কলকাতার বিকাশ এবং বাংলার বিকাশ এক ধারায় হয়নি। আজকের দুনিয়ার মতো সেদিনের দুনিয়া “গ্লোবালাইজড” হয়ে যায়নি। এজন্য উপনিবেশের অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কলকাতা যেভাবে পরতে পরতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেভাবে সমগ্র বাংলার রূপান্তর ঘটেনি। উনবিংশ শতাব্দীর ৩য় দশকের আগে কলকাতার সাথে বৃহত্তর গ্রামীণ বাংলার উভয়মুখী যাত্রাও দুর্বল ছিল। ফলত কলকাতার খণ্ডচিত্র ভিন্নধর্মী – বাংলার অন্য অংশের চেয়ে।
শুরুর কথা
সমাচার দর্পণ পত্রিকায় ১০ কার্তিক ১২৪১ তথা ২৫ অক্টোবর ১৮৩৪-এ প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয়েছিল – “বঙ্গ দেশে যে ৩ কোটি লোক আছে তাহারদিগকে ইঙ্গলণ্ডীয়রা ৯০০ সামান্য গোরা সিপাহী ও ১০০ ফিরিঙ্গি ও ২১০০ সামান্য সিপাহী অর্থাৎ বরকন্দাজ লইয়া জয় করিলেন এবং মুষ্টি পরিমিত সৈন্যের অধ্যক্ষ ৩১ বৎসর বয়সের মধ্যে এক জন অর্বাচীন অর্থাৎ লার্ড ক্লাইব ছিলেন ... দেখুন বঙ্গদেশীয় জমিদারদের মধ্যে ঘোড়ায় চড়িতে পারেন এমত ৫০ জন পাওয়া ভার অতএব বঙ্গদেশীয় লোকেরদের দ্বারা কি প্রকারে ভয় সম্ভাবনা।” (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদিত, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১৯৩)
এ লেখার মাঝে চরম আত্মগ্লানি আছে। কিন্তু কলকাতার জনসমাজকে এ কথাগুলো সেভাবে স্পর্শ করেছিল কি? সত্যার্ণব পত্রিকার মে, ১৮৫৫ সালে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় “বঙ্গদেশীয় নীচ জাতিদিগের বর্তমান অবস্থা (দ্বিতীয় বারের শেষ)” শিরোনামে। এ সংবাদে বলা হল – “আম্র, জাম, কাঁটাল, তেঁতুল ইত্যাদি ফলবান বৃক্ষসকল যাহা অত্যন্ত কষ্টসৃষ্টে বিশেষ পরিশ্রম করিয়া প্রস্তুত করে তাহাও বিক্রয় করিতে হইলে জমিদার মহাশয়রা চৌথ অর্থাৎ চারিভাগের এক ভাগ লন, যদি কোন বৃক্ষ ১৬ ষোল টাকায় বিক্রয় হয়, তবে বার টাকা প্রজার চারি টাকা জমিদারের। কি অন্যায়২। পরিশ্রমের ফলও দুঃখী প্রজারা ভোগ করিতে পায় না।“ (স্বপন বসু, সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালিসমাজ, পৃঃ ৬২) এসব খবরও কলকাতার জনসমাজকে সেভাবে আন্দোলিত করেনি। (চিত্রমূল: উইকি)
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-উত্তর যে ধনী সমাজ (“absentee landlords”) কলকাতায় বসবাস শুরু করে এবং এদের পরবর্তী প্রজন্ম ইংরেজের স্কুলে, অফিসে, আদালতে, কুঠিতে প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষালাভ ও চাকরি করার ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে যে নতুন ধরণের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হল, উনিশ শতক থেকে কলকাতার জনজীবন বলতে সচরাচর ও প্রধানত তাদেরকেই বোঝানো হয়। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান চালু শব্দের বিখ্যাত ইংরেজি অভিধান Hobson-Jobson থেকে জানা যাচ্ছে, ১৭৮১ সাল থেকে বাবু শব্দের ব্যবহার কলকাতা শহরে চালু হয়ে গেছে। ১৮০৩ থেকে এর ব্যবহারের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পায়। ১৭৯৩-এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে অঢেল পয়সার মালিক অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত শ্রেণী কলকাতায় যথেষ্ট সংখ্যায় ঘাঁটি গেড়ে বসলো। চালু হল “বাবু সংস্কৃতি”।
বাবু সংস্কৃতি নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র থেকে “হুতোম” পর্যন্ত বিভিন্ন জনের তুখোড় রচনা রয়েছে। আমি ১৮৬২ সালে প্রকাশিত টেকচাঁদ ঠাকুরের লেখা মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায় থেকে সামান্য অংশ তুলে ধরি – “কোনখানে দলপতি বাবুরা রাত্রে খানা ও মদ সেঁটে প্রাতঃকালে মুখ পুচিয়া জাতমারিতে বসিয়াছেন ... কোনখানে অধ্যাপকেরা শাস্ত্রকে কল্পতরু করিয়া দোকানদারি করিতেছেন ... রাতকে দিন করিতেছেন – দিনকে রাত করিতেছেন ... কোনখানে দালানে পূজা যাগ যজ্ঞ ও ব্রাহ্মণ ভোজনের ধূম লেগে গিয়াছে ও বৈঠকখানায় জাল জুলম ফ্রেব ফন্দির শেষ হতেছে না ... কোনখানে সুশিক্ষিত বাবুরা সাহেব সুবার খাতির রাখিবার ও আপন মান বৃদ্ধি জন্য স্বজাতীয় রীতি ব্যবহার ও ধর্ম্মের বেহিসেবি নিন্দা করিয়া আপন জাতিকে একেবারে ধ্বংস করিতেছেন।” (পৃঃ ৫১; বাবু সংস্কৃতির একটি চিত্র। উৎস অজানা)
দুর্গা পুজোর মরশুম চলছে। পুরনো কলকাতার দুর্গাপুজোর চিত্র দেওয়া যাক। মনে রাখা দরকার, পুজোর সাবেক চরিত্র কলকাতার সেসময়ের “বাবু সংস্কৃতি”তে এসে অনেক বদলে গেল।
কলকাতার পড়শি বোধ
রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তার কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ (আনন্দ, ২০১৯) পুস্তকে বলছেন – “প্যারিস আর অন্যান্য শহরের মতন কলকাতার পুরনো-পুরনো পাড়াগুলো ছিল এক একটা গ্রামের মতন আর সব কিছু মিলিয়ে ছিল এক একটি ছোট্ট ছোট্ট বিচিত্র জগৎ। তার মধ্যে আবার এক একটা গলির নিজস্ব সত্তা ছিল। পাড়ার লোকেরা সবাই সবাইকে চিনত। পরিবারে পরিবারে ঝগড়াঝাঁটি হত, মনোমালিন্য হত, নানা রকমের নীচতাও ছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একাত্মতা, ভালোবাসা ছিল। পাড়ার কারুর বাড়িতে ছেলে হলে বা নতুন বৌ বাড়িতে এলে পাড়ার গিন্নি-বান্নি-বৌ-ঝিরা ঝেঁটিয়ে হাজির হতেন নতুন মানুষটির বা নতুন বৌয়ের মুখ দেখতে। একজনের বিপদ হলে অন্যেরা এগিয়ে আসতেন। কেউ মারা গেলে কাঁধ দেওয়ার লোকের অভাব হত না। নানান কারণে পুরনো পাড়াগুলোর এই পড়শি ভাবটা আস্তে আস্তে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে।” (পৃঃ ৬৮-৬৯)
রাধাপ্রসাদের বই লেখার সময়ের পরে নতুন অর্থনীতির সঙ্গে সামাঞ্জস্য পূর্ণ নব-নাগরিকতা এ ভাঙ্গনকে আরও প্রকট করে তুলেছে। একেবারে সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবার আগে আদি তথা প্রাচীন কলকাতার খণ্ড খণ্ড চিত্র দেখা যাক।
রাধাপ্রসাদের গ্রন্থের বহু আগে রচিত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কলিকাতা কমলালয় গ্রন্থে (প্রথম সংসকরণ ১৮২৩ সালে) ভবানীচরণ বলছেন – “কলিকাতার সাগরের সহিত সাদৃশ্য আছে তৎপ্রযুক্ত কলিকাতা কমলালয় নাম স্থির হইল, কমলা লক্ষ্মী তাঁহার আলয় এই অর্থ দ্বারা কমলালয় শব্দে যেমন সমুদ্রের উপস্থিতি হইতেছে তেমন কলিকাতার উপস্থিতি ও হইতে পারে”। (পৃঃ ৫)
মহেন্দ্রনাথ দত্ত (ভুবনখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দের ভাই) তাঁর কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশঃ ১৯৭৩ সাল। বারিবরণ ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে বিগ বুকস প্রকাশনা থেকে। আমি এই সংস্করণটিকে ব্যবহার করেছি) বলছেন – “ছেলেবেলায় আমরা সকলকে একটা সম্পর্ক করিয়া ডাকিতাম। পিসে জ্যাঠা, মাসি ইত্যাদি, ইহাতে জাতি-বর্ণের কোন কথাই ছিল না। পাড়া-প্রতিবেশীর সহিত একটা সম্পর্ক হইত ... এমনকি চাকরদেরও একটা সম্পর্ক দেওয়া হইত। ইহাতে পরস্পরের ভিতর একটা গার্হস্থ্য সম্পর্ক ছিল এবং আবশ্যক হইলে সকলে সহায় হইত ... বাবু সম্বোধন ছেলেবেলায় আমরা শুনি নাই, এটা ইংরাজী পড়ার দরুন হয়েছে।” (পৃঃ ২৩-২৪)
১৭শ শতাব্দির শেষের দিকে প্রথম গড়ে ওঠা এবং পরের ২০০ বছর ক্রমাগত বিকশিত হয়ে চলা কলকাতা নামক জনপদের মানে ভারত তথা পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক কিছু। একই সঙ্গে উপনিবেশিক বৃটিশ ভারতের প্রথম রাজধানী এবং “জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন”, সম্ভবত ব্রিটিশ ভারতে প্রথম আধুনিক শিক্ষার কলেজ বর্তমান প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির জন্মস্থান, ভারতের প্রথম সুপ্রিম কোর্ট, এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের (১৮৩৫, এশিয়ার প্রথম আধুনিক মেডিসিন শিক্ষার প্রতিষ্ঠান) আঁতুড় ঘর। অ্যাংলিসিস্ট এবং বিতর্কের অবসান-বিন্দু কলকাতা। এবং আরও অনেক কিছুই এখানে প্রথম হয়েছিল। যাঁরা খোজ খবর রাখেন তাঁরা এ বিষয়ে বিলক্ষণ অবহিত।
কলকাতার গোড়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
এ এক সুবিশাল এবং বিস্তীর্ণ ইতিহাস। কিন্তু ইংরেজের বাণিজ্যের প্রথম যুগে নিঃশুল্ক বাণিজ্য এবং ক্ষমতার বৃদ্ধির সাথে জড়িয়ে আছে কয়েকজন ব্রিটিশ ডাক্তারের কাহিনী। আমি কলকাতার গড়ে ওঠার এবং প্রথম যুগের ইতিহাসের কিছু টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে আলোচনা করব।
ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ (মে ২৫, ১৯০৭) একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় “British Medicine in India” (পৃঃ ১২৪৫-১২৫৩) শিরোনামে (লেখক অজ্ঞাত)। সে প্রবন্ধের একটি অংশের শীর্ষনাম ছিল – “Medical Empire Builders”। নামেই অনুমেয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত গড়ে তুলতে ডাক্তারদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হবে। একেবারে গোড়ার যুগে গুরত্বপূর্ণ দুজনের নাম হল গ্যাব্রিয়েল বাউটন (Gabriel Boughton) এবং উইলিয়াম হ্যামিলটন (William Hamilton)।
গ্যাব্রিয়েল বাউটনের মিথ
গ্যাব্রিয়েল বাউটন নিয়ে চালু অতিকথা হল যে দিল্লীর মসনদের সম্রাট শাহজাহানের কন্যার (ভিন্ন মতে স্বয়ং শাহজাহানের) শরীর বাজে ভাবে পুড়ে যায়। বাউটন চিকিৎসা করে পুড়ে যাওয়া মানুষটিকে সুস্থ করে তোলেন। ২ খণ্ডে A History of Indian Medical Service: 1600-1913 (১৯১৪)-এর মতো গ্রন্থের লেখক ডি জি ক্রফোর্ড বলছেন – “One of the most widely known stories of the early history of the English in India is the legend of Gabriel Boughton, Surgeon of the Hopewell; how he was sent for to attend the daughter of the Emperor Shah Jahan, who had been badly burned; how he was successful in effecting a cure ; and how, when desired to name his own reward, he asked for and obtained liberty for his masters, the Company, to trade in Bengal,after which the first settlement of the East India Company in Bengal was founded.” (১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৭) অর্থাৎ, বাউটনের চিকিৎসার ফলশ্রুতিতে দিল্লীর সম্রাট খুশি হয়ে ভারতে ইংরেজদের পত্তনি গড়ার অনুমতি দেন, যা পরে প্রায় ২০০ বছর ব্যাপী ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে শাসিত হবে – এরকম একটি কিংবদন্তি চালু আছে।
সমস্যা হচ্ছে, সম্রাট শাহজাহানের কন্যার চিকিৎসা এবং সুস্থ হয়ে ওঠা নিয়ে বহুলসংখ্যক পরস্পর বিরোধী মতামত পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য মত হল ইতালীয় পর্যটক নিকোলাও মানুচির বিবরণ। মানুচি সেসময় ভারতে ছিলেন (১৬৫৫/৫৬ থেকে ১৭১৭ সাল পর্যন্ত)। তিনি এ ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন – “এই রাজকন্যা নানান ধরণের আমোদ-প্রমোদমূলক কাজে – যেমন সঙ্গীত, নৃত্য এবং আরও অনেক কিছু – যুক্ত ছিলেন এবং আননদ পেতেন। এক রাতে যখন তিনি নৃত্যে মগ্ন সে সময়ে তাঁর একজন প্রিয় নর্তকীর শরীরে আগুন লেগে যায়, এবং তিনি তাঁকে কোলে উঠিয়ে নেন সাহায্য করার জন্য এবংরাজকন্যার বক্ষদেশ বাজে ভাবে পুড়ে যায়।” (Nicolao Manucci, Storia do Mogor, or Mogul India, 1653-1708, Vol. I, পৃঃ ২১৯) মানুচি শাহজাহানের কন্যা জাহানারার পুড়ে যাবার ব্যাপারে বলছেন, কিন্তু বাউটনের চিকিৎসা সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেন নি।
ডোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড তাঁর Surgeons Twoe and A Barber (1950) গ্রন্থে জানাচ্ছেন – “হিজরা ১০৪৬-এ (১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ) শাহজাহানের কন্যা ভয়াবহভাবে পুড়ে যাবার পরে আসাদ খানের পরামর্শে একজন দূতকে সুরাটে পাঠানো হয় ইউরোপীয় সার্জনের সাহায্য প্রার্থনা করে। হোপওয়েল জাহাজের সার্জেন গ্যাব্রিয়েল বাউটন তখন দাক্ষিণাত্যে সম্রাটের ঘাঁটিতে আসেন এবং রাজকন্যাকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। এর ফলে রাজ দরবারে বাউটনের প্রতপত্তির বিপুল বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু তিনি নিজের জন্য কোন কিছু যাঞ্চা করেন নি, ‘but solicited that his nation might have liberty to trade, free of all duties, to Bengal, and to establish factories in that country.’ তাঁর অনুরোধ রক্ষা করা হয় এবং বিনা শুল্কে বাণিজ্যের জন্য এবং দুর্গ গড়ার জন্য সম্রাটের ‘ফরমান’ পাওয়া যায়।” (পৃঃ ৩০-৩১)
কিন্তু পূর্বোল্লিখিত উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তা এবং সুনিপুণ ঐতিহাসিক ডি জি ক্রফোর্ড সমস্ত রকমের ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচার করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বাউটন নন, ব্রিজম্যান নামে এক ইংরেজ শাহ সুজার কাছ থেকে ‘ফরমান’ আদায় করতে সক্ষম হন এবং এ ঘটনা ঘটে ১৬৫১/৫২ সালে। যদিও পরে ফরমানটি খোয়া যায়। (A History of Indian Medical Service: 1600-1913, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫৩) এখানে উল্লিখিত সময়ের সাথে বাউটনের নামে বহুল প্রচারিত সময়ের বিস্তর ফারাক আছে।
আবার আরেকটি ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুযায়ী, বাউটন যে সত্যিই ফরমান পেয়েছিলেন সে সম্পর্কে ক্রফোর্ড বলছেন – “শাহ সুজার কাছ থেকে বাউটন যে সত্যিই কোম্পানির পক্ষে অনুকূল একটি ফরমান পেয়েছিলেন তার আপাত প্রমাণ রয়েছে Court Book of 1674, Vol. XXIX., dated 4th Sept. (১৬৭৪)-এর একটি অনুচ্ছেদে। Bowrey's Geographical Account of-Countries round the Bay of Bengal-এর যে সংস্করণটি স্যার রিচার্ড টেম্পল সম্পাদনা করেন তার ২৩৪ পৃষ্ঠায় এই অনুচ্ছেদটি উদ্ধৃত করা হয়েছে।” (১ম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৩)
কিন্তু সমস্ত ধরণের সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনা করে ক্রফোর্ডের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হল – “সম্রাট শাহজাহানের কন্যা যখন দুর্ঘটনাক্রমে আগুনে পুড়ে যান তখন তাঁকে সারিয়ে তোলার ব্যাপারে বাউটনকে নিয়ে যে কিংবদন্তি আছে তার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। সে সময়ে এমন কোন কর্তাব্যক্তির সাক্ষ্য পাওয়া যায় না যাতে বোঝা যায় যে তিনি সম্রাটের কাছ থেকে কোম্পানির সুবিধার্থে একটি ফরমান আদায়ে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে গ্যাব্রিয়েল বাউটনের বাস্তবে অস্তিত্ব ছিল, তিনি হোপওয়েল জাহাজের সার্জেনও ছিলেন।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৬)
ক্রফোর্ড আরও বলছেন – “গ্যাব্রিয়েল বাউটনের মৃত্যুর দিন এবং স্থান অজানা। তাঁর কোন স্মৃতি ফলক খুঁজে পাওয়া যায়না। তাঁর স্মৃতিতে কোন স্মরণিকাও পাওয়া যায়না। Dictionary of National Biography-তে তাঁর কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু ইতিহাস থেকে জানা যায় যে তিনি কোম্পানির এবং দেশের হয়ে কাজ করেছেন।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬০)
উইলিয়াম হ্যামিল্টনের কাহিনী
ডি জি ক্রফোর্ড তাঁর পূর্বোল্লিখিত পুস্তকে মন্তব্য করছেন – “গত তিন’শ বছর ধরে যত মেডিক্যাল অফিসার ভারতের হয়ে চাকরি করেছেন তাঁদের মধ্যে উইলিয়াম হ্যামিল্টন সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত। এবং নিশ্চিতভাবে সেই ব্যক্তি যিনি দেশের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ হিতকারী (greatest benefactor)।” (প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১১৩)
অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় উইলিয়াম হ্যামিল্টন ১৭০৯ সালে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনো করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরিতে যোগ দেন। এখানে মনে রাখা দরকার, স্বদেশে অর্থাৎ ইংল্যান্ডে সার্জেনদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান একেবারেই সুবিধের ছিল না – কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে। এজন্য পাশ করা ডাক্তারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাঁধা চাকরিতে যোগ দিতেন। এছাড়া প্রাচ্যের তথা ভারতের বিপুল সম্পদ সম্পর্কে লোভ তো ছিলই – যতটুকু কামানো যায় এদেশ তথা ভারত থেকে। কিন্তু এখানেও ডাক্তারদের মাইনে আহামরি কিছু ছিলনা। তবে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করা যেত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উইলিয়াম হ্যামিল্টনের ৬ মাসে মাইনের জন্য বরাদ্দ ছিল £৩৬ বা ১৪৪ টাকা। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৫)
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে কলকাতায় করা প্রথম যে পোস্টমর্টেমের খবর নথিভুক্ত আছে সে পোস্টমর্টেম করেছিলেন যে দুজন সার্জেন তাঁদের একজন হলেন উইলিয়াম হ্যামিল্টন – “In the same year, 1713, Hamilton and Harvey performed a post-mortem, the first in Calcutta of which any record has been preserved, as noted in Cons, of 6th Aug., 1713.” (ক্রফোর্ড, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১১)
যাহোক, তিনি Sherborne জাহাজে করে ভারতে পাড়ি জমান। কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেনের দুর্ব্যবহারের জন্য তামিলনাড়ুর কাছে কাড্ডালোরে নৌকো করে পালিয়ে মাদ্রাজ চলে যান। সেখান থেকে কোম্পানির হুকুম উপেক্ষা করে কলকাতায় এসে পৌঁছন। পরবর্তীতে হ্যামিল্টন সম্পর্কে জানা যায় – “১৭১৪ সালে যখন দৌত্যকার্যের জন্য একটি দলকে কলকাতা থেকে সম্রাট ফারুখ সায়ারের সমীপে পাঠানো হয় তখন কোম্পানির সার্জেন উইলিয়াম হ্যামিল্টন – Dalziel-এর হ্যামিল্টন পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্র – তাঁর দক্ষ চিকিৎসায় সম্রাটকে সুস্থ করে তোলেন। এবং, পরিণতিতে গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সুবিধে লাভ করেন, যার ওপরে কোম্পানির পরবর্তী বহুলাংশে নির্ভর করেছে।” (Donald McDonald, “The Indian Medical Service. A Short Account of its Achievements 1600 — 1947”, Journal of the Royal Society of Medicine, January 1, 1956, pp. 13-17, পৃঃ ১৪)
সম্রাটের কুঁচকির ফোঁড়া সার্জেন হ্যামিল্টন সারিয়ে তোলেন। ৭ ডিসেম্বর, ১৭১৫ সালের বিবরণ থেকে জানা যায় – “We write your Honours the welcome news of the King’s recovery. As a clear demonstration to the world he washed himself on the 23rd ultimo, and accordingly received the congratulations of the whole Court. As a reward for Mr. Hamilton’s care and success, the King was pleased on the 30th to give him in public, viz., a vest, a culgee (এক বিশেষ ধরণের পাগড়ি) set with precious stones, two diamond rings, an elephant horse, and 6,000 rupees; besides ordering at the same time all his small instruments to be made in gold, with gold buttons for his coat and waistcoat, and brushes set with jewels.” (“British Medicine in India”, পৃঃ ১২৪৯)
হীরে, মুক্তো-মাণিক্য খচিত পাগড়ি, সোনার তৈরি সার্জারির যন্ত্রপাতি, কোটের সোনার বোতাম, দাঁতের ব্রাশ রত্নখচিত, এবং কোমরবন্ধের সোনার বোতাম – সবমিলিয়ে হ্যামিল্টনের প্রাপ্তি ভালোই ছিল বলতে হবে।
যাহোক, ফারুখ সায়ারের দরবারে ব্রিটিশ দৌত্য যথেষ্ট সফল হয়েছিল। হ্যামিল্টনের সার্জারি এবং চিকিৎসার গুণে সম্রাটের যন্ত্রণা মুক্তি ঘটে। ব্রিটিশের লাভ হয় বাংলা এবং সংলগ্ন অঞ্চলে শুল্কহীন এবং নিরুপদ্রব বাণিজ্য করার অবাধ অনুমতি তথা ফরমান।
৪ ডিসেম্বর, ১৭১৭ সালে উইলিয়াম হ্যামিল্টনের মৃত্যু হয়। J. Talboys Wheeler মন্তব্য করছেন – “The English mission to Delhi, and story of Hamilton’s success in curing the great Moghul, were long remembered in Calcutta.” (J. Talboys Wheeler, Early Records of British India: A History of the British Settlements in India, 1878, পৃঃ ১৮৪)
হ্যামিল্টনের সমাধিফলকে যা উৎকীর্ণ ছিল (এখন অনেকটাই আর পড়া সম্ভব নয়) সেটা এরকম –
“উইলিয়াম হ্যামিল্টন, সার্জেন,
যাঁর জীবনাবসান ঘটে ৪ ডিসেম্বর, ১৭১৭।
তাঁর স্মৃতি তাঁর দেশের কাছে পরম প্রিয় হয়ে থাকা উচিত
যে সম্মান তিনি ইংরেজদের হয়ে অর্জন করেছেন
হিন্দুস্তানের বর্তমান সম্রাট ফারুখ সায়ারকে সারিয়ে তুলে, সে কারণে
সম্রাটের মারাত্মক ব্যাধি সারিয়ে তুলে
নিজের নামকে তিনি মহান সম্রাটের দরবারে বিখ্যাত করেছেন;
এবং নিঃসন্দেহে বলা যায় তাঁর স্মৃতি
ভারতে এবং গ্রেট ব্রিটেনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে,
এমনকি ইউরোপের অন্যান্য দেশেও।” (Eyre Chatterton, A History of the Church of England in India Since the Early Days of the East India Company, 1923, Chapter IV. Calcutta, 1690-1756, পৃঃ ৫৭))
হ্যামিল্টনের সমাধিফলকে ইংরেজির নীচে ফার্সিতেও একটি লেখা আছে। ফার্সিতে লেখা অংশে কিছু অতিরিক্ত কথা আছে। ইংরেজিতে ফার্সিতে লেখা অংশটির অনুবাদ হল – “having obtained permission from the Court which is the refuge of the universe”। (Wheeler, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮৫)
উইলিয়াম হ্যামিল্টনের মৃত্যুর সমসাময়িক কালে আলেক্সান্ডার হ্যামিল্টন নামে আরেকজন ব্রিটিশ পর্যটক কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি সে সময়ের কলকাতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন – “কলকাতায় সমস্ত ধর্মকে মুক্তভাবে সহ্য করা হয়, but the Presbyterian: and that they brow-beat. The Pagans carry their idols in procession through the town. The Roman Catholics have their Church to lodge their idols in, and the Mahomedan is not discountenanced; but there are no polemics except between our High Church men and our Low, or between the Governor’s party and other private merchants on points of trade.” (Eyre Chatterton, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭২)
অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতায় সমস্ত ধর্মের মুক্ত সহাবস্থান তাঁকে বিশেষ করে প্রভাবিত করেছিল বোঝা যায়।
অষ্টাদশ শতকের শুরুতে কলকাতার চিকিৎসার আংশিক চিত্র
এই আলেক্সান্ডার হ্যামিল্টন সাহেবই সেসময়ে (১৭০৮ সাল নাগাদ) কলকাতার হাসপাতাল নিয়ে এক কৌতুককর মন্তব্য করেন – “The Company has a pretty good Hospital at Calcutta, where many go in to undergo the Penance of Physick, but few come out to give Account of its Operation.” অর্থাৎ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি যথেষ্ট চমৎকার হাসপাতাল রয়েছে। সেখানে বহু মানুষই রোগের চিকিৎসার জন্য যায়, কিন্তু খুব স্বল্প সংখ্যকই ফিরে আসে হাসপাতালের ভেতরের খবর দেবার জন্য। (আলেক্সান্ডার হ্যামিল্টন, A New Account of the East Indies, Being the Observations and Remarks, Vol. II, ১৭২৭, পৃঃ ১১) বিবেচনার দায়িত্ব পাঠকের।
১৭৬৭ সালে “মেডিসিনস, প্রাইস অ্যান্ড ক্লাস” শিরোনামে একটি ছোট সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে – “এটা বিবেচনার মধ্যে রয়েছে যে প্রায় পাঁচ হাজার ইউরোপীয় প্রতি বছর Hon’ble Company-র মেডিসিন নেয়, এছাড়াও রয়েছে সিপাহী এবং কোম্পানির কাজে নিযুক্ত অন্যান্য কালো মানুষেরা।” (Revd. J. Long, Selections from Unpublished Records of Government for the Year 1748 to 1767..., Vol. 1, 1869, পৃঃ ৫১৪)
প্রায় ৫০০০ ইউরোপীয় এবং ভারতীয়র জন্য মেডিসিনের প্রয়োজন পড়ছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফ থেকে যথেষ্ট সরবরাহ না থাকার ফলে বেশি দামে প্রাইভেট সরবরাহকারিদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছিল।
আরেকটি খবরের শিরোনাম “Medicine for Jagat Set” (৪৯৪ নম্বর এন্ট্রি)। আমরা প্রায় সবাই জগৎ শেঠের কথা জানি – পলাশির যুদ্ধে ইংরেজের বন্ধু হিসেবে সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে সেসময়ের বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ব্যাংকার বললে অত্যুক্তি হবেনা।
যাহোক, এ সংবাদে (১৭৬৭) বলা হচ্ছে যে জগত শেঠের জন্য যে যে মেডিসিনগুলো পাঠানো হয়েছে সেগুলো হল – (১) তেল (সম্ভবত তিসির তেল), (২) পশুর শিংয়ের নির্যাস (“extract of horn”), এবং (৩) অন্যান্য মেডিসিন, যেগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়নি। (Selections from Unpublished Records of Government, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩৪)
এরপরে ৪৯৫ নম্বর এন্ট্রিতে সংবাদ হচ্ছে “A Doctor wanted to apply medicine to Jagat Set” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯৪-৪৯৫)। ১৭৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জগৎ শেঠ তাঁর চিঠিতে লিখছেন – “২০ তারিখ, শনিবার, সকাল ৬টার সময় আমি সমতল ভূমিতে পা হড়কে পড়ে যাই এবং এর ফলে আমার কাঁধের জয়েন্ট সরে যায় (disjointed)। ২ ঘন্টা আমার কোন জ্ঞান ছিলনা ... এরপরে আমাকে মেডিসিন দেওয়া হলেও আমার হাত ব্যবহার করতে পারছিনা ... but your favour I have received the use of it again, and I beg you will enquire and send me what other medicines may be necessary to remove the pain, and write me concerning the application, and also send a Doctor that perfectly under stands the nature of the medicines. By your complying with these requests, after my recovery, as long as I have life I shall retain a grateful sense of it.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯৫)
সহজ কথা হল, উইলিয়াম হ্যামিল্টন সার্জারি করে ফারুখ সায়ারের কুঁচকির ফোঁড়া সারিয়ে তুললেও মেডিসিনের জগতে ব্রিটিশদের অবস্থা যথেষ্ট শোচনীয় অবস্থায় ছিল। সেজন্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে পশুর শিংয়ের নির্যাস অব্দি মেডিসিন হিসেবে ব্যবহার করা হত। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক সি এ বেইলির পর্যবেক্ষণ হল – “When the British denounced Indian backwardness in theory, they meant their continued adherence to Aristotelian humoral notions which had only recently been abandoned in Europe. The insecurity of European knowledge was a potent element in their rages.” (C. A. Bayly, Empire and Information. Intelligence Gathering and Social Communication in India, 178-1870, 1999, পৃঃ ২৮১) অর্থাৎ সার্জারির ঔৎকর্ষ সত্বেও মেডিসিনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের সাফল্যের অনিশচয়তা ভারতের ওষধি নিয়ে ক্রোধের একটি বড়ো কারণ ছিল।
যাহোক, কলকাতায় প্রথম ব্রিটিশ হাসপাতাল তৈরি হল ১৭০৭ সালের শেষ দিকে কিংবা ১৮০৮ সালে শুরুতে। (Crawford, A History of the Indian Medical Service, 1600-1913, 1914, Vol. 2, পৃঃ ৪১৮) ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ১৬ অক্টোবর, ১৭০৭-এর একটি অর্ডারে বলা হল – “Haveing abundance of our Soldiers & Seamen yearly Sick, & this year more pticularly our Soldiers, & the Doctr representing to us, that for want of an Hospital! or Convenient Lodgeing for them is mostly the occasion of their Sickness, and such a place will be highly necessary as well for the Garrison and Sloops as Company's Charter party Shiipping to keep the men in health, tis therefore agreed that a convenient spot of ground near the ffort be pitcht upon to build an Hospitall on,” (বানান অপরিবর্তিত, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১৮)
১৭১৩ সালের ২০ আগস্ট, হাসপাতাল রেগুলেশনে বলা হল -
1st. The Hon ble United Company will sup- ply the Hospitall with 30 cots and bedding, 20 Gouns, and 20 Pieces Gurrahs.
2nd. That all the soldiers unmarryd be obliged to repair to the Hospitall when sick.
3rd. That every soldier pay 4 annoes per day whilst sick in the Hospital for his maintenance, every Corporal! six, and a Sergeant half a rupee.
4th. That a centry be kept to secure the sick from going abroad till admitted by the Surgeon, and to hinder all Strong Liquors being brought in.
5. That the Stewaid have all the cloths under his charge and to supply them with all necessarys after the abovementioned gift, his wages 30 rupees per month out of which to pay for firewood, oyl, &c.
6. To provide 6 brass Potts, 6 Saucepans, 12 Porringers, 1 Conge off Pewter Plates with twenty spoons.” (Sd.) Wm. HAMILTON. (Sd.) RICHARD. HARVEY. (Crawford, “Notes on the Eearly Hospitals of Calcutta”, Indian Medical Gazette, January 1903, পৃঃ ১-৬। বানান অপরিবর্তিত)
পাঠকেরা নিশ্চয়ই খেয়াল করবেন যে স্বাক্ষরকারী হিসেবে যে দুজন ডাক্তারের নাম আছে তাঁদের একজন হলেন পূর্বালোচিত বিখ্যাত উইলিয়াম হ্যামিল্টন।
১৭১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম থেকে যে নির্দেশিকা বেরোয় তাতে উল্লেখ করা হল – “Regulations agreed on for the Hospitall, at the Company's charge.
“Medicines out of the stores bought in the Bazar; by Prescription of the Doctors.
“Cotts for the Sick.
“Cloths for Raggs.
“Wood, Charcoal, Potts and Pans, and what else shall be necessary.
“Six Harrys (ক্রফোর্ড জানাচ্ছেন, এর অর্থ ঝাড়ুদার কিংবা মেথর) during the sickly season, and four afterwards.
“Two washermen.
“Dyet of sick men, candles and oil to be made good to the Steward out of the soldier's pay monthly at the Pay Table and no other deduction to be made before he is paid, which expense not to exceed four anaes a day for each man.
“All utensills and necessarys belonging to the Hospitall to be under the Steward's care, and he to be answerable for them.” (Crawford, A History of the Indian Medical Service, Vol. 2, পৃঃ ৪১৯। বানান অপরিবর্তিত)
সংক্ষিপ্ত করার জন্য বলি, ১৭৩৫ সালের একটি অর্ডারে বলা হল যে ডাক্তারদের মধ্যে হাসপাতালেই থাকতে হবে – “Pub. Cons., Fort William, 26th March, 1735. It being necessary for one of the Doctors to reside at the Hospital for the Attendance of the Sick. “Agreed that we build a Couple of Upper Rooms and a Shop for the Medicines at one of the Ends of the Hospitall.” (লক্ষ্যণীয়, এখানে হসপিটাল বানানটি একই নির্দেশে দুভাবে লেখা হয়েছে। প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪২০)
১৭৫৬ সালে পলাশির যুদ্ধের পরে কলকাতার দখল নেবার পরবর্তীতে নতুন হাসপাতাল তৈরি করা হল। কিন্তু সে হাসপাতাল যথেষ্ট বড় ছিল না – “In the Cons, of 6th Sept., 1759, it is noted that the hospital is not large enough for the sick, and it is resolved to purchase Dr. Gray's house, to be used as a hospital, for Rs.15,000.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪২২)
এরপরে সিপাহিদের (অর্থাৎ ভারতীয় সৈন্যদের) জন্য ১৭৬২ সালে Ghireti-তে (সম্ভবত চন্দননগরের একটি অঞ্চল) হাসপাতাল তৈরির খবর পাওয়া যায় – “Agreed till such Time as the Hospitals can be built in the New Fort, that we build one near to Surman's with Fell Trees, and cover’d with Straw, under the Direction of Captain Green, upon the same Construction with those he has built at Ghyrotty, which are found to be extremely good and wholesome Lodgings.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪২২)
কিন্তু এখানে যে সমস্যাটি রয়ে গেল, তা হল যে ঘিরেটির ছবি বা বিবরণ আমরা পাচ্ছি সেটা ফরাসীদের দখলে থাকা চন্দননগরের। সেখানে ব্রিটিশ হাসপাতাল হবে কি করে? এ উত্তর আমার জানা নেই। পুরনো কলকাতার বিশেষজ্ঞরা হয়তো বলতে পারবেন।
১৭৮৮ সালের ১৫ মে একটি নির্দেশিকা থেকে জানতে পারছি – কলকাতার উপকণ্ঠে দমদমে বাতাসের প্রাচুর্যের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, টিকাকরণের উদ্দেশ্যে একটি হাসপাতাল তৈরি করা হবে। টিকা নেবার পরে ১০৫ জনের ইনফেকশন হয়েছিল। এছাড়া, যে ৭২ জন সৈনিক এবং শিশুকে টিকা দেওয়া হয়েছিল তারা সবাই ভালো ছিল। এখানে প্রধানত ইউরোপীয়দের টিকা দেবার জন্য ব্যবস্থা থাকলেও দেশীয়রা টিকা পেত বলে অনুমান করা হয়। (W.S. Seton-Karr, Selections from Calcutta gazettes: showing the political and social condition of the English in India from 1784 to 1823, Vol. 1, পৃঃ ২৫৪)
উনিশ শতকের মধ্যভাগে প্রকাশিত হুতোম প্যাঁচার নকশা-তে “বাবু” কলকাতার চিকিৎসার আরেক চিত্র পাওয়া যায়। “দিসি বিলিতি যমেরা অবস্থা ও রেস্ত মত গাড়ি পালকি চড়ে ভিজিটে বেরিয়েচেন – জ্বর বিকার ওলাউঠোর প্রাদুর্ভাব না পড়লে এঁদের মুখে হাসি দেখা যায় না – উলো অঞ্চলে মড়ক হওয়াতে অনেক গোদাগাও বিলক্ষণ সঙ্গতি করে নেছেন; কলিকাতা সহরেও দু-চার গোদাগাকে প্রাকটিস কত্তে দেখা যায়, এদের অষুধ চমৎকার, কেউ বলদের মতন রোগীর নাক ফুড়ে আড়াম কোড়েণ; কেঊ শুদ্ধ জল খাইয়ে সারেন।” (অরুণ নাগ, সম্পাদনা, সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা, আনন্দ, পৃঃ ৪৭)
আদি ও আধুনিক কলকাতার হাসপাতাল ও চিকিৎসা বৃত্তান্তের রেখাচিত্রে আপাতত এখানেই যতি টানছি।
আদি কলকাতার টুকরো বিবরণ
W. H. Carey-র The Good Old Days of Honorable John Company (Vol. 1, ১৯০৬) থেকে জানতে পারছি – কলকাতার আদিযুগে একই সঙ্গে পোর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসী এবং ইংরেজদের সাম্মানজনক ব্যবসা (?) আইনী পথে লাভের (“lawful gain”) ইতিহাস জানা যায়। (পৃঃ ৩০) পোর্তুগিজদের ব্যবসা ছিল ব্যান্ডেলে, ডাচদের চুঁচুড়ায়, ফরাসীদের চন্দননগরে। এর বাইরে ডেনমার্কের ঘাঁটি ছিল শ্রীরামপুরে। ডেনমার্কের সম্রাট Frederik V-এর নামানুসারে ১৭৫৫ সালের পরে এই শহরের নাম হয়েছিল ফ্রেডেরিকসনগর।
১৭৫৭ সালে ইংরেজ কর্মচারীদের বেতনক্রম ছিল এরকম – রজার ড্রেক বছরে ২০০ পাউন্ড, সিনিয়র ব্যবসায়ীরা বছরে ৪০ পাউন্ড, জুনিয়র ব্যবসায়ীরা বছরে ৪০ পাউন্ড, ডাক্তারদের মাইনে ছিল বছরে মাত্র ৩৬ পাউন্ড এবং কেরানিদের (রাইটার্স) বছরে ৫ পাউন্ড। (The Good Old Days of Honorable John Company, পৃঃ ৩৩)
পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পরে কলকাতার বিন্যাসের অনেক কিছুই আমূল বদলে যেতে থাকে বিভিন্ন স্তরে – প্রশাসনিক চরিত্র, অঞ্চল-বিন্যাস, মিলিটারি অবস্থান, সাদা এবং কালোদের অবস্থানগত বিভাজন ইত্যাদি। ১৭৬০ সালের কলকাতার একটি মিলিটারি ম্যাপ লক্ষ্যণীয়।
বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, ১৭৩৭ সালের ১১ অক্টোবর কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস এবং হারিকেন হয়। সে সময়কার বিখ্যাত Gentleman’s Magazine-এ (লন্ডন থেকে প্রকাশিত) ১৭৩৮ সালের জুন মাসে “হিস্টরিকাল ক্রনিকল” বিভাগে খবরটি প্রকাশিত হয়। প্রাচীন কলকাতার ইতিহাসকার শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা সি আর উইলসন “A Contemporary Account of the Great Storm at Calcutta in 1737” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন Journal of the Royal Asiatic Society-তে ১৮৯৮ সালে (Volume 30, Issue 1, January 1898, pp. 29–33)। প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি জানান – “The great storm of 1737 is one of the few events still remembered in the early history of Calcutta.”
এরপরে জেন্টেলম্যান’স ম্যাগাজিন থেকে তুলে দেন সে বিবরণ – “In the night of the 11th October, 1737, there happened a furious hurricane at the mouth of the Ganges, which reached sixty leagues up the river. There was at the same time a violent earthquake, which threw down a great many houses along the river side; in Golgota (i.e. Calcutta) alone, a port belonging to the English, two hundred houses were thrown down, and the high and magnificent steeple of the English Church sunk into the ground without breaking. It is computed that twenty thousand ships, barques, sloops, boats, canoes, etc., have been cast away; of nine English ships then in the Ganges, eight were lost, and most of the crews drowned. Barques of sixty tons were blown two leagues up into land over the tops of high trees; of four Dutch ships in the river, three were lost, with their men and cargoes; 300,000 souls are said to have perished. The water rose forty feet higher than usual in the Ganges.”
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা ভাবতে কষ্ট হয়। ৩০০,০০০ মানুষ মারা গেছে, ৮টি জাহাজ নিশ্চিহ্ন, ৬০ টনের একটি জলযান উড়ে এসে হাই কোর্টের মাথায় এসে পড়েছে ২ লীগ বা প্রায় ১০ কিলোমিটার উড়ে (১ লীগ প্রায় ৫ কিলোমিটারের সমান)। ঝড়টি ধেয়ে এসেছে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ (৬০ লীগ)। এছাড়া, কত গরীব মানুষের বাড়ি, গোরু-বাছুর এবং পশু-পাখি যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে তার কোন হিসেব ছিলনা।
এ বিবরণে আরও ছিল – ২টি ৫০০ টনের ব্রিটিশ জাহাজ ২০০ ফ্যাদম (১ ফ্যাদম = ৬ ফিট) দূরের গ্রামে গিয়ে পড়ে। ২০,০০০ “ships, barks, sloops, boats, canoes & c” ছত্রখান হয়ে গেছে।
১৮৩৩ সালে প্রকাশিত Memoirs of the Geological Survey of India-য় (ভল্যুম ১৯) এ ঘটনার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল (পৃঃ ১৭০-১৭১)।
কলকাতায় দাস ব্যবসা
পূর্বোল্লিখিত The Good Old Days of Honorable John Company (1906) থেকে জানতে পারছি – “As late as 1760 the neighborhood of Akra and Budge -Budge was infested by slave ships, belonging to Mugs and Portuguese. The East India Chronicle for 1758 gives the following statement showing the origin of this slave system”। (পৃঃ ৪৬৫) প্রতিবছর করাচি থেকে ৬০০ জন যুবাকে (যাদের ৩/৪ অংশ হচ্ছে মেয়ে) দাস হিসেবে বেচে দেওয়া হত। “Slavery was at one time very prevalent in Calcutta, as advertisements in the papers of 1780 and later show.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৬৬)
দাস ভৃত্যদের নিয়ে সে সময়ে যে সমস্ত ধরণের নোটিস বেরোত সেগুলো এরকম – (১) “Wanted”, (২) “To be Sold”, (৩) “Strayed”, (৪) “Slave Boys run away”, এবং (৫) “Eloped”। (পৃঃ ৪৬৬-৪৬৭)
১৭৮৯ সাল পর্যন্ত এরকম ব্যবস্থা চালু ছিল। “During the last century the generality of Europeans in Calcutta kept slave boys to wait on them at table. Slavery was a recognized institution, and as the following advertisement, taken from a Calcutta paper of 1781, shows, the trade was openly carried on even by persons holding holy orders: - “To be sold by private sale: Two Coffree boys , who play remarkably well on the French horn ; about eighteen years of age; belonging to a Portuguese Padrie lately deceased. For particulars enquire of the Vicar of the Portuguese Church .” (পৃঃ ৪৬৮)
দাসদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছিল বাঙ্গালি – “Sir William Jones, in a charge of Grand Jury at Calcutta, in 1785, described the miseries of slavery existing at that period, even in the metropolis of British India”। (পৃঃ ৪৬৮)
১৭৮৯ সালে দাস ব্যবসাকে নিষিদ্ধ করে একটি কঠোর নির্দেশ বেরোয় – “Proclamation, dated 27th July, 1789”। (পৃঃ ৪৬৯)
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৬৯-১৭৭০)
এ প্রসঙ্গে আরও দুয়েকটি কথা বলে নেওয়া যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার absentee landlord-দের কাছে কি বিপুল বৈভবের দরজা তা বোঝার জন্য এ উদাহরণটি যথেষ্ট। “চিরস্থায়ী-বন্দোবস্তের সময় মহারাজাধিরাজ তেজচন্দ্র বাহাদুরের সহিত গবর্ণমেন্টের এই বন্দোবস্ত হয় যে, তিনি নিয়মিতভাবে প্রতি বৎসর ৪০১৫১০৯ টাকা রাজস্ব প্রদান করিবেন এবং ইহা ব্যতীত পুলবন্দী (বাঁধ সারাইবার খরচ) হিসাবে ১৯৩৭২১ টাকা সরকারে সরবরাহ করিবেন।” (হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, কলিকাতা সেকালের ও একালের, ২য় সংস্করণ, সম্পাঃ নিশীথরঞ্জন রায়, ১৯২১, পৃঃ ৫৯৪)
কি বিপুল বৈভবের জোগান থাকলে এই পরিমাণ টাকা সরকারকে দেবার কথা ভাবা যেতে পারে, এ কথা আমাদের ভাবতেও অবাক লাগে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা আমরা সবাই জানি। কৃষক এবং গ্রামীণ উৎপাদকদের রক্তে রঞ্জিত এই অর্থ। ১৭৬৯-৭০ সাল জুড়ে চলা এই দুর্ভিক্ষে ৩ কোটি নিরন্ন বাংলার মানুষের মৃত্যু ঘটে। যদিও আধুনিক গবেষকেরা এই সংখ্যাকে ১ থেকে দেড় কোটির মধ্যে রেখেছেন। সংখ্যাটি যাই হোক কোটির বেশি মানুষ কেবলমাত্র মুনাফার উদগ্র বাসনার কারণে স্রেফ মরে গেল। আরেকদিকে স্তুপীকৃত হল বৈভবের পাহাড়।
এর একটি নমুনা হল – ১৭৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানির রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা, ১৭৬৫-৬৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। (সুপ্রকাশ রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০)
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নিয়ে আধুনিক গবেষকেরা কম বেশি একমত যে একদিকে মুগল আমলের রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, অন্যদিকে জোর করে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছিল, এবং সেটাও নগদে। এর সাথে যুক্ত করতে হবে, ইংরেজ সৈন্যদের জন্য ব্রিটিশরা করমাগত খাদ্য মজুত করে গেছে। পরে সে খাদ্য চড়া দামে কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। ফলে বাংলার কৃষকের অসহায় মৃত্যুবরণ করা ছাড়া অন্য কোন রাস্তা খোলা ছিলনা। অনাবৃষ্টি তুলনায় অনেক গৌণ কারণ ছিল।
বিনীতা দামোদরন তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন (“The East India Company, Famine and Ecological Conditions in Eighteenth-Century Bengal”) – “The evidence suggests low and falling agricultural productivity in the second half of the eighteenth and early nineteenth century and the resulting soaring relative price of grains was to contribute to the scarcity that led to the 1770 famine.” (পৃঃ ৮২)
উইলিইয়াম হান্টার তাঁর The Annals of Rural Bengal (1868)-এ লিখছেন – “In the cold weather of 1769 Bengal was visited by a famine whose ravages two generations failed to repair.” (পৃঃ ১৯) লিখছেন – “The famine which has ensued, the mortality, the beggary, exceed all description. Above one-third of the inhabitants have perished in the once plentiful province of Purneah, and in other parts the misery is equal.” (পৃঃ ৪০১)
L. S. S. O’Malley-কে উদ্ধৃত করে সুপ্রকাশ রায় জানাচ্ছেন – “তাহাদের সন্তান বিক্রয় করিতে বাধ্য হইল। কিন্তু তাহাদের কে কিনিবে? কে খাওয়াইবে? বহু অঞ্চলে জীবিত মানুষ মৃতের মাংস খাইয়া প্রাণ বাঁচাইবার চেষ্টা করিয়াছিল এবং নদীতীর মৃতদেহ ও মুমূর্ষুদেহে ছাইয়া গিয়াছিল। মরিবার পূর্বেই মুমূর্ষুদের দেহের মাংস শিয়াল-কুকুরে খাইয়া ফেলিত।” (সুপ্রকাশ রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২)
দুর্ভিক্ষের অভিঘাতে একটি ভিন্ন চিত্রও জন্ম নিচ্ছিল। তীর্থঙ্কর রায় জানাচ্ছেন – “There is reason to believe that the 1770 famine had strengthened the substantial tenants or jotedars enough to create local bulwarks against zamindari bullying.” (Tirthankar Roy, An Economic History of Early Modern India, 2013, পৃঃ ১৮২) এরপরেই বিদ্রোহী ভারতের আত্মপ্রকাশ ঘটে – সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে যার সূচনা।
কলকাতার বৈভব
কলকাতায় দাস ব্যবস্থার বিপরীতে আরেকটি চিত্রও ছিল সে সময়ের কলকাতায়। ইংরেজের স্নেহধন্য হয়ে বিপুল অর্থ ও বিত্তের মালিক হবার কঠিন প্রতিযোগিতা। একদিকে দাসদের অন্ধকার জগং, অন্যধারে রয়েছে উপচে পড়া সম্পদের পাহাড়। অষ্টাদশ শতাব্দিতে এরকম একজন প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তি হলে, নবকৃষ্ণ দেব।
মহারাজা খেতাব পাওয়া নবকৃষ্ণ দেব বা দে প্রথমে সাবর্ণ চৌধুরীদের এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। সেখান থেকে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থাগম হয়েছিল। শোভাবাজার রাজবংশেরও প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ। “নবকৃষ্ণ উর্দু ও ফার্সি ভাষা খূব ভালো জানতেন। তাই তাঁকে লোকে নবকৃষ্ণ ‘মুন্সী’ বলত। পরে তিনি আরবী ও ইংরেজি ভাষাও শিখেছিলেন। ১৭৫০ সনে ওয়ারেন হেস্টিংসের ফার্সি শিক্ষক নিযুক্ত হন।” ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করলে গভর্নর ড্রেক থেকে শুরু করে বেশির ভাগ ইংরেজ স্ত্রী ও পুরুষেরা লুকিয়ে ফলতায় আশ্রয় নেন। নবকৃষ্ণ সেখানে তাঁদের গোপনে খাবার ও খবর দুই যোগাতেন।
১৭৬৬ সালে ক্লাইভের প্রচেষ্টায় ‘মহারাজা বাহাদুর’ উপাধি এবং ছয় হাজারি মনসবদারি পদ পান। এরপরে ইংরেজের একান্ত আনুগত্যের পুরষ্কার হিসেবে বিভিন্ন পথে বিপুল সম্পদের মালিক হন। মায়ের শ্রাদ্ধে ১৭৬০-এর দশকে ইনি ৯ লক্ষ টাকা খরচ করেন। আজকের হিসেবে এ টাকার পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি হবে। এমনকি বেহালা থেকে কুলপি পর্যন্ত ৩২ মাইল রাস্তা ও কলকাতার রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট নিজের খরচায় তৈরি করিয়ে দেন।” (রাধারমণ মিত্র, কলিকাতা দর্পণ, অখণ্ড সংস্করণ, সুবর্ণরেখা, ২০২১, পৃঃ ৩০০-৩০১)
উইলিয়াম ডারলিম্পল (William Dalrymple) তাঁর The Anarchy: The Relentless Rise of the East India Company (2019) গ্রন্থের ভূমিকায় জানিয়েছেন – “One of the very first Indian words to enter the English language was the Hindustani slang for plunder: loot. According to the Oxford English Dictionary, this word was rarely heard outside the plains of north India until the late eighteenth century, when it suddenly became a common term across Britain.” অর্থাৎ, হাতে গোণা যে ভারতীয় শব্দ প্রথম ইংরেজি অভিধানে স্থান করে তার একটি হল “লুঠ”। বিখ্যাত ইংরেজি অভিধান Hobson-Jobson-এ (নতুন সংস্করণ, লন্ডন, ১৯০৩) লুঠ শব্দটির ব্যাপারে বলা আছে – “The word appears in Stockdale's Vocabulary, of 1788, as “Loot—plunder, pillage.” It has thus long been a familiar item in the Anglo-Indian colloquial.” (পৃঃ ৫১৯-৫২০)
সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত পলাশির যুদ্ধ জেতার পরে বিপুল লুণ্ঠন চলে বাংলা-বিহার জুড়ে। এরপরে ক্লাইভ যখন লন্ডনে পৌঁছন – ““What the people of England did understand very clearly was the unprecedented amount of money – or to use the newly Anglicized word loot – that Clive was bringing back with him.” (The Anarchy, পৃঃ ১৩৮) ডারলিম্পল জানাচ্ছেন – ক্লাইভ নগদে এবং রত্নসম্ভারে ১,২০০,০০০ পাউন্ড অর্থ নিয়ে ফিরেছেন এবং তাঁর স্ত্রীর হেফাজতে যে রত্নসম্ভার ছিল তার পরিমাণ ২০০,০০০ পাউন্ড। এখনকার হিসেবেযথাক্রমে ১২৬ মিলিয়ন পাউন্ড এবং ২১ মিলিয়ন পাউন্ড ছিল লুঠের পরিমাণ। (প্রাগুক্তঃ পৃঃ ১৩৯) “পলাশীর যুদ্ধ বিজয়ের পুরষ্কার স্বরূপ মীরজাফরের নিকট হইতে দুই লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড (৩৫ লক্ষ ১০ হাজার টাকা) আত্মসাৎ করিয়া ক্লাইভ রাতারাতি ইংলন্ডের শ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন বলিয়া গণ্য হইলেন।” (সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, ২০০৮, পৃঃ 8)
সুপ্রকাশ রায়ের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় – “১৭৫৭ হইতে ১৭৬৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলা ও বিহার হইতে মোট ৬০ লক্ষ পাউন্ড, অর্থাৎ নয় কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করিয়াছিলেন।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ 8) লুঠের কিছুটা অংশ ভারতীয় সহযোগীরাও পেয়ে বিত্তশালী হত।
হরিসাধন মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন – “মহারাজাধিরাজ মহতাবচন্দ্র বাহাদুর বঙ্গদেশের শ্রেষ্ঠ জমিদার ছিলেন ... সাঁওতাল বিপ্লবের সঙ্কটকালে এবং সিপাহী বিদ্রোহের সময় মহারাজাধিরাজ মহতাব চাঁদ বিশ্বস্তভাবে ইংরাজ গবর্ণমেন্টকে সাহায্য করিয়াছিলেন।” (কলিকাতা সেকালের ও একালের, পৃঃ ৫৯৫)
চূড়ান্ত বৈভবের পাশে চরম দারিদ্র্য, দাসপ্রথা এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সহাবস্থান। আবার একইসঙ্গে বিদ্রোহী ভারতের প্রস্তুতিও বটে মন্বন্তরের অভিঘাতে।
নটে গাছটি মুড়লো, পুরনো কলকাতার টুকরো কাহিনী ফুরলো।