে সম্মানীত সদস্য আছেন চারজন — দু’জন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক, একজন এনজিও লাইটের নির্বাহী পরিচালক, অন্যজন দৈনিক ন্যায়ের আলোর সম্পাদক। পুরস্কার কমিটিরি সভাপতি যিনি তিনি দেশের অন্যতম জাতীয় বুদ্ধিজীবী।
দ্বিতীয় গল্পের পক্ষে সম্পাদক সাহেব ভোট দিলেন। দুজন কথাসাহিত্যিক তখন নাস্তার প্যাকেট থেকে কিছুক্ষণের জন্য মনোযোগ সরিয়ে মৃদু সম্মতি জানালেন। সভাপতি মহোদয় গম্ভীর হয়ে শুনছিলেন। এনজিওর নির্বাহী কর্তা তখন আপত্তি তুললেন। বললেন, এই গল্পে আমেরিকাকে নেতিবাচকভাবে দেখানো হয়েছে। আমাদের ফান্ডিং যেহেতু আমেরিকা থেকে হয়, তাই এ ধরনের গল্পকে আমরা পুরস্কৃত করতে পারি না। তাছাড়া গল্পে আইএস-এর প্রসঙ্গ আছে, কারো কোনো ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে যাতে আঘাত না লাগে, সেটিও আমাদের ভাবতে হবে। তাই দ্বিতীয় গল্পটি আমাদের জন্য উপযুক্ত হবে না। এনজিও কর্মকর্তার এ বক্তব্যেও দুজন কথাসাহিত্যিক মৃদু সম্মতি জানিয়ে আপেলে কামড় বসালেন। নিরুত্তর বসে আছেন কমিটির শ্রদ্ধাভাজন সভাপতি।
কিন্তু দ্বিতীয় গল্পকে পুরস্কৃত করলে মিডিয়া কভারেজ বেশি পাওয়া যাবে। লেখক কর্পোরেট জগতে খুব প্রভাবশালী মানুষ। কিছু বড় অঙ্কের বিজ্ঞাপনও পেতে পারি। পুরস্কারটির সূচনা পর্বে সেটিও আমাদের মাথায় রাখার মতো বিষয়। সম্পাদক তার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করলেন।
আমাদের মতো নতুন এনজিওর জন্য মিডিয়া কভারেজ অবশ্যই প্রয়োজন আছে। সেক্ষেত্রে আইএস আর আমেরিকার বাড়ি উড়ানোর বিষয়টি গল্প থেকে বাদ দিয়ে প্রকাশ করতে হবে। লেখক কি রাজি হবেন? এনজিও কর্মকর্তা এ কথা বলে দুজন কথাসাহিত্যিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
দুদিন আগেই তো একটা অনুষ্ঠানে বললেন, লেখালেখির জন্য কোনো কম্প্রোমাইজ তিনি জীবনে করেননি। পুরস্কার-সম্মাননা যা এসেছে নিজে থেকে এসেছে, তিনি বরঞ্চ এসব থেকে দূরেই থাকতে চেয়েছেন সব সময়। একজন কথাসাহিত্যিক বললেন।
আমার বন্ধু মানুষ, আমি বলে দেখতে পারি। অপর কথাসাহিত্যিক বললেন।
ঠিক আছে, তোমরা দু’জন দায়িত্ব নাও। প্রস্তাবিত সংশোধনে তিনি রাজি না হলে সর্ব সম্মতিতে প্রথম গল্পকেই পুরস্কৃত করা হবে। গোপনীয়তা যাতে রক্ষা থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সভাপতি মহোদয় এ কথার মধ্য দিয়ে ‘লাইট-ন্যায়ের আলো প্রেজেন্টস জীবনের গল্প’ শীর্ষক পুরস্কার প্রদান কমিটির চূড়ান্ত সভার সমাপনী ঘোষণা করলেন।
দ্বিতীয় গল্পের লেখক ড. হাসান শাহেদ। একটি প্রাইভেট ব্যাংকের এমডি। ছেলেটা আমেরিকায় পড়াশুনা শেষ করে ওখানেই চাকরি নিয়েছে। মেয়েটা গাইনির ডাক্তার। ঢাকার একটি বড়ো হাসপাতালে বসে। হাসান শাহেদের রেফারেন্স ধরে মইদুল গিয়েছিলেন বউকে নিয়ে। বলেছে পঞ্চাশ পার্সেন্ট ছাড়ে অপারেশনটা করে দেবে। কিন্তু ওটি চার্জ থেকে শুরু করে হাসপাতালের অন্যান্য বিল ওখানে এত বেশি যে তাতেও শহরের গড়পড়তা ক্লিনিকের চেয়ে কম আসবে না। পুরস্কারের ঘোষণার জন্য এই কারণে অপেক্ষা করছেন মইদুল। অপেক্ষা হাসান শাহেদেরও আছে। তিনি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন পুরস্কারটা পেলে সঙ্গে আরো কিছু যোগ করে লেখক-বন্ধুদের নিয়ে পার্টি দেবেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে।
মইদুলকে দুপুরের দিকে ফোন করেন হাসান শাহেদ। ফোনটি ধরার আগে মইদুলের চোখে মুখে আশার আলো খেলে যায়। ভাবছিলেন সম্পূর্ণ ফ্রিতে অপারেশন করার যে অনুরোধ তিনি করেছেন সেটা বোধহয় রেখেছে ডাক্তার-মেয়ে। মইদুল হ্যালো বলতেই, হাসান শাহেদ হাসতে হাসতে বলেন, পান আর হৈ-হল্লা করব। পরশু রাতে কন্টিনেন্টালে চলে আসেন। আপনি আজকাল যা লিখছেন, আপনার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ধন্য হব।