বাড়িতে কেউ না থাকলে, না থাকার ছায়া ধরে থাকে উঠোন। শোক ও আনন্দ মেশানো একটুখানি মৃদু আলো এসে পড়ে গাছপালাদের মাথায়।
হিমসাগর গাছের নীচে এমনই অর্ধেক আলো অর্ধেক ছায়ায় বসে আছে কোমল রঙের এক ছেলে। নাম - গোলাপি প্রমাণিক। ত্রিশের কোঠায় বয়স, গাল ঢুকে যাওয়া ও নীচু কপাল, একদা ইস্কুল পাশ করেছিল।
সন্ধের দিকে ওঁর বর্ণান্ধ চোখের নীচে কালো কালো দাগ ফুটে ওঠে। ওর মনে হয় এ দাগ যে শুধু ম্লান অভাব-অনটনের তা কিন্তু নয়, একান্ত করে মানুষের স্পর্শ না পেলে, কেউ কাছে ডেকে না দিলে, নিজের বুকে শক্ত হাতে জড়িয়ে না ধরলে এমন নষ্ট-দাগ পড়ে, যেন পাকাফলের ত্বক জল লেগে লেগে পচে গেছে।
সে আসলে ঘরপোড়া মেয়ে-গোরু। একেকজন মানুষকে দেখে নিজস্ব ঘর ভেবেছে যতবার, ততবারই সব অনলে পুড়িয়া গেল।
মাঝে মাঝে মনে পড়ে, কতবার দুধের ফেনায় ভরে গেছে মুখ। ভালোবেসে মুখ গুঁজে দেওয়া এবং ধীরে ধীরে বিদায়ের চাবি আঁচলে বেঁধে সরে আসা। সেই যে এক তছনছ কষ্ট – রাত জেগে থাকা –কিছুতে উপশম নেই। নিজেকে একটু একটু করে ক্ষয় করে ফেলা। অভাবের সংসারে ও বাড়তি কেউ।
মনে মনে ও খালি গায়ে উদোম হয়ে শুয়ে নাভিতে একটা মোমবাতি বসায়। চোখে শুকিয়ে যাওয়া জলদাগ। তিরতির শিখা কাঁপছে বাতাস লেগে।
গলে গলে নামছে মোম। ছ্যাত শব্দ। গলা মোম নাভিতে ভাস্কর্য তৈরি করছে নরম। নিজেকে মনে হচ্ছে হারমোনিয়াম, কে যে বাজাতে বাজাতে উঠে গেছে, যে চলে গেছে ছায়া-ছায়া বনমাঝে সে আর ফিরবে না... ফিরবে না কোনোদিন।
অনবরত আল ধরে ধরে হাঁটা। জনবসতির চিহ্ন যেখানে মুছে গেছে সেখানে মাথা পেতে শুয়ে পড়া। ঘাসে একটু ওম। পোকামাকড়ের কিরকির শব্দ। কুয়োর নীচ থেকে দ্যাখা আকাশ। কতো লেজচেরা কালো কালো পাখি। চোখে জড়িয়ে আসছে ঘুমের আঠায়। এই মাঠ, ধানজমি, পাখি, পুকুর, আকাশ, অস্তরাগের মেঘ এই সমস্তটাই আমার সমাধি, নাভিতে মোম বসানো ছেলে বিড়বিড় করে এইসব ভাবে।
হাঁটতে হাঁটতে ছেলে ভাবে, কেউ না থাকা বাড়িতে কড়াইয়ে সময় নিয়ে নিয়ে সে জল ফোটাবে। তারপর পাত্রে ঢেলে হাতের শিরাটা কুচ করে কেটে চুবিয়ে বসে থাকবে। আস্তে আস্তে মৃত্যু এসে বাথরুমের পাশটা থেকে ওঁকে দেখবে। মৃত্যুর পায়ে লাল পিঁপড়ে কামড়ালে ডান পায়ের মোটা নখ দিয়ে বাঁ পা চুলকে নেবে।
করুণ গোলাপি ছেলের চোখে যখন জড়িয়ে আসবে শেষ ঘুম, ব্যথায় একটু একটু শীত করবে, তখন মনে পড়বে পড়াশোনা করেও ওঁর কাজ জোটেনি, ছোটবেলা থেকে শখ ছিল পড়াবে তা পূর্ণ হয়নি, বিয়ে থা না করে ভেবেছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সবটুকু উজাড় করে শেখাবে, শেষের দিকে চোখ ঘোলা হয়ে আসছিল ও মুখে তিতো থুতু। মরে যাওয়া ছাড়া পথ ছিল নাকো।
শ্বাস বন্ধ হলেই, মৃত্যু ওঁকে সাইকেলে চাপাবে পিছনের সিটে। চলতে শুরু করবে সাইকেল। ঝোপঝাড়, বনপথ, প্রাইমারী ইস্কুল সব সরে সরে যাবে। খয়েরি চাদর জড়ানো মৃত্যুর শিরদাঁড়ায় ঠোঁট ঘষতে ঘষতে গোলাপি ছেলে বলবে - আমি কিছু পারিনি, আমি কিছু পারিনি, আমাকে তুমি নাও, পুরোটা নাও।
এইসব অলীক রূপকথা হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেও ও আত্মহত্যা করতে পারবে না। আসলে ও ভীতু। খুব ভয় পায়। এইসব নরম-ভীতু মানুষদের খুব মরণ। হয়তো ছেলেটি উবু হয়ে কলমি তুলছে। একজন এসে বলল - চুষে দিবি আমারটা একটু? কিংবা বাতাস কেটে সাইকেল চালাতে চালাতে যেন কিছুই জানে না এমন স্বরে আপনমনে বলল - অ্যাই! মেয়েলি ইটভাঁটায় যাবি?
অপমানে কান জ্বালা করে। ও কিছু বলতে পারত না। একদিন ও রুখে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে কেটে কেটে বলে হিসহিসিয়ে - তোর বউ আর মায়ের পারমিশন নিয়ে আয় চুতমারানির পো তারপর যাব, গিয়ে ইঁট দিয়ে তোর বিচি থেঁতো করে দেব।
বাঁশপাতার মতো কাঁপা গোলাপি ছেলে যে এভাবে রুখে দাঁড়াতে পারে তা ছেলের নিজেরই জানা ছিল না। সেদিন থেকে ও একটু একটু আস্থা পেল বেঁচে থাকার।
বাপ পিতামহর ব্যবসা শিখে সেলুন দিল বাজারের কাছে।
শস্তা সেলুন। বড়ো আয়না, চুল কাটার সরঞ্জাম। দেয়ালে গৌর নিতাইয়ের ছবি।
কার ঘাড়ে পাউডার ছোঁয়ালে সন্তানস্নেহের শিহরণ, কোন খদ্দরের কপালে হাত রাখলে প্রথম পুরুষ স্পর্শের আবেশ বা চিরুনি বুলিয়ে দিতে গেলে কেঁপে উঠছে হৃদি সে সব জানা যায় না। গৌর ওই নিঃসঙ্গ মানুষটির মঙ্গল করেছে। মরে যাওয়া থেকে ফিরিয়ে এনেছে। একা একা বেঁচে থাকার আঠা, নিয়ত কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে বেঁচে থাকার অনেক অনেক অর্থ চোখের সামনে খুলে গেছে।
গোলাপি যখন পুকুরে চান করতে নামে মাঝে মাঝে জলের নীচে ডুব দিয়ে বসে হাতদুটো জল থেকে তুলে রাখে। জলের নীচে সবুজনীল দমবন্ধ অন্ধকার। হাতে পৃথিবীর বাতাস এসে লাগছে। মাঝে মাঝে মনে হয় হাতে শাঁখা পলা পরানো। বুকের কাছটা আনন্দে শিরশির করে।