মায়ের পা ছুঁয়ে বসে আছে অনিমেষ। মা যে আর বেঁচে নেই একথা ভাবতে বা মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরা জলে মায়ের পায়ের পাতা ভিজে যাচ্ছিল। কাল রাতেও কত কথা বলেছিল মা ওর সঙ্গে। বুকের মধ্যে গাঢ় অন্ধকার দলা পাকিয়ে হাহাকার করছে। বুকের মধ্যে বেজে উঠছে করুণ বাঁশির সুর। বাড়ির উঠোনে বস্তিবাসীদের ভিড়, কান্নার আওয়াজ। গতকাল শেষ রাতে মা চলে গেছে নিজের বাড়িতে। এই কথা মায়ের কথা। মা বলত, আমার নিজের বাড়ি ওপারে, ঈশ্বর এপারে পাঠিয়েছেন কিছু কাজ করার জন্য। জানিস খোকা বিধাতা আমাদের জন্মের আগেই মৃত্যু ঠিক করে রেখেছে, আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই, অশুভ বলি তাই কথায় কথায় জন্মমৃত্যু বলি আসলে কথাটা হবে মৃত্যু-জন্ম। মৃত্যু হচ্ছে শুভ আনন্দের সৃষ্টি সুরের মহামিলন। অনিমেষ মায়ের মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। মায়ের মুখের ওপর কেমন যেন প্রশান্তির ছায়া। আমার যা কিছু দেখা-শেখা সবই মায়ের কাছ থেকে। মা-ই আমার জীবনদর্শন। মা মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান গাইতেন-জীবন কাহারে কয় আমি খুঁজে বেড়াই তারে...।
আমি মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, মা তুমি এই গানটা বারবার গাও, তুমি কী খুঁজে বেড়াও, তুমি কি মনের মানুষটাকে এখনও খুঁজে পাওনি?
মা বলত, খোকা মানুষটা এখানে রূপক। যে যেভাবে নেবে, কেউ মনের মানুষ কেউ গৃহদেবতা কেউ একজন শুদ্ধ মানবিকতাসম্পন্ন মানুষ, কেউ দামাল বা শান্ত নদী, কেউ বা পাখি, ফুল, আকাশ বা গ্রহ নক্ষত্র। এই খুঁজে বেড়ানোটাও একটা প্রতীকী। এই খুঁজে বেড়ানোটায় জীবন, কর্ম। খোকা এমন হতে পারে, আমি কী খুঁজছি, নিজেই জানি না। আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি অবিরাম ছুটছি...। বনেবাদাড়ে গাছগাছালির রৌদ্রছায়ায়, ছুটছি এ নদী, সে-নদী, নদীর পাড় ভেঙে ছুটছি। মানুষের দোরে দোরে ঘুরছি কখনও বা তাকিয়ে থাকছি দূর আকাশের দিকে, আকাশ-তারা-গ্রহ নক্ষত্রের দিকে স্থির চোখে। কতটুকু আর দেখতে পাই এই বিশ্বচরাচরের বৈচিত্র্যময় মায়াবী খেলার। আমি অবিরাম ছুটে বেড়াচ্ছি...।
পাড়ার একজন বয়স্ক লোক বলল, সেই কখন ভোরের আগে অন্ধকারে মারা গেছে, এখনও রেখে দিয়েছো তাড়াতাড়ি শ্মশানে নিয়ে যাও, ঘরের বাতাস ভারি হয়ে যাচ্ছে।
বাড়ির বড় ছেলে শিবুদা বলল, আমার বোনেরা অনেক দূরে থাকে ওরা না এলে নিয়ে যেতে পারছি না।
শ্মশানে নিয়ে যাবার কথা উঠতেই, অনিমেষের বুকের মধ্যে ভীষণ কষ্ট শুরু হল, শুনতে পেল সরোদের করুণ সুর। সে বলল, মা তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে, আমার যে আর কেউ থাকল না। বৌ আমাকে ছেড়ে, মেয়েকে নিয়ে কবেই চলে গেছে বাপের বাড়ি। মায়ের কণ্ঠস্বর 'খোকা ঝড় উঠেছে আগে একটা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে বাঁচা, তারপর সবার কথা ভাববি। ভয়ঙ্কর ঝড় এখন দাপিয়ে বেড়াবে সব তছনছ করে দেবে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেবে। ঝড় থেমে গেলে পৃথিবী শাস্ত হবে, মন শান্ত হবে। আর সেই মুহূর্তে শরীরে, মনে নেমে আসবে কর্মতৎপরতা। ঝাঁপিয়ে পড়বি আর্ত মানুষের সেবায়।'অনিমেষ ঘরের বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল প্রচণ্ড ঝড়ের দাপাদাপি। অনিমেষ ভাবল মা কি বেঁচে আছে? মা ঝড়ের আভাস পেল কী করে, আমার সঙ্গে কথাই বা বলছে কিভাবে? তবে ডাক্তার যে বলে গেল মা মারা গেছে।
অনিমেষ মায়ের নাড়ী দেখল, নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে দেখল নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা। মনে হল নিঃশ্বাস পড়ছে। তবে ডাক্তারবাবু যে বলে গেলেন দুঃখিত আপনাদের মা মারা গেছেন। হতে পারে বিভ্রম। মা এর আগে অনেকবার বলেছে, সমস্যা, অশান্তি, বিপদ ও কষ্টের মধ্যে পড়লে বলত, খোকা এই সময়টা একটু সামলে নে, ঝড় থেমে গেলে সব শান্ত হয়ে যাবে। জানিস খোকা পৃথিবীর যা কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম সবই আমাদের জীবনের চলার পথে অনুভব করবি, ঝড়বৃষ্টি বন্যা খরা ভূমিকম্প সব...সব। অনিমেষ মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল, মা তুমি চলে গেলে আমার জীবনটাই শূন্য হয়ে গেল। মা বলল, হ্যাঁ খোকা এই পৃথিবীটা শূন্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরাও তো সব শূন্যের মধ্যে আছি। শূন্য-তবে এত কষ্ট করে, লড়াই করে বেঁচে থাকার অর্থ কী? -এই কষ্ট লড়াই এটাই তো বেঁচে থাকবে এরই নাম জীবন। জীবন কখনও শূন্য হয় না। কর্মময় জীবন সমস্ত শূন্যতা ঢেকে দেয়। শূন্যতা শূন্যই। কর্মময় জীবন হচ্ছে মূলমন্ত্র। খোকা তুই যে গল্প, কবিতা, উপন্যাস লিখিস, তুইও একদিন চলে যাবি, তোর সাহিত্য তোকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমরা যখন এই পৃথিবীতে এসেছিলাম গাঢ় অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আলোর পথে। ঈশ্বর আশা করেন আমরা সেই আলো মানুষজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিই। শেষের সেই দিন সেও এক ভীষণ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া। যারা মানুষের জন্য কিছু কর্ম করে তাঁরা থেকে যায় মানুষের মনের ইতিহাসে। শাসক দল নিজেদের স্বার্থে ইতিহাস বদল করে। কিন্তু তারা জানে না ইতিহাস তৈরি করে মানুষই। কিছু মানুষ আছে যারা মানুষের বাসস্থান কেড়ে নেয়, খাদ্যশস্য কেড়ে নিয়ে শিল্প তৈরি করে। মুনাফা দিয়ে টাকার পাহাড় বানায়, আয় বহির্ভূত টাকা, কালো টাকা হয়ে বিদেশের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখে। তারা কি পারত না গরিব মানুষের সেবায় সেই টাকা কাজে লাগাতে। না পারবে না এরা অন্ধকারের জীব, আলো এদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, এরা আলোর পথে হাঁটতে পারে না। খোকা তোর দুলু পাগলির কথা মনে আছে? তোকে তো সব বলেছি, ওর বাড়িতে তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম, ও শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে ঝাউডাঙা থেকে কোলকাতায় পালিয়ে এসে নিজের মুক্তির খোঁজ পেয়েছিল, রাস্তায় ফুল বিক্রি করে যা রোজগার করত তাই দিয়ে কষ্ট করে রাস্তা থেকে পথশিশুদের বাড়িতে নিয়ে এসে মানুষ করেছিল। কত কষ্ট করে। সেদিন দেখা হয়েছিল, আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল, ওর মানুষ করা ছেলেদের মধ্যে দুজন ডাক্তার, একজন নার্স, কয়েকজন সরকারি চাকরি পেয়েছে। এখন সব ওরাই দেখাশোনা করে। ওরা সবাই মিলে কারবালা ট্যাঙ্ক লেনে একটা বড় বাড়ি কিনেছে। এখন অনেক পথশিশুদের নিয়ে এসেছে। দ্যাখ একটা মানুষ টাকার পাহাড় তৈরি করছে আর একটা মানুষ মানুষের সেবা করছে। অনিমেষ বলল, মা আমার স্ত্রী, মেয়েকে নিয়ে আমায় ছেড়ে চলে গেল। মেয়েকে ছাড়া আমি বাঁচব কী করে? মা বলল, খোকা আমি, আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে মা, বাবা, ভাই দাদা বোন দিদি এই তো আমাদের আত্মীয়স্বজন আমাদের সংসার। আমি, আমার আমাদের এই চিন্তার ভেতর আমরা বেশির ভাগ মানুষই আবর্ত থাকি। আমি, আমার এ-এক ভীষণ মায়ার খেলা। এর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সারা জীবন কষ্টই পেতে হবে। সমস্ত মানুষের কথা ভাবতে হবে, সকল মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। তা হলেই জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করা যাবে। এই কাজটাও খুব সহজ নয়, খুবই কষ্টের সকল মানুষের কথা ভাবা সকল মানুষকে আপন করে নেওয়ার জন্য চাই একটা শুদ্ধ মন, প্রেম, ভালবাসা, আর চাই মনের অফুরন্ত শক্তি। এগুলো জয় করে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারলেই তোর মুক্তি। খোকা তোর মন আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে কেন কেন কী জন্য। খুঁজে পাচ্ছিস না উত্তর? তোর স্ত্রী, তোর ভালবাসা দু পায়ে মাড়িয়ে চলে গেল। প্রেম ভালবাসা নিবেদন ও গ্রহণ করা সাধনার বিষয়। অনেকেই সেই সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে না। মানুষের মনের হদিস পাওয়া খুব কঠিন। মানুষের মনের মধ্যে অনেক ঘর থাকে আগল দেওয়া, কোন ঘরের দরজা কখন খুলে যাবে সে নিজেও জানে না। কারো মনের ঘরে একটা উদাস বাউল থাকে সে ঘরসংসার ফেলে পালিয়ে যায় পথে পথে ঘুরে বেড়ায় নিজের আনন্দে বিভোর হয়ে থাকে। কারো মনের ঘরে এক ভয়ঙ্কর দৈত্য বাস করে সে সব কিছু ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে শেষ, করে দেয়। কারো মনের ঘরে ঈশ্বরের হাতছানি থাকে, সে ঈশ্বর সাধনায় আত্মমগ্ন হয়ে থাকে। কারো বা মনের মধ্যে দেশপ্রেম জন্ম নেয়, সে জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পিছপা হয় না।
অনিমেষের মায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। ছোট বোন এসেছে, সে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছোট বোন অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করল, মায়ের কী হয়েছিল? অনিমেষ বলে, কাল রাত্রে তো ভালই ছিল, আমার সঙ্গে অনেক কথা বলল, শেষ রাতে মা চলে গেল। কাল ছিল আর আজ নেই। আজ যে থাকবে না একথা একবারও মনে হয়নি, একটুও বুঝতে পারিনি। এতক্ষণ তো মা আমার সঙ্গেই কথা বলছিল। ছোটবোন অনিমেষের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। অনেক অনেক মানুষের ভিড়। সবাই ফুলের মালা দিয়ে যাচ্ছে।
অনেক মানুষের ভিড়। ওলাই চণ্ডী বস্তির মানুষেরা এসেছে, এসেছে নতুন পাড়ার নেপালিরা, বেলগাছিয়া ট্রামলাইনের ওপারে মুসলমানপাড়ার লোকেরা, রাজা মণীন্দ্র রোডের ২১নং বস্তি, শহীদ কলোনি, সরকার বাগান, প্রচুর বিহারী মানুষজন, রানী রোড, খিলাৎবাবু লেন, বেশির ভাগ মহিলা। ভিড় সামলাতে মাকে ঘরের বাইরে উঠোনে বার করা হল, মায়ের গায়ে যাতে রোদ না লাগে, সেইজন্য মাথার উপরে শাড়ি দিয়ে সামিয়ানার মত করে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হল। তৃণমূল কংগ্রেস, সি পি এম ও কংগ্রেসের নেতারা মালা দিয়ে মাকে সম্মান জানিয়ে গেছে। চিৎপুর থানার বড়বাবু মাথার টুপি খুলে স্যালুট দিয়ে, একটা বড় মালা দিয়ে সম্মান জানিয়ে গেছে। কয়েকটি ক্লাবের ছেলেরা এসে মালা দিয়ে গেছে। শুধু ফুল আর ফুল। ফুলের মধ্যে মা যেন ঘুমিয়ে আছে। অনিমেষ ভাবছিল, এত মানুষকে খবর কে দিল। খবরটা বাতাসের মতো, ঝড়ের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ও অনুভব করল, বেঁচে থাকা, জীবন যেন শান্ত, ছন্দ সুর তাল লয় নিয়ে সংগীতের মত। আর বেদনা ভয়ঙ্কর। অশান্ত সমুদ্রে ভয়ঙ্কর ঢেউয়ের মত। অনিমেষ পুনরায় মায়ের পায়ে হাত রেখে ভাবতে থাকে, মাকে এত কাছে পেয়ে মায়ের কাজকর্ম, মায়ের চিন্তাভাবনা, আমি যে অন্তরঙ্গ লাভ করেছি, মায়ের জীবন দর্শনের অনুভূতি সম্প্রসারণে আমি ঋদ্ধ হয়েছি, অভিজ্ঞতালব্ধ সম্পদ, সংগ্রাম, আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। মায়ের জীবন দর্শনকেই আমার দর্শন করে আমি এগিয়ে চলেছি।
মা সকালবেলায় ঘরের রান্না, কাজকর্ম সেরে বেরিয়ে পড়ত এপাড়া থেকে ওপাড়া, মানুষের দোরে দোরে ঘুরে বেড়াত। কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কারো ছেলেমেয়ে স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না তাদের নিজের টাকা দিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া। কারো বইখাতা পেনসিল কিনে দেওয়া। প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় আর বৃষ্টিতে ঘরের ভেতর জল জমে যাওয়া মানুষগুলোর সমস্যা দূর করা। কারো স্বামী রোজ মদ খেয়ে বৌকে মারধোর করে, সেই স্বামীকে শায়েস্তা করা। মার সঙ্গে থাকত বিভিন্ন পাড়ার প্রচুর মহিলা। পাড়ায় পাড়ায় চোলাই মদের ঠেক ভেঙে দেওয়া, চোলাই মদের ঠেকের লোকজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। এইসব কাজের জন্যে থানার বড়বাবু মাকে খুব সাহায্য করত। প্রশাসন মায়ের পাশে থাকার জন্য মায়ের সাহস ও কাজের ব্যাপকতা বেড়ে গিয়েছিল। কোন রাজনৈতিক দলের লোকেরা মার কোন কাজে বাধা সৃষ্টি করত না, বরং তাদের দল থেকে প্রস্তাব আসত তাদের দলের কাউন্সিলর বা এমএলএ হওয়ার জন্য ভোটে দাঁড়ানোর। মা সরাসরি তাদের জানিয়ে দিত, আমি এই ভাল আছি। রাজনীতি করার যোগ্যতা আমার নেই। একবার সারা ভারত জুড়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত। আমাদের পাড়ায় পাঁচটা বাড়ি ছিল মুসলমানদের, তারা পাড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছিল তাঁদের আত্মীয়রা থাকে রাজাবাজারে, সেখানে। মা খবর পেয়ে ছুটে গেল তাদের কাছে, তাদের বোঝালো এই পাড়া ছেড়ে বাসস্থান ছেড়ে চলে গেলে পরে ফিরে আসতে অসুবিধা হবে, তোমরা চলে গেলে, পাড়ার বহু মানুষ ভয় পাবে। তোমরা এখানেই থাক আমাকে না মেরে তোমাদের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। মায়ের কথা শুনে তাদের মনে সাহস এল, তারা থেকে গেল পাড়াতে। মায়ের কথামত পাড়ার সবাই দুজন নেপালি, দুজন বিহারি, কানাই আর আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল। ওদের বাড়ির সামনে।
মা, সঙ্গে সঙ্গে বহু মানুষজনকে নিয়ে চলল বেলগাছিয়া মোড়ে। ট্রামলাইনের এ পারে হিন্দুদের বাস, আর ওপারে খুব বড় মুসলমান বস্তি। মা একজন মুসলমান আর একজন হিন্দু এইভাবে সারিবদ্ধ করে বিরাট লম্বা লাইন করে মানব প্রাচীর করে দাঁড় করিয়ে দিল। দুই সম্প্রদায়ের পাড়ায় শান্তিমিছিল করল। মানুষজনকে বোঝাতে লাগল, মানুষ কখনও মানুষকে খুন করে না, গুজবে কান দেবেন না, মানুষ তার ধর্ম নিয়ে ঘরসংসার নিয়ে শাস্তিতে থাকতে চায়। মানুষ খুন করে....একদল শয়তান, তাদের জাত নেই ধর্ম নেই পাপপুণ্য বোধ নেই। তারা মানুষ নয়। আপনারা মানুষ আর একটা মানুষের পাশে দল বেঁধে দাঁড়ান। দেখবেন শয়তানেরা পালিয়ে যাবে। মানুষই পারে মানুষকে বাঁচাতে। মায়ের এই কাজে, পুলিস প্রশাসন খুব সাহায্য করেছিল। দুটো পাড়ার অসংখ্য মানুষজন মায়ের দিকে আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে ছিল। বৃদ্ধার সাহসী পদক্ষেপ দেখে প্রশংসা করছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ আর সেনাবাহিনীর জওয়ানরা সারা রাস্তায় টহল দিতে লাগল। থানার বড়বাবু এসে মায়ের প্রাথমিক কাজের প্রশংসা করে, ধন্যবাদ জানিয়ে গেল। মা বড়বাবুকে বলল, আমরা প্রত্যেক মানুষ যদি যার যেমন ক্ষমতা, সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকে মানুষের জন্য কিছু কাজ করতে পারি তাহলে এক স্বপ্নময় সুন্দর পৃথিবীর জন্ম দিতে পারি। তারপর বিড়বিড় করে বলল, "মানব জীবন আর হবে না"। মা আরও কিছু কাজ করেছিল, চারজন পথশিশু ও একজন অসহায় বৃদ্ধাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বাড়িতে রেখে দিয়ে মানুষ করেছে। বৃদ্ধা অবশ্য অনেকদিন আগে মারা গেছে। মায়ের চোখের জলে বৃদ্ধা যেন বৃষ্টির জলে স্নান করে শ্মশানযাত্রা করেছিল। সেই শিশুগুলো এখন বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখছে, মা ওদের বলেছে তোরা যতদিন পড়াশোনা করতে চাস, পড়বি, আমি চালিয়ে যাব। আমি না থাকলে আমার ছেলেরা তোদের দেখবে। মাঝে মাঝে বলত, খোকা ঈশ্বর আমাকে পথ দেখিয়ে ছিল, ঘরের একটা দেওয়াল ভেঙে ইট বিক্রি করে গাড়ি ভাড়া জোগাড় করে ঝাউডাঙ্গা গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছিলাম শহরে দাদার বাড়িতে। তখন যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষ একসঙ্গে তাড়া করেছিল, তোর বয়স তখন ছ মাস। না এলে, হয়ত সব কজন মানুষ আমরা না খেয়ে মারা যেতাম। এখন তো আমি সুখী আমার পাঁচ ছেলে সরকারি চাকরি করে, এক ছেলে ত্রিবেণীতে ব্যবসা করে। তোর বাবা এই সুখটা দেখে যেতে পারল না। যে কয়েক বছর বেঁচে ছিল, সামান্য মাইনের চাকরি করে অনেক কষ্ট করে তোদের মুখে দুটো ভাত দিতে পেরেছে, তোদের মানুষ করেছে, মাত্র ছাপান্ন বছর বয়সে চলে গেল, সুখ দেখে যেতে পারল না। মায়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মায়ের যত কথা আমার সঙ্গে, আমাকে না বললে মা যেন শান্তি পেত না।
এইসময় পরপর কয়েকটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় অনিমেষ যেন ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। দুলু পাগলি বাড়ি এল, মাকে ঝুড়ি ঝুড়ি বলে ডেকে কাঁদতে থাকল, বলল, কয়েকদিন ধরে ঝুড়িকে আমার অনাথ আশ্রমে দেখতে পেয়েছি, আমার হাত নেড়ে ডেকে বলত আয় একদিন আমার বাড়িতে। কাল যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আমি, আমাকে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙালো, বলল কিরে আমার বাড়ি গেলি নাতো, আর আমার দেখা পাবি না। পরক্ষণেই কোথায় মিলিয়ে গেল, আমি অনেক খুঁজলাম আর দেখা পেলাম না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল তাই সকালেই চলে এলাম ঝুড়িকে দেখতে। ঝুড়ি তুইতো আর গঙ্গায় স্নান করতে যাবি না। আর তো আমার জন্য পরোটা আলুচচ্চড়ি নিয়ে যাবি না।
অনিমেষ ভাবতে থাকে তাহলে মা মৃত্যুর পরে দুলু পাগলির আশ্রমে গিয়েছিল, এটা যদি সত্যি হয় তাহলে মায়ের সঙ্গে যত কথা আমার সঙ্গে হয়েছে এ'ত বিভ্রম নয়, সত্যি..। কিন্তু কেউ তো বিশ্বাস করছে না। বাড়ির পুরোহিত সব শুনে বলেছিল বিদেহী আত্মা ওর উপর ভর করেছে। অনিমেষ বার বার পুরোহিতের কথা খণ্ডন করে বলছে, সত্যি আমি মাকে দেখতে পাচ্ছি, মা আমার সঙ্গে কথা বলছে। অনিমেষের সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে আর এক বিভ্রম অপেক্ষা করছিল। সুনীল জামাইবাবু প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়িতে ঢুকল। পরনে গেরুয়া ধুতি, গেরুয়া পাঞ্জাবি কপালে লম্বা করে বড় একটা সিঁদুরের টিপ। সটান এসে মায়ের দু পা'য়ে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগল আর বলছিল ছোট মা আজ শেষরাতে আমার আশ্রমে গিয়েছিলে, আমাকে দেখা দিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেলে, আমাকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল তো, ক'দিন আগে গেলে না কেন ছোট মা। আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আর নেই, ভোরের আগেই বসিরহাটের আশ্রম থেকে বেরিয়ে পড়েছি, তোমাকে শেষ দেখা দেখব বলে। আমার অনেক ভাগ্য, তোমাকে শেষ দেখা দেখতে পেলাম। অনিমেষ সুনীল জামাইবাবুর কথা শুনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, মনে হচ্ছিল কোথায় যেন সে হারিয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর আর্তনাদ। মায়ের কাছে সুনীল জামাইবাবুর সব কথা শুনেছে, সেই সব মনে পড়ছে। শেষ জীবনে কলকাতার বাড়ি বিক্রি করে, সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর যে টাকাপয়সা পেয়েছিল তাই দিয়ে বসিরহাটে জায়গা কিনে একটা আশ্রম ও মন্দির তৈরি করেছে। মায়ের ছোট বোনের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তাঁর স্ত্রী কল্যাণী আগুনে পুড়ে মারা যায়। মায়ের কাছে সব শুনেছিল, সেই মৃত্যুর কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
শ্মশান যাত্রা শুরু হল। শবদেহ তোলা হল লরিতে। আরেকটা মানুষভর্তি ম্যাটাডোর প্রচুর মানুষ পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সামনে যাচ্ছিল পুলিশের গাড়ি। কৌতূহলী মানুষজন বাড়ির বারান্দা বা ছাদ দিয়ে দেখছিল। অনিমেষ ভাবছিল মাকে এত মানুষ ভালবাসত। মা তো কখনও বলেনি, মায়ের ডাকনাম ঝুড়ি। সে ভেবে পায় না ঝুড়ি নামটা কে দিয়েছিল, কেনই বা ঝুড়ি বলে ডাকা হত। মায়ের ভালো নাম স্নেহলতা। এই নামটা কেউ জানেই না। শুধুমাত্র রেশন কার্ডে, ভোটার কার্ডে এই নামটা আছে। সবাই মাকে ডাকত শিবুদার না বিশুদার মা, অনিমেষের মা বলে। ক্রমশ এই নামগুলো হারিয়ে গিয়ে এখন সবাই ডাকে হারা'দের মা বলে। হারা'দের মা নামেই মা সবার কাছে পরিচিত। কাছেই বাগবাজার কাশী মিত্র ঘাট আছে, ওখানে নিয়ে যাওয়া যাবে না মা আগেই বলে রেখেছিল, তোদের বাবাকে নিমতলা শ্মশান ঘাটে দাহ করা হয়েছিল, আমি মরে গেলে ঐ শ্মশানে দাহ করবি তবে ঐ খাঁচার মধ্যে পুরে দিবি না কাঠ দিয়ে পোড়াবি।
বড় ছেলে শিবুদা মুখাগ্নি করল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল, মায়ের শরীরটা ক্রমশ বিলীন হয়ে যেতে লাগল। অনিমেষ পাগলের মত কাঁদতে শুরু করল, এত চোখের জল ও, বুকের মধ্যে জমিয়ে রেখেছিল হঠাৎ দেখতে পেল জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে মা দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে- খোকা আরতির প্রদীপ থেকে তাপ নিয়ে যা। ও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে হাত দিয়ে তিনবার মাথায় বুকে আগুনের তাপ নিল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ছুটে এল বড়দা, মেজদা, ছোট বোন ও বেশ কিছু শ্মশান যাত্রী। ওকে টেনে নিয়ে এসে জাপটে ধরে রাখল। অনিমেষ চিৎকার করে বলল, তোমরা আমায় আটকে রাখছ কেন- মা আমাকে ডাকছে। মা আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। শ্মশানযাত্রীরা সবাই অবাক হয়ে দেখল, ঐ জ্বলন্ত আগুনে গায়ের জামা বা দেহের কোন অংশ পুড়ে যায়নি। অনিমেষ শ্মশানের মাটিতে শুয়ে পড়ল অনুভব করল মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ও আধো ঘুমের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। অনিমেষ দেখতে পেল মা ওকে নিয়ে ছুটছে। বনবাদাড়ে, নদীর ধারে, আকাশ গ্রহ নক্ষত্র র মাঝে ও ঘুরে বেড়াচ্ছে আবার মাটিতে নেমে এল মা ওকে নিয়ে। আনন্দে ছুটছে এক বাউল একতারা বাজিয়ে গান গাইছে, এমন মানব জীবন আর হবে না...।
একসময় ঘন অন্ধকারের মধ্যে মা হারিয়ে গেল। অনিমেষ মাকে অনেক খুঁজল, মাকে খুঁজে পাচ্ছে না। ভীষণ ভয় হল, ভয়ে যেন ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে করুণ কণ্ঠে মাকে ডাকতে থাকে। পরে ভীষণ আর্তনাদ করে ওঠে। অবশেষে ঘোরের মধ্যে সব কিছু যেন ভুলভুলাইয়া হয়ে যায় মা... মা... মাগো ডাকে সারা বনজঙ্গল কেঁপে ওঠে। ভীষণ অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পেল। বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক যুবতি নারী। সম্পূর্ণ নগ্ন, তার স্তনযুগল যেন কুমোরের হাতে গড়া মাতৃপ্রতিমার মত। তার দেহ যেন রজত শুভ্র, তীব্র আলোর এক দ্যুতি ঠিকরে বেরোচ্ছে। তার দেহ থেকে গড়িয়ে পড়ছে সাদা দুধের মত ফেনা। সেই যুবতি ক্রমশ এগিয়ে আসছে অনিমেষের দিকে। আরও ভয় ওকে গ্রাস করলে। যেন সমুদ্রের মধ্যে ও ডুবে যাচ্ছে। এক সময় সেই নারীর স্তন ওর মুখে। সেই জলীয় অমৃত ওকে নবজন্ম দিল। ভয় দূর হয়ে গেল। ঠাণ্ডা থেকে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সেই নারীর মুখ ওর খুব চেনা মনে হল, ও মনে করতে চেষ্টা করছিল মনে করতে পারল না। মাকে দেখে অনিমেষ কেঁদে ফেলল, বলল এভাবে আমায় ছেড়ে তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? মা মাথায় হাত রাখল, বলল, দূর বোকা তোকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব? আমি তো তোকে চোখে চোখে রেখেছিলাম, তুই তো আমার বুকের মধ্যেই আছিস। মা আমাকে নিয়ে আনন্দ সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছিল।