বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি শব্দগুলির সাথে আরেকটা শব্দ বারবার উঠে আসছিল ওর কথায়। কাজের বাড়ি। গলাটা কাঁপছিল। পুরো কথা বার্তার মাঝে একবারও আমার দিকে তাকায়নি। চোখগুলো গোবর লেপা দাওয়ার দিকে আর নোনা মাটির উঠোনের দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
টিনের চালের ওই ঘরটা সাতজেলিয়া দ্বীপে। গদখালি থেকে নৌকোয় গোসাবা। গোসাবা থেকে মোটর ভ্যানে চড়ে আধাঘণ্টা গিয়ে জটিরামপুর ঘাট। সেখান থেকে নৌকোয় গোমর পার হয়ে সুকুমারী ঘাট। মোটর ভ্যানে উঠে সাতজেলিয়া দয়াপুর হেমিলটন আবাদের পর সাধুপুর। দেড় ঘণ্টার পথ। ডান পাশে নোনা মাটির কাদার উপর শিকর আঁকড়ে ধরা ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। নদীর ওপারে দেখা যাচ্ছে রিসার্ভ ফরেস্ট। রাস্তার ধারে বাড়ি ঘর অনেক দূরে দূরে। বাঁ ধারে বেড়ার দেওয়ালের বনবিবির মন্দির দেখিয়ে দিলেন ভ্যান চালক।
ম্যানগ্রোভ জঙ্গল খাঁড়ি কদাচিৎ বাঘের দেখা আর শহরের ঝুট ঝামেলা জ্যাম গ্যাঞ্জাম থেকে দু-তিন দিনের মুক্তি জন্যেই তো টুরিস্ট ভিড় করে এখানে। আর এখান থেকে প্রতি বছর প্রতি মাস প্রতিদিন মানুষ চলে যায় বাইরে। কাজের খোঁজে। এই নদীগুলি এই নোনা মাটির কাদা পেরিয়ে ট্রেন ধরে শ’ শ’ কিলোমিটার দূরে দিল্লি কেরালা নয়ডা অন্ধ্রপ্রদেশ।
যেতে যেতে ডান পাশে নদীর ধারে সুন্দর একটা রিসোর্ট দেখা যাচ্ছে। ভিউ রুমের জানালা দিয়ে জঙ্গল নদী পাখি আর জঙ্গলের ভেতরের খাঁড়ি দেখা যায়। এই সাতজেলিয়ার আশেপাশের কোনও এক চিলতে খাঁড়িতে একটা ঘটনা ঘটে চলেছিল যখন আমি ওই রিসোর্টটা পেরচ্ছিলাম।
সাধুপুরে যে বাড়িতে গিয়ে প্রথম ঢুকলাম বাড়িতে চাপা একটা উত্তেজনা চলছে। ফিসফিস বিড়বিড়। আস্তে আস্তে গোঙানির আওয়াজ আসছে ঘরের ভেতর থেকে। এ বাড়ির কুটুমকে বাঘে তুলে নিয়ে গেছে ওই একটু আগেই। ওই যে খাঁড়ির কথা বলছিলাম, সড়কখালির জঙ্গলে কোনও এক খাঁড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁকড়া ধরতে গেছিল। কাঁকড়া বেঁচে হাটে। এক মহিলা আর দুই পুরুষ গেছিল ছোট এক খানা ডিঙি নৌকো নিয়ে। সেই তিনজনের একজন এদের কুটুম। তাকেই নৌকো থেকে বাঘে ঘাড় কামড়ে নিয়ে গেছে। বাকি দুই জন ফিরেছে। পুলিশের নিষেধ আছে ওখানে। লুকিয়ে চুরিয়ে ওরা ঢুকে পড়েছিল। বয়স ষাটের বেশি হবে। এ বাড়ির ছেলের বৌয়ের মেসো হয়। থাকত পাশের পাড়াতেই। পাড়ার কিছু লোক এসে ঢুকেছে এ বাড়িতে। মরার খোঁজ খবর নিতে এসেছে চুপিচুপি। কুটুম বাড়িতে সহানুভূতি জানাতে যাওয়ার উপায় নেই। এ মরার খবর জানাজানি হলে বিপদ। জানাজানি হলে এইসব সহানুভূতি জানাতে যাওয়া কুটুম বাড়ির লোকেদের নামেও কেস হবে। ওই পাড়ার লোকের মধ্যে কোনও এক বৃদ্ধ বিড়ি টানার ফাঁকে বলছিল, আরে ওসব কিচ্ছু না। এসব পলিটিকাল ব্যাপার ভাই। ওদের পার্টির লোক হলে কিচ্ছু হতনা। সব বেঁচে যেত। এখন তো এদের ধরে মজা পাবে তাই না! এটাই সুযোগ ঠান্ডা করার। এদেরও কাঁকড়া-মধু-মাছ না ধরলে পেট চলবে না আর ওরাও ওত পেতে থাকে এই সুযোগে মজা দেখার। ওদের পার্টির লোক হলে সে যে খাঁড়িতেই ঢুকুক আর বাঘের ডেরাতেই যাক কিস্যু হত না। ওই পার্টিতে নাম লেখায়নি। ব্যস! সব কটাকে হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে ঢুকিয়ে দেবে সোজা গাড়দে।
আমি অবাক হচ্ছিলাম যত সময় যাচ্ছিল। যিনি মারা গেলেন বাড়িতে রয়েছে শুধু তার বৃদ্ধা স্ত্রী। ভাবলাম সেই বাড়িতে থেকে যাওয়া একলা বিধবা বৃদ্ধাই অবশিষ্ট রয়ে গেল এখন ঠান্ডা করার মত। এই সুন্দরবনে বাঘের পেটে কে যাবে একদিকে যেমন দারিদ্র নির্ধারণ করে দেয় তার সাথে কী লোকাল পলিটিকাল পার্টিও দায়িত্ব নিয়ে নির্ধারণ করে দেয়? এটাই কী সুন্দরবনের নিয়ম? নাকি পার্টি পলিটিক্সের নিয়ম! ওই বিপজ্জনক খাঁড়িতে কাঁকড়া মাছ ধরতে যারা যায় তারা রুলিং পার্টির লোক হোক আর বিরোধী পার্টির হোক একটা বিষয় তো কমন। এ ছাড়া পেট চালানোর কোনো উপায় নেই তাই ওদিকে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যায়। এখন প্রশ্ন হল রুলিং পার্টির মানুষ হলে বাঘের পেটে যাওয়ার ছাড়পত্রও কী খুব সহজেই মিলে যায়?
বডি খুঁজে পাওয়া যায়নি। যাবেও না শুনলাম। ওই বৃদ্ধা তিন দিনের মাথায় অপঘাতে মরার কাজ করবে লুকিয়ে চুরিয়ে। ধুমধাম করে শ্রাদ্ধ! শ্রাদ্ধ করার টাকা কোথায়? যদি জোগাড়ও হয় আবার কেস খামারির ভয়। আমি আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব বহু মৃতের পরিবারে সহানুভূতি জানাতে গেছি। বাড়ির মানুষ এক্ষুণি মরেছে অথচ জোরে চেঁচিয়ে একটু মনের সুখে কাঁদতে পারছেনা এমন অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। সুন্দর বনের এই কাঁকড়া-মধু বিক্রির পেশার মানুষ যদি আমার আত্মীয় হতেন তবে হয়তো এ দৃশ্যেই অভ্যেস হয়ে যেত।
ঘণ্টা খানিক পরে ঘরের ভেতরের উত্তেজনা কেমন কমে এলো। হয়তো শোক জিনিসটাই এমন। যা কথা দিয়েছিল বাড়ির কর্তা তেমনটাই করলেন। বেয়াই মরার খবরে কর্তব্য পালন করতে না পারলেও এই শহরের মানুষটির প্রতি কর্তব্য পালনে ত্রুটি রাখলেন না। সুন্দরবন থেকে দূর শহরে কাজ করতে যাওয়া মেয়েদের পরিবারে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। নিয়ে গেলেন।
মাটির ঘর। ভেতরে উঁকি দেওয়ায় মা লক্ষ্মীর একটা ক্যালেন্ডার আর চৌকির উপর দু’পাশে টাঙানো মশারি চোখে পড়ল। বসলাম মাটি লেপা বারান্দার ন্যাড়া চৌকির উপর।
একটু আগের ওই বাড়ির মহিলা পুরুষের চোখেমুখের ভয় আবার যেন এ বাড়িতে ফিরে এলো। বৃদ্ধ এক লোক কিরকম অবাক চোখে আমার সম্পর্কে দু-একটা কথা জানতে চেয়েই বাড়ির বাইরে চলে গেল। মেয়েটি ঘোলা দুটো চোখ কচলাতে কচলাতে মাটির রান্নাঘর থেকে ঘুম ভেঙে উঠে খোপা বাঁধতে বাঁধতে দাওয়ার সিঁড়িতে বসে পড়ল।
কথা শুরু করল ঝাঁঝালো সুরে, কী বলছেন! বলেন! আমি কিছু জানিনা। কিচ্ছু হয়নি আমার সাথে।
চমকে উঠলাম। ওর ঘুম জড়ানো ঘোলা দু’চোখে বিরক্তি রাগ আর ভয় দেখে। যিনি আমাকে নিয়ে গেছিলেন তিনি খানিক ভূমিকা করে রেখেছিলেন মেয়েটি সম্পর্কে। ওর প্রথম কাজে যাওয়া চৌদ্দ বছর বয়সে। ২০০২ সাল। পাড়ার কোনো মেয়ে এই পাড়া থেকে মেয়ে জোগাড় করত। বলেছিল, কাজে যাবি? কাজ আছে।
- পাঠাও না কাকা তোমার জামাইয়ের সাথে। খেতে পাবে, পরতে পাবে, মায়না পাবে।
ওই বৃদ্ধ লোকটি তখন যুবক। গায়ে শক্তি ছিল অনেক। নৌকা চালাতে পারত খাঁড়িতে খাঁড়িতে। কাঁকড়া ধরতে পারত। কিন্তু পয়সা ছিল কম। নিরুপায় বাবা চারটি মেয়ের এই মেজ মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছিল পাড়ার জামাই এর সাথে দিল্লি। সাধুপুরের জামাই দিল্লির দালাল।
মেয়েটির আপত্তিতে মোবাইল ব্যাগ থেকে বার করিনি। ক্যামেরা অন হল না। শুধু শুনে চললাম ওর কথাগুলি।
মেয়েটি রাগ ঝালের সুরেই বলে চলেছিল- কী শুনবেন? কিচ্ছু মনে নেই।
তাও বলেছিল অনেক কথাই। এই শহর থেকে যাওয়া লেখককে একটি কথাও যদি না বলত কী বা এসে যেত ওর! ওর জীবনের কোন সমস্যার সমাধান করতে পারব আমি! তাও বলেছিল। ওর না বলাটাও অনেক বলা। ওর জীবনের যে অধ্যায়ের কথা ও ঢেকে চেপে রাখতে চায় সেটা ওই জুন মাসের দুপুরে প্রায় আঢাকা হয়ে গেছিল।
হাতের নখ দিয়ে পায়ের নখের শক্ত মোটা পরতের আধা খেঁচড়া নেল পালিশ খুঁটতে খুঁটতে বলে চলছিল।
- ওই আমরা পাড়ার কটা মেয়ে সেবার এক সাথে গেছিলাম। দিল্লি নিয়ে গেছিল আমাদের।
- কী কাজে নিয়ে গেছিল?
- ওই বাচ্চা রাখার কাজ, বাসন ধোয়ার কাজ - এইসব বলেছিল। গলার স্বরটা নেমে এলো।
- তারপর ওখানে গিয়ে কী হল?
কিছুক্ষণ চুপ। আবার বলা শুরু করল, ওই খানে গিয়ে একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। বলল এইখানে থাক। এইখান থেকে কাজের বাড়ি নিয়ে যাবো দুই দিন পর। বাড়িটা যেন কিরকম ছিল, কোনও জানলা নেই। আমাদের সবাইকে এক খানা ঘরে রেখে দিল। সব কটা মেয়ে আমরা ওইখানে। ঘর থেকে বেরোতে দিত না। ওরা আসত সন্ধে বেলা।
সেই মুহূর্তে ওর চোখ গুলো দেখে মনে হচ্ছিল এই সুন্দর বনের খোলা উঠোনটা যেন এক মুহূর্তে বদ্ধ ঘর হয়ে উঠেছে। চারিদিকে উঁচু দেওয়াল। জানলা নেই। আলো নেই। হাওয়া নেই। জুন মাসের গরম চললেও কোলকাতা থেকে এতোগুলো নদী পেরিয়ে এই জঙ্গল নদী ঘেরা জায়গাটাতে গরম আর সেভাবে টের পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাদের এই তিন জনের মধ্যে সব গরম যেন একলা ওকে আঁকড়ে ধরেছে। দরদর করে ঘামছে ও। সতেরো বছর আগের সেই দিন গুলি যেন ওর আশপাশে চেপে ধরেছে। এই বত্রিশ তেত্রিশ বছর বয়সী দুই ছেলে মেয়ের মা আবার যেন সেই চৌদ্দ বছরের কিশোরী। পায়ের নখ খোঁটা ছেড়ে দিয়ে এক হাতের মধ্যে আরেক হাত কচলে চলেছে।
- তোমাকে কাজের বাড়ি পাঠায়নি?
- নিয়ে গেছিল অন্য আরেক জায়গায়। বলেছিল, এইখানে থাক। এখান থেকে নিয়ে যাবো কাজের বাড়ি। ওই খান থেকে ওদের সব পাঠিয়ে দিচ্ছিল কোথায় কোথায়। আমার মনে হচ্ছিল কোথায় যেন পাঠিয়ে দেবে আমাকে। এই মামাকেই তো ফোন করি ওই খান থেকে। একদিন বিকাল বেলা লুকিয়ে বেরাতে পেরেছিলাম ওইখান থেকে।
- কত দিন পরে ফোন করতে পেরেছিলে?
- কি জানি! অতো শত মনে নেই। উঁ… এক সপ্তা পরে হবে। এই মামার নাম্বারটা আমার মানি ব্যাগে লেখা ছিল।
ওর চোখটা চলে গেল আমার পাশে বসে থাকা প্রৌঢ় লোকটির দিকে যিনি আমাকে এ বাড়ি চিনিয়ে নিয়ে এসেছেন। ভদ্রলোকের বলতে শুরু করলেন। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে ফোনটা করেছিলি। নইলে তো যেতি গিয়ে কোথায়! কোথায় পাঠিয়ে দিত কোনও ঠিক ছিল। ওকে বাঁচাতে পেরেছিলাম লোক দিয়ে। আর গুলোকে পারিনি। একজন তো নিজেই আর এলো না।
আমার নাম কোথাও লিখবেন না তো!
মেয়েটির গলার আওয়াজ হঠাৎ দ্বিগুণ জোরে হয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। চিৎকার করে ফেলল।
- আমার শ্বশুর বাড়িতে কিন্তু এইসব কেউ জানেনা। ওরা জানলে কিন্তু আমাকে তাড়িয়ে দেবে।
এটা ওর বাপের বাড়ি। শুনেছিলাম ওর ছেলে মেয়েদের নিয়ে এখন এখানেই থাকে। সেই দু’হাজার দুই সালের পর আরও বহুবার ও কাজ করতে বাইরে গেছে। ওই ঠিকাদার বাদে অন্য অন্য ঠিকাদারের সাথে। সেই দালাল এখনও মেয়েদের নিয়ে যায় অন্য অন্য পাড়া থেকে। স্বামী বাইরে লেবারের কাজ করতে যায়। ছেলে মেয়ে এই বাড়িতেই থাকে। মাস দুই পরে ওর আবার যাওয়ার কথা ব্যাঙ্গালরে ব্যাগের কারখানায়।
কথা শেষ করে চলে এলাম বাড়ির বাইরে। ভদ্রলোক বললেন, এক সপ্তাহ না আরও অনেক দিন ছিল ওইখানে। অনেক দিন ধরেই ওইসব সহ্য করেছে। ওদের ডেরা থেকে ছাড়িয়ে আনা মুখের কথা নাকি! ও বলেছিল জানেন, থাই দু’টোয় আর কিছু ছিল না মামা। সোজা হতে পারতাম না। রোজ সন্ধ্যায় এসে সব ঢুকত। সেসব তো আপনার কাছে গোপন করে গেল।
বুঝলাম, ওই যে ওর এক এক সপ্তাহ কি তার বেশি না বলা সময়টুকুর ইতিহাস গোপন করার চেষ্টাতেই রাগ বিরক্তিকে ঢাল করে নেওয়া।
সাতজেলিয়া দ্বীপে আমার এই চার পাঁচ ঘণ্টার ভ্রমণ। কত রকম ভয় দেখলাম। না খেতে পাওয়ার ভয়, বাঘের ভ্ পুলিশের ভয়, পলিটিকাল পার্টির ভয়, জীবনের সত্য প্রকাশ হওয়ার ভয়। চোখ গুলিতে কত রকম ভয় ঘুরে বেড়াচ্ছে এই জঙ্গল খাঁড়ি নোনামাটির ভেতর ভেতর। আর এই সব ভয়ের ভেতর মেয়েটির চোখে আরও একরকম ভয়। শ্বশুর বাড়ি নামক বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ভয়। যেখানে ও থাকেই না সেখান থেকে তাড়া খাওয়ার ভয়। ওকে ঘুরে বেড়াতে হয় রাজ্যের বাইরের কত কত কাজের বাড়ির কারখানা ঘরের ছাতের তলায়। তবু চোখ ভর্তি ভয় শ্বশুর বাড়ির ছাতের তলা থেকে তাড়া খাওয়ার।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
পিনাকী মণ্ডল
কানাইলাল সরকার
টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট
(লেখাটি লেবার ট্রেন বইটিতে প্রকাশিত)