ওপর থেকে দেখে মনে হয় একটা জটিল গোলকধাঁধা, রাস্তা আর রাস্তা – সোজা, সমান্তরাল, প্রশস্ত, সংকীর্ণ। কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় প্যাটার্ন আছে, জ্যামিতিক প্যাটার্ন। কখনও কখনও বেশ জটিল। অন্ধকার, অপ্রাকৃত, ক্ষয়াটে মাঝে মাঝে লম্বা লম্বা বিস্তৃতি – কুঠুরির পর কুঠুরি, যেখানে ওদের বাস। এগুলো সবই আছে, কিন্তু কেমন যেন যেরকম হবার কথা ঠিক তেমনটি নয়। একটা খুব পুরোনো শহরের মতো – যা ছিল আগে, এখন ভেঙেচুরে গেছে। মনে হয় যেন এক অনন্ত ধূসর ছায়া ঝুঁকে এসেছে – প্রকাণ্ড জায়গা, কিন্তু প্রাণহীন। জীবন থমকে গেছে। মাঝে মাঝে কোনো রাস্তায়, বা কোনো কুঠুরির সামনে, মেলে প্রাণের সাড়া। কীরকম যেন ভীত সাবধানি চলাফেরা। এখন একজনকে দেখা যাচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াচ্ছে। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে কি?
বাঁ দিকের রাস্তাটা নেব নাকি সোজা? ঘরে পৌঁছব কী করে? বারবার এই রাস্তায়ই বা আসছি কেন? কীরকম যেন গা ছমছম করছে। কী করব? যদি এখান থেকে বেরোতে না পারি। এখানেই ঘুরব? এত বলে বড়রা, এতবার করে বলে, দলের বাইরে না যেতে– একদম নতুন জায়গা, কাউকে চিনি না, রাস্তা চিনি না... নিজের দলের সাথে সবসময় থাকতে। কিন্তু কী করব আমি? আমার তো ভাল লাগে না…ওইটুকু জায়গায় আটকে থাকতে। কী ছোট্ট! এতজনের জন্য ওইটুকুনি জায়গা – না আমি পারি না… আমার দম বন্ধ হয়ে আসে… কী বাজে এই জায়গাটা। আর বাইরেটা যেমন পুরোনো, তেমন গোলকধাঁধা।
এরকম ছিল নাকি আমাদের ঘরবাড়ি?
আসলে খুব সুন্দর ছিল ওদের থাকার জায়গা– একদম ঝকঝক করত। যাতায়াতের রাস্তা কত চওড়া… বড়– হাত পা ছড়িয়ে থাকত সবাই। ঘর থেকে বেরিয়ে একটা রাস্তা চলে যেত সোজা। তার ডান দিক, বাঁ দিক থেকে বেরিয়ে যেত অন্য রাস্তা। আর সেখানে পরপর ওদের সকলের থাকার জায়গা। খোলামেলা। সোজা রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে বাঁদিকে খানিকটা গেলে একটু খুব বড় চত্বর। সেখানেই ওদের জমায়েত হত। ওখানেই আসত ওদের রানির সমস্ত নির্দেশ। তার কাছ থেকে অন্য বড়দের কাছে। কত কত খাবার ছিল সকলের জন্য। জমানো খাবারও ছিল। প্রচুর। বড়দেরকে অনুসরণ করে ছোটরা জমা হত চাতালে। সেখানেই নির্দেশ আসত কোথায় আছে খাবার। হাতের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় বয়ে যেত সে খবর…ছড়িয়ে পরত – সবাই মিলে গিয়ে নিয়ে আসত খাবার। এতো খাবার ছিল যে, কখনও কখনও ছোটদের বয়ে নিয়ে আসতে হত।
চিনি, কেক, বিস্কিট। কখনও অভাব হতো না। সবসময় খাবার। খাবার নিয়ে খেলাও করত ওরা মাঝে মাঝে।
আর আমাদের খেলা? খুব খেলতাম বাইরে, কখনও কখনও জলেও।
আমাদের থাকার ঘরগুলো যেখানে শেষ হয়ে গেছে, সেখান থেকে একটা রাস্তা নিচের দিকে নেমে ঘুরে আবার ওপর দিকে উঠে গেছে। একটু বাইরে। ওদিকটা বড় কেউ যেত না। ওই জায়গাটার ঠিক বাইরে, কোনো কোনো সময় জল থাকত। আমরা প্রায়ই যেতাম। যখন জল থাকত আমাদের সে কী আনন্দ। জলে ভেসে থাকা আমাদের কয়েকজনের প্রিয় খেলা ছিল – বড়রা, বারণ করত, বকত, কাজ করতে বলত – তাই আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে যেতাম।
কী আনন্দ – বড়দের, ছোটদের গায়ের গন্ধে শুধু আনন্দ। খাবারের, খেলার, নিশ্চিন্তির।
কিন্তু কী যে শুরু হল…
হঠাৎ করে অদ্ভুত অদ্ভুত খবর কেমন বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো চারদিকে ছড়াতে শুরু করল।…আমাদের ছোটদের কাছেও পৌঁছত। আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না, শুধু বুঝতাম খারাপ খুব, ধ্বংসের খবর…একের পর এক কমিউনিটিগুলোতে – কাছের বা দূরের। নেমে আসছে আক্রমণ, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। কী যেন একটা ঘিরে আসছে সমস্ত দিক থেকে। তারপর কয়েকদিন সব কেমন চুপ হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের পৃথিবী তো চুপ হয় না। মাটি থেকে উঠে আসে আমাদের কথা – জোরে, আস্তে। নিজেদের। বাইরের পৃথিবীর। আশেপাশের সব এত চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে কেন? কী একটা সর্বনেশে নিস্তব্ধতা। বড়দের মধ্যে সবাই কেমন চুপচাপ হয়ে যেতে শুরু করল। কিছুর যেন একটা অপেক্ষা করছে সবাই। কীসের?
তারপর শুরু হল সেই আওয়াজ।
ভূমিকম্পের মতো ভোঁতা একটা জোরালো কম্পন– গুম গুম গুম। যখন তখন, কখনও একটানা, কখনও থেমে থেমে। কী জোরালো আওয়াজ তার, পায়ের তলার মাটি আলগা হতে শুরু করল। চলতে ফিরতেই অসুবিধে। আমাদের নিজেদের কথাই এসে পৌঁছত না, ওই আওয়াজে ঢাকা পরে যাচ্ছিল অন্য সব আওয়াজ। গা ছমছমে একটা ভাব ঘিরে ফেলল আমাদের। বাইরে বেরনো, বিশেষ করে বড়দের চোখের আড়ালে যাওয়া তো একদম বন্ধ। নিজেদের মধ্যেও শুধু আলোচনা… কে কী নতুন খবর নিয়ে আসছে। আর নতুন একটা গন্ধ পেতে শুরু করলাম আমরা। প্রথমবার– ভয়ের। বিপদের।
অবশেষে বিরাট চত্বরে সকলের জমায়েত। কীরকম একটা ভীষণ থমথমে হাওয়া। সবাই নিস্তন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। ওদের রানির কাছ থেকে ঘোষণা এল – প্র্রতিবেশী কয়েকটা কমিউনিটিতে পরপর নেমে এসেছে ওপর থেকে এক ভয়ঙ্কর আক্রমণ। কোনো সতর্কতা নেই, কিছু নেই। কেউ কিছু বোঝার আগেই নিমেষের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কমিউনিটি। যে কোনো সময় ওদের ওপরও নেমে আসবে। পালাতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেটুকু পারে খাবার জড়ো করো... বেরিয়ে পড়তে হবে। এখনই। সেনাপতিরা থাকবে সামনে। সবাই একসাথে তাদেরকে অনুসরণ করবে। অনেক দূর যেতে হবে – হাতে একদম সময় নেই ।
রানির ঘোষণা শেষ হওয়া মাত্র কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা, তারপর একটা প্রচণ্ড ত্রস্ত তাড়াহুড়ো লেগে গেল। তবে অসম্ভব শৃঙ্খলা ওদের মধ্যে, তাই ঠেলাঠেলি হুড়োহুড়ি না করেও বিরাট দলে বেরিয়ে পড়ল ওরা বাসভূমি থেকে। যা নিতে পারে খাবার, সাথে নিল। পরে রইল ওদের অনেক কষ্টে বানানো আজন্মকালের ঘরবাড়ি। এতদিনের আশ্বাস, নিরাপত্তা। শুরু হল ওদের যাত্রা। সারি বেঁধে, শুধু হেঁটে চলা. কোনো দিকে না তাকিয়ে, কোথাও না থেমে। এক তলকুলহীন হাঁটা। অবিরাম। শুধু হাঁটা ছাড়া আর যেন কোনো কাজ নেই। পিছনে কিছুক্ষণ বাদে বাদে ভেসে আসছে এক দানবিক আওয়াজ। ভোঁতা, নৃশংস, অমোঘ। ওই আওয়াজ মৃত্যু বয়ে আনা ছাড়া আর কিছু আনতে পারে না। ওই ধাতব আওয়াজের সাথে তছনছ হয়ে যাচ্ছে তাদের মতো অনেকের বাসস্থান পিছনে, আর তার সাথে নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে পায়ের তলার মাটি; আরো তাড়াতাড়ি চলেছে ওরা, শুধু জানে পালতে হবে, ওই রাক্ষুসে কম্পনের হাত থেকে। অনেক দূরে। ওদের দলটার সাথে এসে যোগ দিয়েছে আরো দল, সবাই একসাথে হাঁটছে। মিশে যাচ্ছে। ছুঁয়ে আছে পরস্পরকে। ভয়, আর সাথে বিপদ থেকে মুক্তি পাবার মরিয়া সাহসের গন্ধ মিশে গেছে ওদের রাস্তায়। সেটাই যেন পথের শেষে পৌঁছে দেবে ওদের – নিরাপত্তায়। যেখানে ওই আওয়াজ নেই। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে, টুপটাপ করে করে পড়ছে এক একজন। তার জন্য কেউ দাঁড়াচ্ছে না। একইভাবে চলেছে লাইন। চলেছে অনেক অনেক দূর খোলা প্রান্তরে।
চলেছে আশ্রয়ের দিকে।
ওহ কী যে কষ্ট। নিজেকে বয়ে নিয়ে যাবার। পা চলছে না, সামনে কী আছে জানা নেই, পেছনে ওই দানবের মতো আওয়াজ, লাইনের কোথায় কে আছে আমার বন্ধুরা কে জানে? অন্ধের মতো শুধু চলেছি বড়দের পেছনে। খাবার শেষ হয়ে গেছে কখন... শুধু ভয়…ভয় পেতে পেতে আর ভয় পাওয়া যায় না। তারপর ওই আওয়াজ সয়ে যায়। তখন শুধু ক্লান্তি।
বসে পড়তে ইচ্ছে করে….পা ছেড়ে দেয়, আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না...এরকম কতজনের হল... নিঃশব্দে সামনে, পেছন থেমে যাচ্ছে কতজন। কতজন। কিন্তু ক্লান্ত হলে চলবে না – শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলাম এখানে ।
প্রথমে কিছু সময়, এত ক্লান্তি এতো অবসাদ। উঠতেই পারতাম না, সবসময় আমাদের ওই কুঠুরিটুকুতেই পরে থাকতাম। ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করলাম। বেরোতে শুরু করলাম। খিদের জ্বালাতে। খাবার কোথায়? এত কম খাবার এসে পৌঁছোয় আমাদের কাছে। যেটুকু পেতাম তাতে কিচ্ছু হত না। সবসময় খিদে পেত। ঐটুকুনি থাকার জায়গা, পেটে খিদে, বাইরে অচেনা গোলমেলে পৃথিবী। আর তার সাথে যোগ হলো অনর্গল বড়দের বারণ, বাধা-নিষেধ – “বাইরে যেও না…একা যেও না। ভুলে যেও না আমরা একা কোথাও যাই না”।
“এই জায়গাটার শেষে একটা বড় দেওয়াল আছে, সেটা ভুলেও পেরবে না”।
আর হ্যাঁ একটা নতুন কথা, “চারদিকে শত্রু।”
এটা নতুন। আমাদের নিজের জায়গায় এটা ছিল না।
এখানে আছে। আমাদের আশে পাশেই থাকে। বড়রা প্রাণপণ সাবধান করতে থাকে – আমাদের মতোই দেখতে, গায়ের রংটা লালচে, অনেক ছোট। ছোট হলে কী হবে, অনেক হিংস্র।
আমি মাঝে মাঝে দেখেছি ওদেরকে এদিক ওদিক থেকে থেকে আসতে; না প্রথমে আমার একদমই ভয় করেনি।
তারপর একদিন। একজন বন্ধুর সাথে যথারীতি লুকিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পাশের ঘরে হওয়া একজন নতুন বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেলাম চারটে সারি ঘর পরপর পেরিয়ে ডানদিকে ঘুরলে একটা খাবারের সন্ধান আছে।
হ্যাঁ আজকাল এরকম হয়ে গেছি আমরা। বাইরে থেকে খাবারের খবর পেলে সবাইকে বলি না, একা চলে যাই। কী করব? সব সময় খিদে পায় যে...আমরা যারা ছোট, যাদের সব সময় খিদে পায়, খাবার সন্ধান আগে পেয়ে যাই। যাদের আমার মতো খিদে পায়, তাদের শরীরে অন্য গন্ধ। আমরা এখন অনেক সময় একসাথে ঘুরি। আর খাবারের খবর পেলে, সেই খবর আমরা সবার সাথে ভাগ করি না...এই নতুন জায়গায়, আমাদের অনেক নিয়ম উল্টেপাল্টে গেছে। আমাদের দল ভাগ হয়ে গেছে। সেদিন মোড়ের মাথায় পৌঁছনোর আগেই থেমে গেল আমার বন্ধু। গন্ধটা তীব্র। অচেনা। একটার সাথে একটা মিশে গেছে। চেনা আর অচেনা। তারপর ভেসে এল আমাদের ভাষা। “বাঁচাও বাঁচাও।...মেরে ফেলছে আমাদের।” আমাদের কারোর আর্তনাদ। মাটি কেঁপে যাচ্ছে। হিংস্রতার আর মৃত্যুর গন্ধে চারদিক ছেয়ে গেছে। তারপর দেখতে পেলাম। কিছু ছড়ানো চিনির দানা আর তাদের ওপর ঝুঁকে আছে ওরা। লালরা। কী আগ্রাসীভাবে ঝুঁকে আছে কিছুর ওপর।
আর ওটা কী?
বেশ কিছু লাল মিলে টুকরো টুকরো করেছে আমাদের একজনকে – একটা কালোকে। আর একজনকে সবে ধরেছে। ওহ কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য!
তারপর বয়ে নিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া ওই কালোর শরীর – কিছু লাল একদিক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমরা নড়তে পারছি না…ওখানেই শরীর আটকে গেছে। ঝনঝন করছে ওই কালোর মৃত্যু চিৎকারে।
এক্ষুনি ওকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে লালগুলো।
কী করব? কে বলে দেবে কী করতে হবে?
ওই অবস্থায় দেখি কয়েজন লাল, ওই কালোকে ছেড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
আমার পাশ থেকে দু’জন দৌড়োতে শুরু করেছে।
“পালাও পালাও”।
ওহ! ওই লালরা আমাদের গন্ধ পেয়েছে। আমাদের আতঙ্কের, দুর্বলতার। ছুটে আসছে আমাদের দিকে। প্রাণপণ দৌড়োচ্ছি আমরা। ধরলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে মারবে আমাদের।
সেদিন কোনোরকমে বেঁচে ঘরে ফিরে এসেছিলাম।
ওই জন্যই। বড়রা এতবার সাবধান করে...
কিন্তু কী করব, তাও থাকতে পারি না ঘরে...আবার বেরতে শুরু করি। খুব সাবধানে। কবে বেরব এই জায়গা থেকে? বড়রা বলে খুব শিগগিরি বেরিয়ে যাব এখান থেকে। অনেক ভাল জায়গায়। শুধু এই কটা দিন যেন ওদের কথা শুনে চলি…একা বাইরে না যাই। আর ওই ছাইরঙা দেওয়ালটার কাছে যেন একদম না যাই। এখন মনে পড়ছে ওদের কথা আর নিজের ওপর রাগ হচ্ছে।
কেন আমি শুনি না ওদের কথা...
কেন আমি অন্যদের মতো নই?
কেন আমার এত খিদে পায়?
কেন বেশিরভাগ খালি সময়ে আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে জলে? আমার সবচেয়ে ভাল লাগার জায়গা – .
তাই তো আজকাল যখনি সময় পাই, শুধু জল খুঁজি। কোথাও যদি জল খুঁজে পাই...আমি জানি পেছনের কোথাও জল আছে, আমি একবার ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছেছিলাম – খুব স্যাঁতস্যাতে। আমার মন বলছিলো জল আছে খুব কাছাকাছি। তাই এরকম ভাবে ঘুরে বেড়াই। হারিয়ে যাই, যেমন আজ হারিয়েছি।
আরে সামনের দিকটা অন্যরকম দেখাচ্ছে না?
গোলকধাঁধার থেকে বেরিয়ে গেছি মনে হয় – এ যাত্রা বেঁচে গেলাম…
আরে ওই তো দেওয়ালটা। বিশাল ছাইরঙা দেওয়াল। চারদিকে কেউ কোথাও নেই দেখছি, একদম খালি।
পাথুরে দেওয়ালটার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে ও। কিছু ভাবছে, উঠবে নাকি উঠবে না? এক না একজন তো থাকে যারা সেটাই করে যা তাদের বারণ করা হয়। ঠিক সেটাই। খাড়া দেওয়াল ধরে উঠতে শুরু করেছে ও, পায়ে দ্রুততা, উৎসাহ, অধৈর্য। কী আছে এই প্রায় দম বন্ধ করা আশ্রয়ের বাইরে? এখানে কতদিন আর? যদি মুক্তি দেখা যায় এই দেওয়ালের ওপর থেকে তাহলে তো ওরা বেরিয়ে পড়তে পারে। এই উত্তেজনায় উঠে আসছে। তবে ও একা নয়, এর আগে এরকমভাবে অনেকে উঠে এসেছে। ওদের ছোট শরীর আটকাতে পারেনি ওই খাড়া, আকাশছোঁয়া পাথুরে দেওয়াল। আর একটুখানি কষ্ট করি ভেবে হয়তো।...
পৌঁছে গেছে ওপরে ও। দাঁড়িয়ে আছে। জীবনের স্পন্দন, গন্ধ নেবার ধরবার চেষ্টা করছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।
আসলে তো চারপাশে যতদূর দেখা যায় ধু ধু করছে। একদম বালি পাথরে ভরা। কিচ্ছু নেই কোথাও। সম্পূর্ণ শূন্য। জীবনহীন। ও বুঝতে পেরেছে। কী চলছে ওর ভেতরে? অসাড় হয়ে গেছে কি? একটামাত্র সুতোয় আটকে ছিল ওর আশা। ওর কল্পনার সম্পূর্ণ বাইরে ছিল যে, ওই দেওয়ালের থেকে দূর-দূরান্তে ওই বন্ধ্যাত্ব ছাড়া কিছু নেই, নতুন কোনো শুরুর সম্ভাবনাটুকুও যখন গুঁড়িয়ে মিশে যায় ধুলোয়, তখন কেমন মনে হতে পারে ওদের? ও কি বুঝতে পারছে এখন কেন বড়রা এতবার করে নিষেধ করেছে ওদের দেওয়ালটাতে উঠতে? কেন না ওরা জানে ওই দেওয়ালের ওপারে আসলে কিছুই নেই – কোথাও যাবার নেই।
ওরা জানে, বড়রা তার মানে সব জানে। কোথাও কিচ্ছু নেই এইটুকু জায়গায়, না খেয়ে ওই লালদের হাতে মরতে হবে আমাদের। কেন এত মিথ্যে কথা বলা আমাদের? এত মিথ্যে? না আমি কিছুতেই থাকব না এখানে। মৃত্যুর জন্য এখানে অপেক্ষা করব না। পালাতে হবে।
ধীরে ধীরে খুঁজে পাচ্ছি নিজেকে। আমি কাউকে ঘুণাক্ষরেও জানাইনি যে আমি জেনে ফেলেছি – এখন থেকে যাবার আর কোনও জায়গা নেই। জানাব কেন বড়দের? ওরা আমাদের ভাল চায় না। শুধু পাশের ঘরের একজন বন্ধুকে জানালাম। ভেবেছিলাম আমার মতোই ওর রাগ আর ভীষণ কষ্ট হবে, কিন্তু ও জানাল ও আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরেছিল। এরকম কিছু উড়ো খবর ওর কাছে এসেছিল যে এখান থেকে বেরনোর কোনো রাস্তা নেই আর খাবার বিশেষ অবশিষ্ট নেই। এর পরে আমাদের কাজই হলো খোঁজা আর খোঁজা। আমাদের একটা ছোট দল তৈরি হল, খাবার কমতে লাগল আর লালদের হাতে আমরা কালোরা আরো বেশি করে মরতে লাগলাম। খাবার পাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। প্রায় বন্ধ। আজকাল ঘরের মধ্যেই পড়ে থাকে সবাই। আজকাল দু’একবার আমার চোখে পড়েছে লালরা বেশ কাছে ঘেঁষে ঘুরে বেড়ায়। কীসের অপেক্ষা করছে ওরা?
বহুক্ষণ ধরে ঘুরছে ও আজ। এখন গতি অনেক ধীর তবুও এক রাস্তা থেকে আর এক রাস্তা, এক গলি থেকে আর এক গলি ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে জায়গাটা স্যাঁতস্যাঁতে তার কাছ দিয়ে। ও আজ যেন একটা শেষ না দেখে ছাড়বে না। জল তো শুধু আর খেলা নেই….ওই জলে টিঁকে আছে আশা। সেদিনের পর থেকে এ তো পরিষ্কার, একমাত্র জল দিয়েই আছে বেরোনোর উপায় এখান থেকে। আর কোনওভাবে নয়। প্রায় পৌঁছে গেছে। ডান দিকটাতে ঘুরলেই জল। থেমে গেছে ও একদম। কত দিনের কত কষ্ট, কত পরিশ্রম। এতদিনে পৌঁছল। অনেক অনেক দূর পর্যন্ত চিকচিক করছে জল...তাতে বেশ স্রোত। ওই তো ভীষণ দ্রুতবেগে এগিয়ে যাচ্ছে ও…ওই কোণের দিকে। ওখানে ওর মতো কয়েকজন কালো একটা পাতার ভেলা টানাটানি করে প্রায় নামিয়ে এনেছে জলে। ও খুব কাছে পৌঁছে গেছে। যেন এই কয়েক মুহূর্তে বুঝতে পেরেছে ওকে কি করতে হবে।পালাতে হবে। এক্ষুনি।
ঝাঁপ দিলো ও পাতায়।
পাতার ভেলা স্রোতের টানে এগোতে শুরু করল।
দমল না ও; হাঁচোড় পাঁচোড় করতে করতে উঠে পড়ল। ওর মতো আরো তিন চারজন ওই ভেলাতে। স্রোতের মুখে আরো তীর বেগে চলতে শুরু করল। আশ পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে আরও কয়েকটা ভেলা। ওই তো ডুবে যাচ্ছে একটা, তার মধ্যে বেশ কয়েকজন। নিমেষের মধ্যে ডুবে গেল কয়েকটা শরীর। ছটফট করতে করতে। ওদের ভেলাটা প্রচণ্ড ওঠানামা করতে করতে এগিয়ে চলছে। দিগন্তের দিকে। কোনওরকমে পড়ে আছে ওরা পাতার মধ্যে। একটু পরে হয়তো স্রোত কমবে। দিগন্তের কাছে পৌঁছলে ওরা দেখতে পেল আরো অনেক অনেক পাতার ভেলা। শুরু হবে অজানা পথে যাত্রা। লম্বা যাত্রা।
পৌঁছবে কি ওরা?
যেখানে খাবার আছে।
যেখানে আশপাশে হিংস্রতার গন্ধ নিয়ে শত্রু নেই।
যেখানে শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা নেই।…
পৌঁছবে?
কেউ জানে না। তবুও সবাই চলেছে।