সুমনের কোন গন্ধবাতিক নেই। যেখানে সেখানে যে কোন গন্ধ তার নাকে লাগে না। বিশেষত যে গন্ধ যেখানে লাগবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। ভালো কিংবা মন্দ হোক যে কোন রকম। গন্ধ তার প্রাত্যহিকতাকে কোনো ভাবেই প্রভাবিত করে না। গন্ধকে প্রিয় কিংবা অপ্রিয় কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করার বাতিক ও তার নাই, যেমন ছিল দুলালের। দুনিয়ার তাবৎ ভালো গন্ধকেই তার লাগতো হাসনাহেনা ফুলের মতো। কিন্তু এই ঝামেলা সুমনের নাই, পাশের দোতালা বাসায় পোলাও রান্না হলে ঘি গরম মশলা ফোড়নের গন্ধই নাকে লাগে তার, মেসে শুঁটকি রান্না হলে শুঁটকির। রোজ রাতে মধুবন রেস্তোঁরার পাশ দিয়ে ফেরার সময় ড্রেনে জমে পচে উঠা বাসি খাবারের নাড়ি-ভুড়ি উল্টে আসা গন্ধ আর বারান্দায় শিককাবাব ভাজার পেটের তীব্র ক্ষুধা জাগিয়ে দেয়া গন্ধ মিলেমিশে যে খানিক গন্ধময় ঘোর তৈরি করে তার ক্লান্ত ক্ষুধার্ত শ্রান্ত দেহ ঘিরে, তাও খুব স্বাভাবিকই বোধ হয় সুমনের। মোটেই তা বাতিকগ্রস্ততার পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু আজ ২৫ মাইল সি এন জি চালিত যান আর বর্ষার কাদা প্যাচপ্যাচে রাস্তায় ১০ মাইল রিক্সায় আদিত্যপুর গ্রামে দুলালের বাড়িতে পৌঁছে প্রথমেই তার চোখ যায় বাড়ির শেষ মাথায়। যেখানে গোয়াল ঘরটি খড় ভুসির গামলা আর গরুগুলি নিয়ে সহ সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। মূলত সুমন জানে এ গোয়াল ঘরটির জন্মগাথার মধ্যেই দুলালের যাবতীয় দুঃখ কিংবা বাতিকগ্রস্ততার মূল প্রোথিত। গোয়াল থেকে চোখটা ফেরাতে না ফেরাতেই হঠাৎ তার নাকে এসে ধাক্কা দেয় তীব্র গোবরের গন্ধ। মুহূর্ত মাত্র। ঘ্রাণেন্দ্রিয় বার বার টেনে নিশ্চিত হয় সে, কই নাতো আর লাগছে না। সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে গোয়াল ঘরটির দুরত্ব কম করে ১০০ হাত। এই ১০০ হাত দুরত্ব আর মাঝখানে কফিনঘিরে জ্বালানো শ'খানেক আগরবাতির গন্ধ ছাপিয়ে গোবরের গন্ধ তার নাকে লাগার প্রশ্নই উঠেনা। সুমন ভাবে, এ তার ভ্রম, নিশ্চিত ভাবে ভ্রম । বেঁচে থাকতে শালা জ্বালিয়েছে আজ মরেও রেহাই নাই। ‘দূর অ-আলা’ নিজেকেই নিজে গালি দেয় সুমন। যার উৎপাতে তার ‘ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি’ অবস্থা হয়েছিল তার কফিনবন্দী লাশটা দেখতে এসে এ আবার কি নতুন উৎপাত! ঘ্রাণেন্দ্রিয় আবার সজোরে টেনে নিশ্চিত হয় সে । না পাওয়া যাচ্ছে না। এ ভ্রমই। বিশ্বাসে স্থিত হয়ে উঠানভর্তি শ খানেক নারী পুরুষের ভিড়ে জবা নামের মেয়েটিকে সনাক্ত করার চেষ্টা করে সে। এক্কেরে মৌসুমীর লাখান- বলতো দুলাল। চিত্রনায়িকা মৌসুমী কিংবা তার ধারে কাছেও দেখতে কোনো মেয়ে চোখে পড়ে না সুমনের। এমনকি আশে পাশে মানুষের জটলাবান্ধা বারান্দা কিংবা কোনো জানালার শিকে উঁকি দেয়া প্রেমিকের মৃত্যুতে তীব্র শোকচিহ্ন বহনকারী অশ্র“ ভারাক্রান্ত কোনো নারীর চোখই পড়ে না সুমনের কৌতূহলী নজরে। নিজের আচরণে নিজেই বিব্রত বোধ করে ভিতরে ভিতরে, দুলালের মরামুখ দেখতে এসে সে তার প্রেমিকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। নিজের ভিতরে জেগে উঠা বিব্রত বোধটা ভিতরেই চাপা দেয় সে, মূলত আজ এই দুলালের মরামুখ দেখতে আসার পিছনে চপলা জবার মুখটা দেখার একটা অনিবার্য তাড়াও যে ছিল তা প্রাণপনে অস্বীকার করতে চায় সুমন। দুনিয়াতে কত জবা আছে। গোদারা পাড় হয়ে স্কুলে যাবার পথে যে জবা ঘাটে নেমে তার দোকান থেকে প্রতিদিন বাকিতে চানাচুর নিতো আর চোখের ইশারায় সুমনের রাতের ঘুম হারাম করে দিতো, যদিও তার চেহারা খানিক মৌসুমীর মতোই ছিল, তবুও এ জবাতো সে জবা নাও হতে পারে। পাশাপাশি গ্রাম হলেই বা কী? পাঁচ গাঁয়ে কী একটাই জবা? না জবাকে আবিষ্কারের জন্য সে আজ এখানে আসে নি, নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে নিজের কাছেই নিজেকেই প্রমাণের দৃঢ়তায় সে এগোয় দুলালকে এক নজর দেখার প্রচেষ্টায়। জটবাঁধা চুলের মতো মানুষের জটলা কাটিয়ে কফিন পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন। সুমন বোধ করে দেখার যে সামান্য ইচ্ছেটুকু ছিল তাও কেমন মরে গেছে এতনে, জলজ্যান্ত ছেলেটাকে যেখানে সে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পারে। সেখানে একটা নিথর মৃতমুখের পর্দা দিয়ে সেটা ঢেকে দেয়ার কী দরকার ভাবতে ভাবতে সে যখন ফিরে যাবার উদ্যোগ নেবে কিনা এ নিয়ে অনেক দ্বিধায় ভোগে ঠিক তখনই তার নাকে আবার ধাক্কা দেয় তীব্র গোবরের গন্ধ, শুধু তাই নয় এবার একই সাথে একটা উজ্জ্বল নীল আলোর আভা চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় বলে মনে হয় তার। কী বিপদ!! বিভ্রম কাটানোর জন্য আশেপাশে আতিপাতি খুঁজে দেখে সে, না কোথাও কোনো নীলের চিহ্ন নেই। কারো ছিন্ন শার্ট, মলিন শাড়ি কিংবা নোংরা লুঙ্গিতে কোথাও না। এমনকি উপরে আকাশটাও আজ নীল নয়। মেঘে সাদা। দুরঅ- আলা মইরাও শান্তি দিত না দেখি-মনকে স্থির করে যে উদ্দেশ্যে সাতসকালে এতো দূর আসা সেই উদ্দেশ্যকে অসফল রেখেই ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে সে। বাড়ির শেষ মাথা যেখানে জটলাহীন মানুষের এলোমেলো ঘোরাফেরা সেদিকে পা বাড়ায় সুমন, বের হবার রাস্তাটা এই দিকেই। যেতে যেতে মনটা টনটন করে, কাতার যাবার জন্য একই দালালের কাছে টাকা দেয়া ছাড়া আর কোনো কার্যকা্রণই ছিল না দুলালের সাথে সম্পর্ক তৈরি হবার। একই গন্তব্যের যাত্রী দুজন মিলে শলা-পরামর্শ করবে শুধু এই একটা অভিসন্ধিই তাকে প্ররোচিত করেছে একেবারেই না জেনে শুনে দুলালকে মেসের খালি বেডে তুলতে, পরবর্তীতে এর মাশুলও কম দিতে হয়নি তাকে। রোজ রাতে ঘণ্টাজুড়ে বাথরুম দখল করে থাকত দুলাল, এ নিয়ে মেস মেম্বারদের সাথে প্রায় হাতাহাতির উপক্রম। কিন্তু বাতিক যায় নি তার। গভীর রাতে শার্ট নিয়ে ঢুকত বাথরুমে, পরনের শার্টটা ধুতে ধুতে আসল রংটা যখন আর বুঝার উপায় নেই, তখনো তার গন্ধ যায় না। একটু হাসনা হেনার গন্ধের লোভে রাতের রাত বসে থাকে মেসের সামনে নিমতলায়। শুধু বসে থাকায় হয়তো সমস্যা ছিল না, যদি না উঁচুসুরে বাজানো গান পাশের দোতলা বাড়ির অষ্টাদশী মেয়েটির মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাতো। ঐ মাইয়াডার গা থেইক্কা ও হাসনাহেনার গন্ধ আয়ে গো সুমন ভাই বলত দুলাল যে গন্ধ সে পেতো জবার গায়ে, গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে যখন জবা চুপিচুপি আসতো হাসনাহেনার ঝোঁপের আড়ালে। জবার শরীলডা এক্কেরে তুলার লাখান নরম, বিব্রতকর আলোচনাটাকে এড়িয়ে জন্য ধমক দিত সুমন, যা ব্যাডা কিতা কস না কস ঠিক নাই, ঘরের কিনার ঘেইষ্যা হাসনাহেনার ঝোঁপ আর তুই গন্ধ পাস মাইনষের গাত। দুলাল দ্বিগুন উৎসাহে প্রমাণ করতে চাইত তার অভ্রান্ত গন্ধগ্রস্ততা। কেন মৃধা বাড়ি রেজিস্ট্রিকরার পর সবার আগে হাসনাহেনার ঝোঁপটা কেটে যখন গোয়ালঘর বানাল, তখনো তো জবা গোয়ালঘরের পিছনে দেখা করতে এলে হাসনাহেনার গন্ধই পেতো সে। আর মৃধার পোলা বাজারের মুখে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে যতোই বিদেশ থেকে আনা সেন্ট মাখতো ততোই তার গা থেকে পেতো গোবরের গন্ধই । সুমন কে জ্ঞান দিত- গন্ধ ফাইতে জানন লাগে গো ভাই, এই মেতাডা আয়ে ভিত্রের থিক্কা। সুমন সাবধান করেছে বেশ কদিন দেখিছ ঐ মাইয়ার দিকে চাইয়া বিপদ ডাইক্কা আনিছ না কইলাম। কিন্তু বিপদ যেদিন ঘটলো সেদিন প্রথমটায় কেউ বুঝতেই পারেনি ঘটনা টা কী, রাত দশটার দিকে মেসের মালিক মেসে ঢুকেই দুলালের গালে গায়ের জোরে দুই থাপ্পড় লাগায়, সাথে মুখে অকথ্য বাক্যবাণ, আলার ঘরে আলা গান তর পাছা দিয়া ডুকামু । মজনু আইছ এইখানে ! সেদিন হাতে পায়ে ধরে কোনরকমে দুলালের আশ্রয়টা টিকিয়েছিল সুমন। পরে ভেবেছিল অনেক হয়েছে একটা বাহানায় এ আপদরে এবার মেস থেকে বিদায় করতে পারলে সে বাঁচে। কিন্তু পরনের ও পরিবারের দুরবস্থার কথা বলে যখন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে টাকা ধার চাইত দুলাল, তখন সুমনের বাঁচার প্রস্তুতিটা মোটামুটি পথ হারিয়ে ফেলত নিজের পরিবারের দুর্বিষহ স্মৃতির ভিড়ে। ভিটা বাড়ি হারিয়ে তার বাপ মাও সরকারের খাস জমির ছাপড়ায় প্রায় নির্ঘুম রাত কাটায় যে কোন মুহূর্তে উদ্বাস্তু হবার আশঙ্কায়, আর ছেলে বিদেশ গেলে দুঃখ ঘুচবে এই আশায় পাওনাদারদের খোঁটা সহ্য করে মুখ বুঁজে। দুলালের এই কান্নায় যে তার নিজেরও অশ্রুফোঁটা খুঁজে পায় সুমন। তাই মেসের সবাই যখন দুলালের যন্ত্রণায় মহাবিরক্ত, তখন সুমন নিজের একবেলা মিল বাঁচিয়ে হলেও কিছু টাকা তুলে দিত দুলালের হাতে। কিন্তু কাহাঁতক ধৈর্য থাকে? যে দিন দোকানের ম্যানেজার মেসে আসলো দোকান থেকে দুলালের কাপড় চুরির বিচার নিয়ে মালিক আর তাকে চাকরিতে রাখবে না জানাতে, সেদিন সুমন লজ্জায় ক্ষোভে প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে অমানুষের মতো মারতে মারতে দুলালকে বাধ্য করেছিল মাচাঙের উপর পলিথিনে বান্ধা পোটলা থেকে চুরির কাপড় বের করে দিতে। সে দিন রাতে ঘুমানোর সময় তার প্রথম দিনের অভিসন্ধি পরি্ণত হয়েছিল দুরভিসন্ধিতে। দুয়েকদিনের মধ্যেই মেসে টাকা চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে মেস থেকে বিদায় করে দিবে, মোটামুটি প্রতিজ্ঞা করে ফেলে সুমন। কিন্তু সেদিনই রাতের আন্ধারে তার পায়ে ধরে কান্নার ফলেই হোক কিংবা জবার সাথে দেখা করতে যাবার চরম উৎকণ্ঠাময় গল্পটার জন্যই হোক রাতের প্রতিজ্ঞার কথা বেমালুম ভুলে পরদিন দোকানের মালিকের হাতে পায়ে ধরে আবার চাকরিতে বহাল করে দিয়ে আসে। মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়- তরে আমি একটা নীল শার্ট কিন্যা দিমুনে যা। দুলালের উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কা অমূলক ছিল না। মৃধার টাকার অভাব নাই, তার পোলা হোন্ডা দৌড়ায়, জবার জন্য এক পায়ে খাড়া। যদি দুলালের কাতার যাওয়া না হয়, জবাকে হারাবে সে, অবশ্য সান্ত্বনা খুঁজতো আবার নিজেই, জবা বলেছে- ঐ পোলারে আরেক দিন হাতের নাগালে পাইলে জুতাইয়া লাম্বা কইরা ফালামু। সুমনের চোখে বোধ করি কিছুটা অবিশ্বাসের ছায়া দেখে দুলাল তাই সাথে সাথে বলে- বিশ্বাস যাও সুমন ভাই হাছাই একদিন এমুন চড় দিছিল ইস্কুলের সামনে। দুলাল গ্রাম ছেড়ে দেয়াতে ইদানিং আবার উৎপাত নাকি বাড়ছে তার, জবা খবর দিয়েছে, দুলাল যেন একদিন দেখা করতে যায়। পরনের শার্টটার যা চেহারা, কেমনে এটা পরে প্রেমিকার সামনে দাঁড়ায়, শার্ট কিনবার টাকা ও তো নাই। বাধ্য হয়ে এই চুরি। ভিসা পাওয়ার পর সত্যি সত্যি একটা নীল রং এর শার্ট কিনে দিয়েছিল সুমন দুলাকে, নীল রং জবার খুব পছন্দ। শার্টটার পিছনে লেখা ‘লাভ ফরএভার’। প্রথম বার শার্টটা পরে জবার সাথে দেখা করে এসে কী খুশি দুলাল, শার্টটা জবার খুব পছন্দ হয়েছে, বিশেষতঃ পিঠের লেখাটা। কিন্তু দ্বিতীয় বার বিদায় নিতে বাড়ি গিয়ে দুলাল আর শার্টটা ফেরত আনে নি। জবা নাকি সেটা রেখে দিয়েছে দুলালের স্মৃতিস্বরূপ। পুরানো মলিন শার্টটা পরে বিমান বন্দরের দিকে যাবার সময় নীল শার্টটার জন্য সুমনের খারাপ লাগলেও দুলালের ভিতরের স্বস্তিটা সে পড়তে পারছিল, যে প্রেমিকা প্রেমিকের অবর্তমানে তার স্মৃতিচিহ্ন যত্ন করে রেখে দেয়, সে কী ভীষণ ভালোই না বাসে তাকে। দুলাল চলে যাবার পর মেসের নিমগাছটার নীচে আসলেই বুকটা খচখচ করতো তার। আহারে বেচারা! চোখ যেতো পাশের দোতলা বাসাটার দিকে। জানালায় সেই ষোড়শী। চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে নেয় সুমন, দুলালের শাস্তির স্মৃতিটা দগদগে তো হয়ে আছে এখনো, সুমন সরে যায়। কিন্তু টের পায় মেয়েটি নির্বিকার কাজ করে যায় জানালার পাশে। প্রায় নিয়মিত।
মাথার উপর শ্রাবনের মেঘ ঘন জমাটবেধে ভারি হতে থাকে, গুড়–গুড়– আওয়াজে সুমন টের পায়, বৃষ্টি নামবে আবার যে কোনো সময়। যাওয়া দরকার তাড়াতাড়ি। লাশ দেখায় ইচ্ছা যখন বিসর্জনই দিয়েছে তখন আর সময় নষ্ট করার কী দরকার? দুলালদের বাড়ি থেকে নামার পথটা খানিক চালু বৃষ্টিতে পিচ্ছিল, সাবধানে পা ফেলতে ফেলতে সুমন হিসাব করতে চায় শেষ কবে ফোন দিয়েছিল দুলাল, দালাল বলেছে মাসখানেক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিল সে। হ্যাঁ মাসখানেকই হবে। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল- মাইরা সারা শরীল দাগ ফালাইয়া দিছে গো সুমন ভাই, আমি এই সীমার- এজিদের দেশঅ থাকতাম না। দেশ আইয়া গু সাফ করমু। তুমি অ আইও না লাইনটা কেটে গিয়েছিল কথা শেষ হবার আগেই। মাত্রই সুদে ঋণ নিয়ে বাকী পঞ্চাশ হাজার টাকা দালালকে দিয়েছে সুমন তুমিঅ আইয় না- এখন বললে কী হয়? ইচ্ছা ছিল আরেকদিন ফোন দিয়ে বাস্তব অবস্থাটা জানতে চাইবে। কিন্তু এর আগেই চলে এসেছে দুলালের লাশ। এখন কী হবে দুলালের নিঃস্ব পরিবারের? অপোয় থাকা জবার? আদিত্যপুর গ্রামের বৃষ্টিতে ভেজা ধানতে, সুপারি আর তাল গাছের সারির ছবি আড়াল হয়ে চোখের সামনে ভাসতে থাকে নিজের অসহায় পরিবারটির ছবি। দুই কান থেকে নির্গত হতে থাকে শোঁ শোঁ গরম বাতাস। কফিনবন্দী লাশটি থেকে নিজেকে বিযুক্ত করার প্রাণপণ চেষ্টায় বাড়ির বাইরে চলে আসে সে। দুর্বহ লাগে তার দুলালের আদ্যোপান্ত স্মৃতির ভার। ফিসফাস, করুণ কান্নার সুর, কোরান তেলাওয়াতের হৃদয়স্পর্শী উচ্চারন কিছু আর তাকে স্পর্শ করে না। শোক বেদনা কষ্ট কিছু নয়, কেমন অস্থির বোধ হয়, মাথাটা ঘুরে উঠে। বমি বমি লাগে, ধপ করে সে বসে পড়ে কাদামাখা একটা গাছের গুঁড়িতে। তাকে সাহায্য করতে সিগারেট হাতে এগিয়ে আসা ছেলেটাকে চিনতে পারে না সুমন, চিনবার কথাও নয়। পাশের টিউবওয়েলে নিয়ে সুমনের চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেয় সে। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সুমন মাথা তুলে, চোখ পড়ে ছেলেটার গায়ের নীল শার্টটার দিকে। এতো সেই নীল শার্ট যেটা সে দুলালকে কিনে দিয়েছিল। আমি মৃধার ছোট পোলা সেলিম- ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেক করার জন্য ........ হাতখানা বাড়ায় সুমনও, বলে- আমি দুলালের লগে এক মেস থাকতাম। ছেলেটি প্রস্তাব দেয়, চলেন হোন্ডা দিয়া বড় রাস্তায় তুইল্যা দিয়া আসি। না, না লাগত না- দ্রুত হাত ছাড়িয়ে হেঁটেই বড় রাস্তার দিকে পা বাড়ায় সুমন, গলার কাছে একদলা কান্না আটকে থাকে। নিজের সি এন জি চালিত যান নিয়ে সদরের দিকে আসতে আসতে হাঠাৎ কাকতালীয় ভাবে রাস্তায় হাত দেখায় সেই মেয়েটি, পাশের দোতালা বাড়ির বাসার অষ্টাদশী। এ দিকেই নাকি কলেজ তার। সি এন জি তে উঠে কোন ভনিতা ছাড়াই পূর্ব পরিচিত জনের মতো মেয়েটি জানতে চায়- আপনাদের মেসে যে গান বাজাতো ছেলেটা, দুলাল, সে চলে গেছে না? সুমন সংক্ষেপে তার চলে যাওয়া আর দিয়ে আসার গল্পদুটো শুনায়। মেয়েটা চুপ করে যায়। সুমন একবারও মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটির মুখের ভাষা পড়ে দেখার চেষ্টা করে না। কিন্তু মেয়েটা নেমে ভাড়া দিয়ে চলে যাবার সময় তার নাকে ঝাপটা দেয় তীব্র হাসনাহেনার গন্ধ।
মাগধী প্রাকৃত
আমাকে প্লিজ আধুনিক ভাষার উদহারন দিন। আমি নিশ্চয়ই শেখার চেষ্টা করবো।
অনেক ধন্যবাদ সবাইকে মন্তব্যের জন্য