১।
বড়রাস্তার ধারের মাচানে কয়েকজন ওম নিচ্ছে গুটিসুটি।
একপাশ দিয়ে যে সরু রাস্তা বেঁকেছে ওদিকে এগোলেই গ্রাম- কাঁপতে কাঁপতে কেউ একজন বলে দিল।
আমরা গলা ভিজিয়ে বাঁক নিলাম। রাস্তার কাজ হয়নি কোনোদিন অথবা হয়েছিল দায়সারা এখন খারাপ হয়ে গেছে। হোঁচট খাচ্ছি আটকে যাচ্ছি।
দেখেশুনে যেতে হচ্ছে। কেউ একজন আসছে টুংটাং টুংটাং।
-এখানে ধুমগাঁ কতদূরে?
-ওই সাঁকো দেখছেন। ওটা পেরিয়ে বাঁক নেবেন। দুপাশে ক্ষেত। আর একটু গেলে একটা পুরনো মড়া গাছ পাবেন। তাবিজ কবজ গুপ্তরোগ চিকিৎসার চিরকুট চেটানো আছে ওর গায়ে স্থানীয় সংবাদ আছে যুদ্ধের খবর আছে নিখোঁজ আর কে কবে কী করেছিল তার বিজ্ঞাপন। গাছের পাশ দিয়ে যে আলপথ ওটা ধরে এগোলেই গাঁ। ধন্যবাদ জানিয়ে গতি বাড়ালাম।
সেতুর নড়বড়ে সুতো ধরে পেরোলাম সবাই। ক্ষেতের কুয়াশা থেকে কেমন একটা আবেশ করা গন্ধ আসছে। ধীরে ধীরে ভাঙাচোরা শরীর নিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে ধুমগাঁ র ঘুমন্ত প্রহরী নির্দেশক। আলপথ ধরার পথে দেখলাম গাছটার গা চকচকে মলিন ছোট বড় অজস্র কাগজ চিরকুট তথ্য সংবাদ বিবৃতিতে ভরে গেছে। নতুন শব্দ কোথায় স্থান পাবে এরপর?
একটু এগোলাম দেখি একটা অবয়ব তারস্বরে প্রলাপ গাইছে জড়িয়ে জড়িয়ে গান গাইছে। গাঁ নিয়ে আমাদের কোন বার্তা দিচ্ছে? সতর্ক করছে? ভয় দেখাচ্ছে? স্বাগত আমন্ত্রন জানাচ্ছে? আমরা ক্রমশ নেশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছি?
এখনও এখানকার ঘরবাড়ি পুকুর দোকান গাছে কুয়াশা জড়িয়ে আছে। ক্রমশ গাঁয়ের ভিতর ঢুকছি। কতটা এলাম জানি না…… একটা বড় ঢিবি চুল্লির পাশে দাঁড়িয়ে বসে কিছুজন নিচুস্বরে কথা বলছে। এটা কি ইঁটভাটা অথবা সমাধিক্ষেত্র?
একজন অস্পষ্ট শুয়ে আছে। তারপাশে কয়েকজন জড়সড় বসে আছে মাথা নিচু করে মাথা উঁচু করে আর শোয়ানো অবয়বে ভাবলেশহীন তাকিয়ে। দাঁড়িয়ে থাকা ভীড় থেকে কুঁইকুঁই করে ধ্বনি ভেসে আসছে চিৎকার আর্তনাদ আসছে। কে বা কারা কাকে বা কাদের সম্বন্ধে যেন কিছু বলছে। আমাদেরকে কেউ দেখছে না বা গুরুত্বই দিতে চায় না হয়ত।
করুণ যেতে যেতে একটা অদ্ভুত বাক্সদর্শন ঘর দেখলাম। দেওয়াল স্পর্শ করলাম। একজন কেউ বেরিয়ে এল। এর গন্ধ আমরা চিনি। এতদিন পর দেখাদেখি অবাক উদাস খুশি হলাম দু’পক্ষ। ভিতরে বসাল। কিছু খেতে খেতে গল্পকথা বলা যাবে। কেমন আছি আমরা? কেমন আছে ও আর ওর অপরিচিত পরিচিতরা? বরফবিস্কুট গলছে।
বাইরে ধাক্কাধাক্কি আর গলার আওয়াজ পেয়ে উঠলাম। কটা অর্ধপরিচিত পরিচিত অপরিচিত অবয়ব জড়ো হয়েছে। আঙুল উঁচিয়ে আমাদের দিকে দুর্বোধ্য ভাষায় কিসব বলছে। দোষারোপ করছে?
কয়েকজন স্পষ্ট হচ্ছে। সাঁড়াশিচাপে আটকে ধরেছে আমাদের।
তারা নিয়ে এল কতগুলো চেয়ারের সামনে। চাপাস্বরে আলোচনা শুরু হল হয়ত। কেউ একজন গুনগুন আবৃত্তি শুরু করেছে। আমাদের অপরাধ আর শাস্তি পাঠ করছে মনে হয়।
না না এই গুঞ্জন একটা গল্প শোনাচ্ছে কেন জানিনা। একসময় এক বৃদ্ধ যাযাবর মারা যায়। তার দুই ছেলে পিতাকে শেষবার ছুঁয়ে ভাগ্যান্বেষণে বের হয় দুটো ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তরে। একজন বিশ্বাসী আর অন্যজন অবিশ্বাসী। তারা ভবঘুরে চলল আর কিছুজন কিছুজন করে জড়ো হতে লাগল তাদের সাথে সাথে। দুটো গোষ্ঠী পুষ্ট হতে থাকে। বৃত্তের আকার ছোট হতে থাকে। একসময় আকাশে ধুলোবাতাস উড়িয়ে লড়াই শুরু হল দুজনের। ছুটতে থাকল দুই দল সমুদ্রের দিকে। সকল বিশ্বাসীর জন্য সমুদ্র দুইভাগ হয়ে রাস্তা করে দিল। অন্যদিকে অবিশ্বাসীরা ডুবে গেল। একদম তলদেশে চলে গেল। তাদের ইতিহাস মুছে গেল বালিঝড়ে। আর সমুদ্র চিরে এগিয়ে যাওয়া বিশ্বাসীর দল শ্বেতডানা মেলে আকাশ কোলে ঘরবাড়ি গড়ল। রুপোলি রাতগুলোতে এই গ্রামে নেমে আসে সদ্যস্নাতা গাছসবুজ স্বচ্ছশরীরের কটা প্রাণ। সুর তুলতে থাকে তারা। আকাশ থেকে সেইসব রাতে সন্তর্পণে নেমে আসে শ্বেতডানারা। মাটি থেকে উঠে আসে ঘেয়োশরীররা। সকলে গুটিগুটি এগোয় সেই ইঁটভাটা সমাধিস্থলের মাঠে। গাছসবুজরা তালে তালে সুর তুলতে থাকে। তাদের ঘিরে ধরে থেবড়ে বসে অপেক্ষা করতে থাকে আকাশ আর পাতালের জীবগুলো। চাঁদের ক্লান্তির সাথে সাথে সুরদের ঘুম জড়িয়ে আসে। এমন সময় শুরু হয় অপেক্ষমাণ দু’পক্ষের দখলযুদ্ধ। তরলে ভেসে যায় চিমনি সমাধি। সব ফুরিয়ে এলে বিজয়ীদল ক্লান্তস্নাতা স্বচ্ছশরীরদের চেয়ারে বসিয়ে রেখে মৃতদের চারপাশে গোলগোল ঘুরতে থাকে। না পুরনো আখ্যান তৈরি করে। তারপর পাখির ডাকের সাথে সাথে এক এক করে সবকিছু মিলিয়ে যায়। গাঁয়ে থেকে যায় পুরনোদের ঘরদোর চুল্লি সমাধিক্ষেত্র মড়াগাছ প্রলাপগান।
এই কাহিনি কেন শোনালো? এটা কি শাস্তির পূর্বে স্তোত্রপাঠ? এটা ঘুমপাড়ানি কথা?
আমাদের সাঁড়াশিচাপ শিথিল হয়ে আসছে ক্রমশ। ‘এস্কেপ’ কেউ চিৎকার করে উঠল। প্রাণপণ দৌড় শুরু হল। জল পেরোচ্ছি মোড়াম কাদা পেরোচ্ছি ফসল খড়কুটো পেরোচ্ছি। হুইসেল বাজছে আর একটু দূরে আর সামান্য একটু দূরে
২।
আমরা এখন একটা স্পেস-এ রয়েছি। জোনাকি নিয়ন সাইরেন টুপটুপ করে নামছে। আশেপাশে জ্যামিতিক আকারগুলো ঘুরছে। আমাদের মুখগুলো মাস্কে ঢাকা। এখানে বাইনারি রঙে কাজ গল্প হয়। সবাই একই গতিতে দুলছে। এক দেওয়াল জুড়ে ফুটে উঠল নালন্দা। সেখানে দাঁড়িয়ে কেউ একজন মাস্ক নিখোঁজের গল্প শোনাচ্ছে বাইনারিতে। এরপর ঘরে ফিরে আসার আর একটা গল্প। তারপর একটা ভূতের গল্প। খানিক থেমে একটা ভবিষ্যতের গল্প। আমাদের গা গোলাচ্ছে খেতে পারছি না। কোনটা খাবার এখানে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ঘুম পাচ্ছে সকলের আর সবাই একটা করে জ্যামিতিক আকার জড়িয়ে লেপ্টে শুয়ে পড়ছি। তরল গড়িয়ে পড়ছে জ্যামিতিতে, সেখান থেকে কাঁচপাতাশিকড়ে, সেখান থেকে নালন্দায়, সেখান থেকে আবার একটা কোথাও।
তরলে ফুটে উঠছে দেখছি- একদল বয়স্ক অল্পবয়সি গোল অক্ষের চারপাশ ঘিরে মুখ হাত পা শরীর নাড়ছে। অতঃপর অনেকের ছোটাছুটি পড়ে যাওয়া দেখলাম। তারপর আবার ফালি হয়ে যাওয়া চাঁদ। তারপর আবার গলে যাওয়া সময়।
এখানে হয়ত একদিন থিতু ঢেউ ঘেঁসে নোঙর পড়বে। সন্ত এসে চরণ গাইবে। ফসল চাষ হবে মরশুম জুড়ে। উপত্যকায় হামাগুড়ি ভোঁ ভোঁ ডাক আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। অজগর কাদামাটিতে শ্রান্ত অপেক্ষা করবে।
এখানে চাদর সাদা চন্দ্রাতপে ঢেকে যাচ্ছে সবকিছু। অতিমারি ফুরোবে না আর?
৩।
আখ্যান ভাসছে এরকম- এই বছর পাহাড়ঘেরা সবুজউপত্যকায় দাঁড়িয়ে থাকবে শক্তিশালী অঞ্চলপ্রধানরা। স্মিত আলগা উদার হাসবে। গল্প আলোচনা বাঁটোয়ারা করবে। কয়েকজন নাতিশক্তিশালী প্রধানকেও গল্প করতে ডেকে নেবে তারা। ফ্যাসি পিতামহের চমৎকার ঘরে থাকবে। প্রত্যেকে সমান বিলাস পাবে কোন ভেদাভেদ তারতম্য নেই। ঘরের বাইরে কজন বাদী বিবাদী পতাকা শ্লোগান ওড়াবে।
আখ্যান ভাসছে এরকম- এক চিকিৎসক শিশু মৃত্যুর কারণ। সংগঠন তার পাশে নেই। সে শাস্তি পাচ্ছে। সে কারণ দেখাচ্ছে। প্রতিবাদ ইত্যাদিতে অংশ নিচ্ছে। সমাজসেবা ইত্যাদি করছে।
আখ্যান ভাসছে এরকম- প্রাচ্য লিপির কোনো বিশেষ গুরুত্ব নেই। কাগজের বইয়ের বাজার নেই।
আখ্যান ভাসছে এরকম- এক প্রধান রেনফরেস্ট পুড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
আখ্যান ভাসছে এরকম- একত্রে গ্রহকে জীবিত রাখার অভিলাষে মিটিং শুরু হবে এবছরও।
আখ্যান ভাসছে এরকম- হোমো স্যাপিয়েন্সররা নিরীহ নিয়ানডার্থালদের বিলুপ্ত করেছে।
কয়েক হাজার বছর পার করছে এক মদালসা খাঁচা
মাকড়সাবমি নীলগুল্মর বিস্তার ঘটছে
বিপরীতমেহন চুঁইয়ে উঠছে কোষের ভারীতে
ধুলো ধূসর দশক খাঁজে খাঁজে তুলো লেগে যাচ্ছে
তিনটে পেটকাটি মইয়ের মাথায় ঝুলে রয়েছে আলগা শক্ত
জল পেরোচ্ছি মোড়াম কাদা পেরোচ্ছি ফসল খড়কুটো পেরোচ্ছি। হুইসেল বাজছে আর একটু দূরে আর সামান্য একটু দূরে
এখানে চাদর সাদা চন্দ্রাতপে ঢেকে যাচ্ছে সবকিছু। অতিমারি ফুরোবে না আর?