আশ্বিনমাসের ভোরবেলা বেরিয়ে পড়া এ আমার বহুদিনের স্বভাব। অল্প অল্প হিম বাতাসে, আকাশে বেশ একটা নরম পাখির মতো আলো বিছানো,চারিদিক স্তব্ধ। বেলা বাড়লে দুপুরের দিকে যখন মফস্বলের ভিড় কিছুটা কমে এসেছে, তখন ট্রেনে চেপে কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ বেহুলা ষ্টেশনে বা বিষ্ণুপ্রিয়া নেমে পড়া; এতে অনেকরকম বিচিত্র মানুষজন দেখা যায়, কতোরকম দৃশ্য, কেবল দেখার নেশায় ঘুরে বেড়ানো।
শরৎকালে রাজারা মৃগয়ায় বের হত আমি আমার নীল রঙের ছোট নৌকাটিকে মনে মনে সাজিয়ে বের হই।এবারের ভিড় মাত্রাছাড়া। দুবছর সব থেমে থাকার জন্য বোধকরি।গান বাজছে এমন উঁচুস্বরে প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি রব ছাড়ছে তাই নির্জনতার জঙ্গলের দিকে থাকছিলাম অনেকটা সময়।
ভোররাত থেকেই জলহাওয়া মেঘ থমথমে। সকাল থেকেই চারিদিক আঁধার।ভোর শেষ হয়নি তখনো।চারিদিক জনহীন, বাজারের দিকে শুধু ভিড়। সাইকেলে চেপে ঘুরে ঘুরে দেখছি দশদিক।ফলের ঝাঁকা নিয়ে পাতাইহাটের লোক, নতুন গামছা নিয়ে জগদানন্দপুর, মাটির জিনিস ও পদ্মফুল নিয়ে ঘোড়ানাশের মানুষজন বসে আছে।
ঢাক নিয়ে আসে ঢাকিদের ভিড়ের পাশাপাশি সাহেবতলার কাছে দেখলাম একদল হিজড়ে।ঢাকে এখন বক মেরে পালক গাঁথা বন্ধ হয়েছে। হিজড়েদের হাতে ঢোলক একটা, রঙিন জামাকাপড়, দূরের দিকে তাকিয়ে আছে চুপ করে।
বোলান নাচের দল, গাজনের সঙ, রিক্সা চড়ে হাততালি দিয়ে পাড়া কাঁপানো হিজড়ে দেখে বড়ো হয়েছি।ঢোল কাঁধে কোমর বাঁকিয়ে নেচে-কুঁদে বলেছে - 'এই বাবু, টাকা না দিলে তোর উঠোনে দাঁড়িয়ে শাড়ি তুলে ঢোলে জল ঢেলে দিব'।সেই নাচের কী তীব্রতা,সমস্ত না-পাওয়া নাচে ফুটিয়ে তুলে কী প্রচণ্ড বেঁচে থাকা, চড়া গলার খটখটে গান আকাশের ঠোঁট অবধি ছুঁয়ে ফেলছে।
ছোটবেলা মনে পড়ছে। বোলান গানের সভায় বসে ওইটুকুন বয়সে সাংঘাতিক প্রশ্ন করেছিলাম মাকে। উল্টে আছে সন্ধেবেলা, ছেলেরা মেয়ে সেজে আছে। ক্লাবঘরে সাজসজ্জা চলছে। আমি বললাম - মাগো, ওরা তো ছেলে ; বুকে ওমন দুধ হল কী করে? পাশ থেকে হাসির শব্দ উঠল।কে একটা বলল - দুধ নয় রে ওতো নারকেলের মালা রে। তার পরের ঘটনা মনে নেই।
পায়ের গোছ থেকে উঁচুতে শাড়ি পরা পা, ফাটা ফাটা নখ, ও কেন জানি না একমনে ঢোলকে জল ঢেলে যাচ্ছে। আকাশে লাল আর কমলা রঙের মেঘ ফুটেছে।
এই নেচে-গেয়ে প্রাণটাকে উঁচুতে রেখে বেঁচে থাকতে হয়।
এই নাচগানই পেশা।আমার নিজের ঠাকুরদাদার কথা ভাবি। হুঁকো খেত আয়েস করে,রক্তে ছিল বেড়ানোর নেশা। চুন বিক্রি করতে গেছিল ভাদ্রের শেষে। পুরোনো পাতার জঙ্গলে একটা শ্যাওলাধরা গাছের গুঁড়িতে বসে মৌজ করে চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালতেই শুয়ে থাকা গাছ নড়ে উঠল,বুড়োর পোঁদের নীচে গাছভাবা পুরোনো ময়ালসাপ জেগে উঠল শব্দ করে। সেই থেকে বংশ থেকে বুড়ো নিরুদ্দেশ হল কোন দূরে দেশে, সংসার থেকে মন উঠে গেল। শুনেছি ওর থুতনি কাটা ছিল ঠিক এই জলঢালা ফাটাশাড়ির মতোন।
লালবাড়ির কাছে হোগলার কোলের কাছে দাঁড়িয়ে একজন লোক ইশারা করছে বিড়ি ধরানো, চোখে সানগ্লাস পরা ঢোল থেকে একটু দূরের হলুদ চুড়িদারকে।
শরতের রাতে যখন দূরে গান, ওই ঝোপজঙ্গলের পাশে দাঁড়িয়ে লোকটা উবু হয়ে বসবে লুঙ্গিটা খুলে, হলুদ চুড়িদার চামড়ার গোড়াটা শক্ত করে ধরে জিভ দিয়ে ঈষৎ কালচে-গোলাপি মেশানো ত্বকের ফুটোয় জিভ বুলিয়ে চুষে দেবে কিছুক্ষণ, নালেঝোলে একাকার,প্রেমের সংযোগ নেই।রোজগার।রোজগার। রোজগার। সঙ্গে সঙ্গে টাকা। একশো কিংবা দেড়শো।অথবা এসবের কিছুই হবে না।ট্রেন এল আমি উঠে গেলাম।
কামরায় মৃদু ভিড়। আশ্বিনমাসের নৌকা আকাশে। এক বুড়ি গান গাইছে।ওর হাত বাড়িয়ে রাখা। গানের কথা ঝাপসা। করতল ফুটিফাটা, মনে হল বুড়িকে এক আত্মঘাতিনী হরিণ রূপে দেখছি।