১
আমগাছে ভরা বাড়ির ভিতরে বসে তিরতির করে বুক কাঁপছিল মা মরা রুকুর।
পাশের পুকুরে মাগুরের মাথায় ঘি জমলে ছটফট করছিল জলের মাছ।
এদিকে আজকের মতো সন্ধ্যা করে এসেছে চারিদিকে।
বাড়ির সকলে গেছে শনিবারের পুজোয়,
ফিরতে অনেক অনেক রাত হবে।
এমনি সময়ে ভানুমতীর খেল জানা তালেব দা এসে আঁধার ঘর আরো আঁধার করে বসে আছে।
যেন পাহাড়ের কালোমেঘ নেমেছে ঘরের মাথায়।
তার কালো পুরুষ্টু চেহারা, সারা গায়ে সুন্দর রোম, নাভিতে ঘূর্ণি, কোঁকড়াচুলো, এক হাতে পেতলের বালা, কোমরের তাগায় ফুটো কড়ি বাঁধা আছে।
রুকু সন্ধে দিয় এল, পরনে গামছা, চায়ের জল চাপিয়ে বসে রইল খালি গায়ে তালেবের কাছে।
তালেব তখন বলল, আজ আর ময়ূরসাপ খেলা না, শাদা পায়রায় বদলে যাওয়া নয়। অন্য খেলা দেখাব,
তুমি জলদি গা ধুয়ে এসো।
তারপর গোসল করা রুকুকে কোলে তুলে উবু হয়ে বসে মাই দিতে লাগল তালেব।
রুকু হাতপা মুড়ে যেন গর্ভের পরের স্মৃতি ফিরে পেয়ে চোঁ চোঁ পান করতে লাগল সব।
তারপর তালেব হয়ে গেল নারায়ণের ঠান্ডা দাবনার মতো রুকুর লক্ষ্মীকোলে শুয়ে।
দুজনের দুটি সাপ বহুক্ষণ ছাতা ধরে ছিল।
চায়ের জল ফুটে ফুটে উবে গেছে।
লেবুবনের ওধারে শূর্পনখার মতো হাওয়া একলা হেঁটে হেঁটে বেড়াচ্ছে, বাড়ির কেউ ফিরলে ' কু ' সতর্কশব্দে জানান দেবে।
আর দুজন দুজনাকে জাপটে রেখেছে, চোখে দুজনার যুগলমিলনের জল, আর সন্ধ্যাবেলার ধুনুচিধোঁয়া এদেরকে কালো পাথরের রাধবিনোদ ভেবে পাকিয়ে উঠে প্রণাম করছে!
২
আজকের রাতের হাওয়ায় মনে পড়ছে মনসা পুজোর জন্য কচুফুল সংগ্রহের দুপুরবেলাটি!
এক মানুষ উঁচু পাটভুঁয়ের ফাঁকে ফাঁকে জল।
আর জলের ভিতর জল হয়ে আমরা দুজন।
ঢোঁড়াসাপ জড়িয়ে ধরে সেসব সাপসাপ খেলার
ভাঙা দিনের কাঁচ আর হাড়গোড় জেগে ওঠে!
তোমাকে বাহন করে নাভিতে পা দিয়ে বুকে উঠে
ঘটের ভিতরের জল ঘুলিয়ে দিয়েছি।
আমের- শাখা, দুব্বোঘাস সরিয়ে সেই তছনছ করা দৃশ্যটি ভেসে ওঠে, ভেসে ওঠে জলেডোবা কাঠের শবের মতো।
কেমন হুঁ হুঁ করে করে কাঁদছিলাম, আর মুখে আঙুল ভরে কান্না ভুলিয়ে দিচ্ছিলে প্রাণ তুমি।
আজ তোমার বিবাহ হয়ে গেছে।
তোমাদের বাসরের বাইরের পুকুরঘাটে আমি মুখ ঘষটে মরে থেকেছি না দংশাতে পারা মাজাভাঙা বুড়ো সাপ!
৩
অনেকদিনের শোলমাছের লেজের মতো পুরো বাঁশবন জুড়ে চৈত্রমাস নেমে আসছে। ফেটে যাওয়া কালো পাথরের শ্যাওলার ভিতর ভাঁটফুলের বন গজিয়ে গেছে।এদিকটায় কেউ আসে না, তাই ঘাটলায় একা বসে আছে সে। সারা গায়ে গনগনে তাপ। চুল আলুথালু।
বাম স্তন ছোট বলে তাকে কপালে লাথি মেরে খেদিয়েছে বর। কান্নায় গলা অবধি তলিয়ে সে এইখানে বসে একলা স্মরণ করছে মজে যাওয়া পুকুরের ডুবে থাকা বিশালাক্ষ্মীর ঝকঝকে সিঁদুর লেপা স্নেহচোখ।
এবারে দেবী জল থেকে উঠে ফর্সা ব্লাউজে, রুনুঝুনু মল বাজিয়ে গাধায় চাপিয়ে, গলায় রূপমোহের ফাঁস লাগিয়ে টানতে টানতে আনছে শেয়ালের বাম ঠ্যাংয়ের মতো সেই বরকে। সেই জানোয়ার স্বামীর নাভিতে ঢেঁকি রেখে দুজনে মিলে কুটছে বরের যন্ত্রণা দেওয়া হাত, গলা টিপে দেওয়া কব্জি আর চুলে আগুন ধরিয়ে দিতে চাওয়া আঙুল!
কোটার শব্দে গঙ্গাজলের হাওয়া এসে লাগছে বকুলফুলের ডালে। দেবীর গায়ের পুরোনো মাছের আর পদ্মশালুকের ঘ্রাণ এসে জড়িয়ে রাখছে একলা মেয়েটির প্রাণ!
ঠান্ডা শীতল বরের লোভের হাড়, হিংস্রতার মাংস মুখে করে টেনে নিয়ে বাদামগাছের গোড়ায় জমিয়ে রাখছে পিঁপড়েদল। সার হবে।
বেলপাতা ঘেরা বনের ভিতর কাঁচা দুধের সর নামছে। সবশেষে এইবারে দেবীর কোলে শুয়ে পড়লে শ্রান্ত মেয়েটির চুল থেকে উকুন বেছে নখে টিপে মেরে ফেলছে ঘামতেল দেওয়া প্রতিমার হাত।
গর্তের ভিতর খরগোশ ছানা ঘুমোতে যাচ্ছে এতক্ষণ পর। আর দূরে আলোচালের পিঠের মতো চাঁদ উঠছে দূরে কলাপাতার ফাঁকে। চৈত্রের আকন্দবনে পেতলের ত্রিশূল এদের ঘুম পাহারা দিচ্ছে ভোলানাথ। কারা যেন পুরোনো পাতায় আগুন দিয়েছে, তারই মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে নাকে..