ভোর পাঁচটা বেজে বারো মিনিট। হাবড়া স্টেশন। তিন নং প্ল্যাটফর্ম। একজনের ছাতার জল অন্য অন্য জনের ঘাড়ে ছিটে ছিটে পড়েই চলেছে। ঝগড়া লেগেছে জোরতার। লেডিস কামরার চার নং গেটটা এসে দাঁড়িয়ে পড়ল একেবারে সামনে। ওই চারজনের কেউই ঝগড়ার চোটে এতোক্ষণ খেয়াল করেনি ট্রেনটা যে ঢুকে পড়ে স্পিড কমাতে কমাতে একেবারে থেমে গেছে। গেট থেকে জোরসে ধাক্কা। পিছন থেকেও জোর ঠেলা এবার। থেমে গেল ঝগড়াটা। হুড়মুড় করে উঠতে নিল তিন পক্ষই। গেটের ভেতর ঠেলাঠেলির মাঝে আবার কিছুটা শুরু হতে গিয়ে এ ওদিকে সে সেদিকে ছিটকে গিয়ে আর বেশি জমাতে না পেরে একেক জনের একেক প্রসঙ্গ শুরু হল। পরের সেন্টেন্স গুলো প্রশ্নবোধক। ও মাসি কোথায় ? হ্যাঁ তারপরের মাসি ? হ্যাঁ হ্যাঁ ওই যে তোমার পিছনে ঘুমাচ্ছে ওই মাসি কোথায় নামবে?
গেটের ডান দিকে একটা রো। লেডিস কামরার শেষটুকু। মানে কামরা ওখানেই শেষ। মুখোমুখি সিটের মাঝখানে ডানে বাঁয়ে দুখানা লাইন। ফাঁকা বলতে কিচ্ছু নেই। ওই ডান পাশটায় প্রথমে এপাশ ওপাশ মুখ করে পিঠে পিঠে দাঁড়ানো চারজন। তার পিছনে দেখে মনে হচ্ছে কিছুটা যেন ফাঁকা। ফাঁকা না। ওখানে বসে মাটিতে জনা ছয়েক মহিলা। জানলার নীচে হেলান দিয়ে বসে এক জন। তার এক হাঁটু উপরে এক হাঁটু মাটিতে পাতা। শাড়িটা গুটানো হাঁটু অবধি। ওর দুই হাঁটুর গা ঘেঁষে আর দুজন। তার পিছনে আগু পিছু করে জনা তিনেক। ওই জনা তিনেকের মাথার উপর প্রায় ঢেলে পড়ছে দাঁড়ানো দুই মহিলা। এরই ফাঁকে ফাঁকে দুটো ঝুড়ি রেশন ব্যাগ এখানে ওখানে গোঁজা। সিটের উপর যারা বসে নিয়েছে পা গুলো তুলে দিয়েছে সিটে। ওই সিটে মেঝেতে বসে থাকা দলটার কে কোথায় বসবে কে উঠে দাঁড়াবে কে কাকে এই দুটো স্টেশন বসতে দেবে সব ঠিক করে দিচ্ছে একজন পিছন থেকে। ওই যে জানালার নীচে হেলান দিয়ে বসা, উনি। বসে পান চিবিয়ে যাচ্ছেন। জর্দার গন্ধটা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ফ্যাকাশে কমলা ব্লাউজের পিঠটা ভিজে গেছে জানলার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে গড়িয়ে।
গুমা ছাড়ছে ট্রেনটা। ভিড়ের চাপটা আরও বেড়ে গেছে। বৃষ্টিটাও বেড়েছে। কাচের জানলার পিছনের কাঠের ফাঁক ফাঁক জানালাটা এর মধ্যে এক ফাঁকে উঠে দাঁড়িয়ে বন্ধ করে আবার কাচের জানালাটা আটকে দিয়েছে। জানালা গড়িয়ে জল এখনও পড়ছে। ওই ডানপাশটা এখন অন্ধকার। গেট দুটো থেকে ভিড়গুলো সামান্য একটু ঢুকে বসে গেটদুটো টেনে দিয়েছে। বিড়া আসার আগে আবার খুলে যাবে। ওই জানালার কোণে ডানপাশে রাখা রেশন ব্যাগ ভর্তি ডাঁটা শাক। ট্যাগ ছেঁড়া কোল্ড ড্রিংক্সের জল ভরা বোতলটা ডাঁটার মাঝ দিয়ে মাথা উঁচু করে রয়েছে। একখানা টিফিনকারি বেরিয়েছে ওই কোনায়। এই টিফিনকারির মালিক মালতী। ওরই ফ্যাকাশে কমলা ব্লাউজের পিঠ জানালার জলে ভিজছে। অন্ধকারে দু এক মিনিট তাকিয়ে থাকলে দেখা যাচ্ছে চওড়া গোল একখানাই বাটি। মোটা চালের ভাতে মাখামাখি হয়ে আছে কাঁটা পেঁয়াজ ডাল ডাঁটা চচ্চড়ি। আগে থেকেই সব মিশে রয়েছে। মালতী তাও মিশিয়ে যাচ্ছে। পুরো চেটো দিয়ে চটকে চটকে মিশিয়ে যাচ্ছে ভাত মুসুরির ডাল ডাঁটা শাকের চচ্চড়ি। হাতের চাপে মোটা মোটা ভাতগুলো গলে যাচ্ছে। একেক গ্রাসে যতদূর নেওয়া যায় তততাই মুখে তুলে চিবাতে চিবাতে এ সবিতা এ সবিতা বলতে বলতে কি সব বলে চলেছে। মুখ ভর্তি ভাতে শোনা যাচ্ছে না ভালোমতো কথাগুলো।
ভেতরের চ্যাঁচামেচি একটু কমেছে ট্রেনের চালে বৃষ্টির আওয়াজে। বাটিতে আর একখানাও ভাত নেই। হাতেও নেই। পুরোটা চেটে খাওয়া হয়ে গেছে হাতের পাতা আঙুলগুলো এদিক ওদিক ঘুরিয়ে। ওই বাটিতেই হাত ধুয়ে এক ফাঁকে জানলা খুলে ঘোলাটে জলটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। বৃষ্টির জলের সাথে মিশে গেছে এঁটো ভাত ডালের ঘোলাটে জল। চেটো আঙুল থেকে হলুদ রঙটা এখনও যায়নি। চ্যাঁচেমেচি একটু কমেছে। বৃষ্টি বেড়ে গিয়ে বিড়া দত্তপুকুর থেকে লোক ওঠেনি তেমন। পিঠটা এখনও ভিজে চলেছে টিনের দেওয়াল বেয়ে আসা বৃষ্টির জলে।
বড় একখানা ঢেঁকুর তুলে আঙুল দিয়ে চুন ডলে ডলে সুপাড়ি খয়ের তিনশ জর্দা দিয়ে পান সেজে মুখে পুড়ে দিল। গালটা কেমন ফুলে উঠল। ভেজা ব্লাউজের উপর তেলচিটে ভেজা ভেজা চুলগুলো পিঠ বুকের উপর ছেড়ে দিয়েছে। চেঁচামেচির বদলে একটা সুর আসছে কানে। ওই অন্ধকার জানালার নীচ থেকে। ওই যে হাঁটু তুলে বসা মালতীর গলায়। মুখের চিবোনো পান ডান গালে জমিয়ে রেখে সুর তুলছে। ওর হাঁটুর উপর ঢেলান দিয়ে আরও একজন গলা মিলাচ্ছে। বাকি তিন জন ঝিমছে। মালতীর গলার রগগুলো ফুলে উঠছে উঁচুতে সুর ওঠার সাথে সাথে। গানের সব কথা বোঝা যাচ্ছে না ভাল মতো। কিছু ঠিক কিছু বেঠিক। যা যতটুকু বোঝা যাচ্ছে…