সম্মিলনের কথা বলছো তো, আমার কাছে ওটা এমনভাবে আসে, যেন আলাদা কিছু নেই, সকল সম্প্রদায়ের মানুষই একে অন্যের মতো। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমার তোমার কাছে মিলনের ছবি এমনিভাবে এলেও, সকলের কাছে তো বিষয়টা এমন নয়, নাহলে আর 'তেরা নাম মহম্মদ' বলে বারংবার প্রহার করে একজন অপ্রকৃতিস্থ মানুষকে হত্যা করা যায়! এবং হত্যার পরে জানা যায় যে সে হন্তারকের স্বধর্মের মানুষ! একথা জানার পর কি সেই উন্মত্ত খুনী মান্টোর গল্পের চরিত্রের মতো বলে ওঠে,'চ্চু চ্চু মিসটেক হয়ে গেছে'?
ঠিক করেছি নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলব শুধু, গল্প সাহিত্যের দিকে যাবনা। আচ্ছা, স্বধর্মের মানুষ না হয়ে ভিনধর্মী হলে কি খুনটা বৈধ হতো? যেমনটা সেই নৈরাজ্যের সরকার মনে করছে, একটু সামান্য ভুল হয়ে গেছে শুধু, লোকটা মুসলমান হলে তো ঠিকই ছিল! তারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী অপরাধীকে বাঁচানোর!
না না দুঃখের, যন্ত্রণার কথা না বলে আনন্দের সাগরের তীরে যাওয়ার চেষ্টা করি, হলেই বা তা জোয়ার ভাটার সঙ্গে সঙ্গে লুকোচুরি খেলে, তবু সাগর তো, অসীম সম্ভাবনা তার!
যে কথা বলতে চাইছি তখন থেকে, প্রথম এমন মিলনের ছবি দেখেছিলাম আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। প্রায় না, ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে, এক মেঘাচ্ছন্ন বিকেলে আমার তরুণী পিসি ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে কাঁদছিলেন। ওঁদের সে ঘরে একলা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার তখন নিতান্ত শৈশব, দরজার বাইরে থেকে এমন দৃশ্য দেখে হতবাক হয়েছিলাম,কিন্তু বিষয়টা একেবারে বুঝতে পারিনি তা নয়। বয়েসের তুলনায় এঁচড়ে পক্ক ছিলাম, ক' বছর আগে বড়োদের গোপন আলোচনায় কান পেতে খবর পেয়েছিলাম, 'পিসি মুসলমান বিয়ে করেছে' এবং তা করেছে ঠাকুমার অমতে! সময়টা সাতষট্টি, আটষট্টি সাল হবে।
তখন আমরা এখনকার মতোই কলকাতায়, বাবা কলেজে পড়ার এবং চাকরির সূত্রে এখানকার পাকাপাকি বাসিন্দা, ঠাকুমা থাকেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লায়, পিসি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে এবং কর্মসূত্রে ঢাকায়।
বাবার এ বিষয়ে খুব আপত্তি কিছু ছিল না, থাকলেই বা শুনছে কে, আমাদের পরিবারের মেয়েরা ভয়ানক জেদী আর একগুঁয়ে, যাহোক বাড়িতে মা এবং মাতৃসমা প্রতিবেশিনীদের মধ্যে বেশ একটা সভয় উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম। উদ্বাস্তু অধ্যুষিত পাড়া, দেশভাগের আতঙ্কের স্মৃতি তখনও ফিকে হয়নি।
এরমধ্যে যুদ্ধ বাঁধলো একাত্তরে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার সংগ্রাম, বাংলার রূপ রস গন্ধকে আপ্রাণ বুকে জড়িয়ে রাখার আমরণ লড়াই। কত দামাল ছেলে, মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ দেশী অস্ত্র নিয়ে সংগ্রামে নামলো এক নৃশংস রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যার পেছনে আবার আর এক যুদ্ধব্যবসায়ী বৃহৎ রাষ্ট্রের শক্তি! কত মুসলমান তরুণের বুক এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল তাদের স্বধর্মীয় সৈন্যদলের বেয়নেটে! তখন আকাশে যুদ্ধবিমান, ব্ল্যাক আউট,সাইরেনের আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে রেডিওতে বাজতো গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা গান, 'শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি..'! কন্ঠ ও সুর অংশুমান রায়ের।
সেও এক সম্মিলন!
কিন্তু যুদ্ধ বাঁধবার পর ওদেশের মানুষের প্রাণ হয়ে উঠল একেবারে মূল্যহীন, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্নকরণ ছিল পাক সেনাদের একেবারে প্রারম্ভিক কর্তব্যের তালিকায়। বহুদিন ঠাকুমার কোনও খবর না পেয়ে বাবা ছুটলেন পাগলের মতো সেদেশে। ত্রিপুরার বর্ডার দিয়ে ঢুকে আটক হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে, গুপ্তচর সন্দেহে। তবে সৌভাগ্যক্রমে কুমিল্লার এক মুসলমান সেনা অফিসার বাবার পিতৃপরিচয় জেনে (প্রয়াত পিতামহ ছিলেন কুমিল্লা কলেজের বাংলার বিভাগীয় প্রধান, ঘটনাচক্রে সেই অফিসার তাঁর প্রাক্তন ছাত্র) তাঁর মুক্তির উপায় করলেন। ইতোমধ্যে ঠাকুমাও পৌঁছে গেলেন আগরতলায়, প্রায় নিরাপদেই, কারণ তিনিও কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালার মেয়েদের বিভাগের প্রধানা শিক্ষয়িত্রী, 'সুধা মাসিমার' ছাত্রীসংখ্যাও গোটা দেশে কিছু কম ছিল না।
ঠাকুমা এলেন, কিন্তু পিসিদের কোনও খবর নেই। বাবা মাঝেমাঝেই দেখেন,অবাধ্য, ত্যাজ্য কন্যার জন্য দুশ্চিন্তায় সবার অগোচরে চোখের জল ফেলেন ঠাকুমা। তখন যুদ্ধের পরিস্থিতি আরো ঘোরালো হয়ে উঠেছে। আমেরিকা পাকিস্তানকে প্রায় প্রত্যক্ষ মদত দেবার জায়গায় চলে এসেছে। বাবার কাছে কানাঘুষোয় খবর এসেছিল, ঢাকায় পাক সেনা দেশের যেসব বিশিষ্ট নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, তাঁদের মধ্যে পিসি আর পিসেমশাইও.....
কিন্তু এরই মধ্যে একদিন এক বিকেলে আমাদের বাড়ির গেটের সামনে মেঘচেরা সাদা আলোর মতো একট গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামল পিসি, কোলে আমাদের ছোট্ট একটি বোন, পাশে বড় বড় চোখের, অপলক দৃষ্টির, তিন বছর বয়েসী আমাদের ভাই।
তারপরই সেই পূর্বোল্লিখিত দৃশ্যের অবতারণা, ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদছে পিসি, ঠাকুমার মুখে এতদিনের অভিমান, উৎকণ্ঠা, যন্ত্রণা পেরিয়ে নিশ্চিন্তি ও আনন্দের এক অভাবনীয় মিশেল! সদ্য আগত ভাইবোনগুলো দেখলাম আমার ছোট বোনেদের মতোই, একইরকম, কোনও তফাত নেই। আরো অবাক হলাম পিসেমশাইকে দেখে, তাঁর সুদর্শন চেহারায়, মধুর সম্ভাষণে ভয়াবহ কিছু তো নেইই, বরং সকলের কাছেই, এমনকি ঠাকুমার কাছেও তিনি খুব সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেন। তবে একটা ব্যাপার ছিল। পিসিদের বাংলা নম্বর লেখা সাদা ফোর্ড কন্টিনা গাড়ির ডিকিতে ছিল পা বাঁধা এক ঝাঁক মুরগি, পিসেমশাই রোজ সকালে তাদের একটাকে নিজের হাতে জবাই করতেন, সে দৃশ্য চোখ মেলে দেখতে পারতাম না । ঠিক যেমন ইসমত চুগতাইয়ের গল্পের হিন্দু বালক পুষ্কর তার প্রতিবেশী মুসলমান বালিকা বিবিকে প্রশ্ন করেছিল, 'তোর বাবা এত পাঁঠা মারেন কেন'- তেমনি ব্যথিত বিস্ময় নিয়েই আমরা মনে মনে ভাবতাম, রোজ এত মুরগি মারবার প্রয়োজন কী!
দেখো, না চাইতেও আবার ফিরে এলাম সাহিত্যে, কী আর করা, জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এরাও যে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে! যাহোক মুরগির ব্যাপারটা এখন বুঝি, খাদ্যাভ্যাস! আপামর বাঙালির মাছ খাওয়া নিয়ে কি নিরামিষাশী অন্য প্রদেশের মানুষের মনে প্রশ্ন নেই! কিন্তু আসল কথা হল, ছোটবেলার সেই অভিজ্ঞতার পর থেকে আমার মনে সব মানুষের একটা বিভেদহীন ছবি গেঁথে গেছে, যা আজও দূর হয়নি।
আর একবার আগ্রা শহরে গালিবের জন্মস্থানের খোঁজে গিয়েছি। জায়গাটার নাম গালিবপুরা, মুসলমান মহল্লা। আগ্রা হোটেলের মালিক সাবধান করে দিয়েছিলেন জায়গাটা সম্পর্কে, কিন্তু গিয়ে দেখি একেবারে অন্য চিত্র। অতিথি আপ্যায়নের জন্য কী আন্তরিক আয়োজন! গালিবের সন্ধানে এসেছি শুনে মহল্লার দানিশমন্দ অর্থাৎ জ্ঞানী মানুষজন উপস্থিত হলেন। গালিবের অনেক কথা জানা হল। তার চেয়েও বড় কথা, তাঁরা বৃজেন সিং সয়াল নামে এক পন্ডিত মানুষের সন্ধান দিলেন, যাঁর মধ্যে নাকি গালিবের রুহ্ বা আত্মা বসবাস করে। তিনি পাথরে, গাছের পাতায়, প্রকৃতির বিচিত্র সম্ভারে গালিবের কবিতা খুঁজে পান। এ নিতান্ত গল্পকথা নয়, সাহিত্য আকাদেমি র সচিত্র সকাব্য একটি অতি মহার্ঘ গ্রন্থ রয়েছে শ্রী সয়ালের সৃষ্টি নিয়ে, কলকাতা বইমেলায় সে বইয়ের পরশ পেয়েছি আমি নিজে।
গালিবপুরার বুদ্ধিজীবীদের সনির্বন্ধ অনুরোধ অনুসারে দিল্লিতে এসে সয়াল সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। সেই অশীতিপর ভদ্রলোক আলাপকালে আমাকে নির্দ্বিধায় সহাস্যে জানালেন, 'Ghalib was a scoundrel, yet he is irresistible!'
গালিবপুরার মুসলমান অধিবাসীদের, দিল্লির হিন্দু পাঞ্জাবী বৃজেন সিং সয়ালকে এবং আমাকেও, সেদিন একসূত্রে গেঁথেছিলেন গালিব, সে কি বড় কম সম্মিলন!
আর একটি মিলনকাহিনীও আমার গোচরে আছে, অভয় দিলে বলি। সেবার লখনৌ থেকে ফিরছি, পুজোর সময়, কামরায় প্রচন্ড ভিড়। আমাদের এক পরিচিতের ওপরে দায়িত্ব ছিল টিকিটের, সে সেগুলির কনফার্মেশন না করেই আমাদের হাতে গুঁজে দিয়ে শেষ মুহূর্তে গা ঢাকা দিয়েছে। অথচ ফিরতেই হবে, উপায় নেই।
অমৃতসর মেইল এর টিকিট পরীক্ষক মহবুব আলম, সহৃদয় হয়ে ব্যবস্থা করে দিলেন সকলের কোনোরকমে। দিলীপ কুমারের মতোই সুদর্শন, অমায়িক, মধুর লখনৌয়ি জবানের অধিকারী মহবুবের মুখে একটি গল্প শুনেছিলাম সেদিন। শোনাই।
মহবুব বলছিলেন, 'বাঙালীদের আমার খুব ভালো লাগে। আমার এক সহকর্মী ছিল বাঙালী। তার নাম ছিল সীমা।' মহবুবকে গল্প বলবার সময় অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। সত্যি বলতে কি, আমাদের দলের মধ্যে মহবুবের কথা একমাত্র আমিই হাঁ করে গিলছিলাম, সবে তখন ভাষাটা শিখছি, গল্প শোনার সঙ্গে লখনৌ এর খালিস অর্থাৎ প্রকৃত উর্দু শুনতে পেয়ে কানদুটো জুড়িয়ে যাচ্ছিল।
'সীমা ছিল প্রবাসী , বাংলা হিন্দি দুটোই সমান আসানির সঙ্গে বলতে পারত। লখনৌ এ আমরা রেলের এক অফিসেই ছিলাম। আমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে একটা ভালো লাগা তৈরী হয়েছিল। একবার সীমা একটা ট্রেনিং এ গেল কাছাকাছিই একটা সুন্দর শহরে। কয়েকদিনের ট্রেনিং, দুদিন পর আমায় ডেকে পাঠালো সেখানে। আমি জরুরী ছুটি নিয়ে গেলাম। দুদিন রইলাম।' মহবুবের চোখে কোন বিস্মৃত সময়ের মধুর স্মৃতি ভেসে এল।
মোগলসরাই স্টেশন চলে এল। মহবুব উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর ডিউটি এখানেই শেষ। আমি মরীয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনাদের শাদি হলনা কেন?'
মহবুব বললেন, 'আমি বিবাহিত ছিলাম। দুটো বাচ্চাও তখন জন্মে গিয়েছে। ও ওদের ভালোবাসতো। তাই ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেল দূরে। পরে খবর পেয়েছিলাম বিয়ে করেছে।'
মোগলসরাই স্টেশনের লম্বা প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মহবুব। তাঁকে হঠাৎ খুব নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছিল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিল। আমার কানে বাজছিল ফয়েজের কবিতা -
দোনোঁ জহাঁ তেরী মুহব্বত মে হারকে
উয়ো যা রহা হ্যায় কোই
শব এ গম গুজারকে ......
হারিয়ে ফেলে দুই পৃথিবীই
তোমার প্রেমে
দুখের রাতের শেষে
ওই যে চলেছে সে.....
তাই বলছিলাম, সম্মিলনের অর্থ আমার কাছে অন্যরকম।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত কবিতাকেও এড়ানো গেল না, কী আর করা, এও যে এক মহান সম্মিলন!