২১ অগাস্ট ছিল উর্দু সাহিত্যিক কুররাতুলায়েন হায়দারের প্রয়াণদিবস। সেই উপলক্ষেই এ সপ্তাহে এই বিভাগে রইল তাঁর সাহিত্য নিয়ে দুটি লেখা। একটি লিখছেন সঞ্চারী সেন, অন্যটি দময়ন্তী।
কুররাতুলায়েন হায়দার। স্বাধীনতা-পরবর্তী জমানায় উর্দু সাহিত্যের বহুধাপ্রবাহিত আধুনিক ধারার একটি বিশেষ স্রোতের অন্যতম পথিকৃৎ—যা প্রবাহিত মূলত মনের বিচিত্র উপত্যকা দিয়ে। বহুবর্ণময় তাঁর সাহিত্যের চরিত্রগুলি—এদেশের, বিদেশের, নানা জাতের, নানা শ্রেণির, নানা ভাষার। তেমনই কথাসাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় ছিল তাঁর অবাধ গতায়াত— উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাটক, ভ্রমণকহিনি। সমসাময়িক অন্যান্য উর্দু সাহিত্যিকের থেকে তাঁর দরিয়ার প্রবাহ ভিন্নতর। আলোচনায় লেখক ও উর্দু থেকে বাংলা ভাষায় সাহিত্য-তরজমাকার সঞ্চারী সেন।
কুররাতুলায়েন হায়দার (২০ জানুয়ারি, ১৯২৭—২১ অগাস্ট, ২০০৭)
পমপম ডার্লিং! জেনে অনেকেরই চোখ কপালে উঠবে, ঠিক এইভাবেই আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম স্রষ্টা মোহতরমা কুররাতুলায়েন হায়দারকে একটি নিবন্ধে সম্বোধন করেছিলেন তাঁর কিছুকাল আগের আর-এক অসাধারণ সাহিত্যস্রষ্টা ইসমত চুগতাই! দুই মহান স্রষ্টার পারস্পরিক কোপের কেচ্ছা-কাহিনি দিয়ে তাঁদের বিষয়ে লেখা শুরু করা কদাচ আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু কুররাতুলায়েন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে হলে তাঁর প্রেক্ষিতটা বোঝা জরুরি, আর সেখানেই চুগতাইয়ের এই মন্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা, কারণ এ সম্বোধন করেই তিনি নবীনাকে ভারী গুরুত্বপূর্ণ একটা উপদেশ দিয়েছিলেন—তুমি পারসিক গালিচার বিলাস ছেড়ে পৃথিবীর মাটিতে নেমে এসে দ্যাখো আসল জীবন বলতে ঠিক কী বোঝায়!
কুররাতুলায়েনও যে এই সমালোচনা একেবারে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছিলেন এমনটা নয়। কারণ এক, তিনি নিজস্ব সাহিত্য-অঞ্চল থেকে সরে আসেননি এবং দুই, কোনো একসময়ে ইসমতের দুর্দমনীয় মনোভাবের কারণে তাঁকে ‘লেডি চেঙ্গিজ় খাঁ’ বলে আখ্যায়িতও করেছেন।
এই কাহিনির একটি পূর্ব-ইতিহাস রয়েছে। সে প্রেক্ষাপটে এই আলোচনার শুরুতেই একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করা ভালো। ১৯৩২ সালে ‘অঙ্গারে’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল লখনউ শহর থেকে। এই গ্রন্থে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদী কিছু গল্প এবং একটি নাটক প্রকাশিত হয়েছিল। ডক্টর রশিদ জাহাঁ সেই সময়ের এক নবীন মহিলা চিকিৎসক, তিনিও তাঁর একটি গল্প এবং আর-একটি নাটকে এই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল ধিক্কার জানিয়েছিলেন। বইটি সেসময়ে এমন অভিঘাত হেনেছিল যে সেটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল এমনকি সেটিকে বাজেয়াপ্ত করার দাবিও উঠেছিল সেসময়ে, এবং এতটাই তীব্র ছিল সেই দাবি যে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার শেষপর্যন্ত সেই বইটি বাজেয়াপ্ত করেন। এমনকি সেইসময় এই বইটির লেখকদের বিরুদ্ধে ফতোয়াও জারি করা হয়েছিল মৌলবাদীদের তরফে।
এর ফলে বেশ কিছুদিন এমন প্রচেষ্টা বন্ধ থাকলেও তারপরে আবার ক্রমশ আধুনিক সাহিত্যের প্রভাব আমাদের দেশের সাহিত্যক্ষেত্রে নতুন করে এসে পড়বার পরে, মূলত কৃষণচন্দর, রাজিন্দর সিং বেদী, ইসমত চুগতাই এবং সাদাত হাসান মান্টো—উর্দু ছোটোগল্পের এই চার দিকপালের নেতৃত্বে—নেতৃত্বে এই কারণে বলছি যে তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজস্ব শৈলীতে লিখলেও, তাঁদের গল্পের বিষয়বস্তু প্রভাবিত করেছে আরও অসংখ্য রচনাকারকে—এক প্রগতিশীল গল্পলেখনের জোয়ার শুরু হল। এই সমাজের দরিদ্র, দলিত, নিঃস্ব মানুষের বিষয়ে অকথিত কথাগুলি সোচ্চারে বলবার একটা প্রবণতা দেখা দিল। এবং সেটি যে কত প্রার্থিত ছিল তা প্রগতি লেখক সংঘের জনপ্রিয়তা থেকে সহজেই বোঝা গেল।
কুররাতুলায়েন হায়দার এই উত্তাল জোয়ারের একটু পরবর্তী সময়ের এবং ভিন্নতর ক্ষেত্রের সাহিত্যিক। সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁর অবস্থান কিছুটা অন্যতর। একটি অত্যন্ত আধুনিক, স্বতন্ত্র এবং অভিজাত পরিবারে বড়ো হওয়ার কারণে—তাঁর পারিবারিক পরিচয় বিষয়ে পরে আসছি—তিনি মূলত ব্যক্তিমানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। অস্যার্থ, উর্দু সাহিত্যের আধুনিকতার একাধিক ধারা তৈরি হচ্ছিল।
দেশভাগের পর তিনি স্বেচ্ছায় নিজের পরিবারের সঙ্গে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন, এসম্পর্কে প্রত্যক্ষত কোনো বিক্ষোভ বা যন্ত্রণা তাঁর মধ্যে ছিল না এবং দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর উপন্যাস ‘আগ কা দরিয়া’-তে তিনি এক আবহমান কালের সন্ধান সম্পর্কে লিখেছেন, যে খোঁজ মানুষের নিজস্ব অস্তিত্ব সম্পর্কে খোঁজ, যে জিজ্ঞাসা আজও সমধিক বাস্তব। যুগ যুগান্ত ধরে অর্থনৈতিক ভাবে সুবিধাজনক জায়গায় থাকা মানুষ এবং কখনও বা সেসম্পর্কে উদাসীন মানুষ, সমাজ, অর্থনীতি নিরপেক্ষেতার নিজের সত্তাকে খুঁজেই চলেছে। এখানেই সেকালের অনেক রচনাকারের সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির এক বিরাট ফারাক হয়ে যায়। অবশ্য ১৯৪৭ সালে কুররাতুলায়েনের বয়স ছিল মাত্র কুড়ি, কাজেই মায়ের সঙ্গে দেশত্যাগ করে যাওয়ার সময় তাঁর পরিণতমনস্কতা বা নিজস্ব চিন্তার স্বাধীনতা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নিগড়ে যখন হাঁপিয়ে উঠেছিল তাঁর মন, ততদিনে অবশ্য তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বকীয়তা সম্পূর্ণরূপে তাঁর সাহিত্যের উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল।
পারিবারিক ভাবে কুররাতুলায়েন এক আশ্চর্য সৌভাগ্যের অধিকারিণী ছিলেন। জন্মেছিলেন আলিগড়ে, ১৯২৭-এর ২০ জানুয়ারি। পিতা সৈয়দ সাজ্জাদ হায়দার ইয়ালদরিম একজন সিভিল সার্ভেন্ট ছিলেন, কিন্তু তারচেয়েও বড়ো পরিচয় ছিল যে তিনি উর্দু ছোটোগল্পের লেখক ছিলেন, অর্থাৎ প্রথম ছোটোগল্প-লিখিয়েদের অন্যতম ছিলেন তিনি। নারীশিক্ষা নিয়েও যথেষ্টই উৎসাহী ছিলেন এবং স্ত্রীর সঙ্গে মিলে তাঁদের কন্যার বিদ্যারম্ভের আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
কুররাতুলায়েনের মাতৃগত উত্তরাধিকারও ছিল অসাধারণ। তাঁর মা নজ়র সাজ্জাদ হায়দার ছিলেন একজন নজরকাড়া ঔপন্যাসিক, গল্পলেখিকা এবং প্রথম যে ইসলাম ধর্মীয়া নারীরা এ দেশে অবরোধ ভেঙে বাইরে এসেছিলেন, নজ়র ছিলেন তাঁদের অন্যতমা। তাঁর গুরুস্থানীয়া মহম্মদি বেগমও ছিলেন সাহিত্যগুণসম্পন্না আর-এক নারী, অর্থাৎ পিতার দিক থেকে তো বটেই মায়ের দিক থেকেও কুররাতুলায়েন এক অসাধারণ সাহিত্যিক উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন । ফলে মাত্র এগারো বছর বয়সেই প্রথম গল্প ‘বিচুহিয়া’ (ইঁদুরকন্যা)-র প্রকাশ, ‘ফুল’ নামের শিশুপত্রিকায়, যার সম্পাদক ছিলেন সাজ্জাদ হায়দার নিজেই। এবং কৈশোরেই আরও একটি সাহিত্যসৃষ্টি—‘সিতারোঁ সে আগে’ (তারাদের ছাড়িয়ে)।
কুররাতুলায়েন-এর পড়াশোনার দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ কলেজ, তারপর লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তী কালে অধ্যাপনা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে, যার মধ্যে রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া, শিকাগো, আরিজোনা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতবর্ষের আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির উর্দু বিভাগও।
কুররাতুলায়েনের পেশা ও লেখালিখিতেও ছিল বৈচিত্র্য। তিনি সাংবাদিকতা করেছেন, সাংবাদিকতা করার পাশাপাশিই ছোটোগল্প লিখেছেন। ইংরেজি ও উর্দুর পারস্পরিক অনুবাদ করেছেন, লিখেছেন উপন্যাস, উপন্যাসিকা, ভ্রমণকাহিনি। ‘ইমপ্রিন্ট’ পত্রিকার (মুম্বাইয়ের) ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’ নামের সেসময়ের দারুণ জনপ্রিয় পত্রিকার এডিটোরিয়াল বোর্ডের সদস্য ছিলেন এবং এমনকি পাকিস্তানে থাকাকালীন একটি তথ্যচিত্রও বানিয়েছিলেন।
১৯৫৯ সালে লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘আগ কা দরিয়া’, যার ইংরেজি অনুবাদ তিনি নিজেই করেছিলেন—River of Fire—সেখানে একজায়গায় তাঁর উপন্যাসের একটি চরিত্র সম্পর্কে লিখছেন—‘The human who found himself in god and who was himself a god…’ এমন চিন্তার যে তৎকালীন পাকিস্তানে কিছু লোকের চক্ষুশূল হবে তাতে আর আশ্চর্য কী! সুতরাং কিছু পত্রপত্রিকায় সমালোচনা শুরু হল এবং কিমাশ্চর্যম্, একটি কাগজে এই মর্মে লেখা হল যে, কমিউনিস্ট রশিদ জাহাঁ কুররাতুলায়েনের নিকটাত্মীয়া, এবং সম্ভবত একথার অর্থ হল এই যে এই আত্মীয়তাই তাঁর এই প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস-বিরোধী উপন্যাসের জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ পঁচিশ বছরেরও আগে প্রকাশিত একটি প্রতিবাদী গ্রন্থ—অঙ্গারে—তখনও তাড়া করে ফিরছিল মৌলবাদীদের এবং সমস্ত বৈপ্লবিক কাজের পেছনেই রয়েছেন কমিউনিস্টরা, এমন ধারণা চিরকালের মতোই বলবৎ ছিল।
যাহোক, এমন আলোচনা এবং প্রতি-আলোচনা কুররাতুলায়েনের আত্মসম্মানকে যথেষ্টই আহত করল, এবং মায়ের চিকিৎসার কারণে ১৯৬০ সালে ইংল্যান্ড চলে গিয়ে, সেখান থেকে ফিরলেন পাকিস্তানে নয়, ভারতে। এদেশ অবশ্য তার এই প্রত্যাবর্তিতা কন্যাটিকে সাদরে গ্রহণ করেছিল এবং বহুবিধ পুরস্কারে ভূষিত করতে কুণ্ঠিত হয়নি। সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (গল্পগ্রন্থ ‘পতঝর কি আওয়াজ়’-এর জন্য), জ্ঞানপীঠ (‘আখির-এ-শব কে হমসফর-এর জন্য) এবং ২০০৫ সালে পদ্মভূষণ, তারই প্রমাণ। উদারমনা এই সাহিত্যিক ততদিনে আইনি আপা বা আইনিদিদি (আইনি কুররাতুলায়েনের ডাকনাম) আখ্যায়িত হয়ে পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।
প্রসঙ্গক্রমে ১৯৫৮-৫৯ সালে লেখা কুররাতুলায়েনের ‘জিলাবতন’ (নির্বাসিত) উপন্যাসের একটি অংশ উদ্ধৃত করলে হিন্দু-মুসলমান মিলিত সমাজ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে—“হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সামাজিক ভাবে তেমন কোনো ফারাক ছিল না। বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে । মহিলারা বেশির ভাগ শাড়ি পরতেন... অবিবাহিত মেয়েরা, কি হিন্দু কি মুসলমান, শাড়ি ছাড়া পাজামাও পরত, হিন্দুরা যাকে বলত ইজার। ভাষা এবং প্রবাদ একই ছিল। মুসলমান বাচ্চারা টিন পিটিয়ে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনায় চিৎকার করে গাইত, ‘বরসো রাম-ধড়াকেসে, বুঢ়িয়া মর গয়ি ফাকেসে’, (লক্ষ করুন প্রবল বা অঝোর ধারায় বোঝাতে বলা হচ্ছে ‘রাম-ধড়াকেসে’, বুড়িটা যে মারা গেল অনটনে)। পুতুলের বিয়ের বরযাত্রী বেরোনোর সময় ওয়াজিফা (ইসলামি শুভকামনা) করা হত। যেসব মুসলমান পর্দানশিন নারীরা জীবনে কোনো হিন্দুর সাথে কথা বলেনি, রাত্রিবেলা ঢোলক নিয়ে বসে তারাও গাইত... ‘আমার ভরা গাগরি মাটিতে গড়িয়ে দিল শাম।’ কৃষ্ণের এমন ছবি তাদের ইসলামি ধ্যানধারণার সঙ্গে কোনো বিরোধ ঘটাত না। বরং এই গান, কাজরি, খেয়াল, জনপ্রিয় প্রবাদবাক্য, এই ভাষা, এদের সকলের কাছে বড়ো প্রিয় ঐতিহ্য বলে গণ্য হত।... ’
কুররাতুলায়েনের প্রখ্যাততম উপন্যাস ‘আগ কা দরিয়া’, যার কাহিনির সময়কাল পূর্বসাধারণাব্দ চতুর্থ শতক থেকে দেশভাগ-পরবর্তী সময় পর্যন্ত। সেখানে চারটি চরিত্র—গৌতম, চম্পা, কামাল (ধর্মে মুসলমান) এবং সিরিল (জাতিতে ইংরেজ) বিভিন্ন সময় জুড়ে এই উপমহাদেশে বিচরণ করেছে। তাঁর আর-একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘চায় কি বাগ’ মূলত চা-বাগানের জীবনযাত্রা নিয়ে রচিত।
তিনি চারটি উপন্যাসিকা লিখেছিলেন, তার মধ্যে একটি ‘অগলে জনম মোহে বিটিয়া না কিজো’ (পরের জনমে আমায় মেয়ে কোরো না) লিঙ্গবৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। নিজের পরিবারকে নিয়ে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন—‘কার এ জাহাঁ দরাজ় হ্যায়’ (সুবিশাল কর্মযজ্ঞ বিশ্বের)। আর-একটি বৃহৎ উপন্যাস ‘গরদিশ এ রঙ্গ্-এ-চমন’। এর বিষয়বস্তু হল ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর অভিজাত পরিবারের নারীদের দুর্দশার কাহিনি। জ্ঞানপীঠ-প্রাপ্ত ‘আখির-এ-শব কে হমসফর’১-এর প্রেক্ষিত নকশাল আন্দোলন ও তৎকালীন অস্থিরতা। দেশভাগের চল্লিশ বছর পরে মুসলমানদের সাধারণ সামাজিক অবস্থা নিয়ে লেখা তাঁর শেষ উপন্যাস চাঁদনি বেগম।
গল্পের প্রসঙ্গে আসি। সেখানেও বহুবর্ণের চরিত্র, এদেশের, বিদেশের, নানা জাতের, নানা শ্রেণির। তবে ওই গোড়াতেই যে কথা উল্লেখ করেছি, সম্পন্ন পরিবারের ব্যক্তিমানুষের সংকটই জুড়ে আছে তাঁর রচনার সিংহভাগ।
এবারে ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর লেখা অনুবাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে দু-কথা বলি। উর্দু থেকে তরজমা করেছিলাম একটি গল্প আর একটা নাটক। গল্পটির নাম ‘ইয়ে গাজ়ি ইয়ে তেরে পুরইসরার বন্দে’ (তোমার গোপন অনুচর এই ধর্মযোদ্ধারা)। এটি মূলত ইসলামি জঙ্গিদের নিয়ে লেখা। অসাধারণ গল্প। শুরু থেকেই পাঠককে টেনে নেয় রুদ্ধশ্বাসে। এক ক্যানেডিয়ান তরুণ ছাত্রী তামারার সঙ্গে পশ্চিম জার্মানির এক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অতিসুদর্শন এক ইরানি প্রোফেসরের প্রেমের উৎসার দিয়ে গল্পটির সূচনা। দুজনেই সেদেশে নবাগত। তারপরে একদিন হঠাৎ সেখানকার এয়ারপোর্টে এক বিস্ফোরণের ফলে সেই অধ্যাপককে জঙ্গি হিসেবে জানা যায়। সুইসাইড স্কোয়াড-এর অন্তর্গত এক জঙ্গি। তামারার ভীষণ চেনা সেই সুন্দর দেহ বিস্ফোরণের ফলে তখন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। টেলিভিশনে সে ছবি দেখার পর তামারার প্রতিক্রিয়া, তার নার্ভাস ব্রেকডাউন, আতঙ্ক ও মৃত্যুর অবিশ্বাস্য রকমের বর্ণনার বুনোট তাঁর এই গল্প।
নাটকটির নাম ‘পালি হিল কি রাত’। তৎকালীন বম্বের পালি হিল-এ বেশ কিছু পারসি পরিবারের বসবাস ছিল। সেখানকারই দুই নিঃসঙ্গ অবিবাহিত বোনের কাহিনি। প্রবল বৃষ্টিতে আটকে পড়ে দুই ইরানি তরুণ-তরুণী সেই বাড়িতে কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নেয়। দুই বোনের আলাপচারিতায় জানা যায়, তাদের একজনের পুলিশের-ভয়ে-ফেরার প্রেমিক তাদের সঙ্গে আজ দেখা করতে আসবে। নাটকের শেষ দৃশ্যে ডিনার টেবিলে খাবার সাজিয়ে, পিয়ানোয় ‘ওয়েডিং মার্চ’ বাজিয়ে তারা হুইলচেয়ারে বসানো একটি মোমের পুতুলকে নিয়ে আসে। তার মুখে সেই মৃত প্রেমিকের মুখের ছাপ দেওয়া ডেথমাস্ক!
ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বোত্তম ঔপন্যাসিকদের অন্যতমা তিনি। অসাধারণ রূপসি, বিদুষী, আকর্ষণীয়া আইনি অশীতিপর বয়সে ২০০৭ সালের ২১ অগাস্ট, প্রয়াণদিনটি পর্যন্ত একাকী জীবনযাপন কেন করলেন, সেকাহিনি অবশ্য আজও অকথিতই রয়ে গেল।
লিখলে লিখতে পারতেন কুররাতুলায়েন নিজেই। ‘পতঝড় কি আওয়াজ়’ বা ‘হেমন্তে পাতা ঝরার শব্দ’ গল্পে লিখেছিলেন, আমাদের সমাজ এখনও শিক্ষিত মেয়েদের গ্রহণ করবার জন্য তৈরি নয়। সেটাই কি তবে কারণ?
খুব মনোগ্রাহী আলোচনা।