আমার অনেক ইদ ছিল। কৈশোর থেকে যৌবন। সেই বৃত্তান্ত যদি বলি, বলতে হয় আমার ইদ হারিয়ে যাবার বৃত্তান্তও। দুটোরই বড় অবশ্যম্ভাবী আগমন জীবনে। তারও আগে যে সত্য স্বীকার্য – একটা বয়সে যে উৎসবে নতুন জামা জুতোর রং, নির্ঘুম অপেক্ষা, বালিশের নিচে জুতো নিয়ে ঘুমানো আর রান্নাঘরে মায়েদের রাতভর সেমাই পিঠা – তাই ইদ, তাই উৎসব। এই রাতজাগা আনন্দে যতদিন ঘুম টুটে টুটে যায়, ততদিন উৎসব রঙিন।
যে উৎসবে একটা বয়সে প্রেমিকের ইশারার গোপন শিহরণ নেই, যে উৎসবে প্রেমিকের নতুন পাঞ্জাবির ছায়া ধাওয়া করে না দিনমান, সে উৎসবে কোনোই রং নেই। প্রেমিকের ইশারা আর পাঞ্জাবির ছায়া হৃদয়ে মেখে নেওয়ার মনটা যতদিন জেগে থাকে, ততদিন উৎসব রঙিন।
তারপর এক বয়সে দারা-পুত্র-পরিজনের হাসিতে থাকে উৎসবের আনন্দ। উৎসব মানে তখন ঘরে ফেরা, স্মৃতির কাছে ফেরা, শৈশব কৈশোরের কাছে ফেরা। পেশার প্রয়োজনে যে শিকড় ফেলে যাওয়া উৎসবের আয়োজনে তাতে সার-জলের সিঞ্চন। জীবনের বাস্তবতার ডাল-পাতায় সতেজ সবুজ প্রাণের স্পর্শ লাগিয়ে আবার কর্মব্যস্ততায় ফিরে যাওয়া। কে না জানে এই একদিনের উৎসব আয়োজনের দিনই বারবার আনন্দ ফিরিয়ে নিয়ে আসার অপেক্ষায় বাঁচিয়ে রাখে বছরের বাকি দিন।
আর উৎসব রঙিন জেগে থাকে অপেক্ষার আয়োজনে প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ার জীবনে। জীবনের অক্লান্ত যুদ্ধ শেষে যাদের অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই আর।
এই যে প্রায়শই বয়স্করা বলেন ইদের আনন্দ নেই, আসলে তাদের প্রেমের মনটা মরে গেছে। স্বীকার করুন কিংবা না করুন ভেবে দেখুন, সব আছে ঠিকঠাক, কিংবা বেড়েছে আয়োজন। পোশাকের, খাবারের, মিডিয়ার, উদযাপনের সব রঙিন হয়েছে বহুগুণ। কেবল বদলে গেছে উৎসবের রং। একজনের কাছ থেকে চলে গেছে অন্যের কাছে। উৎসব রং হারায়নি। হারায় না তার রস কিংবা উল্লাস। কেবল হাতবদল হয় তার। একই বয়স আর বরং বহু বর্ণিল রং নিয়ে উৎসব অপেক্ষা করে থাকে নব বোধনের নব বৈচিত্র্যের। আমরা বুড়িয়ে যাই, ক্ষয়ে যাই বয়সের ভারে, চামড়ার ভাঁজে, পাকা চুলে। উৎসব চিরযৌবনা কালের সবচেয়ে আধুনিক গন্ধ গায়ে মেখে সে দাঁড়িয়ে থাকে পাড়ার মোড় থেকে সিনেফ্লেক্স কিংবা পাঁচতারায়। কোথাও অনভ্যস্ত বেমানান নয় সে কোনো কালেই নয়।
আমাদের কৈশোরে এই মফসসলের বাতাস সকাল থেকেই ভাসত আতরের গন্ধসাগরে। আমার বাড়ির পাশেই সওদাগর জামে মসজিদ। ঘুম ভাঙত মাইকের আহ্বানে। সওদাগর জামে মসজিদে পবিত্র ইদ-উল-ফিতরের প্রথম নামাজ বেলা ৮টায় অনুষ্ঠিত হবে...। তখনই বাতাস ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকে আতর আর পাটভাঙা পাঞ্জাবির ঘ্রাণে। রাস্তার পাশে, মসজিদের পাশে আমার ঘর বর্ণিল হয়ে ওঠতে শুরু করত উৎসবের রঙে। সারাবছর যে ছেলেটি খাতা বই নিয়ে কেবল টিউশনি মাস্টারের বাড়ি দৌড়ায়, এদিক সেদিক তাকানোর ফুসরতই নেই, সেও আজ ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো বাঁকা হাসি আর ইশারা নিয়ে তাকায়। ইদ মানে উৎসব, উৎসব মানে আনন্দ, আনন্দ মানে শিহরণ, নব যৌবনের শিহরণ, প্রেমে পতিত হওয়ার শিহরণ।
জন্ম পরিচয়ে হিন্দু বলে ইদে বিশেষ নতুন জামাটামা জুটত না। রোজার ছুটির আগে দিয়ে রাখা বন্ধুদের আমন্ত্রণে বিকেলে পুরানো জামাতেই যাওয়ার প্রস্তুতি। প্রায়শই পরিবার থেকে কোথাও যাওয়ার অনুমতি মিলত না, একা একটা মেয়ের। দল-বল একত্রিত হয়ে মিলত কোনওবার, সন্ধ্যা নামার আগে আগে ফিরে আসার শর্তে। সে এক স্বর্গীয় বিকেল যেন বা, এ বাড়ি, ও বাড়ি! কত অপেক্ষা প্রাণ পেত সেই বিকেলে, শুরু হত কত লাইলি-মজনু উপাখ্যান। সেমাই-পিঠে পুলির ভাঁজে ভাঁজে হয়তো বা লুকিয়ে আছে সেই ইতিহাস।
আমাদের ইদ আসত সাদাকালো টিভিতে কেবলই কিছু বিশেষ দেখার অপেক্ষায়। ক’দিন আগে থেকেই দেখাত বিজ্ঞাপন আর আমাদের অবরুদ্ধ অপেক্ষারা অধীর হত, অধীর হত। এ অপেক্ষার তুলনা নেই। এর তুল্য আনন্দ আয়োজন আর পাইনি এ জীবনে। ইদের রাত, আর রাতের আনন্দমেলা, নাটক...জুয়েল আইচ, আনিসুল হক, আফজাল হোসেন আবু সাঈদ আব্দুল্লাহ আর রোকন দুলাল জবা কুসুমের মা তারপর দখল করে থাকত কয়েক মাস। আলোচনা আড্ডা। আমাদের সেকালের ইদের এইসব অপেক্ষার আনন্দ অনুবাদ করতে পারে কী একালের রিমোটের প্রতিটি সেকেন্ড কিংবা ফেইসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের বাহুল্য! অসম্ভব।
আমার জীবনে ইদ আসত, হলের দাদু এসে নোটিশ বোর্ডে নোটিশ লাগিয়ে দিত আর ডিপার্টমেন্টের সেমিনার রুমের সামনে। হলে ফিরে শুরু হত গোছগাছ। শানুর সাথে নিউমার্কেট, গাউছিয়া ঘুরে বেড়ানো সারাদিন। এটা ওটা কেনা বাসার জন্য, হয়তো দুই গজ কাপড় কিংবা ছোট্ট একটা শো পিস। রোজাদার শানু এক ফাঁকে কোন পর্দাঘেরা রেস্টুরেন্টে বসে জোর করে আমাকে খাইয়ে নিত। রোজাদার মানুষটি চুপচাপ বসে থাকত সামনে। আমি প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে মুখে তুলতাম ধনে পাতা দেয়া নলা মাছের ঝোল। শানুর চাপাচাপি এড়ানো কঠিন। আহা আমাদের সেই সব হিন্দু হিন্দু, মুসলিম মুসলিম না ভাবা দিন। প্রচণ্ড শীতে আঁধার ভোরে শানু বিলকিস লেপের নিচ থেকে টেনে নামাতো ভোরবেলা, আমাদের সাথে খাও রুমাদি...আমি আরও লেপের উষ্ণতায় লুকিয়ে বাঁচাতাম নিজেকে।
তারপর সায়দাবাদ থেকে বাড়ি আসার টিকিট নিয়ে আসত একজন। সবাই পঞ্চান্ন-ষাট টাকা দিতাম তার কাছে। দুটিই মাত্র বাস হবিগঞ্জে ফেরার। অগ্রদূত আর বিসমিল্লাহ। হবিগঞ্জের সবাই একসাথে। প্রায় সময়, সন্ধ্যায় বাকি পথটুকু একা ফিরতে হবে বলে থেকে যেতাম শানুর চুনারুঘাটের বাসায়। বাসগুলো তখন চুনারুঘাট হয়ে হবিগঞ্জ আসত। তখনও হাইওয়ে হয়নি। একটা ময়না ছিল শানুদের বাসায়। এ্যানির সাথে ছড়া কাটত, মেজপা আইছইন। মেজপা আইছইন। আর সুমন, এই যে এখন ব্যারিস্টার সুমন লাইভে কথার ফুলঝুরি ছুটায়, আমাকে দেখে লজ্জায় লুকিয়ে পড়ত টেবিলের তলায়। সোহাগ পরদিন লোকাল বাসে আমাকে পৌঁছে দিত হবিগঞ্জ।
ছুটিতে একসাথে ফেরায়, একটা উপহারের অপেক্ষা কিংবা ক্যাম্পাসের উদারতাহীন ক্ষুদ্র মফসসলে ইদের দিনে একনজর দেখা! এক একটা ইদের জন্য কী উন্মাতাল অপেক্ষা। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ইদগুলি। একটা সামান্য লিপস্টিক কিংবা একটা বডি স্প্রে উপহারে যেন সাত রাজার ধন সম প্রাপ্তি থাকতো লুকিয়ে। এর চেয়ে অধিক কোনো প্রাপ্তি প্রত্যাশা ছিল না। তার চেয়ে বরং অধিক কাঙ্ক্ষিত ছিল এক নজর দেখা! ক্যাম্পাসের সহজলভ্যতা অধিক তৃষ্ণায় কাতর হত এই মফসসলের ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধতায় এক নজর দৃষ্টি বিনিময়ে...। শাহানার বাসা। মাছের পিঠা আর ভাবির স্পেশাল পুডিং ছাড়া ইদ হয়? হয়েছে কখনও? আমার ইদ মানেই শাহানার বাসা।
তারপর চলে গেছে কত আহ্নিকগতি বার্ষিকগতির দিন-রাত, জোয়ার-ভাটার বছরের পর বছর! আমাদের বিটিভির অপরিমেয় নির্ভেজাল আনন্দ কেড়ে নিয়েছে ইদের পঞ্চম দিন ষষ্ঠ দিনের গুণহীন মানহীন হুল্লোড়। আমার জীবনকে ফাঁকি দিয়েছে ইদের আনন্দ। বন্ধুরা সব সবার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত স্বাবলম্বী। কতজনের কত উপহার আসে, তবু সেই একটা লিপস্টিক কিংবা বডি স্প্রে পাবার শিহরণ কই?
আমি জানি এই সময়ে প্রতিটি নরনারী যে পেরিয়ে এসেছে কৈশোর কিংবা যৌবন, ইদ কাটে তাদের নস্টালজিয়ায়, স্মৃতিতে আর রোমন্থনে।
ইদ আবার ফিরে আসে দেখি চতুর্পাশে বেশ কয়জন প্রৌঢ় আর প্রৌঢ়ার জীবনে। নিঃসঙ্গ বাড়ি আগলে পড়ে থাকা জনক-জননী। সারাবছর কেবল মোবাইলে, ভিডিও কলে কথা বলা নাড়িছেঁড়া ধনের আকুল অপেক্ষা এই একটি উৎসবে। তার আগে আচার দেয়া, পাঁপড় দেয়া, পিঠে-পুলির আয়োজন। ইদ তাদের রঙিন হয়ে ওঠে সারাজীবনের সার খুঁজে। তারা হয়তো জানেন, হয়তো জানেন না, কিংবা জেনেও বুঝেন না ছেলে-নাতি-নাতনিরা পিঠে-পুলির স্বাদ কবে ভুলে গেছে। আনন্দ পাড়ি জমিয়েছে রান্নার চুলা থেকে ফাস্টফুডের টেবিলে। তবু ক্লান্তি নেই প্রৌঢ় প্রৌঢ়াদের। চুলায় রান্না চাপাতে চাপাতে, আচারের বয়াম রোদে শুকাতে দিতে দিতে তাদের দৃষ্টি পড়ে থাকে পথের ধারে...ইদের আনন্দ আসে সেই পথ বেয়ে। ব্যস্ত সন্তানদের দুর্লভ অবকাশ নিয়ে।
এই ইদে পত্রিকা মিডিয়ায় কেবলই খবর হয়, শেকড়ের টানে খালি হয়ে যাচ্ছে রাজধানী। কিন্তু খালি হওয়া রাজধানী এসে যেখানে জমায়েত হয়, সেই মফসসলগুলো যেন এই ইদে এক একটা জমাট কার্নিভাল। অভূতপূর্ব বর্ণিল রং এর। পেশার টানে, জীবিকার টানে দেশে কিংবা দেশের বাইরে থাকা মানুষগুলো এই উৎসব কেন্দ্র করে ছুটে আসেন নিজ শহরে কিংবা গ্রামে। পাড়ায় মহল্লায় দোকানে মার্কেটে চায়ের স্টলে জটলা জটলা আড্ডা। সারাবছর নীরবতার গাঁজায় ঝিমুতে থাকা মফসসলগুলো হঠাৎ যেন গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ায় ঝলমলে প্রাণসজীবতায়। বাড়ি বাড়ি, ঘরে ঘরে যেন প্রানের স্পর্শ ফিরে আসার স্পন্দন। আত্মীয়-পরিজন, নাওইরি-ঝিয়ারি, বন্ধু-বান্ধবে গল্পে, গুজবে, পুনর্মিলনে মফসসলগুলো যেন গরবে ঝলমল করে। কত কৃতি সন্তানের জন্মদাত্রী সে। যারা বারবার নাড়ির টানে ফিরে ফিরে আসে।
ইদ কী সীমাবদ্ধতায় আর কেবলই সীমাবদ্ধ নয় শুধুই ধর্মীয় আচরণে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে পারস্পরিক আত্মার মিলনে এক অন্য মাত্রা পেয়েছে এই মাটিতে। শিকড়ের টান এক অমোঘ টান হয়ে এই উৎসবকে দিয়েছে সার্বজনীন ঐতিহ্য।