কুলিয়ানা কোন কূলে, জানা ছিল না। সফরসূচিতেও ছিল না স্বাভাবিক ভাবে। ‘এবার পুজোয়? ভিন রাজ্যে।’ পুরনো দিনের পুজোর সফরের বিজ্ঞাপনের মতো এটাই ছিল আমাদের ক্যাচলাইন। সেই কারণেই হাতিবাড়িতে ‘বেস ক্যাম্প’ করা হয়েছিল। বাংলা-ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা, তিন রাজ্যের সীমানায় জায়গাটা। ঝাড়গ্রামের হাতিবাড়িতে যে গেস্ট হাউসে ছিলাম, সেখানকার কেয়ারটেকার বাবলুদা কুলিয়ানার ডোকরা শিল্পীদের কথা বলেছিলেন। তারপর অটো ভাড়া করে যাত্রা শুরু। দিনটা ছিল দুর্গাপুজোর অষ্টমী।
ঘুরতে গেলে গাড়ি নিয়ে কোনও বাছবিচার নেই। চার-চাকা দামে না পোষালে হামেশাই তিন চাকায় সওয়ার। ইঞ্জিন ভ্যান, টোটো, অটো। কত পুজোয় এমন বাহনে সফর চলেছে আমাদের! আমরা চারজনে লটবহর, ক্যামেরার স্ট্যান্ড নিয়ে অনায়াসে এঁটে গিয়েছিলাম অটোয়। দামি ক্যামেরা। তাই ছবি তোলার দাবি নিয়ে ইন্দ্র চালকের পাশে। বাবলা, দীপু আর আমি মাঝে। পিছনে আমাদের ব্যাগপত্তর। অটো ওড়িশারই ছিল। কিন্তু চালক জানতেন না ডোকরা গ্রামের খবর। রাস্তায় বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ।
খোঁজখবর আমরাও নিচ্ছিলাম। কারণও ছিল। মিষ্টির খোঁজ করছিলাম। একটা বাজার এলাকায় দোকান চোখে পড়েছিল। ছোটখাট দোকান। তাতে মিষ্টির সঙ্গে নানা ভাজাভুজি। গুলগুলা, বড়া, পিঁয়াজি। গুলগুলার সঙ্গে নামে পরিচয় ছিল। রতন ভট্টাচার্যের একটা গল্পে পড়েছিলাম। বড়াটা কিন্তু অন্যরকম। বালুসাইয়ের মতো। মাঝে ফুটো। এ বড়া খেয়েছি খাস কলকাতাতেই। আর রয়েছে জিলিপি, মালপোয়া। আমরা খাইনি। আসলে ক্ষীরমোহনের খোঁজে ছিলাম। রসগোল্লার সঙ্গে এত লড়াই দিয়েছেন যিনি, তাঁকে চোখে আর চেখে দেখা জরুরি। ওই দোকানে ক্ষীরমোহন ছিল না। দোকানকার কিছুটা আগে গিয়ে একটা দোকানে খোঁজ করতে বললেন। সেখানেও ক্ষীরমোহন নেই। কিন্তু মালপোয়ার সম্ভার আমাদের চোখ টানল। তিন ধরনের মালপোয়া পাওয়া যায় দোকানে। কাকরা মালপোয়া, কাতরা মালপোয়া আর সাধারণ মালপোয়া। কাকরা মালপোয়া আমাদের বাঙালি বাড়িতে পরিচিত গোল মালপোয়ার মতো। বাঙালি মালপোয়া আকারে ছোট। ওড়িশার কাকরা রেকর্ডের মতো প্রায়। কাতরা মালপোয়া বেশ স্বাস্থ্যবান এবং আকারে বড়। মাঝে ফুটো। অন্য মালপোয়াটা গুটলি মতো। ওড়িশায় মালপোয়ার চল আছে মনে হয়। তিনটে দোকানে দেখেছি। দোকানে খেলাম ওড়িশার রসগোল্লা আর ছানাপোড়া। এ দোকানেও দেখলাম বুকে ফুটো বড়া আর গুলগুলা। তার পর আবার কুলিয়ানা যাত্রা।
রাস্তা বেশ ভাল। দু’পাশের প্রকৃতিও। শরতের কাশের বন রাস্তার পাশে। দূরে সবুজ জটলা পাকিয়ে রয়েছে। মাঠে ধান চাষ হয়েছে। একসময়ে পৌঁছনো গেল ডোকরা গ্রামে। গ্রামের নাম কমতা। থানা কুলিয়ানা। জেলা ময়ূরভঞ্জ। গ্রামে ঢোকার পরে রাস্তার লোকজন দেখিয়ে দিলেন এক ডোকরা শিল্পীর বাড়ি। রাস্তার গায়েই। লম্বাটে বাড়ি। মাটির দেওয়াল, টালির চাল। দাওয়ায় বসে কাজ করছিলেন যুধিষ্ঠির জানা। খালি গা। পরনে গামছা। এক প্রবীণ ডোকরা শিল্পী। কথা বলা শুরু করেছিলাম আমরা। বলতে গিয়ে দু’টো অসুবিধেয় পড়েছিলাম। বয়সের কারণে শ্রবণশক্তি কমে গিয়েছে তাঁর। ভাষার ব্যবধান তো ছিলই। আমরা কথা বলছিলাম বাংলায়। আর উনি বলছিলেন মাতৃভাষা ওড়িয়ায়। শব্দগুলো চেনা লাগছিল। কিন্তু শব্দের প্রয়োগে মনে হচ্ছিল অর্থের কিছু হেরফের হয়ে যাচ্ছে। শিল্পীর শ্রবণগ্রাহ্য করার জন্য আমাদের উঁচু স্বরে কথা বলতে হচ্ছিল। উচ্চারণ করতে হচ্ছিল দু’বার করে। তাতে শব্দ হারাচ্ছিলাম আমরা। সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন শিল্পীর নাতি। রাজেশকুমার রানা। রাজেশ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। ডোকরার কাজ করেন তিনিও। আমাদের বোঝাতে গিয়ে রাজেশও শব্দ-বাধায় পড়ছিলেন। আপনা থেকেই হিন্দি শুরু হয়ে যাচ্ছিল। দীপু রাজেশকে হিন্দিতেই কথা বলতে বলল। সংযোগরক্ষাকারী ভাষা হিসেবে কাজে এসেছিল হিন্দি। এটা কিন্তু হিন্দির পক্ষে সওয়াল নয়। শুধু একটা তথ্য। বলিউডের কল্যাণে যেটুকু হিন্দি শেখা তা দিয়ে কাজ চালাচ্ছিলাম।
যুধিষ্ঠির জানার ঘরে, দাওয়ায়, উঠোনে ডোকরার নানা পর্বের নমুনা। উঠোনে রোদে পিঠ শুকিয়ে নিচ্ছে কিছু কচ্ছপ। দাওয়ায় অর্ধ সমাপ্ত কিছু ছাঁচ। শিল্পী যেখানে কাজ করছিলেন, সেখানে একটা কালো রঙের বড়সড় টুকরো পড়েছিল। সেটার এক পিঠ উত্তল। আরেক পিঠ সমতল। দেখলে মনে হয় পাথরের তৈরি। শিল্পী জানালেন, এটি কেঁদ গাছের কাণ্ড দিয়ে তৈরি। শিল্পের উপকরণ। নাম একটা বলেছিলেন। কিন্তু ভুলে গিয়েছি। যুধিষ্ঠির জানার পরিবার ডোকরার কাজে ফুটিয়ে তোলেন নানা অবয়ব। পশুপাখি, দেব-দেবী, মানুষ, আদিবাসীদের জীবনযাত্রার টুকরোর মূর্ত রূপ। কী ভাবে তৈরি হয় ডোকরার শিল্পকর্ম? রাজেশ বুঝিয়ে দিলেন। তাঁর দাদু মাঝে মাঝে সাহায্য করলেন। হাতে কলমে দেখিয়েও দিলেন কয়েকটি পর্ব।
যে অবয়ব গড়তে চান, শিল্পীরা প্রথমে তার একটা ছাঁচ তৈরি করে নেন। এই ছাঁচ হয় মাটির। ছাঁচটি শুকিয়ে পুড়িয়ে নেওয়া হয়। ধরা যাক, শিল্পী কচ্ছপ তৈরি করবেন। তাহলে প্রথমে মাটির ছাঁচে কচ্ছপের আকারটা তৈরি করে নেবেন। পোড়ানোর পরে মোম দিয়ে ছাঁচে চোখ, মুখ, পা, হাতের নকশা করা হবে। ডোকরার কাজে বিশেষ ধরনের মোম লাগে। মোম দিয়ে নকশার বিষয়টা বুঝতে পারছিলাম না আমরা। প্রবীণ শিল্পী অশৈল্পিক চারজনকে হাতে কলমে দেখিয়ে দিলেন। সরু সুতোর মতো মোম দিয়ে কচ্ছপের ছাঁচের পিঠে নকশা করলেন। জ্যান্ত কচ্ছপের পিঠে যেমন ছোপ দেখা যায় তার একটা ছাঁদ। মোম দিয়ে চোখ তৈরি করলেন। ছাঁচের নকশার জন্য বিভিন্ন আকার লাগে। গোল, তিন কোণা। শিল্পী প্রথমে সেই কেন্দু কাঠের টুকরো দিয়ে মোম পিষে লম্বা, চ্যাপ্টা করে নেন। তার পর মাপ অনুযায়ী কেটে নেন। কেন্দু কাঠের টুকরো দিয়ে মোম পেষাইয়ের পদ্ধতিটা বাবালা আর ইন্দ্রর চেনা লেগেছিল। ওদের কথায়, সোনার কাজে যে দলনা মেশিন ব্যবহার করা হয় তার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। সেটি যন্ত্র, ডোকরার দলনা কেঠো।
মোমের নকশা তৈরি হয়ে গেলে ছাঁচের উপর মাটির প্রলেপ পড়ে। বিল থেকে সাদাটে একরকম মাটি সংগ্রহ করেন ডোকরা শিল্পীরা। সেই মাটির প্রলেপ পড়ে দু’তিনবার। মাটি লাগানো ছাঁচ শুকিয়ে নেওয়ার পরে পিতল ঢালার পালা। সেই কাজ হয় ভাটিতে। বাড়িতেই রয়েছে ভাটি। শিল্পীরা চোঙার মতো একটা পাত্রে পিতল ভর্তি করেন। তার পর চোঙায় ছাঁচটার কিছু অংশ ঢুকিয়ে দেন। এ জন্য ছাঁচে লম্বাটে একটা অংশ যোগ করেন তাঁরা। সেটাই পিতল ভর্তি চোঙায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এবার চোঙাটা ভাটির আগুনে বসিয়ে দেওয়া হয়। উত্তাপে একসময়ে পিতল গলে যায়। ঠিকঠাক গললে পিতল থেকে একধরনের গন্ধ বার হয়। এবার চোঙাটি উল্টে দেন শিল্পীরা। এর ফলে ছাঁচের সঙ্গে লাগানো লম্বাটে অংশ বেয়ে তরল পিতল ছাঁচের গা বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকে। পুরো ছাঁচ ঢেকে ফেলে তরল পিতল। পিতল ছাঁচ দখলের সময়েই মোম, বিলের মাটির আস্তরণ গলে বেরিয়ে যায়। রয়ে যায় শুধু সেই প্রথমের পোড়ামাটির ছাঁচটা। ওই ছাঁচই নকশার ধারক। পিতল ভর্তি চোঙায় বসানোর জন্য শিল্পীরা ছাঁচের সঙ্গে যে লম্বাটে অংশ যোগ করেছিলেন সেটা ভেঙে দেন। পিতল ছাঁচের আকার নেওয়ার পর পালিশ করা হয়। তবেই শিল্পকর্ম ঝকঝকে হয়।
যুধিষ্ঠির রানার পরিবারের সকলেই ডোকরা শিল্পী। রাজেশের বাবা নেই। মা পদ্মাবতী রানা, কাকিমা রঙ্গলতা রানা, কাকা মনোজকুমার রানা— সকলেই ডোকরার কাজ করেন। এঁদের সকলের শিক্ষক যুধিষ্ঠির। আমাদের মতো আনাড়িকে ডোকরার কাজ বোঝাতে সকলেই যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। বাড়ির দাওয়ায় একটা ছাগল ছানা শুয়েছিল। গলায় নেকলেসের মতো করে ঘুঙুর বাঁধা। আমাদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে মা-কাকিমারা ছাগলের সঙ্গেও কথা বলছিলেন। বোঝাই যাচ্ছিল, খুব প্রিয় ছানা।
কমতা গ্রামে যুধিষ্ঠির রানার পরিবার ছাড়াও আরও ১০-১৫ ঘর ডোকরার কাজ করেন। কুলিয়ানা থানার পারিয়াগুলি গ্রামেও ডোকরার কাজ হয়। এই গ্রামে রানাদের ডোকরার কাজ শুরু করার পিছনে কি রাজা বা জমিদারদের কোনও হাত রয়েছে? যুধিষ্ঠির জানা যা বললেন, তাতে বোঝা গেল, তাঁরা এ গ্রামের বরাবরের বাসিন্দা। বংশ পরম্পরায় ডোকরার কাজ করে আসছেন। যুধিষ্ঠির একটি সংস্থা থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন। আমাদের দেখালেন পুরস্কারের শংসাপত্র।
শিল্প জানা হল। এবার স্মারক সংগ্রহ। কিন্তু শিল্পীর বাড়িতে কোনও কাজ নেই। বাতিল দু’টো কচ্ছপ পড়ে রয়েছে। আমরা কিনতে চাইলেও সেগুলো দিতে চাইলেন না তাঁরা। যুধিষ্ঠির নিজে আমাদের নিয়ে গেলেন অল্প দূরের একটি বাড়িতে। বাড়িটি পাকা। জগন্নাথ ও লক্ষ্মীধর সাউয়ের বাড়ি। তাঁরা বিভিন্ন রকমের কাজ দেখালেন। পছন্দ মতো কিনলাম চারজনেই। কাজগুলো পালিশ করে দিলেন লক্ষ্মীধর। এঁরাও ডোকরার কাজ করেন বলে জানালেন।
ডোকরা শিল্পীদের গ্রাম ছাড়ার পরে অটোয় বসে বাবলা একটা কথা বলেছিল। ‘‘এত টাকার জিনিস, যদি যুধিষ্ঠির জানার কাজ থেকে কিনতাম ভাল হত।’’ কথাটা ঠিক। ওঁদের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। শিল্পী আর চাষিরা কেন শ্রমের দাম পান না এদেশে? মধ্যস্বত্বভোগীদের রমরমা হয় কেন? যুধিষ্ঠির জানা আমাদের বলছিলেন, তাঁরা যেমন অর্ডার পান, সেই অনুযায়ী জিনিস তৈরি করেন। মেলায়, প্রদর্শনীতে বিক্রি করতে যান। ময়ূরভঞ্জে কারও কাছে তৈরি জিনিস পাঠান। কিন্তু এঁদের অবস্থার কোনও উন্নতি হয় না। কেন? যাঁরা ডোকরা শিল্পীদের নিয়ে কাজ করেন নিয়মিত, তাঁরা নিশ্চয় টান দিতে পারবেন এই অনুন্নয়নের কারণে। কিছু সময়ের দেখায় আমরা আর কতটা বুঝব?
ফিরতে ফিরতে আলোচনা হচ্ছিল, শিল্পীর হাতে কি কিছু দেওয়া উচিত ছিল? আমাদের সাধ্যমত? কিছু না কিনে শিল্পীর হাতে অর্থ দেওয়াটা বাধো বাধো ঠেকছিল। মনখারাপ হয়ে যাচ্ছিল।
বিশেষ দ্রষ্টব্য— কেউ যদি কুলিয়ানার ডোকরা গ্রাম নিয়ে আগ্রহী হন যোগাযোগ করতে পারেন রাজেশের নম্বরে। 7077954086 এবং 6372897159 (হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর)।
ডোকরা শিল্পীদের গ্রামে গেলে ভ্রমণও হবে। কুলিয়ানা থেকে কিছু দূরে বাংরিপোসি এবং বারিপদা। পশ্চিমবঙ্গের হাতিবাড়িও খুব দূরে নয়।
ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ ও দীপশেখর দাস