১
সাত সকালেই কথাটা রটে যায় ক্রমে, বাতাসের বেগে, হালকা চালে পাতা নড়ার বাতাসে নয়, তীব্র ঘূর্ণির বাতাসে। ইতিপূর্বের অভিজ্ঞতাসমূহ সাক্ষী দেয় যতোবার এই ঘূর্ণির বাতাস ছড়িয়েছে রটনা, আসন্ন ঘটনার, ততোবার কিছু ঘটেছে ঠিক ঠিক এবং কখনোই তা হয়ে উঠেনি সুখবর স্মৃতি কোনো গাঁয়ের আবাল-বৃদ্ধ-কারো কাছে । পরম্পরাক্রমে জীবিত সাক্ষীগণ, বয়স যাদের আশি তাদের সাথে আজ যুক্ত হয় আট বছর বয়েসের বালকেরাও। যখন শেষবারের মতো রটনাক্রমে রটে যায় গ্রামে।
ঘন্টাকয়েকের মধ্যেই জটলা জমে যায় মুদি দোকানে, রেলস্টেশনে, স্কুলঘরের কমনরুমে আর গৃহস্থ বাড়ির উঠোনে, তাদের সকলের রুটিন বাধা নৈমিত্তিকতার রঙ পাল্টে যায় চরম ও পরম উৎকণ্ঠায়। তারা ভীত হয়। তন্ন তন্ন করে খোঁজে নিকট অবশ্যম্ভাবী কোনো বিপদের উত্তপ্ত আঁচ। না পেয়ে তাদের উৎকণ্ঠা বাড়ে দ্বিগুণ। রূপ নেয় উদ্বিগ্নতায়, হাল ছাড়ে না, আলোচনায় মুগ্ন হয়, খোঁজে..., খোজেঁ... । জটলা-জটলা করে খোঁজে।
মুদি দোকানে জমে উঠা জটলাটা যুবক দলের, দিন শুরু হয় যাদের আলস্যে-অবসন্নতায় । কোনো তাড়া নেই কর্মব্যবস্ততায় হারাবার । আহ্নিক গতি-বার্ষিক গতির নিয়মের নিয়ত পরিবর্তনশীল দিন রাত বা ঋতু পরিবর্তন তাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনে না । মুদি দোকানের মাচাঙের বাঁধা কাঠের তক্তার উপর খাঁচার ভিতর নিরাপদে বসানো টিভিতে তারা সিনেমা দেখে আর অপেক্ষা করে আসন্ন ঈদ উৎবের পরপরই কারো দুবাই যাওয়ার ভিসা আসবে, কারো আসবে শহরের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে সেলসম্যানের চাকরি হওয়ার ডাক। কারো আসবে সরকরি চাকরির ইন্টারভিউ কার্ড, কারো ব্যাংক ঋণ অনুমোদনের খবর যা দিয়ে সে একখানা নতুন মুদির দোকানের গোড়াপত্তন করবে।
অপেক্ষার দিনগুলি তাদের খুব দীর্ঘ মনে হয় বেকারত্বের যন্ত্রণায় । সিনেমা দেখতে দেখতে তারা প্রতিদিন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ভুল ছিল না বিএনপির ভুল ইত্যাদি আলোচনার তাদের কাটানো অলস সময় বিভীষিকাময় হয়ে উঠে বাড়ি ফিরে আবিরত কাশতে থাকা তামুক টানা পিতা আর শ্বাসকষ্টে ধুঁকতে থাকা জন্মদাত্রীর অনাকাঙিক্ষত আপ্যায়নের ভয়ে । তবু ক্ষুধানিবৃত্তির দায়, যেতে হয়। আজ অবশ্য জীবনকে জাপটে ধরে রাখা সমস্যাগুলো ভুলে তারা যায় চরম উদ্বিগ্নতায় মগ্ন হয় রটে যাওয়া ঘটনাটির আলোচনায়...... ।
বৃদ্ধরা অক্লান্ত শ্রমে যুবক বয়েসে সাজানো সংসারের বর্তমান তাচ্ছিল্য হজম করে জটলা বাঁধে রেলস্টেশন জামে মসজিদের বাঁধানো ঘাটে। পুত্রদের অবহেলা , পুত্রবধূদের আড্ডার বিষণ্ন গল্পগুলোর সাথে যুক্ত হয় পবিত্র গ্রন্থের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্য-বিশ্লেষণ। যৌবনকাল রঙ্গে অতিবাহিত হওয়ার পর হতাশ তাদের জাপটে ধরে, তারা সান্ত্বনা পায় এক অসীম সুখের হাতছানিতে। এতএব তাদের সঞ্চয় দরকার। সেই কালে পাড়ি দেওয়ার পাথেয় সঞ্চয় । অনস্বীকার্য এই যে ক্রমে ক্রমে একঘেয়ে হয়ে উঠতে থাকে তাদের ঘর ছেড়ে বাইরে অতিক্রান্ত সময় আর দিনের সর্বশেষ আজান আর নামাজের পর ঘরে ফেরার অবসন্ন বেদনারা।
সম্মুখে আর কিছু নেই তাদের চক্ষু মেলে দেখার কিংবা বিস্মিত হওয়ার, বিস্ময়ের আনন্দে আবার জীবনকে ভালোবাসার । তারা হাঁটে চলে খায়, পবিত্র প্রার্থনালয়ে যায় উদ্দীপনাহীন নিয়মে। তবে আজ হঠাৎ আরেকবার অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাত্যয় ঘটে একঘেয়ে নিয়মে, তারা হিসাব করে প্রচণ্ড উদ্দীপনায় ঠিক কতো বছর পর আবার রটলো রটনাটি...।
প্রৌঢ় শিক্ষকেরা ছেলে ঠ্যাংগিয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফেরে ঠনঠনে পকেটে, পরবর্তী মাসের বেতনের টাকা বরাদ্দ না আসার দুঃসংবাদ সঙ্গী করে । তাদের বৌগুলো খিটখিট করে, ঘরে তেল ছিলে না তাই ডাল-খিচুড়ির অতিরিক্ত কিছু চাপানো যায়নি চুলায়। তারপর শুরু হয় নিত্য পাচাঁলি যে কী কুক্ষণেই ভাগ্য বিড়ম্বিত তারা বাধ্য হয়ে জীবন অতিবাহিত করছে এই অকর্মণ্য মাস্টারদের ঘরে । সেই ফাঁকে তাদের বাচ্চারা নাকের সিকনি ঘষে পরনের প্যান্টে। বউয়ের প্যাঁচপ্যঁচানিতে রোজা-রমজানের দিনে ইফতার রোচে না মুখে, তবু খেতে হয় গোগ্রাসে উদরপূর্তির দায়ে।
অতিক্রান্ত সন্ধ্যায় তারপর স্কুলের কমনরুমে যখন এটা-ওটা কাজের অজুহাতে আড্ডা বসে হেডস্যারকে মধ্যমণি রেখে, তখন সেখানে উহ্য থাকে অশান্তিময় সংসার থেকে ক্ষণিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ঈদের আগেই আসবে কি না বরাদ্দকৃত টাকা কিংবা রহমান বাড়ির মেয়েটা ঢাকায় পড়তে গিয়ে কেমন পাংকু হয়ে গ্রামে ফিরেছে কিংবা মিয়াবাড়ির উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেটা সীমান্ত পার হয়ে আসা ফেন্সিডিলের দালালÑ কী সুন্দর নামাজ কালাম ধরেছে মাশাল্লাহ। গ্রামে ঘরে ঘরে দ্বীনের বার্তা নিয়ে যায়। প্রতিদিন একঘেয়ে হতে থাকা সান্ধ্য আড্ডাগুলো আজ হঠাৎ ঝলসে উঠে রটনাটির নাড়ি নক্ষত্রের খোঁজে...।
আর গৃহস্থ বাড়ির বৌরা আজ জটলা জমায় বড় নিশ্চিন্তে। কারণ তারা জানে দিনমান পরিশ্রম করা বদমেজাজী স্বামীগুলো আজ সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে ইফতারে লবণহীন তরকারি পেলেও চ্যালাকাঠ হাতে তুলে নেবে না।
তারা নিকানো উঠোনে পা ছাড়িয়ে বসে, যেনো কতোকাল পরে মিলেছে অবকাশ নিশ্চিন্ত অবকাশের। তাদের আজ তাড়া নেই এনামুল মিয়ার বৌ পিটানোর গল্পটা অসমাপ্ত রেখে কিংবা আব্দুল হাইয়ের প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী ঘরে তোলার খেসারত দেওয়ার ইতিবৃত্ত অর্ধসমাপ্ত রেখে ফেরার। অপক্ক জ্ঞানে তারাও রটনা অনুযায়ী হন্যে হয়ে খোঁজে আসন্ন্ বিপদের পূর্বাভাস... ।
২
কে শুনেছে কিংবা কারা শুনেছে তার কোনো হদিস মেলে না । যেমন হদিস মেলে না মামা ফকিরের বয়সেরও। কেউ বলে শতকের ঘর পার করেছে সে সবে, কেউ বলে আরো বেশি । গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক বৃদ্ধের চাক্ষুষ সাক্ষ্যও কোনোভাবেই নামে না দুই অংকের ঘরে । কেননা বুঝ হওয়ার পরই সে দেখেছে একমাথা ভর্তি পাকা চুল নিয়ে মামা ফকির ঘুরছে গ্রামের এমাথা ওমাথা। তখন গ্রামের বুক চিরে চলে যাওয়া এই পিচ করা রাস্তা ছিলো না। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ক্ষীণ নদীটি ছিলো প্রমত্তা। নাইওরী নৌকা ভিড়তো, ভিড়তো হাটফেরত মানুষগুলোর নৌকা, ঘরে ঘরে কুপি-লন্ঠন জ্বলে উঠলে মামা ফকির হারিয়ে যেতো, আর কেউ তাকে খুঁজতো না।
আজো তার ব্যত্যয় হয় না রাত গভীর হতে থাকে, বন্ধ হয়ে যেতে থাকে একের পর এক দরজার ঝাঁপ। একটা ঝাঁপ পড়ার সাথে সাথে উঠানের উপর নির্বিবাদে শুয়ে থাকা আলোগুলো ঝাঁপ করে ডুবে যায় অন্ধকারে। তারপর মধ্যরাতে ঘরে ঘরে স্টার জলসা-জী বাংলার শেষ ফিসফিসানিটুকু থেমে গেলে, গাঁয়ের বুক চিরে জন্ম নেওয়া সদ্য পিচ করা রাস্তাটার সীমানা ঘেঁষে নিঃশব্দে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে নিয়ন আলোর দল। সোজা দৃষ্টি বরাবর দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যাওয়া রাস্তাটাকে তখন নদী বলে ভ্রম হয় । দূরে কোথাও একদল জোনাকী জ্বলে- নেভে। নিয়ন বাতির সাথে পাল্লা দিতে না পেরে তারা সরে যায় ফসলের মাঠ পেরিয়ে পরিত্যক্ত গম্বুজটির কাছাকাছি ।
আর গম্বুজের ভিতরে ভাঙা কাঠ , জংধরা লোহার পাতে পরতে পরতে জমানো কোথায় নিশ্চিন্তে ঘুমায় মামা ফকির। ঘুমাচ্ছে বছরের পর বছর । কাঁথাগুলো চেয়ে চিন্তে নিতে হয় না তার, গ্রামবাসী এমনিতেই দেয়, তার লাগুক না লাগুক হাত পেতে নেয় । শুধু কাঁথা নয়, গম্বুজের ভেতরে আজব সংসারে তার এভাবে জমে উঠে শার্টের উপরে শার্ট , প্যান্টের উপর প্যান্টের পাহাড়। কিন্তু তাকে পরনের পোশাক বদলাতে দেখা যায় কদাচিৎ, শেষ কবে দেখেছে কেউ স্মারণে আনতে পারে না ।
রাতে কেউ তাকে খুঁজে না বটে দিনভর তাকে নিয়ে টানাটানি চলে ঘরে ঘরে। মাঝে মাঝে তাকে ঘিরে ঘুরতে থাকা মিথগলো আরো উস্কে দিয়ে হারিয়ে যায় সে । কোথায় যায় সে কেউ নিশ্চিত জানে না, তবে তারপর দিনকয়েক মুদির দোকান রেলস্টেশন স্কুলঘর আর গৃহস্থের উঠোনগলো উচ্চকিত থাকে তুমুল তর্কে। কেউ বলে তাকে দেখা গেছে নিমতলির হাটে মাছের চাতালে বসে বিড়ি ফুঁকছে, কেউ বলে তাকে একই সময় গেছে দাউদনগরের মাদ্রাসা মাঠে একা একা দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে । অন্যার দেখা মিথ্যা প্রমাণে সকলেই তাকে টানটানি করে, অসীম জনতে চায়, কওছেনরে বা মামা ফকির, তুমি শুক্কুরবারে বিয়াইন্না কালা নিমতলির হাটঅ আছলায় না? মুখের প্রশ্ন কেড়ে নিয়ে জিয়াউদ্দিন জনতে চায়, না রে বা মামা ফকির, হাছা কইরা কাওছাইন তুমি দাউদনগরের মাদ্রাসার মাডঅ আছলায় না?
মামা ফকির কোন উত্তর দেয় না, কখনই না। কেবল বিড়বিড় করে। তুমুল উত্তেজনায় তর্ক-বিতর্ক শেষে, অবশেষে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের মতোই সিদ্ধান্তে স্থিত হয়, কোনো ভুল নেই যে মামা ফকির এক আলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী তিনি একক সময়ে দ্ইু স্থানে অবস্থান করতে সক্ষম। নিজের প্রতি সসম্মান সমীহে মামা ফকিরের কোন ভাবান্তর হয়, না সে বিড়বিড় করতেই থাকে। আর তাকে ঘিরে মানষের টানা-হেঁচড়া চলতেই থাকে।
নিশিকান্তর মা তাকে বসিয়ে গুড়-মুড়ি দেয়, জানতে চায়, কইনচাইন মামা ফকিরে নিশিকান্তর ইবার পুলা অইব না মাইয়া? আব্দুর গণির বউ কোরবানির মাংস আর চালের গুড়ির রুটি দেয়, জানতে চায়, মামা ফকির কইনচাইন বা শরীফ্যার ইবার দুবাই যাওন ডা নি অইব। কতগুলা টেকা দিছি দালালরে। মামা ফকির উত্তর দেয় না বিড় বিড়বিড় করে । নিশিকান্তর মা , আব্দুর গনির বউ কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে। ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় প্রচেষ্টা কিছুই বুঝা যায় না।
তবু নিশিকান্তর ছেলে হলে, শরিফের দুবাই যাওয়ার ভিসা হলে তারা এর সব কৃতিত্ব মামা ফকিরকেই দেয়। তাদের মায়েরা সাক্ষী দেয়, হ্যাঁ সেদিন গুড়-মুড়ি কিংবা মাংস-রুটি খেতে খেতে এমন ঘটবে বলেই বলেছিল মামা ফকির । বাকি সবাই সে কথা বিশ্বাস করবার জন্য মুখিয়ে থাকে । কেননা তাদের হতাশাময়, বিষাদ নিমজ্জিত নিস্তরঙ্গ জীবনে মামা ফকিরই একমাত্র আশার তরঙ্গ জাগাতে পারে।
৩
কবে থেকে মামা ফকিরের এই কেরামতি , গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক বৃদ্ধ মানুষটি জানান, যেদিন নোয়াখালিতে বাবুজি মহাত্মা গান্ধী আসেন আর মালগাড়ী কামরাভর্তি করে মরা মানুষ এনে ভৈরবের মেঘনা নদীতে ফেলে দেওয়ার খবর বাতাসে উড়তে উড়তে এই গ্রাম পর্যন্ত এসে পোঁছেছিল সেদিন কাকডাকা ভোরে মামা ফকির প্রথম আগুন আগুন! বলে চিৎকার করে। তার দৃষ্টি ছিল রায়বাড়ি বরাবর। গ্রামবাসী পরদিন ভোরে অবাক বিস্ময়ে দেখে রায়বাড়ির উত্তরাধিকার বাবু মহেন্দ্র নারায়ণ রায়, (এমএ ডিস্টিংশন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)-এর রক্তাক্ত দেহ তুলসিতলায় পড়ে আছে আর নাটমণ্ডপ সিন্দুক ভর্তি কাঁসার বাসন-কোসন, লক্ষনৌ থেকে আনা সেতার সব সুসজ্জিত রেখে তার পরিবারটি রাতের অন্ধকারে ভারত পালিয়েছে।
এরপর বেশ ক’টা বছর তারা ছেলেদের অসুস্থতায়, জমি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে মোকদ্দমায় কারো কাছে কোনো সৎ পরামর্শ পায়নি। যদিও রায়বাড়ির বসতভিটাটি খালি থাকেনি, তবুও বছর এর পর বছর গ্রামবাসী উদভ্রান্ত ঘুরে মরেছে অর্বাচীন সিন্ধান্ত আর ভুল বোঝাাবুঝির চোরাগলিতে ।
তখনই মামা ফকির একদিন তার নিয়মিত বিড়বিড় হঠাৎ থামিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল, ডরাইসনা ডরাইসনা বলে। আর আর সেদিনই ডাক্তার হয়ে গ্রামে প্রত্যাবর্তন করে করিম মৃধার বড় ছেলে শামিম মৃধা। হাটের ঠিক মাঝখানে চেম্বার খুলে বসে সে রোগীদের প্রেসার দেখে আর স্বায়ত্ত্বশাসন আর ছয়দফা বোঝায় । গ্রামবাসী বুঝুক না বুঝুক হাঁ করে শোনে। কারণ তারা টের পায় অসীম মমতার আধার এই করিম মৃধার বড় বেটা রায়বাবুর মতোই তাদের সুপরামর্শ ছাড়া কুপরামর্শ দেয় না। যতই অশিক্ষিত অপরিণত হোক তাদের বুদ্ধি তারা সেই বুদ্ধিতেই তফাৎ ঠিকই বুঝে, তাই তাকে আশ্রয় করে, ভরসা করে।
সত্তরের নির্বাচনে সবকটা ভোট তাকেই দেয় এবং এই আপাত ডামাডোলে তারা মামা ফকিরের কথা খানিক ভুলে গেলেও বছর না ঘুরতেই মামা ফকির আবার ডা. শামিম মৃধার চেম্বারের ঘরভর্তি মানুষের সামনে পুনরায় ‘মরণ মরণ’ বলে চিৎকার করে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। তার উচ্চকিত গলা বঙ্গবন্ধুর “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” বজ্রকণ্ঠের আহবান ছাপিয়ে ছড়িয়ে পুরো গ্রামে মুহুর্তে। গ্রামবাসী নড়ে চড়ে বসে।এপর্যন্ত তারা অবিশ্বাস করে নি মামা ফকিরকে। সন্দেহের তীর ছুটে ডাক্তারের পাণেই। আপাতত সেই সবচে সংকটে আছে তাঁর কৃতকর্মের জন্য। ভালো মানুষ ডাক্তারটাকে আগলে রাখতে চায়।
কিন্তু থানা সদরে ব্যাংক লুট হবার পরদিন একাত্তরের মে মাসে, টাকাভর্তি ব্রিফকেসসহ সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় পকিস্তানিদের গুলি খেয়ে মারা যায় ডাক্তার শামিম মৃধা । রাজাকার মছদ্দর আলীর নেতৃত্বে গ্রামের পর গ্রাম দাউ দাউ আগুনে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে থাকলে তারা আবার মামা ফকিরের শরণাপন্ন হয়। কয়েকদিন চুপ থাকে মামা ফকির।কেউ কিচ্ছু বলাতে পারে না।
তারপর একদিন নিজেই মামা ফকির বিড়বিড় ভুলে পুনরায় বলে ডরাইস না ডরাইস না । এবং এই অলৌকিক ভবিষ্যদ্বাণীতে মছদ্দর আলীর রাজাকার বাহিনী সে গ্রাম পর্যন্ত পোঁছানোর আগেই ভারতীয় বাহিনীর আকাশযান পৌঁছে যায় আকাশসীমায় । অতপর মামা ফকিরের প্রতি গ্রামবাসীর সমীহ আরো বেড়ে যায়।
অনেকগুলো বছর মামা ফকির আর মুখ খোলে না । পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টে বত্রিশ নম্বরে রক্তের বন্যা বয়ে গেলেও মামা ফকির মুখ খোলে না। দীর্ঘকাল গ্রামবাসী শোনে না তার উচ্চকিত কণ্ঠ । যদিও রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান আর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, হরতাল, পেট্রল, বোমা, গণজাগরণ মঞ্চ, ব্লগার হত্যা আর হেফাজতি তা-ব ইত্যাদি রক্তাক্ত মৃত গন্ধ বেয়ে বেয়েই স্বদেশ পার করতে থাকে তার বন্ধুর যাত্রাপথ তবুও যে মুখ খোলে না মামা ফকির , গ্রামবাসী বুঝে নেয় যতোই উত্তাল হোক অস্থির সময়ের হাত্তয়া মামু ফকির নিজ থেকে না বললে,কারো সাধ্য নেই কিছু বলায়।
কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছে আবার আজ সকালে । মামা ফকির পুনরায় অস্তগামী সূর্যের পানে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করেছে ‘সর্বনাশ, সর্বনাশ’ । সে চিৎকারে সব কাজ থমকে গেছে সংযম পালন করা গ্রামবাসীর। কিন্তু কে শুনেছে সবার আগে, কারা শুনেছে? যদিও তার কোন হদিস মেলে না তবুও ভীত-সন্ত্রস্ত আতঙ্কিত জনপদ তারপর থেকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ কোন্ দিক থেকে কোন্ লোহার বাসরের ছিদ্র বেয়ে আগুনের আঁচ লাগে গায়ে!
না পেয়ে কম্পিত বক্ষে ঘুমাতে যায় তারা । আর পরদিন ভোরে মুদি দোকানের টিভি স্কিন জুড়ে ভাসতে থাকা রক্তাক্ত গুলশান অভিযানের ছবিতে মিয়াবাড়ির ছেলেটির নিথর দেহ আবিস্কার আবার প্রবলভাবে জটলার মানুষগুলোকে মামা ফকিরের কেরামতিতে বিশ্বাসী করে। তারা দ্রুত বের হয় মামা ফকিরের খোঁজে। এপাড়া-সেপাড়া ঘুরে গম্বুজে, সেখানে কাঁথা শার্ট-প্যান্ট স্তুপীকৃত পরে আছে অসহায় নিরুত্তর। মামা ফকির উধাও।
তারপর অনেকগুলো দিন জেলা সদরে হাট করতে যাওয়া মানুষগুলো মামা ফকিরকে খোঁজে, থানা সদরের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাত্তয়া মানুষগুলো মামা ফকিরকে খোঁজে, পাশের গ্রামে আত্মীয়ের বাড়ী বেড়াতে যাওয়া মানুষগুলো মামা ফকিরকে খোঁজে ...। তার কাছে আরেকবার উত্তরণের একটা চিৎকার শোনা খুব জরুরী এখন। যদিও সে বলা না বলা তাঁর মর্জি।
কিন্তু এবার কেউ আর তাকে খুঁজেই পায় না।
গল্পটা ভালো লেগেছে। গল্পের বর্ণনাটা সুন্দর, এবং নিজস্ব।