ছোটবেলায় দু’টো জিনিসে বেশ আগ্রহ ছিল। বাঁদিপোতার গামছা আর মোল্লার চকের দই। ঠিক ছোটবেলায় নয়, একটু বড় ছোটবেলায়। মানে বুঝবেলায়। গামছা নিয়ে আগ্রহটা কমে গিয়েছে। জীবনভর নানা ছাঁদের গামছা দেখেছি। বাড়ির গামছা ট্রেনের গামছা। মামার বাড়ির গামছা। আমার মামার বাড়ি বর্ধমান জেলায়। জায়গাটা অবশ্য একেবারেই নদিয়া সীমানায়। দুই জেলায় তো ঘরে ঘরে হয় তাঁত, নয় চরকা। ছেলে, বুড়ো, ঝিউড়ি, বউড়ি, শাশুড়ি সকলেই এই দু’টোর কোনও একটার কাজ করত। শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা।
আরেকটু বড়বেলায় দেখলাম গামছার বিরুদ্ধে জেহাদ। গর্ব ছিল মদন তাঁতির। ‘শিল্পী’ গল্পের মদন তাঁতি। সূক্ষ্ম শাড়ি তৈরিতে ওস্তাদ মদন তাঁতি। শস্তার গামছা সে বুনবে না। নিজেই বলত, তাঁতিপড়ার নাকি প্রবাদ চালু আছে, ‘মদন তাঁতি যেদিন গামছা বুনবে...’। সেদিন তাঁতিপাড়ার শিল্পীসত্তা শেষ। এই সেদিন দেখলাম, গামছার রংবদল। ‘চাষার ব্যাটা’র গলার গামছার টকটকে লাল রংটা কেমন যেন ফিকে হয়ে গেল। ফলে বাঁদিপোতার হোক বা অসমের গামোসা, গামছায় আর গা-মন কিছুই ওঠে না।
তবে মোল্লার চকের দইয়ে আগ্রহ এখনও অটুট। কিন্তু মোল্লার চকটা কোথায়? সেটাই তো এখনও পর্যন্ত সন্ধান করে উঠতে পারলাম না। শুনেছি লাল রঙা সেই দই দারুণ জমজমাট। এতটাই জমাট যে উপুড় করলেও হাঁড়ির কোল নাকি আঁকড়ে থাকে দধি-ধীমান। নাকি হাঁড়িই ছাড়তে চায় তার সুসন্তানকে। ভোগী মানবের পাতে! নিউটনের তত্ত্ব-টত্ত্ব সব ফেল দইয়ের জনকদের হাতের জাদুতে। এবং অতীব সুস্বাদু। মোল্লার চকের দইয়ের আক্ষেপ পূরণ করে দিয়েছিল নবদ্বীপের দই। বিখ্যাত লাল দই।
মাসির বিয়েতে খেয়েছিলাম। এবার বলি, আমার মামার বাড়িটা নবদ্বীপের কাছেই। ভাণ্ডারটিকুরি রেলস্টেশনে নামতে হয়। আমাদের ছোটবেলায় নবদ্বীপের পরের স্টেশন ছিল ভাণ্ডারটিকুরি। এখন একটা স্টেশন পরে। মাঝে বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট তৈরি হয়েছে। ছোটমাসির বিয়ে হয়েছে আরও দু’টো স্টেশন পরেই। মেসো কনেযাত্রীদের জন্য নবদ্বীপ থেকে লাল দই আনিয়েছিল। বিয়েবাড়ি ছিল গরমকালে। ঘরে ঘরে ফ্রিজের কোনও বালাই নেই। ৯০ এর দশকে যাতায়াতের এত সুবিধে ছিল না। নবদ্বীপ থেকে ভারীরা বাঁকে করে দই ট্রেনে তুলেছিলেন। নেমেছিলেন মেড়তলা ফলেয়া হল্টে। সেখান থেকে মাসির বাড়ি অন্তত দু’কিলোমিটার। তাঁরা হেঁটে এসেছিলেন।
এত ঝক্কি সামলেও কিন্তু দইয়ের মেকআপ এতটুকু চটেনি। সেই হাঁড়ি আঁকড়ে চেপে বসে থাকা। হাঁড়ির মুখ জোড়া লালচে মোটা সরের পরত। যেন হাঁড়ির হালকা লিপস্টিক। শুধু ছোট্ট টিপ পরিয়ে দিলেই একেবারে শাড়ির বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়াবে। ছোট্ট টিপ, হালকা লিপস্টিক আর লাল দই। পরিবেশনের সময়ে দই কাটা চামচকে গভীরে ঢুকেই দধিসুন্দরীর স্পর্শ পেতে হচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এই সেই মোল্লার চকের দই। হাঁড়ি উল্টে ধরলেই ফির নিউটন ফেল।
নবদ্বীপের লাল দইয়ের খ্যাতি নিয়ে সাতকাহন করার কোনও মানে হয় না। এমনিতেই সে সেরিব্রিটি। শুধু একটা তথ্যই যথেষ্ট। এই সর্বব্যাপী বেচারামদের যুগেও নবদ্বীপের কিছু দোকান শুধু দই বিক্রি করে। মানে সেগুলো দইয়ের দোকান। অথচ উপভোক্তাদের যুগে এখন লাভালাভের চিন্তা বেশি। এতই বেশি যে ব্যবসা বাড়িয়েই চলে সংস্থাগুলো। তামাক কোম্পানি এখন লজেন্সও বেচে।
নবদ্বীপে শুধু লাল দই ভাল, তা নয় কিন্তু। এখানকার রসগোল্লাও বেশ ভাল। শুধু নবদ্বীপ নয়, সংলগ্ন বর্ধমানের বেশ কিছু জায়গার রসগোল্লা সুস্বাদু। দেবশ্রী রায় ‘আমি কলকাতার রসগোল্লা’ বলে নেচে বেড়াতে পারেন। তবে আমি নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি, এই এলাকার রসগোল্লা খেলে তিনি গীতিকারকে বলে গানের কলি পরিবর্তন করাবেন। সেইরকমই একটা মিষ্টির দোকানের সন্ধান পেয়েছিলাম মামার বাড়ির দৌলতে। জায়গাটার নাম জাহাননগর। পূর্বস্থলী ব্লকে পড়ে। মোড়ের মাথায় ছোটখাট দোকান। কিন্তু রসগোল্লা তৈরি করেন বিশাল হৃদয় দিয়ে। সেই রসগোল্লা কলকাতার রসগোল্লার মতো কচকচে নয়। ফুটোফুটো নয় স্পঞ্জের মতো। গুলজারের গানের কথার মতো...। ঐশ্বর্য রাইয়ের ঠোঁটের মতো। মসৃণ, পেলব। মুখে দিলেই ‘জিসকি জুবা উর্দুকে তরহা’। তালুর সঙ্গে আশ্লেষ।
জাহাননগর মোড়ে এখনও আছে মোদক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এবং একই রকম রসগোল্লা রসিক।
জিলিপিকে মিষ্টি হিসেবে ধরা হবে? মানে বলতে চাইছি, তেমন আভিজাত্য রয়েছে কি জিলিপিতে? কথাটা মনে হল এক প্রবীণ সাংবাদিকের মজার কথায়। একসময়ে ওঁর সহকর্মী ছিলাম। অফিসের কাছে ফুটপাতের একটা দোকানে মাঝে মাঝে টিফিন করতাম একসঙ্গে। উনি পছন্দ করতেন খাস্তা কচুরি আর জিলিপি। একদিন খেতে খেতেই বলছিলেন, গরম দুধে জিলিপি ফেলে খেলে অপূর্ব লাগে। কিন্তু এই অপূর্ব স্বাদ বাড়িতে তৈরি করতে গেলেই তাঁর গিন্নি খেপে ওঠেন। হোম মিনিস্টারের ঝংকার, ‘তোমার যতসব বিহারি ব্যাপারস্যাপার।’ আসলে ওই ভাল মানুষ সাংবাদিকটির জন্ম হয়েছিল বিহারের ঝাঝায়।
সেই জন্যই বলছিলাম, জিলিপি নিয়ে কিছু বলব মিষ্টিমহলের কথায়? বলেই ফেলি। আড়াই প্যাঁচের উৎস নিয়ে মতভেদ থাকলেও রসাল এক প্যাঁচে আপত্তি হবে না। মুগের জিলিপি। মেদিনীপুরের অবদান। একবারও চোখে না বন্ধু তরুণ সিংহ মহাপাত্র জানিয়েছিলেন, পূর্ব মেদিনীপুরে হাউরের একটা দোকানে অসাধারণ মুগের জিলিপি করে। ন’টার পর থেকে মেলে। কিন্তু বেশ দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। জিলিপির প্যাঁচ খুলতেই একদিন চারমূর্তির অভিযান। শুভ, দীপু, আমি আর চিনি। হ্যাঁ ওর নাম চিনি। সে-ও জিলিপিতে আকৃষ্ট হয়েছিল।
হাউর স্টেশন লাগোয়া ভৌমিক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দোকানের শ্রী-ছাঁদে আহামরি কিছু নয়। মানে মোটেই ঝাঁ চকচকে নয়। আধুনিক কেতার কোলাপসিবল গেট বা শাটার কিছু নেই। পুরনো আমলের ঝাঁপ ফেলার ব্যবস্থা। এই দোকানের এত নাম! কাচের শো কেসের কাছেই মেঝেয় বড় গামলায় রসাম্বুতে ঠাসাঠাসি হয়ে ভাসছে জিলিপি। আগে খেয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হল। তার পর ইতিহাসের খোঁজ। রাবড়ির খোঁজে গিয়ে বুঝেছিলাম, প্রথমেই ইতিহাসের পড়া ধরলে লোকে কেমন যেন ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে যায়। মনের দেওয়ালে ছেঁদা করার বড় অস্ত্র হল অর্থনীতি। না হলে এমনি সারা ভারত জুড়ে ডোল রাজনীতির এমন রমরমা।
চাখার জন্য দু’টো করে জিলিপি নিলাম। গরম তখনও। মুখে মাখার ক্রিমের কাছাকাছি নরম। দু’বার মুখে নাড়াচাড়া করতেই সারা জিভে ছড়িয়ে পড়ল স্বাদ। জিভের সঙ্গে মন ভরল। খেতে খেতে অর্ডার। অর্থনীতির দ্বিতীয় ধাপ। আমরা চারজন তো নেবই। বন্ধু বাবলা আর ইন্দ্রকে ফোন করে ওদের চাহিদাও জেনে নেওয়া হল। আমরা খেতে থাকি। দোকানদার প্যাক করুন।
খাওয়া শেষে ছবি তোলার অনুমতি প্রার্থনা। মিলল। দোকানে বেশ ভিড়। তাঁরা আমাদের দিকে কিছুটা বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছেন। ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি, এবার ইতিহাসের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। দোকানের বর্তমান মালিক বিশ্বনাথ ভৌমিক। বিশ্বনাথবাবু জানালেন, মুগের জিলিপি তৈরি হচ্ছে তাঁর বাবা পুলিনবিহারীর আমল থেকে। দোকানটা ৮০ বছরের। রেলের জায়গায় তৈরি। রেল কোম্পানি মাঝে মাঝে দোকান ভেঙে দেয়। কিছুদিন কারবার বন্ধ রেখে আবার দোকান দেন। এবার বোঝা গেল, দোকানের কাঠামোয় কেন আধুনিক ব্যাপারস্যাপার নেই।
বাবার কাছ থেকেই জিলিপি করা শিখেছেন বিশ্বনাথবাবু। কিন্তু এমন একটা জিনিস এল কোথা থেকে? বিশ্বনাথবাবু জানালেন, তাঁর বাবা আগে মেলায় দোকান দিতেন। তার পর দোকানটি করেন। বাবার আমলে সবদিন জিলিপি হত না। হতো বছরে দু’বার। একবার ভাইফোঁটায়। আরেকবার জামাইষষ্ঠীতে। চাহিদা দেখে রোজ জিলিপি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন কেমন চাহিদা? সকালে ৬০০ পিস আর বিকেলে ৬০০ পিস মুগের জিলিপি হয়। কোনওদিনই ফেলা যায় না একটা পিসও।
মুগের জিলিপি দেখতে অনেকটা ছানার জিলিপির মতো। সাধারণ জিলিপির মতো আড়াই প্যাঁচ দেওয়া যায় না। একটাই প্যাঁচ। কিন্তু প্যাঁচের দু’টো মুখ পরস্পরের কাছাকাছি এসে লাজুক ভাবে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। সেই জন্য মনে হয় অর্ধেক অর্ধেক প্যাঁচ মিলে এক প্যাঁচ হয়েছে। উপকরণ সামান্যই। মুগ ডাল। ডালের কাই ধরে রাখার জন্য সামান্য ছাঁটাই বিড়ির ডাল মেশানো হয়। অর্থাৎ খোসা ছাড়ানো। সেই মিশ্রণ প্যাঁচ মেরে তেলে ভাজা। তার পর রসের সাগরে ছেড়ে দেওয়া। আগে হাতে বাটা হত ডাল। শিলনোড়ায়। পাড়ার মেয়েরা কেজি প্রতি টাকা নিয়ে ডাল বেটে দিতেন। সেই বাটা ফেটাতে হত ভাজার আগে। ফেটানোর কাজটা বিশ্বনাথবাবু করতেন। তিনি জানালেন, ফেটানোর ওপরেই নির্ভর করে জিলিপির স্বাদ। যেদিন উনি ফেটান না সেদিন জিলিপির স্বাদের তফাৎ হয়ে যায়। খদ্দের সেটা বুঝতেও পারেন। এখন অবশ্য বাটা এবং ফেটানোর কাজটা মেশিনে হয়। জিলিপির জন্য ডাল বাটা ফেটাতে ফেটাতে এক সময়ে ডান হাতের পেশি জখম হয়ে গিয়েছিল বিশ্বনাথবাবুর। ভেলোরে গিয়ে অপারেশন করাতে হয়। জামা খুলে দেখালেন কাটা দাগ। তার পর থেকে মেশিন। তবে ফেটানোটা এখনও যন্ত্রবিদের হাতের কৌশল। স্বাদের ফারাক হয় তাতেও।
দোকানের ইতিহাস জানা গেল। কিন্তু জিলিপির ইতিহাস? উৎস? ট্রেনে আসতে আসতে এক সহযাত্রী জানিয়েছিলেন, ডেবরায় নাকি মুগের জিলিপি বিখ্যাত। ওখানেই নাকি জন্ম এই মিঠাইয়ের। বিশ্বনাথবাবু জানালেন, উনিও শুনেছেন সে কথা। ডেবরা ব্লকের লোয়াদার আষাড়িতে নাকি মুগের জিলিপির জন্ম। কিন্তু তিনি কোনওদিন আষাড়ি যাননি। হাউর পূর্ব মেদিনীপুরে। আষাড়ি পশ্চিমে।...
চারজনে কিছুক্ষণ পরেই আষাড়ি মোড়ে। রাহুল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। মুগের জিলিপি অর্ডার দিলাম। এখানকার জিলিপিটা খেতে একটু আলাদা মনে হল। আকারে একটু ছোট। প্যাঁচের মুখগুলো জড়ামড়ি করে রয়েছে। খেতেও হাউরের মতো মোলায়েম নয়। একটু যেন দানা দানা। স্বাদে অপূর্ব।
দোকানদারের নাম হরিপদ রাহুল। তিনি নীলমাধববাবুর ভাই। বাড়ি লোয়াদার ধোবাডাঙ্গিতে। দোকান করেছেন আষাড়ির এই বিষ্ণুপুরে। বছর ৩৫ এর দোকান। আগে চাষবাস করতেন। এই দোকানে মুগের ডাল এখনও হাতে বাটা ও ফেটানো হয়। সেই জন্যই এই দোকানের জিলিপি খেতে একটু দানা দানা। তবে দুই দোকানের জিলিপির তুলনা করা ঠিক হবে না। দুই দোকান নিজের নিজের বৈশিষ্ট্যে ভাল। আষাড়ির দোকানের জিলিপির জন্য গ্রামের মেয়েরা বাটার কাজ করেন। কেজিতে ৫০ টাকা পান। বাটায় মেশানো হয় ছাঁটাই বিড়ির ডাল। মাখায় চিট আনার জন্য। হরিপদবাবুদের মুগের জিলিপি মুম্বই, চেন্নাই যায়। কলকাতায় তো যায়ই।
দোকান থেকে বেরিয়ে মনটা খচখচ করছিল। মুগের জিলিপির পূর্বপুরুষদের পেলাম কী? আলোচনা করলাম চারজনে। প্রথমে মনে হয়েছিল, এই এলাকায় খুব মুগ ডালের চাষ হয়। তাই বাড়তি জিনিস দিয়ে কেউ কোনওদিন কোনও এক খেয়ালে জিলিপি বানিয়েছিলেন। সে তত্ত্ব খারিজ করতে হল। হরিপদবাবু জানিয়েছেন, তাঁর দোকানের মুগ ডাল আসে কলকাতা থেকে। সোনার বাংলা মুগ। দাম সাধারণ মুগ ডাল থেকে বেশি। আবার হরিপদবাবুর দোকানের বয়স হাউরের বিশ্বনাথবাবুর দোকানের বয়স থেকে অনেকটাই কম। তাহলে? একটা অনুমান করা যায়। হয়তো ডেবরাতেই তৈরি হয়েছিল প্রথম মুগের জিলিপি। কিন্তু তা কোনও স্থায়ী দোকানদারের হাতে নয়। করেছিলেন মেলায় জিলিপির দোকান দেওয়া কোনও কারিগর। তাঁর হয়তো উদ্ভাবনী প্রতিভা ছিল। জনপ্রিয় হয় তাঁর মিষ্টি। তাঁর দেখাদেখি অন্য মেলাদাররাও তৈরি করতে থাকেন। ধীরে ধীরে এলাকায় জনপ্রিয় হয়। সেই জনপ্রিয়তা দেখে কেউ কেউ দোকানে তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। যেমন করেছিলেন হাউরের বিশ্বনাথবাবুর বাবা, পুলিনবিহারী। উনি কিন্তু প্রথমে মেলায় দোকান দিতেন।
আষাড়ির মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানসিক গবেষণায় একটা তত্ত্ব খাড়া করে বেশ আনন্দেই ছিলাম। কিন্তু মাসখানেক পরেই সেই তত্ত্ব খারিজ করার উপক্রম হল। অফিসের কাজের জন্য দেখা করতে হয়েছিল প্রণব রায়ের সঙ্গে। ঐতিহাসিক এবং ‘বাংলার খাবার’ গ্রন্থটির লেখক। কথায় কথায় উঠল, মুগের জিলিপির কথা। উনি জানালেন, মুগের জিলিপি বিখ্যাত নাড়াজোলে। জায়গাটা পশ্চিম মেদিনীপুরে। ঘাটাল মহকুমায়। তাহলে কোথা থেকে উদ্ভব এমন প্যাঁচাল কিন্তু রসাল বস্তুটির? সেই প্যাঁচ এখনও পর্যন্ত ছাড়িয়ে উঠতে পারিনি।
ও হ্যাঁ, একটা কথা। আষাড়িতে রাহুলদের দোকানে আমরা কালাকাঁদ খেয়েছিলাম। হরিপদবাবু আমাদের খাইয়েছিলেন। দাম নেননি। সে-ও অপূর্ব খেতে। কালাকাঁদ সব জায়গাতেই মেলে। একবার ঘাটশিলা থেকে রাখামাইনের দিকে যাওয়ার পথে একটা দোকান দেখেছিলাম। দোকানে শুধুই লেখা, কালাকাঁদ। নিশ্চয় বিখ্যাত। না হলে কেন এমন ঘোষণা! তবে খাওয়া হয়নি। আষাড়ির কালাকাঁদের স্বাদ সত্যিই ভাল। স্বাদের কারণেই ভিনরাজ্যে পাড়ি দেয় রাহুলদের কালাকাঁদ।
একবার আমরা একটানা খাদ্য সফর চালিয়েছিলাম। মুগের জিলিপির পরের দিনই কৃষ্ণনগর। ভায়া রানাঘাট। সেই মুগের জিলিপি দলের চারজন। দীপু, শুভ, চিনি আর আমি। কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মিষ্টি তো সকলেই জানেন। সরভাজা আর সরপুরিয়া। খেয়েছিলাম বিখ্যাত অধরচন্দ্র দাসের দোকান থেকেই। এখন দোকান আদি এবং নব্য দু’ভাগ হয়েছে। আমরা আদিতেই গিয়েছিলাম। নেদিয়ার পাড়ায় ১৭/২ অনন্ত হরি মিত্র রোডের উপরেই দোকানটা। লম্বাটে একতলা দোকান। পুরনো ছাঁদ। রংচটা দেওয়াল। দোকানের নামধাম লেখা জায়গাটাও খুব উজ্জ্বল নয়। অনেক অক্ষরই আবছা হয়েছে। কিন্তু খাদ্য সফরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিজ্ঞাপনের ছটাহীন, পুরনোপন্থী দোকানগুলোতেই আসল স্বাদ মেলে। শহরটাই এত প্রাচীন যে এখানে ঝাঁ চকচকে ব্যাপারটাই কেমন যেন বেখাপ্পা লাগে। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে মনে হয়। দোকানের কাছেই একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হয়েছে। কিন্তু কেমন যেন! শাহজাহানের হাতে গোলাপের বদলে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিলে যেমন লাগে তেমন।
আমরা যেখানেই যাই দোকানদারদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে মিষ্টির ইতিহাস, ভূগোল জানার চেষ্টা করি। অধরচন্দ্রেও ভাব জমিয়েছিলাম এক কর্মীর সঙ্গে। তিনি অধর খুলেছিলেন। সরভাজার রেসিপি বলতেও শুরু করেছিলেন। দুধের সর লাগে, ঘি লাগে...। তারপর হঠাৎ কী মনে হল, থেমে গেলেন। বললেন, ‘কারখানা অন্য জায়গায়। আমরা দোকানের কর্মী।’ হঠাৎ কাজের এলাকা ভাগের কথা মনে পড়ে গিয়েছে তাঁর। সরকারি অফিসের কর্মীদের মতো। ফলে ইতিহাস খুঁজতে নেট ভরসা। সরভাজা-সরপুরিয়ার বয়স নিয়ে টানাপড়েন আছে। জনকের নাম নিয়েও। কেউ বলেন, অধরচন্দ্র দাসই জনক। কারও মতে, তাঁর বাবা সূর্যকান্ত। এই মিষ্টি খুব বেশি পুরনো নয় বলেই অনেকের ধারণা। তবে শতায়ু। আরও একটা কথা, রেসিপি সকলে জেনে যাওয়ার ভয়ে অধরচন্দ্রেরা রাতে দরজা, জানালা বন্ধ করে সরভাজা-সরপুরিয়া বানাতেন। অর্থাৎ প্রথম থেকেই একটা লুকোছাপা রয়েছে। যেটা করলেন দোকানের কর্মী।
আমরা কিনলাম যে যার মতো। বেশ দাম। সরভাজা ৫৪০ টাকা কিলো। সরপুরিয়া ৪৬০ টাকা। এক কিলোতে দু’ধরনের মিষ্টি খান কুড়ি হয়। মোটামুটি ভাবে। থালার উপরে সাজানো সরভাজা একঝলক দেখলে মোটাসোটা গোলা রুটির মতো লাগে। সেটাকেই কেটে টুকরো টুকরো করে দেন দোকানের কর্মীরা। অধর দাসের সরভাজা ওপরে হালকা বাদামি দাগ। ভাজার চিহ্ন। দুধের সর, ঘি, চিনির মিশ্রনে তৈরি মিষ্টির এক টুকরো জিভের নাগালে এলেই মনটা ভরে ওঠে। আমাদের এলাকাতেও সরভাজা মেলে। ছোট ছোট টুকরো। গাঢ় খয়েরি রং। পাঁচ টাকা পিস। অধর দাসের সরভাজার এক টুকরো গড়ে ২৭ টাকার মতো পড়ে। সরভাজার স্বাদ আর ঐতিহ্য দামে পুষিয়ে দেয়।
সরপুরিয়া চৌকনো টুকরো। ঠাস বুনোট। এমন ঠাস বুনোটের জন্য হাতে নিলে শক্ত লাগে। কিন্তু কামড় বসালেই বোঝা যায় সন্দেশের মতো নরম। এরও মূল উপাদান সর। সঙ্গে খোয়া ক্ষীর, নানা বাদাম। খাওয়ার আগে একবার নাকের কাছে ধরা উচিত। জিভ-গলা-মন ভাল কিছু পাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যাবে।
সকলেই জানেন, রানাঘাটের পান্তুয়া বিখ্যাত। কিন্তু আমাদের মত, তিন জায়গার পান্তুয়া বিখ্যাত। মানে খেতে ভাল। দু’টো আগেই চাখা হয়ে গিয়েছিল। আমতার পান্তুয়া আর কালনার নোড়া পান্তুয়া। বাকি ছিল শুধু রানাঘাটের। কৃষ্ণনগর থেকে ফেরার পথে নেমে পড়লাম। তবে দোকানে গিয়েছিলাম আমি আর শুভ। দীপু আর চিনি ট্রেনে জায়গা ধরার জন্য স্টেশনে রয়ে গিয়েছিল। স্টেশনের কাছেই বাজার এলাকায় জগু ময়রার দোকান। বেশ ঝকঝকে। জগুবাবুর নাতি খোকনবাবু এখন দোকান চালান। তাঁদের দোকানে মেলে দু’ধরনের দামের পান্তুয়া। সাত টাকা এবং ১০ টাকা। এখানকার পান্তুয়া কিন্তু গোল নয়। লম্বাটে। ঠিক কালনার নোড়া পান্তুয়ার মতো (মিষ্টিমহলের আনাচেকানাচে প্রথম পর্ব দ্রষ্টব্য)। পান্তুয়ার রং একটু কালচে লাল। ছালটা মোটা। তার মানে ভাল ভাবে জ্বাল দিয়ে ভাজা হয়েছে। ওপরটা শক্ত মতো। অনেকটা আমতার পান্তুয়ার মতোই। পান্তুয়ার ভিতরটা জালের মতো। ফুটো ফুটো। ভিতরে রস ঢুকেছে ঠিক মতো। কামড় দিলে ভিতরের রসের আস্বাদ মেলে। ভাল পান্তুয়ার গুণই হল, ওপরের ছাল হবে শক্ত। ভিতরটা নরম। লালচে, থ্যাসথ্যাসে পান্তুয়ার মানে কম আঁচে ফাঁকিবাজিতে তৈরি।
জগু ময়রার তিন পুরুষের ব্যবসা। পান্তুয়া লম্বাটে কেন? খোকনবাবু তা জানেন না। শুধু বললেন, ‘লম্বা, গোলে কী আসে যায়। স্বাদটাই তো আসল।’ একেবারে হক কথা। রানাঘাটে আরও একটা দোকানের নাম রয়েছে। সেই দোকান চৌরঙ্গি মোড়ের কাছে। নাম ‘মেজদার জলযোগ’। নামে নতুন মনে হলেও এই দোকানের পান্তুয়াও বেশ ভাল। স্বাদে তফাৎ করতে পারা যায় না।
মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ছানাবড়াও খেয়েছিলাম একবার। তবে অভিযান করে নয়। ঘরে বসে। সহকর্মী জিয়া ভাই মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। ও এক বন্ধুকে দিয়ে আনিয়েছিল মেসের সহবাসীদের জন্য। আমাকেও দু’টো দিয়েছিল। হ্যাঁ, দু’টোই। সেদিন আমাদের ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ দলের সদস্যদের মধ্যে শুধু দীপু হাজির। আমাদের বাড়ির চারজন আর দীপু, ভাগিদার পাঁচ। দু’টো ছানাবড়া পাঁচ ভাগ করা হয়েছিল।
কোন দোকানের ছানাবড়া জিয়া খাইয়েছিল, জানি না। যতবার জিজ্ঞাসা করেছি বলেছে, ‘জেনে তোমাকে বলব।’ সেই জানা আর হয়নি। ঠিক করেছি, একেবারে লালবাগে গিয়েই চেখে আসব। ছানাবড়ার উৎপত্তিই তো লালবাগ।
কেমন লেগেছিল সেই ছানাবড়ার টুকরো? সেদিন দীপু ছানাবড়া খাবার পর আঙুলগুলো অনেকক্ষণ ধরে চেটেছিল। ও-ই ছানাবড়া ভাগ করেছিল কিনা। তারপর হাত ধুল। তারপর বলল, ‘মুখ ধোব না। দারুণ স্বাদ। ধুলে সব ধুয়ে যাবে।’
রঞ্জন স্যার,
‘তবে তখন বোধহয় মাজু ছিল ,কিন্তু জালালসি ছিল না’। এ বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য জোগাড় করতে পেরেছি। মার্টিন রেলের জালালসি স্টেশন ছিল। ছোট রেলটির পাতিহাল থেকে আমতার দিকে যাওয়ার পরপর স্টেশনগুলো হল— পাতিহাল, মুন্সিরহাট, মাজু, দক্ষিণ মাজু, জালালসি..’। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ইএমইউ চলাচলেও জালালসি স্টেশন রয়েছে। নেই শুধু দক্ষিণ মাজু স্টেশনটি। স্টেশনগুলো নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। তাই নতুন তথ্য মিলছে।
ভাল থাকবেন।