সেইবার ভোটাভুটি হয়েছিল। সেইবার? সেইবার মানে কোনবার? এত দিন তারিখের হিসাব তাদের জানার দরকার কী বাপু? বছরের পর বছর যায়, কখন ভোট হবে তার খবর জানার কোনও দরকার তাদের পড়ে না। তবে ভোট এলে গ্রামে ‘‘ক্যান্ডিডেট’’দের আনাগোনা বাড়ে, দলে দলে ক্যানভাসাররা আসে, দরকার না পরলেও তারা ঠিক জেনে যায় ভোট এসেছে। সেইবার ভোটের দিন সকাল সকাল পঞ্চায়েত পুকুরে ডুব দিয়ে তেলে-সিন্দুরে-স্নো-পাউডারে সেজে কোলের গেদাগুলোকে নিয়ে তেমুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে লাইন ধরে ভোট দিয়েছে তারা। পুরুষদের এক লাইন, নারীদের আরেক।
গেদা ভোট দেয়ার জন্য স্কুল মাঠে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না শুরু করলে, পোলিং অফিসারের কাছ গিয়ে তার আঙ্গুলে কালির ছাপ দিয়ে– ‘এইডাই’ ভোট, বলে পাশের দোকান থেকে চিপস কিনে বাড়ি ফিরেছে তারা। বাড়ী ফিরে নারীরা আগে টিভিখানা ছেড়ে তারপর রান্না চাপিয়েছে কাঠকয়লার উনুনে, ভোট বলেই টিভিতে আজ খালি সিনেমার গান আর সিনেমা, দেখতে দেখতে হাড়িতে চাপানো ডাল পুড়ে গেছে, কি আর করা, প্রতিদিন তো টিভিতে দিনভর সিনেমার গান আর সিনেমা হয় না। গেদার বাপও টিভি পর্দায় চোখ রেখে ঠিক পুড়া ডালই খেয়ে নেয়। এই পর্যন্ত ভালোই কাটে দিনটি, কিন্তু গোল বাধে সন্ধ্যার পর, ভোটে কে হারে কে জেতে কে জানে, হল্লা করতে করতে পোলাপানের দল পাড়ায় ঢুকে প্রথমেই মন্টুদের ঘরে আগুন দেয়, গনশাদের সাদাকালো টিভি আর আমকাঠের মিটসেফ ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে, নিয়তির চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে, রাধামাধবের মন্দিরের চাতালে উঠে ঠাকুরের মাথা ভেঙ্গে চুল কেটে হই হই করতে থাকে.... রাতভর চলে তাণ্ডব। (বিব্রতকর প্রসঙ্গটির সাথে এ প্রসঙ্গটি আপাতভাবে অপ্রাসঙ্গিক বোধ হলেও, প্রসঙ্গটি যে প্রাসঙ্গিক গল্পের অন্তে পাঠক তা হয়তো উপলব্ধি করবেন।)
অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দুজনের কথাগুলো শুনে ফেলে মোনা। কথা শুনার জন্য ও মোটেই কান পেতে ছিল না। কানে আসাটা নেহাৎই কাকতালীয়। গৃহপরিচারিকা পার্বতী যখন বাড়ির কর্ত্রী রাজলক্ষী দেবীর কাছে কথাগুলো বলছিল, মোনার তখন বাড়িতে থাকার কথা নয়। ও, নিশি আর দ্যুতি বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে হাঁটা দূরত্বে খ্রিস্টান মিশন দেখতে। ইংরেজ আমলের কীর্তি, অপূর্ব স্থাপত্য। বাথরুম চেপেছে বলে নিশি-দ্যুতিকে রেখে বেড়ানো সংক্ষিপ্ত করে ফিরে এসেছিল মোনা। কিন্তু এটি জানা ছিল না তাদের দুজনের কারোরই। পার্বতীরও না, রাজলক্ষ্মী দেবীরও না। জানা থাকলে তারা যে এ মুহূর্তে প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা বলত না, এটা নিশ্চিত জানে মোনা। না এ জানাটা দু’দিনে ঠিকঠাক মতো চিনে না ওঠা এ বাড়ির বাসিন্দাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ভরসায় নয়, বরং যে প্রসঙ্গ নিয়ে ওদের আলোচনা, প্রসঙ্গটা এতই বিব্রতকর যে মোনা স্বাভাবিক বিবেচনায়ও বলতে পারে, অন্তত মোনাকে শুনিয়ে একথাগুলো বলার মতো কুরুচিসম্পন্ন মানুষই আসলে হতে পারে না। একজন ছাড়া বাড়ির মানুষগুলোর সাথে পরিচয় হয়েছে মাত্র দুদিন। যে একজনের সাথে সম্পর্কের যোগসূত্রে এ বাড়িতে আসা, বাড়ির সদস্যদের সাথে পরিচয়, তার সাথে মোনার সম্পর্কের গভীরতা যে কত গভীর তা অশীতিপর বৃদ্ধা রাজলক্ষ্মী দেবীকে ঠিকঠাক মতো বোঝানোর ব্যাপারে কোনও ক্রটি ছিল না পার্বতীর। আর এজন্যই সত্যের সাথে মিথ্যের মিশেল নিয়ে খানিকটা অশ্লীলতার রং মিশিয়ে পার্বতী যখন কথাগুলো বলছিল তখন দমবন্ধ ঘরে মোনার নাক কান দিয়ে গরম বাতাস বের হচ্ছিল। রাজলক্ষ্মী দেবী, এ বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ কর্ত্রী, যার নামে এই বাড়িখানার নাম ‘রাজলক্ষ্মী’, তিনি যে কোনও প্রশ্ন করে পার্বতীকে উৎসাহিত করছেন এমনটি বোধ হয়নি মোনার কোনও শ্রুত শব্দেই। তবে সে মুহূর্তে তাঁর মুখাবয়বটি দেখার কোনও উপায় ছিল না বলে তাঁর সত্যিকারের প্রতিক্রিয়াটি আঁচ করা সম্ভব হয়নি মোনার পক্ষে।
পার্বতী মেয়েটি বুদ্ধিমতী, ভীষণই বুদ্ধিমতী। তবে তার এই বুদ্ধিমত্তার সাথে যুক্ত হয়েছে গ্রাম্য অশালীন কৌতূহল আর অসহ্য বাচালতা। ‘রাজলক্ষ্মী’তে আসার পর পরই তা টের পেয়েছে মোনা, আর যতটা সম্ভব সাবধান থেকেছে আচরণে-কথায়। পারতপক্ষে সমীরের সাথে একা-একা কথাই বলেনি। সবার সাথে মিলে কথা বলার সময়ও যথাসাধ্য নির্বিকার থেকেছে, কখনও সাথে আসা আরও দু-বন্ধু নিশি-দ্যুতির চেয়েও বেশি। ভরা পূর্নিমায় সমীরদের শত বছরের পুরনো দালানের ছাদে বসে বন্যার ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’ শুনতে ইচ্ছে হলেও প্রাণপণে তা দমিয়ে রেখেছে। দমিয়ে রেখেছে বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ী ছড়ায় সমীরের হাতে হাত রেখে পা ভেজানোর ইচ্ছেটাও। তবু বিকেলের জলখাবারে সমীরের বৌদি টেবিলে ফুলকো লুচি আর ছানার ডালনা এনে দিলে ওরা যখন ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়– শোন, শোন এগুলো মোটেই তোদের আজিজ সুপারের লুচি নয়, খেয়ে দেখ কী ভীষণ মোলায়েম আর টেস্টি, আরে এগুলো হল আসল লুচি, আজিজ সুপারে যা খাই ওগুলো তো ক্লোন রে ক্লোন, লুচির ক্লোন– তখন সমীর মুখ টিপে হেসে– খাও খাও, নিজের বাড়ি মনে করে খাও– বলে যখন মোনার প্লেটে আরও দুটি লুচি তুলে দেয়, তখন আর কারো চোখে না হোক পার্বতীর চোখে সন্দেহ ছাপিয়ে ‘চোর ধরে ফেলা’র মতো সাফল্যের আনন্দ পড়তে ভুল হয় না মোনার। নিশি-দ্যুতির সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপও করে মোনা। ওরা উড়িয়ে দেয়– দুর, গৃ-হ-প-রি-চা-রি-কা এত পাত্তা দেয়ার দরকার আছে? পাত্তা তো মোনা দিনে চায়নি। কিন্তু ওর মুখে লেগে থাকা রহস্যময় হাসি, চপলা দৃষ্টি, সুযোগ পেলেই গা ঘেঁষে অযাচিত কৌতূহল কেমন যেন উদ্দেশ্যমূলক মনে হয়। পাত্তা না দিয়ে উপায় থাকে না। সমীরকে বলেও ফেলে একবার– তোমাদের কাজের মেয়েটি ভারি ইঁচড়ে পাকা তো..., সমীর সুযোগ পেয়েই টিপ্পনি কাটে– ও বাবা এরই মাঝে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে কমপ্লেন শুরু হয়ে গেল? আপাত বিষয়টা হাসিঠাট্টার মাঝে ফুরিয়ে গেলেও শেষতক তো আর শেষরক্ষা হল না, পচা শামুকে পা কাটার মতো পার্বতীর কারণেই ঘটনা ঘোট পাকিয়ে গেল।
আসার আগে থেকেই বললে ভুল হবে, সম্পর্কের শুরু থেকেই সমীর ধারণা দিয়েছিল– আসলে ঠিক রক্ষণশীলতা বলা যায় না। এটা সংস্কার, কিছু সংস্কার মেনে চলতে হয় গ্রামের অভিজাত হিন্দু পরিবারগুলোকে। মোনা টিপ্পনি কেটেছিল– ইস অভিজাত বলে আবার দোষ হালকা করা হচ্ছে, গোঁড়া বলো গোঁড়া। আসার আগেই জেনে এসেছে মোনা, সমীরের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারটি এখনই জানানো যাবে না পরিবারে। হ্যাঁ আঁচ তো সে করেই এসেছিল কিন্তু রক্ষণশীলতা কিংবা গোঁড়ামি কিংবা সংস্কার যাই হোক না কেন, তার শেকড়বাকড় যে এতটা দৃঢ়, এতটা গভীরে ছড়ানো মোনা তা কল্পনাই করেনি।
এই শেকড়বাকড়ের সন্ধান খুঁজে না বেড়ালে অবশ্য বাইরে থেকে পাবার কথা নয়। যেমন পায়নি নিশি-দ্যুতি। বাইরেটা একেবারেই মসৃণ-ছিমছাম। আদর-আপ্যায়ন-আন্তরিকতা কিছুরই অভাব নেই। মেয়েগুলো হোস্টেলে কী খায় না খায়– বলে দাদা আস্ত খাসি নিয়ে আসে, বৌদি পাটিসাপটা বানায়। মা ইলিশ-পোলাও এর আয়োজন আনতে বলে। কিন্তু সমীরের সাথে সম্পর্ক আর সম্পর্কটাকে পরিণতির দিকে টেনে নেয়ার প্রবল ইচ্ছেটার কারণেই আসা অবধি মোনা গোয়েন্দার চোখ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে ‘রাজলক্ষ্মী’র মানুষ আর পরিবেশকে। বাবা-মা-দাদা-বৌদি-রাঙাজেঠু-রাঙামা-সোনাকাকা-কাকীমা, ইউরোপ আমেরিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দিদি-দাদারা, এক ‘রাজলক্ষ্মী’তে শিকড় পুতে রাখা একান্তবর্তী সংসারনিষ্ঠ মানুষগুলোকে দুদিনে জেনে ওঠা বেশ কঠিন, তবু মোনা জানতে চেয়েছে, কাউকে বুঝতে না দিয়ে আঁচ করতে চেয়েছে এই ‘রাজলক্ষ্মী’তে শেকড় পোতা সমীরের সাথে কতটা বেমানান হবে সে, কতটাই বা মানানসই।
যতই গভীর থেকে দেখছে ততই মুষড়ে পড়ছে মোনা ভিতরে ভিতরে। সিদ্ধান্তহীনতা, দ্বিধা, সংকোচ তার তিন বছরের প্রেম আর অনাগত ভবিষ্যতকে বারবার উন্মত্ত জোয়ারে খেই হারানোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যদিও সমীর হেসে উড়িয়ে দিয়েছে– রাখো তো, ও বিয়ে করে ফেললে সব ঠিক হয়ে যাবে। কী ঠিক হবে? এই যে বাড়ির উঠোনে পূজামণ্ডপ, প্রতিদিন নিয়ম করে পুরোহিত এসে পঞ্চপ্রদীপে ঘিয়ে ভেজানো সলতে জ্বালিয়ে আরতি দেয়, ধুপের গন্ধ আর ধোয়ায় ম-ম করে চারদিক, বারান্দায় লাইন দিয়ে বসে থাকে ‘রাজলক্ষ্মী’র নারীরা, পার্বতীও থাকে এককোণে, সেদিন মোনার বারান্দায় উঠতেই সবাই যেভাবে হৈ হৈ করে উঠেছিল এমন কী সমীর পর্যন্ত, মোনা ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়েছিল। মোনা এ বাড়ির বউ হয়ে এলে কি এই পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে যাবে? মোনা নির্দ্বিধায় মণ্ডপের বারান্দায় উঠতে পারবে? এখন যদি জাত যায় তো তখন যাবে না?
এই অভিজ্ঞতার পর থেকেই মোনার দৃষ্টি আরও সূক্ষ্ম দূরবীন দৃষ্টিতে খালি খুঁজে ফিরেছে ছিদ্রগুলো। মোনা লক্ষ্য করেছে ওদের জন্য টেবিলে সাজানো খাবারের বাটিগুলোর উদ্বৃত্ত খাবার কোনদিন রান্নাঘরে ফিরে যায় না আর। পড়ন্ত বিকেলে খাবারগুলো পুকুরে ফেলে, বাসন ধুয়ে, গোসল করে পার্বতী ঘরে ঢোকে। ওদের রান্নাঘরটা যে ঠিক কোন দিকে এখনো খেয়াল করে উঠতে পারেনি মোনা। ওদের যাতায়াত এই সামনের দু-তিনটা ঘরেই সীমাবদ্ধ। যেন অন্দরের বাকী ঘরগুলোর মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল। ওরা যে ঘরটায় থাকে, রাজলক্ষ্মী দেবী তার ভিতরে ঢোকেন না, বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলেন। ওরা অনেক ডেকেও এ কদিনে একবারও ঘরে নিতে পারেনি তাঁকে।
কথাগুলো নিশি-দ্যুতির কাছে বলে খুব একটা পাত্তা পায়নি মোনা। উল্টো ওকেই ওরা দোষী সাব্যস্ত করেছে– আরে বাবা কী ভীষণ আন্তরিক এরা, এত্তো ঘেঁটে গন্ধ বের করার দরকার আছে? ঘাঁটার দরকারটা মোনা ঠিক ওদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারে না। আর সমীরের সাথে সম্পর্কটা যেমন ওর একান্ত নিজস্ব, সম্পর্কটাকে পরিণতি পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবার পরিকল্পনাটাও তো ওর একান্ত নিজস্বই। আর এই ঘাঁটার প্রয়োজনটাও নিজেরই থাক, নিজের সাথে বোঝাপড়ার জন্যই থাক।
কিন্তু আজ যা ঘটল তাতে আর একান্ত নিজস্ব থাকল কই? মোনা প্রথমটায় কাউকেই বলতে চায়নি। লুকিয়েচুরিয়ে খুঁজেপেতে না পেয়ে বাধ্য হয়েই বলতে হয়েছে নিশি-দ্যুতিকে। পরে সমীরকেও। সাথে আনা দুটো প্যান্টির একটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বারান্দায় ব্লু উড়নাটার নীচেই ছিল বলে স্পষ্ট মনে আছে মোনার। প্রথমে রুম, বাথরুম, ওদের ব্যাগ, বারান্দায় আনাচেকানাচে না পেয়ে বাধ্য হয়ে ওদের জানিয়েছে মোনা। কেননা আরও দুদিন থাকতে তো হবে এখানে। এত্তো জরুরী জিনিসটা, নাগরিক অভ্যাসে এখন এটি ছাড়া চলা মুশকিল। সমীরকে না জানিয়ে উপায় ছিল না– এই গ্রামগন্ধী উপজেলা শহরে কোথায় মার্কেট, কোথায় দোকান। আর এ জানানোটাকেই পার্বতী সমীর-মোনার সম্পর্কের অকাট্য প্রমাণ হিসাবে হাজির করেছে রাজলক্ষ্মী দেবীর দরবারে– ও দিদিমা, জামাই ছাড়া কাওরে বেডিরা এগুলান শরমের কথা কয় গো দিদিমা? আমি নিজের চক্যে দেখছি, ছোটদাদার গায়ে গা লাগাইয়া ঢলতে ঢলতে কইতাছে...। ক্যাম্পাসে লুকিয়ে চুরিয়ে ডেটিং করলেও এ বাসায় এসে ভুলেও মোনা সমীরের গায়ে গা লাগিয়ে কথা বলেনি। অনেক সাবধানে নিজেকে সংযত রেখেছে সে, পার্বতীর বর্ণনার অশ্লীলতায় লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে ওর।
সন্ধ্যায় সমীরের বাবা বাজার থেকে ফিরলে, সমীরকে মাঝখানে রেখে বিশাল সভা বসে বৈঠকখানায়। টেলিভিশন সেট ঘিরে এমন সভা নিত্য বসে এ বাড়িতে। ব্যতিক্রম কিছু নয়। কিন্তু মোনা ঠিক পর্যবেক্ষণ করে আজ সবার চোখেমুখে আলাদা ঘন কালো মেঘের ছায়া। নিশি-দ্যুতি সকালে ঘুরে আসা খ্রিস্টান মিশনে তোলা ছবি আপলোডে ব্যস্ত ফেসবুকে। ওদের বলে বোঝানোর চেষ্টা বৃথা। একান্ত নিজস্ব সমস্যাগুলো নিজের কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, অন্যের কাছে তা কখনওই হয় না। মোনা লক্ষ্য করে মাথা নীচু করে অপরাধীর মতো বসে আসে সমীর। ভিতরে কাঁটা বিঁধতে থাকে মোনার, যতটা না সমীরের জন্য তার চেয়ে বেশি প্রসঙ্গটার জন্য। আচ্ছা এই যে কথা-পাল্টা কথা, যার কিছুই এখান থেকে শোনা যাচ্ছে না, ওখানে কী ঘুরে ফিরে মোনার প্যান্টি হারানোর বিব্রতকর প্রসঙ্গটি আসছে? হয়তো না। কিন্তু এই হঠাৎ করে পাল্টে যাওয়া পরিবেশের পিছনে এই বিব্রতকর প্রসঙ্গটাই রয়েছে তা তো সবাই জেনে গেছে এর মধ্যে নিশ্চয়ই। কী লজ্জা!
‘রাজলক্ষ্মী’তে এরপর কাটানো দিনগুলো বড় নিরানন্দ বিষন্ন-প্রাণহীন-অসহ্য ঠেকে মোনার। বিদায় নেয়ার সময় কেউ বাইরে আসে না বৌদি ছাড়া। বিষণ্ণ মুখে গেট পর্যন্ত আসতে আসতে সে রেকর্ড বাজিয়ে চলে কেমন বনেদী বংশ তার শ্বশুরবাড়ির, পুরুষের পর পুরুষ ধরে কি করে এই বংশমর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষা করে চলছেন তারা। এই বংশের কোন এক মেয়ে শুদ্র বিয়ে করেছিল বলে তার শ্রাদ্ধ করে মানুষ খাইয়েছেন মেয়ের বাবা। এই মুহূর্তে এসব গল্প বলার মানে বোঝে মোনা। স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে সমীরের সদা উচ্ছ্বল চেহারাটার স্তব্ধ হয়ে যাওয়াটা অচেনা লাগে মোনার। মনে মনে আকাশপাতাল হিসাব মেলায়, একটা মুসলিম মেয়েকে বাড়ির বউ করে ঘরে তুললে কতটা অস্তিত্বের সংকটে মুষড়ে পড়বে পরিবারটি, কতটাই বা ভেঙ্গে পড়বে লোকলজ্জার ভয়ে। সংস্কারের যতটা গভীরে তাদের শিকড় প্রোথিত সেখান থেকেই উঠে আসা চারাগাছ সমীর। যত অযৌক্তিক গোঁড়ামিই হোক না কেন, কতটা বিচ্ছিন্ন করা যাবে সমীরকে এর থেকে? করাটা কী উচিত হবে? স্বজন-পরিজন-উৎসব-সম্মিলনের আনন্দ না থাকলে শুধু একটি মানুষকে নিয়ে বিয়ে নামের সামাজিক প্রথায় বন্দী হবারই বা দরকার কী? মানুষ কতদিন ‘ভালোবাসার মোহে’ ডুবে থাকতে পারে, জৈবিকতা যার অন্তরালের সত্য? ভিতরে সমীরের জন্য মোহ-আবেগ, আর খুব কাছ থেকে দেখা সংস্কৃতির দ্বন্দ্বে বিপন্ন বোধ করে মোনা। সমীরের হাতে হাত রাখে, সমীর অন্য হাতে ঢেকে দেয় মোনার হাতটি, বলে– জানো মা কাল রাতে আমার পায়ে ধরে কেঁদেছে, বলেছে আমি যেন আমাদের সাজানো সংসারটা ধ্বংস না করে দেই। মোনা চুপ করে থাকে, সমীরের জল ছলছল চোখে মোহ-আবেগ আর বিপন্নতার ছায়া স্পষ্ট পড়া যায়। একটা বিব্রতকর প্রসঙ্গ কেমন রাতারাতি নগ্ন করে দিয়েছে পুরো বাস্তবতা, উন্মোচন করে দিয়েছে সত্যের রূঢ়তা। সেগুনবাগিচার শিল্পকলায় নাটক দেখতে দেখতে আর আজিজ সুপার মার্কেটে লুচি খেতে খেতে যা মোটেই আঁচ করতে পারেনি মোনা, কোনদিন পারতও না।
সবাই চলে গেলে এক নিস্তব্ধ নীরবতা নামে পুরো ‘রাজলক্ষ্মী’ জুড়ে। হঠাৎ টর্নেডোর আঘাতে যেন বিপর্যস্ত জনপদ। রাজলক্ষ্মী দেবী একা একা হাঁটেন এঘর সেঘর। একটু আগেই গেস্ট রুমটা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। ঘরে ঢুকে পার্বতীকে দেখেন তিনি, পিছন ফিরে বসে কী যেন দেখছে– কী অটা রে তর হাতে? দেখা, দেখা আমারে– রাজলক্ষ্মী দেবীর কণ্ঠে চেনা ক্রোধ। পার্বতী জানে, ওর টুকটাক হাতটানের অভ্যাসটা আর সবাই সহ্য করে নিলেও রাজলক্ষ্মী দেবী একদম সহ্য করতে পারেন না। পার্বতী যতই লুকানোর চেষ্টা করে, ঠিক ধরে ফেলেন রাজলক্ষ্মী দেবী– এইটা, এইটা তুই চুরি করছস? মাগী, কত্তো বড় কইলজা তর। ক্রোধান্ধ রাজলক্ষ্মী দেবীর মুখ নিঃসৃত হয়ে বের হয়ে যায় দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অশালীন গালিটি। অসহায় কাঁদতে থাকে পার্বতী। আজ আর রক্ষা নাই। বাঁচার জন্য বলতে থাকে আকুল স্বরে– দিদিমা গো সেইবার ভোটের পরে নমশুদ্র পাড়ার নিয়তি সহ দুই-দুইটা মাইয়ারে ধইরা লইয়া গেলে মায় বাপের লুঙ্গি ছিড়া পায়জামা নীচে পেঁচাইয়া পাটক্ষেতে লুকাইয়া রাখছে গো দিদিমা। আবার ভোট হইলে এইডা পইরা লুকামু গো দিদিমা...।
"নির্বাচিত গল্পপাঠ" থেকে