কানের কাছে এনে নাড়ালে ভিতরে ‘ছলবল’ করে রস নাড়ার শব্দ পাওয়া যেত। বলছিলেন পান্তুয়ার বিখ্যাত দোকানদার। পান্তুয়ার পেটে রসার্ণবের এমন উচ্ছ্বাসময় উপস্থিতিতে বিস্মিতই হয়েছিলাম। বিস্ময় জাগে অজ্ঞানতা থেকেই। আর সেটা তখন সম্ভব ছিল।
সে বহু বছর আগের কথা। দু’দশকের ওপারের স্মৃতির শব্দ। এক সংবাদপত্রের খুঁটে খাওয়া সাংবাদিক তখন। ফ্রিল্যান্সার। হাওড়া জেলার আমতায় গিয়েছিলাম সেখানকার পান্তুয়ার পরিচয় পেতে। পান্তুয়ায় রানাঘাটের যেমন নাম তেমনই আমতার। এ সুনাম বহুদিনের অর্জন। সেই রাজেন মুখার্জি, বীরেন মুখার্জির মার্টিন রেলের ধিকি ধিকি চলার কালেরও বহু আগে থেকে প্রাণ তুষ্ট করেছেন আমতার চরিত, দেনে, রাণারা। চরিতদের দোকানই তো প্রায় ১২৫ বছরের। হাওড়া-আমতা মার্টিন রেল বন্ধ হয়েছে ১৯৭১ সালে। কয়েকটি পান্তুয়ার দোকানও পাট গুটিয়েছে। কিন্তু আমতার ইতিহাস-ঐতিহ্য-স্বাদ-সুনাম সচল রয়েছে এখনও।
গিয়েছিলাম চরিতদের দোকানে। চরিতরা আক্ষেপ করছিলেন, এক সময়ে আমতার কারিগরেরা এমন পান্তুয়া তৈরি করতেন কানের কাছে এনে নাড়ালে ভিতর রসের নড়াচড়ার আওয়াজ পাওয়া যেত। কারণ পান্তুয়ার ছালটা শক্ত হত। তখন পেশায় নতুন। আর সেই প্রথম আমার মিষ্টিমহলের সিংহ দুয়ারের সামনে দাঁড়ানো। মিষ্টির ভিতর থেকে রসের আওয়াজে বিস্ময় তো জাগবেই। পরে মিষ্টিমহলের ভিতরে যত এগিয়েছি বিস্ময়ের মাত্রা কমেনি। বেড়েছে। নানা কাহিনি, কারিগরি, নামের সুষমা ও বৈচিত্রের গুণে। এখন যেমন জেনেছি, ভাল পান্তুয়ার গুণই হল ছালটা হবে কিছুটা শক্ত। থ্যাসথ্যাসে নয়। ভিতরটা হবে জালি জালি। সেই জালির ফাঁকে ফাঁকে রসের অবস্থান। কামড় দিলে ভিতর থেকে গড়িয়ে আসবে রস। পান্তুয়ার ভিতরে ডেলা মানে স্বাদে কিছুটা ঘাটতি। বিভিন্ন দোকানে দেখেছি, পান্তুয়ার ভিতরের জাল বিন্যাস করার মতো কারিগর এখন আর খুব একটা মেলে না।
মিষ্টিমহলে নানা বদল এসেছে সময়ের সঙ্গে। কারিগর একটা কারণ। ঘুরে ঘুরে মিষ্টি চাখায় অন্য কিছু কারণও চোখে পড়েছে। তবে এ দাবিতে শর্তাবলী প্রযোজ্য। বয়স যে চল্লিশ অতিক্রান্ত। চালসের কাল। ভ্রান্ত দর্শন হতেও পারে। একটু ভয়ে ভয়েই বাঁক বদল লিপিবদ্ধ করা।
কিছুদিন আগে ডিহিভুরশুট গিয়েছিলাম মন্দির দর্শনে। হাওড়া জেলার প্রান্তবর্তী কিন্তু প্রাচীন জনপদ। নানা কারণেই বিখ্যাত। কোথাও গেলে সেখানকার মিষ্টি নিয়ে খোঁজ এবং চাখা অভ্যাস। সঙ্গী দীপু আর বাবলাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম এক দোকানে। পুরনো দোকান। উদয়নারায়ণপুর চার মাথার মোড়েই। প্রথমে রসগোল্লা। শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে জেলার দূরতম প্রান্তে রসগোল্লার স্বাদ নেওয়া আমাদের ঘোরাঘুরির দলের দস্তুর। স্বাদের বৈচিত্র মেলে। বিশেষ করে স্পঞ্জ নামক প্রজাতির অসুখকর চর্বণে জিভ ও মন মুষড়ে পড়ে না। এসব জায়গায় পেলব রসগোল্লা মেলে। এমন রসগোল্লা আমাদের বড় প্রিয়। হুগলিতে, চব্বিশ পরগনায়, নদিয়ায়, বর্ধমানে এবং হাওড়ার প্রান্তবর্তী এলাকায় এরকম রসগোল্লা পেয়েছি।
উদয়নারায়ণপুরের দোকানে মিলল পছন্দের অস্পঞ্জ রসগোল্লা। মিলেছিল বাকসির হাটের এক দোকানেও। সামান্য আয়োজনের দোকান। মিষ্টির দোকান না বলে খাবারের দোকান বলাই ভাল। সকালে জলখাবারে পরোটা, ঘুগনি ইত্যাদি তৈরি হয়। মিষ্টিও থাকে। আমরা গিয়ে পৌঁছেছিলাম সন্ধের আগে। সেদিন হাটবার নয়। ঘোলাটে কাচের শোকেসে তিনটি মিষ্টির গামলা দেখেছিলাম। একটায় পান্তুয়া, বাকি দু’টোয় রসগোল্লা। সব মিষ্টিই গামলার তলদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সফরসঙ্গী দীপু দু’টোর স্বাদই নিতে চেয়েছিল। দোকানদার অতি সৎ ব্যবসায়ী। তিনি বলেছিলেন, ‘‘পান্তুয়া খেতে হবে না। রসগোল্লা খান।’’ খেলাম এবং মন ভরে গেল। রূপনারায়ণ নদের তীরে বাকসিও হাওড়ার প্রান্তবর্তী। নদ পার হলেই একদিকে পশ্চিম মেদিনীপুর আরেক দিকে হুগলি।
উদয়নারায়ণপুরের দোকানে রসগোল্লার পরে খেয়েছিলাম রাজভোগ। একটু কড়াপাকের। রসে একটু বেশি সময় দিয়ে জ্বাল দেওয়া। তাই বাদামি রং ধরে। কাটোয়া লোকালের হকারেরা ক্ষীরমোহন নামে এক মিষ্টি বিক্রি করেন। এই রাজভোগের রং সেরকম। রাজভোগের পর চাখা হয়েছিল মাখা সন্দেশ। তিনটি মিষ্টিই বেশ ভাল। খাওয়ার পর টুকটাক গল্প। কথায় কথায় একটা বদল জানতে পারলাম। এ দোকানে রসগোল্লা তৈরিতে আর নকুলদানা ব্যবহার করা হয় না। ছানার মণ্ড গোল্লা পাকানোর সময়ে ভিতরে একটা নকুলদানা দেওয়াই রীতি। ছোট থেকে সেটা শুনে আসছি। রীতিতে বদল কেন? দোকানদার বললেন, এতে গোল্লা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পাকানোর সময় নকুলদানা যদি কোনও কারণে ধারের দিকে চলে আসে তাহলে গোল্লা রসে ফোটানোর সময়ে ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফাটা গোল্লা বাতিল করতে হয়। তাতে লভ্যাংশ কমে। সময়ও নষ্ট হয়। তবে রাজভোগের ভিতরে এখনও ক্ষীরের পুর দেওয়া হয়। ক্ষীরে সমস্যা নেই। রসে ফোটালে সেটা গলে যায়। স্থানচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
চিনির কোটিং ছাড়া মনোহরা
সময় এবং কারিগর উভয় কারণে মিষ্টিতে বদল হয়েছে। তাতে মিষ্টির পরিচয় সঙ্কট তৈরির উপক্রম। এমনটা দেখেছি জনাইয়ে। মনোহরার পীঠস্থান জনাই। মাসকয়েক আগে গিয়েছিলাম জনাইয়ে। ললিত ময়রা বা কমল ময়রার দোকান মনোহরায় প্রাচীন ও নামী। যদিও টিভি চ্যানেলের এক ধারাবাহিকের দৌলতে অন্য একটি দোকানের জাঁক বেড়েছে। দোকানের সামনে মস্ত হোর্ডিং। এই দোকানে ধারাবাহিকটির শ্যুটিং হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ললিত ময়রার পুরনো ছাঁদের দোকান মনোহরায় এখনও অপ্রতিরোধ্য। এবার গিয়ে দেখি, মনোহরায় চিনির কোটিংটা নেই। চিনির এই আবরণ বা আভরণ, যাই বলা হোক না কেন, দু’টো মিষ্টির পরিচয় চিহ্ন। একটা মনোহরা, আরেকটা ম্যাচা। সেই চিহ্নই উধাও! জিজ্ঞাসা করেছিলাম। জানলাম, করোনা অতিমারির সময়ে এই বদল ঘটেছে। কারিগর পাওয়া যায় না। আর সময় বাঁচাতে চিনির কোটিং দেওয়া বন্ধ হয়েছে। তবে তাতে স্বাদের কোনও বদল হবে না বলেই আশ্বাস দিলেন কমল ময়রার ছেলে, ললিত ময়রার নাতি। কারণ চিনির কোটিং দেওয়া হয়েছিল সন্দেশটিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে। মনোহরা খাওয়ার সময় কোটিং ছাড়িয়ে খেলে তবেই সন্দেশের প্রকৃত স্বাদ মেলে। এখন সরাসরি স্বাদ পায় জিভ।
মনোহরা নামের সন্দেশটি অবশ্য বরাবরই পরিবর্তনপন্থী। ইতিহাস তা-ই বলছে। বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘মিষ্টান্ন পাক’ বইয়ে এক মনোহরার সন্ধান দিয়েছিলেন। বইটি একশো বছর আগে লেখা। সে মনোহরার সঙ্গে উপকরণে-পাকে জনাইয়ের মনোহরার কোনও মিলই নেই। বিপ্রদাসের মনোহরায় চিনির কোটিংটাও নেই। তবে জনাইয়ের অন্য মিষ্টির দোকানগুলোয় মনোহরা এখনও ‘চিনির চাদর’ জড়িয়েই ট্রেতে শুয়ে থাকে।
গরিবের অমুক, গরিবের তমুক হিসেবে নানা কথা প্রচলিত। যেমন, গরিবের মাংস হল ছাতু। অর্থাৎ মাশরুম। প্যাকেটজাত নয়, বনে জঙ্গলে হয়ে থাকা মাশরুম। বলিউডে একসময় ‘গরিবের অভিতাভ বচ্চন’ বলা হত এক অভিনেতাকে। খুব সম্মানজনক নয় কথাগুলো। অশালীন একটা ভাগাভাগির গন্ধ মাখা। মিষ্টিমহলে এমন গরিব-বড়লোকের ভাগাভাগি রয়েছে। তবে তা অন্যায় বা অসম্মানজনক নয়। বরং মিষ্টি ব্যবসায়ীদের সকলের নাগালে স্বাদ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা প্রশংসনীয়। ব্যবসায়িক ভাবনাটিও উপেক্ষণীয় নয় যদিও। মালদহের রসকদম্ব এর উদাহরণ। পোস্তর দানা ছড়ানো রসকদম্বই আদি। কিন্তু দামে পোস্ত দিন কে দিন উচ্চমার্গগামী। মাটির টান ক্রমশই কাটিয়ে উঠছে পোস্ত। ফলে রসকদম্বের দামও বাড়ে। তাতে মিষ্টি অনেকের নাগালের বাইরে চলে যায়। সাধারণ মানুষ পোস্তর রসকদম্ব কিনতে পারেন না। তাঁরা কি মিষ্টির স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন? মিষ্টি ব্যবসায়ীরা উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিলেন। রসকদম্বে পোস্তর বদলে ছড়িয়ে দিলেন হোমিওপ্যাথি ওষুধের দানা। খরচ কমল রসকদম্বের। দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে এল। মালদহের মিষ্টি ব্যবসায়ীরা জনাইয়ের মনোহরার চিনির কোটিংয়ের মতো পোস্ত বা হোমিওপ্যাথি ওষুধের দানা ছড়ানো বন্ধ করে দিতেও তো পারতেন? দিলে রসকদম্ব নামের প্রতি অবিচার করা হত। মিষ্টিটি কদমফুলের মতো দেখতে। তাই নামের সঙ্গে কদম্ব যোগ। পোস্ত বা হোমিওপ্যাথির দানা না ছড়ালে কদমফুলের রূপটা আসে না। তাই উপকরণ বাতিল নয়, বদল।
মশাটের রসমাধুরী
হুগলির মশাটের একটি মিষ্টির দোকানে খেয়েছিলাম রসমাধুরী। কেশর, ছানা আর মোষের দুধ এই মিষ্টির উপকরণ। কেশর, ছানার মিশ্রণ নির্দিষ্ট পাক করতে হয়। তার পর চৌকো করে কেটে নেওয়া। আলাদা করে তৈরি করতে হয় দুধের লট। রসমালাই বা লট চমচমের থেকে এই লট হয় বেশ ঘন। কেশর দেওয়ার কারণে লটের রঙেরও বদল হয়। মশাটের রসমাধুরীর থেকেও প্রবীণা আরেক রসমাধুরীর সন্ধান মেলে। পেয়েছি প্রণব রায়ের ‘বাংলার খাবার’ এবং বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘মিষ্টান্ন পাক’ বইয়ে। প্রণব রায় রসমাধুরীকে ‘রসের খাবার’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর বইয়ে পাকপ্রণালী নেই। বিপ্রদাসে রসমাধুরীর পাক প্রণালী হল, টাটকা ছানা বেটে তাতে ক্ষীর আর ছোট এলাচের দানা গুঁড়ো করে মেশাতে হবে। ভাল করে মেশানো হলে মিশ্রণ ইচ্ছে মতো গোল, চৌকো করে ঘিয়ে ভাজতে হয়। তার পর চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা। বিপ্রদাসের রসমাধুরী ভাজা এবং চিনির রসের। মশাটের দুধের রসের। ভাজা নয়। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে বদল হয়েছে মিষ্টিটির
চকলেট শনপাপড়ি
বদল বেঁচে থাকার প্রমাণ। মানুষ, নদী, জাতি এবং মিষ্টি জগতেও একই সূত্র। বারবার বদল এসেছে মিষ্টিমহলে। বাঙালির মিষ্টিকে স্পষ্টতই দু’টো ভাগে ভাগ করা যায়। ছানা-পূর্ব এবং ছানা-উত্তর। এখন অবশ্য মিষ্টিমহলে কিছুটা ফিউশনের যুগ চলছে। আমার মতো কিছু মিষ্টি গোঁড়া ফিউশনে তেমন স্বস্তি পায় না। তবে পক্ষপাতহীন দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, বাঙালির মিষ্টিমহলে ছানার যোগ ফিউশন ছাড়া আর কিছুই নয়। বাঙালি মিষ্টির আদি পর্ব দুধ, ক্ষীর, গুড়, চিনি আর কিছু ভাজা মিষ্টির। এই উপকরণের সঙ্গে ছানা মিশে বিপ্লব এনেছিল মিষ্টিমহলে। এখনকার মিষ্টি-ফিউশনে চকলেটের কিছুটা প্রভাব রয়েছে। চকলেট রসগোল্লা, চকলেট সন্দেশ (এই দু’টো বিশেষ ব্র্যান্ডের নামেও চলে) এমনকি চকলেট শনপাপড়িও হয়। ছানার মতো চকলেটও ‘বহিরাগত’। ছানা ছিল ছক ভাঙা। দুধ ছিন্ন করে হত বলে একসময়ে দেব দেবীর ভোগে দেওয়া হত না ছানার কোনও মিষ্টি। এখন ছানার গোলক রসগোল্লাও ভোগে নিবেদিত হয়। সময়ের পরীক্ষায় পাশ করে ছানার মতো চকলেটও মিষ্টিমহলে চিরস্থায়ী হয় কিনা সেটাই দেখার।
মিষ্টির জগতে আরেকটি বদল এসেছে বলে মনে হয়। মিষ্টিমহলের মালিকানা কি ধীরে ধীরে মোদকদের হাত থেকে ঘোষেদের অর্থাৎ গোয়ালাদের হাতে চলে যাচ্ছে? শেষ কথা বলার মতো পরিসংখ্যান হাতে নেই। তবে বেশ কয়েকটি দোকানে খোঁজ করে বদলের একটা রেখা দেখা যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে। মিষ্টির দোকানের মালিক ঘোষেদের দু’একজন বলেছেনও, দুধ, ছানার মতো কাঁচামাল গোয়ালাদের হাতে থাকায় সুবিধেই হয়। অতিরিক্ত খরচ কমানো যায়।
মিষ্টিমহলের ‘জলসাঘর’ নতুন করে সাজছে হয়তো!