বিবেকানন্দ কলেজের ভেতরে ঢুকলে পোর্টিকোর ওপর ঝুঁকে পড়া গাছ দেখা যেত। ঠাকুরপুকুর বিবেকানন্দ কলেজ, সেখানে পোর্টিকোয় একটা শহীদ বেদী। অরূপ তোমায় ভুলিনি। গাছ ঝুঁকে এলে সাধারণত তা ফুলের ভারে ঝুঁকে আসে। সেটাই স্বাভাবিক কারণ ফুলের ভার আছে কিন্তু এ গাছটা শহীদ বেদীর পাশ দিয়ে উঠেছে আর ঝুঁকে ঝুঁকে ঝোপ তৈরি করতে করতে গেছে। তাতে পোর্টিকো আর অরূপের বেদীর ওপর অসীম ছায়া -সেখানে বসতে ভালো লাগে। অরূপ কোথায় কোপ খেয়েছিল কে জানে? তবে তার শহীদ বেদীর জায়গা নিশ্চিত আর সেটা পোর্টিকোর ঠিক তলাতেই।
আমি এমন এমন জায়গায়-স্কুলে –কলেজে পড়েছি যে সেখানে আমার মামার বাড়ির কেউ না কেউ পড়েছে। যেমন মিত্র ভবানীপুরে এইট থেকে পড়েছিলাম সেখানে আমার দুই মামা পড়তো। মেজোমামা আর নিতাই মামা। দাদু সাউথ কলকাতা কংগ্রেসের প্রেসিন্ডেট ছিল। সুভাষ বোস যেবার মেয়র হয়,দুঁদে উকিল দাদু ছিল তার ইলেকশান এজেন্ট। দাদু উকিল আর তার ভাই ছোড় দাদু ডাক্তার। দুজনেই কংগ্রেসি। তখন মিত্র ইস্কুল ভবানীপুর, স্বাধীনতার এলিট লড়ুয়েদের ছেলেদের পড়ার জায়গা ছিল সেখানে গুড়াপ থেকে কেশব চন্দ্র নাগ পড়াতে আসতেন আর কালিদাস রায় পড়াতেন আর জানকীনাথ শাস্ত্রী সংস্কৃত পড়াতেন। খুবই খিটকেল সাবজেক্ট এই সংস্কৃত যা আমাকেও পড়তে হয়েছিল আর তাতে চুয়াল্লিশ পাই। সেই পেয়েই বিবেকানন্দ কলেজে ভর্তি হলাম হয়ত ওখান থেকে আমার মামাতো দাদা টুকুদাদা আর দুই দিদি পড়েছিল বলে।
তবে কলেজের কথা মনে পড়তে অরূপের কথা, তার পোর্টিকোর কথা আর মামাদের বা মামাতো ভাইবোনদের কথা মনে পড়ছে কেন কে জানে? মেজোমামার সঙ্গে অরূপকে রিলেট করানো যাবে কি? কী করে যাবে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। এটা ঘটনা যে মেজোমামার টিবি হয়েছিল কিন্তু সেতো অল্প বয়েসে মারা যায়নি। দীর্ঘদিন পেন্দ্রারোর বলে একটা জায়গায় সেনিটোরিয়ামে ছিল।তখন স্টেপ্টোমাইসিন বেরিয়েছে, সেই ওষুধ আর সেখানকার হাওয়ায় মেজোমামার আর মরা হয়ে ওঠেনি। সে বেঁচে ফিরে এলো তবে ছেড়ে যাওয়া ডাক্তারিটা আর পড়তে ঢুকলো না কোনো কারণে। পরে সে সিনেমা করতে গেল, মানিক ব্যানার্জির পুতুল নাচের ইতিকথা কিন্তু সেটাও হয়ে উঠলো না করা।
শেষমেশ দেখা যায় মেজোমামা প্রথমে রাশিয়া আর পরে চীন থেকে ছাপাই মেশিনের ইম্পোর্টার হয়ে পড়েছে। দুটোই সমাজতান্ত্রিক দেশ তবে ব্যবসাটা ব্যবসাই। সে বেশ পয়সাকড়ি করে। ১৯৬২এ চীনের যুদ্ধের পর ধরপাকড়ের কারণে মেজমামা ব্যবসা গুটিয়ে দুটো বাড়ি করে -বঁড়শের সখেরবাজার এলাকায় আর গিধনির পরের স্টেশন সেসময় বিহারের চাকুলিয়ায়। তাড়াতাড়ি বড়লোক জাতীয় হওয়া আর তারপর ব্যবসা ছেড়ে দেওয়াটা কী রকম গোলমেলে লাগে আমার। পার্টি ব্যান হবার সময় ১৯৪৮ এ বা তারপরের লুকিয়ে থাকার দিনে সিপিআইয়ের এক খুব বড় নেতার সম্ভবত শেল্টার ম্যান ছিল মেজোমামা। সে জন্য কিছু জ্যাক পেয়েছিল? জ্যাক এমন একটা যা ধরে ওঠা যায়। কেউ কেউ ওঠে। মেজোমামা উঠেছিল নিশ্চিত। কিন্তু একটা টাকার প্রবাহের অংশ হয়েছিল কি, যাকে আজকাল মানি ট্রেল বলে হৈচৈ হচ্ছে যা না হলে শাঁসালো ব্যবসা হবে না? এর কিছুই আমি জানি না। জানলে বলতাম আর সেটাও প্রশ্নের মুখে পড়তে পারত। পারত না কি? শুধু পার্টির কথা জানি, মেজমামার কথা আর অনেকটা আন্দাজ করা যায় একটা আর্থিক লেনদেনের কথাও যা না হলে ব্যবস্থা –সিস্টেম চলে কি? কোন ব্যবস্থাই সে এমনকি সোভিয়েত বা ব্যবসা যে কোনকিছু হতে পারে, অথবা অতি বৈধতারও হ্যাপা আছে আর হয়ত সে হ্যাপা মেজমামা পোয়াতে পারে না কিছুতেই। তাই সে সরে আসে অথবা সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে? বুঝতে পারি না কিছুতেই, পারি না কেন কে জানে। বৈধতার ডিটেলে কোন দিন থাকব না বলে ঠিক করেছি বলে বুঝতে পারি না? কিন্তু আমিই বা পুরো বৈধতার বাইরের লোক হতে পারলাম কই? চাকরি বাকরি করে তো জীবন গেল। ছক ছাড়া, তার বাইরে চাকরি আর কিই বা হতে পারে।
তবে নিতাই মামার কথা আলাদা। সে মিত্র থেকে খুবই ভালো রকমের ম্যাট্রিক পাস দিয়ে কোথা থেকে জানি ইন্টার মিডিয়েটেও ভালো করে কম্যুনিস্ট পার্টির হোল টাইমার হয়। তারপর তার টিবি হলো। টিবি মামার বাড়ির ছেলে মেয়েদের কাউকে ছাড়ছিল না। সবার আগে মারা যায় মায়েদের মেজদি। তারপর ন মাসির হয়েছিল তারপর নিতাই মামার, ওরা দুজনেই ওষুধ বেরনোর আগের কেস। স্টেপ্টোমাইসিন বেরনোর আগে মামার বাড়িতে যাদের টিবি হয় তাদের দুজন মারা যায়, বেঁচে গেল ন মাসি। তার মানে নিতাই মামাকে মারা যেতে হবে। সে পেদ্রারোরে গিয়ে আর ফেরে না। চিঠি চালাচালি ওই যাওয়া আর সুদূর সেনিটোরিয়াম থেকে আসা কথার সাক্ষী হয়ে আছে। কংগ্রেসি দাদুর অভিযোগ ছিল পড়াশোনা লাটে তোলা আর আদাড়ে পাঁদাড়ে শ্রমিকের মহল্লায় মহল্লায় –বস্তির খাটিয়ায় খোটটা আর মুসলমানদের ঘর করার দোষে টিবি হয়।
নিতাই মামার রোগটা ধরে ছোড় দাদু। তার ট্র্যাজেডি হলো বাড়ির সবার মারণ রোগ ধরা, তারপর নিজেই চিকিৎসা করা। ছোড় দাদুর হাতের ওপরেই মায়েদের মেজ বোন মারা গেল। তাই নিতাই মামার ব্যপারটা আর সহ্য করতে পারছিল না সে। ছোড় দাদু গেল বিধান রায়ের কাছে আর দাদু অক্ষম রাগে গজরাতে গজরাতে পড়ল নিতাই মামাকে নিয়ে।
-ও ভাবে করে করে বেড়াচ্ছ। আমি জানতাম।
-আপনিও রাজনীতি করেন।
-তোমাদের ব্যাপারটা আলাদা।
-কিসে?
-দেওয়ালের ওপারের দুশমনকে তোমরা এপার থেকে মারার জন্য তৈরি হচ্ছ। হাতে তোমাদের ছুরি ঘোরে।
-কোথায়? এই দেখুন, খালি হাত।
-মনের ছুরির কথা বলছিলাম যা সময় মতো হাতে আসবে। যাক ওসব কথা। যা বাঁধিয়েছ, এখানে থাকা মোটেই সুবিধের বোধ হয় না। ডাক্তার রায়ও তোমার কাকাকে বললেন পেন্দ্রারোরে নিয়ে যেতে।
-আমাকেই যেতে হবে? কই মেজদি আর নদিকে তো পাঠানো হয়নি। মেয়ে বলে?
-তোমার কথার উত্তর দিতে হবে নাকি, জবাবদিহি করছ।
-জিজ্ঞেস করছিলাম।
-রোগ বাঁধিয়ে মুখে মুখে কথা বলবে না।
-আচ্ছা।
-আমি তার করেছিলাম। আজই উত্তর এসেছে। জুপির পরীক্ষা, গোরা তোমায় নিয়ে যাবে।
দাদু কী করে জানবে কিছুদিন বাদেই জুপি মানে মেজোমামাকেও পেদ্রারোরে পাঠানোর জন্য, গোরা মানে বড়মামাকে সঙ্গে যেতে হবে। মেজমামার টিবি হয়েছিল সবার পরে।
তবে নিতাই মামা সম্পর্কে মেয়েদের বয়ানটা আলাদা আর সেটা বেশি রকমের আবেগী পলিটিক্যাল। ন ফুল রাঙ্গা আর ছোট এই চার অবিবাহিত বোন, যারা হয় টিবি হয়ে বা হবার আশঙ্কায় ভুগে বেঁচেছিল, যারা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে কলকাতা জুড়ে চলা মিলিটারির ট্রাক –সাদা কালো বিদেশি সৈন্যদের কিঞ্চিৎ আতঙ্ক –অত্যাচার সয়ে,রাস্তায় বেরনোর অধিকার হারিয়ে এমনকি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিঙের সময় নিজের বাবা মানে দাদুকে মিলিটারি ট্রাকে করে মৃত –অর্ধমৃত আর ধর্ষিতাদের রেস্কিউ অপারেশনে দিনরাত এক করে খাটতে দেখে কঠিন হয়েছে –তারা সবাই অনুপস্থিত ছোট ভাই আর নিতাইদার জন্যই ঝাড়ে বংশে কম্যুনিস্ট সমর্থক হয়ে পড়ল।বড় মামার ছেলে টুকুদাদাকে লাল সেলাম দিয়ে, তার ছবি তুলিয়ে পাঠানোয় সবচেয়ে বড় উদ্যোগী ছিল আমার মা সেই চার বোনেদের মধ্যে যে ফুল বোন।ওই ছবি নিতাই মামার কাছে পৌঁছবে আর সে খুবই রেগে ওঠে। সে চিঠিতে বোনদের লিখেছিল তার দ্বিধার কথা, কোথাকার জল কথায় গড়ায় সেই নিয়ে আশঙ্কার কথাও।
এটা তোরা ঠিক করিস নি। একি করলি? ছোট ছেলে, ওইটুকু ছেলে। কী বোঝে ও লাল সেলামের।বড় হতে দে। নিজে বুঝুক। বোঝার সময় পড়ে আছে অনেক। সব বুঝে তারপর ও সব হবে।তখন চাইলে, মন থেকে চাইলে তবে না লাল সেলামের কথা ওঠে। তার আগে থেকে কী করে ওঠে লাল সেলামের কথা? ওঠে কি? ওঠে না। বুঝলি, কিছুতেই ওঠে না। উঠবে কী করে?
নিতাই মামাকে ওষুধ ছাড়া কিছুতেই বাঁচানো যায় না। কাউকে কাউকে যায় যেমন ন মাসি। সে এই সেদিন মারা যাচ্ছে তিরানব্বই বছরে।যাকে বাঁচানোটা খুব দরকার মনে করেছিল পরিবার, বিশেষ করে বোনেদের দল আর পার্টি তাকে বাঁচানো যায় না।মায়ের কাছে তার স্মৃতিরা ছিল আর মা সেসব আমাদের দিয়ে গেছে। অসুখ –ওষুধ, ওষুধ না বেরনোর আফসোস আর বড় বড় সব রাজনীতির আইডিয়া আর লুকিয়ে, লুকিয়ে ভোরে, ভোর চারটের সময় বেরিয়ে পাড়ার দেওয়ালে দেওয়ালে কংগ্রেসি বাড়ির মেয়ের দল পোস্টার সাঁটিয়ে দিয়ে আসতো,'ইংরেজ ভারত ছাড় ' তার তলায় লেখা থাকত তাদের ছোট আর প্রিয় ভায়ের- দাদার পার্টির নাম –সি পি আই।সকালে উঠে পাড়ার লোকেরা লাল লাল আলতা দিয়ে ধ্যাবড়া লেখা সেসব দেখত আর ভাবত কে লাগাতে পারে? নিতাই তো নেই। পাড়ার কোন ছেলেটা আবার …। মায়েরা মাসিরা তখন মুখ টিপে হাসাহাসি করছে একান্তে।
নিতাই মামা মারা যাবার পর দাদু সক্রিয় রাজনীতিতে বেশি দিন থাকেনি। ছোড় দাদুকে সাউথ ক্যালকাটা কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হতে হয় আর মেজমামা বড় মামার সাহায্যে সব কটা বোনের সহযোগে বাড়িটা হয়ে উঠল আইপিটিয়ের সেন্ট্রাল স্কোয়ার্ডের রিহার্সালের আখড়া। সেখানে ঋত্বিক থেকে সলিল আর বটুকবাবুর আনাগোনা। ছোড়দাদুর চেম্বারে জহরলালের ছবি দোলে। ওনার সঙ্গে ছোড়দাদু। একদিকে রিহার্সাল অন্যদিকে সম্ভ্রান্ত ডাক্তারি আর নেহেরুর কংগ্রেস, মাঝে একটা মেঠো এলাকায় বাড়ির খানিক বখাটে, খানিক পার্টি ঘেঁষা অঞ্চলে পাড়ার হিরো হয়ে উঠতে থাকবে ছোড়দাদুর এক ছেলে নেদো মামা, তাকে ধরতে পুলিশ এলে দেখা যায় পেছনের দরজা হাট হয়ে খোলা। কি, না নেদো পালায় পাঁচিল টপকে। স্বাধীনতা এসেছে আর কংগ্রেসি প্রেসিডেন্টের রুগী দেখার চেম্বারে একদিন গদাম করে পেটোর আওয়াজ শোনা যাবে। সেখানকার এক্সরে দেখার আলো ভেঙে চুরচুর। ভাগ্যিস কেউ ছিল না ! নেদো তার কোন এক দিদিকে শাল পাতায় মুড়ে পেটো রাখতে দিয়েছে। সে দিদিও সবচেয়ে সেফ জায়গা বেছেছে এক তলায় ছোড় দাদুর চেম্বার। মায়ের কাছে ছেলেবেলায় আমার দুটো জিজ্ঞাস্য ছিল।কে রেখেছিল আর কটা পেটো ছিল? উত্তরে মাকে এড়িয়ে যেতে দেখলাম।শুধু মুচকি মুচকি হেসেছিল। হ্যাঁ, এই ভাবে নিতাই মামা মরে গিয়েও ওই আঁটসাঁট সম্ভ্রান্ত কংগ্রেসি বাড়ির ভেতরটা অন্তর্ঘাতে ফাটল ধরিয়ে গিয়েছিল সে মায়ের কথায় বেশ বোঝা যাচ্ছিল, অনেক ও নানাবিধ সব ফাটলেরা।এর মধ্যে বিপিএসফের হয়ে এক পিকেটিঙয়ের সময় ইন্টার মিডিয়েট পড়া মাকেও হাজত বাস করতে হয় এক রাত। ছোড় দাদু সে সময়ের হোম মিনিস্টার কালী মুখুজ্জেকে ফোন করলে তিনি নাকি বললেন,' ও তোমাদের বাড়ির মেয়ে তো ! ওরা তো সব কম্যুনিস্ট হয়েছে ! বেশ হয়েছে আটকেছে !' কিন্তু পরের দিন ভোরেই মা আর অন্যদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
দাদু আস্তে আস্তে প্র্যাক্টিস থেকেও সরে আসে। গীতা পাঠ আর ধ্যানে ডুবে থাকত। উপনিষদ পড়ত সংস্কৃতয়। আমাকে ইংরিজির ইটালিক্সে হেলানো লেখা শিখিয়েছিল আর গ্রামার। অনেকটা আধ্যাত্মিক করে তুলছিল কিন্তু আমার ক্লাস সিক্সেই সে মারা গেল চাকুলিয়ায়। পেচ্ছাপ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছিল দাদুর, থামছিল না কিছুতেই -ক্যান্সার। মেজোমামা সিনেমা করতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে সফল ব্যবসায়ী হয়ে সংসারের হাল ধরে। বড়মামার বিয়ে হয়েছিল আগেই, পরে তাকে মেজমামার ব্যবসা সহযোগী হিসেবে দেখা যাবে। খাস কলকাতার বাড়ির ভাগ বেচে দিয়ে মেজমামা বঁড়শের সখেরবাজার আর চাকুলিয়ায় বাড়িতে ঘুরে ফিরে থেকে ব্যবসা করে। ছোড় দাদুরা ওখানেই রয়ে গেল। বিয়ে করেনি মেজ মামা। বড় মামার পরিবার শখের বাজারেই থাকে। টুকুদাদা আর দিদিরা সব ঠাকুরপুকুর বিবেকানন্দ কলেজে পড়ত, আমিও।
টুকুদাদার সময় অরূপের শহীদ বেদীটা হয়নি হবেই বা কী করে? অরূপ তো নকশাল ছিল আর টুকুদাদা পাস করেছে অনেক আগে। দিদিরা দেখে থাকবে শহীদ বেদীটা।আমি যখন দেখি, মানে কলেজে ঢোকার মুখেই দেখি আরকি, তার ওপর বেগেনভেলিয়ার ঝাড়টা নেমে এসেছে।ছায়ায় ছায়ায় ঘেরা একটা অঞ্চল তৈরি হয়ে গেছে।একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে গাছের ছায়া পথ আকাশের থেকেও বড়। সেটা সময়কে বাধাই মনে করবে না। আমি মায়ের শরীরের ভেতর দিয়ে স্বপ্ন মাড়িয়ে যেতে ভীষণ ভয় পেতে পেতেও পাইনি কারণ সারাক্ষণ, পুরো যাত্রায় মামা বাড়িটার একমাত্র ব্লাকশিপ নেদো আমাকে ভরসা দিয়ে এসেছে। আমি কুঁকড়ে মুকড়ে তাকালে সে বার বারই বলে, "আরে তোর মামা হইরে। কোন চিন্তা করিস না। কেউ ঘেঁষবেও না, এলে বলবি নেদোর ভাগ্নে, ব্যাস।" নেদো মামাই যে আমাকে নিতাই মামার কাছে নির্ঘাত পৌঁছে দেবে, সেই ছোটবেলায় একবার হারিয়ে গেলে এক লম্বা চওড়া কাবলি ওলা যেমন বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল ঠিক তেমন করেই, সে আমি বেশ বুঝতে পারি। অরূপের শহীদ বেদী দেখে আশ্চর্য ভুরু তুলে নেতাই মামা আমাকে জিজ্ঞেস করল, "কে এটা বানালো রে?'' আমি, "কংগ্রেসিরা'' বলায় আমার সেই মামা আরো আশ্চর্য হয়। তাকে বোঝাতে বেগ পেতে হচ্ছে যে অরূপ ছিল নকশাল, তাকে মেরেছিল সিপিএমরা আর শহীদ বেদী বানিয়েছে কংগ্রেসিরা। নেহাত নেদো মামা থাকায় এতো দিনের মরা মানুষকে বোঝাতে সুবিধে হয়।দেখছি মরা মানুষরা মরা মানুষদেরই বেশি বিশ্বাস করে। মরে যাওয়া নেদো মামা, মরে যাওয়া নিতাই মামাকে সব বুঝিয়ে বলে ওঠে, "ঠিক বললাম কিনা নেতাইদা? দেখো, ভুল হলে ধরিয়ে দিয়ো কিন্তু।"
মৃতদের জগতের ওপারে তখন, ঠিক তখনই আমার একার কথোপকথন শুরু হবে সেই শহীদ বেদীটার সঙ্গে, অরূপের শহীদ বেদী যার ওপর গাছের ছায়ায় ফুলেরা ঝুঁকে থাকে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, ''একে ঠিক আত্মজীবনী বলা যাবে কি?''