এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  কাব্য  তর্জমা  শুক্রবার

  • ব্রেড অ্যান্ড রোজেস - ১

    ইরফানুর রহমান
    কাব্য | তর্জমা | ২৫ জুন ২০২১ | ৩৩৫৫ বার পঠিত
  • ইরফানুর রহমানের ‘‘ব্রেড অ্যান্ড রোজেস’’ সিরিজ থেকে অনুমতিক্রমে নেওয়া এক গুচ্ছ অনুবাদ কবিতা।



    ১. যদি আমি থামিয়ে দিতে পারি একটি হৃদয়ের ভেঙে পড়া
    – এমিলি ডিকিনসন (১৮৩০-১৮৮৬)


    যদি আমি থামিয়ে দিতে পারি একটি হৃদয়ের ভেঙে পড়া,
    আমার জীবন বৃথা যাবে না
    যদি আমি হালকা করতে পারি একটি জীবনের অস্বস্তি,
    বা কমিয়ে দিতে পারি একজনের ব্যথা,

    বা মূর্ছা যেতে থাকা একটা রবিনকে
    ফেরাতে পারি নীড়ে তার,
    জীবন বৃথা যাবে না আমার।

    ২. মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা বন্ধ করো
    –নাজওয়া জেবিয়ান


    মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা বন্ধ করো
    কেনো আরো আগেই সে সরব হলো না।
    হয়তো সে কখনোই জানতে পারেনি
    যে একটা জবান আছে তার।
    মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা বন্ধ করো
    কেনো সে কাউকে এই ঘটনাটি জানায়নি।
    হয়তো তার আশেপাশে শুধু সেই মানুষেরাই ছিলো
    যারা তাকে শিখিয়েছে
    কী করে গিলে ফেলতে হয় নিজের চিৎকার…
    শিখিয়েছে নারীর এমন একটা ভাবমূর্তি তৈরি করতে
    যে সয়ে যাবে সবকিছু, একটিও কথা না বলে।
    হয়তো এই লোকগুলো তারাই
    যারা তাকে শিখিয়েছে একটা পুরুষ
    সম্মতি ছাড়াই তাকে স্পর্শ করার অধিকার রাখে
    আর পুরুষটার মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দ
    সবসময়ই সত্য।
    তা সর্বদাই সঠিক।
    মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা বন্ধ করো
    তার শরীরের কোথায় আঘাতের চিহ্ন দেখা যাবে।
    মেয়েটার আত্মা থেকে তো ইতোমধ্যেই রক্ত ঝরছে।
    আর তার আত্মার ক্ষতগুলো যে গল্প বলে
    কোনো ঘুষি বা লাথির পক্ষে
    তা বলতে পারা সম্ভব ছিলো না কোনোদিন।
    মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা বন্ধ করো
    সে ভয় পায় কেনো।
    হয়তো তার কণ্ঠস্বর ডুবে যাচ্ছে
    লজ্জায়, ইজ্জত আর সুনামের নামে।
    তোমাকে তার মার খাওয়া শরীরটা দেখানোর আগে
    তোমাকে তার মার খাওয়া আত্মাটা দেখানোর আগে,
    ওটা তাকে নিজে দেখতে হয়েছিলো।
    ওটা তাকে নিজে আগে যাপন করতে হয়েছিলো।
    তার আগে আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে হয়েছিলো
    আর দোষারোপ, বিদ্রুপ ও বেঈমানির প্রলেপগুলো
    ত্বক থেকে ছাড়াতে হয়েছিলো একটা একটা করে।
    তাই মেয়েটাকে দোষ দিও না।
    বিদ্রুপ কোরো না।
    বেঈমানি কোরো না তার সাথে।
    তার গল্পটাকে হালকা করার চেষ্টা কোরো না
    তার ধর্ম-সম্প্রদায়ের ব্যাপারে তুমি কী ভাবো
    বা যে-সংস্কৃতির বিষ সে পান করেছে তার ব্যাপারে
    তোমার ভাবনাচিন্তা কী তার দ্বারা।
    হয়তো সেই সংস্কৃতি তাকে বলেছে
    নিজেকে রক্ষা করাটা তার দায়িত্ব
    বলেছে এমন একটা নারী হয়ে উঠতে
    যে শিখে নেবে
    সে পুরুষের চেয়ে হীন।
    মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা বন্ধ করো
    আক্রমণকারীকে সরিয়ে দিতে সে কী করেছে।
    মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা বন্ধ করো
    কেনো কেউ তার গায়ে হাত দিলো।
    তার আত্মায় হাত দিলো।
    তার হৃদয়ে হাত দিলো।
    এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার দায় তার নয়।
    মেয়েটার শুশ্রূষা প্রয়োজন।
    প্রয়োজন মানুষ তাকে বিশ্বাস করবে।
    তাকে দেখতে পাবে।
    তাকে শুনতে পাবে।
    তাই বিশ্বাস করো তাকে।
    দেখো তাকে।
    শোনো তাকে।

    অনুবাদকের নোটঃ ৬ ডিসেম্বর দিনটি ক্যানাডায় National Day of Remembrance and Action on Violence Against Women হিসেবে পালিত হয়। এ-বছর এই উপলক্ষ্যে দেশটির টরন্টো স্টার পত্রিকায় লেবানিজ-ক্যানাডিয়ান অ্যাকটিভিস্ট ও লেখক নাজওয়া জেবিয়ান এই কবিতাটি (Stop Asking Her Why) লেখেন। আমি কবিতাটি ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তরিত করেছি।

    ৩. বাতাস আমাদেরকে বয়ে নিয়ে যাবে
    –ফারুগ ফারাখযাদ


    আমার ছোট্টো রাত্রিতে, আহা
    বাতাস প্রেম করছে গাছের পাতাদের সাথে
    আমার ছোট্টো রাত্রিতে, যেখানে রয়েছে ধ্বংসযাতনা
    শোনো
    শুনতে কি পাও বয়ে যাচ্ছে অন্ধকার?
    আমি আগন্তুকের মতো তাকিয়ে থাকি এই রহমতের দিকে
    যে কিনা নিজেরই নিরাশায় আসক্ত।

    শোনো, শুনতে কি পাও বয়ে যাচ্ছে অন্ধকার?
    কিছু একটা বয়ে যাচ্ছে বাতাসে
    চাঁদ, ক্লান্তিহীন ও রক্তাভ,
    আর ছাদের ওপরে
    তার ভেঙে পড়ার ভয়টা তো চিরকালীন;
    মেঘেরা, শবযাত্রীদের মতো
    মনে হচ্ছে একটা মুহূর্তের অপেক্ষায় আছেঃ বৃষ্টির।
    একটা মুহূর্ত আর
    তারপর কিছুই নেই;
    এই জানলার পাশে থরথর করে কাঁপছে রাত্রি
    আর দুনিয়া যেনো হঠাৎ থেমে গেছে
    এই জানলার পাশে
    অচেনা কিছু একটা দেখছেঃ তোমাকে, আমাকে।

    ওগো পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরোটাই প্রকৃতি
    স্মৃতির মতো পুড়তে থাকা তোমার হাতগুলো রাখো
    আমার ভালোবাসাময় হাতে
    তোমার ঠোঁটগুলোকে দাও
    আমার ঠোঁটের আদর
    সত্ত্বার উষ্ণ অনুভবের মতো
    বাতাস আমাদেরকে বয়ে নিয়ে যাবে
    বাতাস আমাদেরকে বয়ে নিয়ে যাবে।

    অনুবাদকের নোটঃ আধুনিক ফারসিসাহিত্যের মশহুর কবিদের একজন ফারুগ ফারাখযাদ। জন্ম ১৯৩০এর দশকে, তেহরানের এক সামরিক পরিবারে। ১৯৬৭তে, মাত্র ৩২ বছর বয়সে, তেহরানেই এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৭৯র ইসলামি বিপ্লবের পর প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে তাঁর কবিতা নিষিদ্ধ ছিলো। এই কবিতাটি ফারাখযাদের সবচে বিখ্যাত কবিতাগুলোর একটি, ইরানি চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়ারোস্তমির The Wind Will Carry Us (১৯৯৯) সিনেমার নামটি এই কবিতা থেকে নেয়া। মূল ফারসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন আহমদ কারিমি হাক্কাক, আমি বাংলায় অনুবাদ করেছি সেই ইংরেজি অনুবাদ থেকে। ফারসি নামগুলোর বাংলা উচ্চারণ উদ্ধার করে দিয়েছেন বলে মীর হুযাইফা আল-মামদূহের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

    ৪. অঙ্কণশিক্ষা
    –নিজার কাব্বানি


    আমার ছেলে আমার সামনে তার রঙতুলির বাকশো রাখল
    আর আমাকে বলল একটা পাখি এঁকে দিতে।
    আমি ধূসর রঙের মধ্যে তুলিটা ডুবিয়ে দিলাম
    আর তালা ও গারদের একটা চতুর্ভুজ আঁকলাম।
    তার চোখ থেকে উপচে পড়ল বিস্ময়ঃ
    "...কিন্তু এটা তো একটা জেলখানা, বাবা
    তুমি জানো না কী করে পাখি আঁকতে হয়?"
    আর আমি তাকে বললামঃ "বাপ আমার, আমাকে ক্ষমা করো।
    আমি ভুলে গেছি পাখিদের আকার ও আকৃতি।"

    আমার ছেলে আমার সামনে তার অঙ্কণপুস্তকটা রাখল
    আর আমাকে বলল একটা গমের বৃন্ত আঁকতে।
    আমি কলমটা ধরলাম
    আর একটা বন্দুকের ছবি আঁকলাম।
    আমার ছেলে আমার অজ্ঞতা নিয়ে ঠাট্টা করল,
    দাবী করতে করতে,
    "বাবা, তুমি এটাও জানো না, একটা গমের বৃন্ত
    আর একটা বন্দুকের মধ্যে কী ফারাক?"
    আমি তাকে বললাম, "বাজান,
    একসময় আমি জানতাম কী আকৃতি গমের বৃন্তের
    কী আকৃতি পাউরুটির
    কী আকৃতি গোলাপের
    কিন্তু এই কঠিন সময়ে
    জঙ্গলের গাছেরা যোগ দিয়েছে
    মিলিশিয়াদের সাথে
    আর গোলাপ পড়ে নিয়েছে বিবর্ণ পরিচ্ছদ।
    এই সশস্ত্র গমের বৃন্তের সময়ে
    সশস্ত্র পাখির সময়ে
    সশস্ত্র সংস্কৃতির সময়ে
    এবং সশস্ত্র ধর্মের সময়ে
    তুমি এমন কোনো পাউরুটি কিনতে পারবে না
    যার ভেতরে একটা বন্দুক নেই
    তুমি বাগানের এমন কোনো গোলাপ ছিঁড়তে পারবে না
    যার কাঁটা বিঁধে যাবে না মুখে তোমার
    তুমি এমন কোনো বই কিনতে পারবে না
    যা তোমার আঙুলের মাঝখানে বিস্ফোরিত হবে না।"

    আমার ছেলে আমার বিছানার ধার ঘেঁষে বসল
    আর আমাকে বলল একটা কবিতা আবৃত্তি করতে,
    এক ফোঁটা অশ্রু চোখ থেকে আমার গড়িয়ে পড়ল বালিশে।
    আমার ছেলে তা জিভে ছোঁয়াল, অবাক হয়ে, বললঃ
    "কিন্তু, এটা তো অশ্রু বাবা, কবিতা নয়!"
    এবং আমি তাকে বললাম,
    "যখন তুমি বড়ো হবে, সোনামনি আমার
    আর আরবি কবিতার দিওয়ান পড়বে
    তুমি আবিষ্কার করবে শব্দ আর অশ্রু যমজ
    এবং আরবি কবিতা
    লেখমান আঙুল থেকে ঝরে পড়া অশ্রু ছাড়া কিছু নয়।"

    আমার ছেলে তার কলম, ক্রেয়ন বক্স সরিয়ে রাখল
    আমার সামনে
    আর আমাকে বললো তার জন্য একটা দেশ এঁকে দিতে।
    আমার হাতে তুলিটা থরথর করে কাঁপছে
    আর আমি ডুবে যাচ্ছি, কান্নায়।

    অনুবাদকের নোটঃ সিরিয়ান কবি নিজার ক্কাবানির জন্ম ১৯২৩এ, দামিশকে। আরব বিশ্বের সবচে জনপ্রিয় কবিদের একজন তিনি, পেশাগত জীবনে যিনি ছিলেন একজন কূটনীতিক। নিজার বিয়ে করেছিলেন দুইবার, দ্বিতীয় স্ত্রী ইরাকি, ব্যবহৃত আলোকচিত্রটি তাঁর ইরাকি স্ত্রী বালকিস আল-রাওয়ি ও বালকিসের গর্ভে জন্মানো তাঁর দুই ছেলেমেয়ে জয়নাব আর ওমরের সাথে তোলা। ১৯৮১র ডিসেম্বরে, লেবাননের গৃহযুদ্ধ চলকালীন সময়ে, বৈরুতে ইরাকি দূতাবাসে বোমাবর্ষণে বালকিস খুন হন। এই ঘটনায় নিজার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, এবং নিহত স্ত্রীর শোকে রচিত একটি কবিতায়, সমগ্র আরব বিশ্বকে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন। এরপর নিজার আরো সতেরো বছর বেঁচে ছিলেন, আর বিয়ে করেননি, এবং প্রেম তাঁর কবিতা থেকে বিদায় নিয়েছিলো। ১৯৯৮এর এপ্রিলে লন্ডনে এই কবির চিরপ্রস্থান ঘটে।

    ৫. আমার একটি ঘোড়া আছে
    – তোমাজ সালামুন (১৯৪১-২০১৪)


    আমার একটি ঘোড়া আছে। আমার ঘোড়াটির চারটি পা আছে।
    আমার একটা রেকর্ড প্লেয়ার আছে। আমি ওটার ওপর ঘুমাই।
    আমার একটি ভাই আছে। আমার ভাইটি ভাস্কর।
    আমার একটা কোট আছে। যেন আমি উষ্ণ থাকি।
    আমার একটা গাছ আছে। যেন ঘরটা সবুজ থাকে।
    আমার মারুশকা আছে। কারণ আমি তাকে ভালোবাসি।
    আমার দেশলাই আছে। ওগুলো দিয়ে সিগ্রেট ধরাই।
    আমার একটা শরীর আছে। তা দিয়ে করি সবচেয়ে সুন্দর কাজগুলো।
    আমার আছে বিনাশপ্রবণতা। যার জন্য নানাবিধ ঝামেলা পোহাই।
    আমার রাত আছে। তা আমার ঘরের জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ে।
    আমার জোশ সব রেসিং কার আছে। কারণ কার রেসিং ব্যাপারটাই জোশ।
    আমার টাকা আছে। টাকা দিয়ে রুটি কিনি।
    আমি আসলেই ভালো ছয়টা কবিতা লিখেছি।
    আশা করি এমন আরো কয়েকটা লিখতে পারব।
    আমার বয়স সাতাশ। এই বছরগুলো বিজলির মতো চলে গেছে।
    আমি মোটামুটি সাহসী। এই সাহস দিয়ে আমি লড়াই করি নির্বুদ্ধিতার সাথে।
    মার্চের সাত তারিখে আমার জন্মদিন। আশা করি দিনটি ভালো যাবে।
    আমার একটা বন্ধু আছে, যার মেয়ের নাম ব্রেদিতজা।
    বিকালে যখন তারা তাকে বিছানায় শোয়ায়;
    সে বলে সালামুন, এবং ঘুমিয়ে পড়ে।

    অনুবাদকের নোটঃ তোমাজ সালামুনের জন্ম বর্তমান ক্রোয়েশিয়ার রাজধানি জাগরেবে। তিনি জাতিতে স্লোভেন। লিখতেনও স্লোভেন ভাষায়। অখণ্ড যুগোশ্লাভ আমলে স্লোভেনিয়ার রাষ্ট্রপতি কট্টরপন্থী টিটোবাদী আইভান মেচেক সালামুনের একটি কবিতায় একটা মৃত বেরালের প্রসঙ্গ দেখে বেরালটিকে তার রূপক ভেবে ক্ষুব্ধ হন, ফলে কবি গ্রেপ্তার হয়ে যান, এবং পাঁচ দিন জেল খাটেন। অ্যাবসার্ডিস্ট ধারার কবি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত সালামুন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলব্রাইট ফেলো এবং স্লোভেনীয় একাডেমি অফ সায়েন্সেস অ্যান্ড আর্টসের সদস্য ছিলেন। মৃত্যু তিয়াত্তর বছর বয়সে, স্লোভেনিয়ার রাজধানি জুবজানায়।

    ৬. ১ করিন্থীয়গণ ১৩:১-১৩
    নতুন নিয়ম


    যদি আমি কথা বলি মানুষ বা ফেরেশতার স্বরে, কিন্তু না থাকে আমার ভালোবাসা, তাহলে আমি স্রেফ সজোরে বাজানো ঘন্টা বা ঝনঝন করে চলা করতাল মাত্র। যদি আমার থাকে ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা, আর আয়ত্তে আসে সব রহস্য ও জ্ঞান; আর আমার ভেতরে থাকে এমন বিশ্বাস যা সরিয়ে দিতে পারে আস্ত পাহাড়; কিন্তু ভালোবাসা হৃদয়ে না থাকে আমার, আমি কিছুই নই। যদি আমার যা কিছু সম্পদ সব গরিবদের দিয়ে দেই, আর আমার শরীর সয় এতোটা যন্ত্রণা যা নিয়ে গর্ব করা চলে; কিন্তু আমার না থাকে ভালোবাসা, অর্জন করি নি আমি কিছুই। ভালোবাসা ধৈর্যশীল, ভালোবাসা দয়ালু। সে ঈর্ষা করে না, গর্ব করে না, অহংকারী সে নয়। সে অন্যকে অসম্মানিত করে না, স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টায় রত হয় না, সহজে রেগে যায় না, কোনো ভুলের হিসেব রাখে না। ভালোবাসা কোনো অশুভের সাথে উৎফুল্ল হয় না, সে শুধু সত্যের সাথে উল্লাস করে। সে সবসময় রক্ষা করে, সবসময় আস্থা রাখে, সবসময় আশা করে, সবসময় সংরক্ষণ করে। ভালোবাসা কখনোই ব্যর্থ হয় না। কিন্তু যেখানে ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা আছে, একদিন লোপ পাবে; যেখানে জবান আছে, একদিন বন্ধ হয়ে যাবে; যেখানে জ্ঞান আছে, একদিন তাও চলে যাবে। কারণ আমরা যা জানি তা আংশিক ও যে-ভবিষ্যৎ বলি তাও আংশিক; কিন্তু যখন সম্পূর্ণতা আসে, যা কিছু অসম্পূর্ণ তা মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। যখন আমি শিশু ছিলাম, আমি শিশুর মতো কথা বলতাম, শিশুর মতো চিন্তা করতাম, শিশুর মতো মীমাংসা করতাম। যখন আমি মানুষ হয়ে উঠেছি, পেছনে ফেলে এসেছি শৈশবের চিন্তাঅভ্যাস। এই মুহূর্তের জন্য সবকিছু ঝাপসা দেখছি আমরা; তারপর সবকিছু যেমন ঠিক তেমনটাই দেখতে পাব। এখন আমি আংশিকভাবে জানি; তখন জানবো সম্পূর্ণটা, ঠিক যেমন করে আমাকে সম্পূর্ণভাবে জানেন খোদা। আর এখন বাকি রয়ে গেছে শুধু তিনটা বিষয়ঃ বিশ্বাস, আশা, আর ভালোবাসা। কিন্তু এই সবকিছুর ভেতরে ভালোবাসাটাই শ্রেষ্ঠ।

    ৭. আমাদের নারীদের মুখগুলো
    – নাজিম হিকমেত


    মারইয়াম ঈশ্বরকে জন্ম দেন নাই
    মারইয়াম মা নন ঈশ্বরের
    মারইয়াম অসংখ্য মায়ের মধ্যে একজন মা
    মারইয়াম জন্ম দিয়েছিলেন একটি ছেলেকে,
    অসংখ্য ছেলের মধ্যে একটি ছেলে
    এই কারণেই মারইয়াম তার সব ছবির মধ্যেই এত সুন্দর।
    এই কারণেই মারইয়ামের ছেলে এত আপন আমাদের, আমাদের নিজেদের ছেলেদের মতই।

    আমাদের নারীদের মুখগুলো আমাদের যন্ত্রণার এক একটা বই
    আমাদের যন্ত্রণার, আমাদের ত্রুটির, আর সেই রক্তের যা আমরা ঝরাই
    যা আমাদের নারীদের মুখগুলো লাঙলের মত ক্ষতবিক্ষত করে।

    আর আমাদের সুখগুলো প্রতিফলিত হয় নারীদের চোখে
    যেন হ্রদে ঝলমল করতে থাকা এক একটি ভোর

    আমাদের কল্পনা বাস করে
    সেই নারীদের মুখগুলোয়
    যাদেরকে আমরা ভালোবাসি।
    দেখতে পাই বা না পাই, তারা আমাদের সামনেই থাকে,

    আমাদের সমূহ বাস্তবতার
    সবচেয়ে কাছে আর
    সবচেয়ে দূরে।

    অনুবাদকের নোটঃ নাজিম হিকমেতের জন্ম ১৯০২এ, অটোমান সাম্রাজ্যের সালোনিকায়। বর্তমানে জায়গাটি থেসালোনিকি নামে পরিচিত, অবস্থিত গ্রিসে। অর্থনীতি আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে মস্কো যান, ১৯২৪এ যখন মার্কসবাদী হয়ে জন্মভূমিতে ফেরেন, ততোদিনে তুরস্ক একটি প্রজাতন্ত্র। র‍্যাডিকাল বাম রাজনীতি সম্পৃক্ততার কারণে দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন, ১৯৫১তে চিরকালের জন্য দেশ ছেড়েছেন। ১৯৬৩এ তুর্কিসাহিত্যের এই মহান কবি সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোয় চিরনিদ্রায় শায়িত হন, যদিও তার শেষ ইচ্ছা ছিল আনাতোলিয়ার কোনো গ্রামীণ কবরখানায় বৃক্ষছায়ায় সমাধিস্ত হওয়া, যা অপূর্ণই রয়ে গেছে। ২০১৩র ৮ মার্চ এই কবিতাটি অনুবাদ করেছিলাম। আট বছর পর ঘষামাজা করে চূড়ান্ত করলাম।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • কাব্য | ২৫ জুন ২০২১ | ৩৩৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২৫ জুন ২০২১ ১১:৪০495275
  • ইরফানুর রহমানকে ধন্যবাদ।


    সাতটি অনুবাদ কবিতাই খুব ভাল, কবি পরিচয়ও যথাযথ।


    আমায় ভিজিয়ে দিয়েছে।

  • বিপ্লব রহমান | ১১ জুলাই ২০২১ ০৬:০৯495719
  • "হয়তো সে কখনোই জানতে পারেনি


    যে একটা জবান আছে তার।"


    (মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করা বন্ধ করো) ... অসম্ভব শক্তিশালী কবিতা। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন