প্রাণেশ পালের মাথা দ্বিতীয়বার ফাটার পর পার্মানেন্টলি ফাটাপানু নাম অর্জন করে। ভালো নাম ছিল প্রাণেশরঞ্জন পাল। কিন্তু পরবর্তীকালে ফাটাপানু নামে এমন প্রচার পায় যে, সে নিজেও ব্যাঙ্কে লোনের দরখাস্ত করতে গিয়ে প্রাণেশরঞ্জন পাল বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। সঙ্গে লোকাল কমিটির সেক্রেটারি, যে কিনা কিছুদিন আগেই ভোটার লিস্ট নাড়াচাড়া করতে গিয়ে আবিষ্কার করে যে, এ আসলে ফাটাপানু, ফলে মনে ছিল – বলে দেয় যে – লেখ, প্রাণেশরঞ্জন পাল। তখন ফাটাপানু বোঝে সত্যদা যখন বলছে, তখন তার নাম তাই হবে।
পানু পাল আঠারোতেই দানা ভরতে শিখে গিয়েছিল। প্রথমবার মাথা ফাটে ষোলোতে। সে আদতে বকুলতলার। সদ্য অ্যাক্সিলেটর গিয়ারের রহস্যভেদ করতে শিখে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিল। ধাবার মালিক হরদয়ালের ভেস্পা নিয়ে মুচিপাড়ায় গিয়েছিল রং ওড়াতে। কিন্তু বেশি উৎসাহে ভুল জায়গায় আওয়াজ দিয়ে ফেললে তরুণতীর্থ ক্লাবের ছেলেরা তাকে ধরতে আসে। সে ভেবেছিল একবারে ফোর্থ গিয়ারে ফেলে ঝড়ের বেগে উড়ে যাবে। কিন্তু স্ট্যাটিক পজিশন থেকে একবারে ফোর্থ গিয়ারে ফেললে ভেস্পা প্রয়োজনীয় গতিজাড্য পায়না, সামনের চাকা উঠে যায় এবং প্রাণেশ মাটিতে পড়ে যায়। ক্লাবের ছেলেরা এই নবকর্ণকে আচ্ছাসে বানিয়েছিল। প্রথমবারের মত তার মাথা ফাটল।
কিন্তু ফাটাপানু নাম অর্জন করার জন্য এ যথেষ্ট নয়। এ রকম মাথাফাটা কেস প্রতিদিন শহরজুড়ে অজস্র হচ্ছে। ফাটাপানু হতে গেলে এলেম লাগে। অনেক রক্ত ঝরাতে হয়। সাইকেল এবং আগুন বিষয়ে গভীর বোধ দরকার হয়। সেজন্যই দেখা যায় যে, সবাই ফাটাপানু হতে পারে না। এসব ছেলেদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সাধারাণত খুব গন্ডগোলের হয়। দেখা যায় যে, বাপ মাতাল, জুয়াড়ি, ওয়ান ডিজিট খেলে খেলে ফ্যামিলির সর্বনাশ করে দিয়েছে। অথবা মা অসতী। ছেলে সমাজের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। যে কানুন তার বচপন নষ্ট করে দিয়েছে, সেই কানুনকে সে নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।
কিন্তু খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, প্রাণেশরঞ্জন পালের বাবা ধ্যানেশরঞ্জন পালের একটা রেডিমেড পোশাকের দোকান আছে। ভদ্রলোক নেহাতই সাদামাটা। তিনি তার বউকে সুখে রাখার জন্য এবং একমাত্র পুত্র প্রাণেশ তথা পানুকে এডুকেশন দিয়ে ভদ্রলোক তৈরি করার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করে দোকানটা দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু তার সারাদিন দোকানদারি এবং মা নিরীহগোছের হওয়ায় প্রাণেশরঞ্জন ফাটাপানু হওয়ার অবাধ সুযোগ পেয়ে যায়।
সে ছিল হরিপ্রসন্ন ঘোষ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের পুরনো ছাত্র। হরি ঘোষের গোয়াল নামে এই স্কুলের বেশ নামডাক ছিল। তাদের স্কুলের দক্ষিণে খেলার মাঠ, তার ওপাশেই নারায়ণী ঘোষ স্মৃতি বালিকা বিদ্যাপীঠ। এই দুই স্কুলের মাস্টারমশাই এবং দিদিমণিদের ভেতর যেমন যে কোনও অনুষ্ঠান নিয়ে আকচাআকচি ছিল, তেমনি বেশ একটা প্রেম প্রেম ভাবও ছিল। এই ভাব এই স্কুলের ডেঁপোছেলেরা এবং ওই স্কুলের পাকা মেয়েরা না শেখাতেই শিখে যায়। ইতিমধ্যে পানু তার উঁচু ক্লাসের বন্ধুদের নিবিড় প্রশিক্ষণে নারী শরীরের গভীর গোপন রহস্য দ্রুত শিখে নিচ্ছিল। করিশ্মা কাপুরের বিয়ারিং-এ টাল আছে – ক্লাস টেনের চিন্ময়ের মুখে বাক্যটি শুনে পানু প্রথমে কিছুই ঠাওর করতে পারেনি। পরে চিন্ময় পিস্টন, বিয়ারিং, হর্নবল বিষয়ে একটা তুলনামূলক আলোচনায় গেলে ক্লাস সেভেনের পানুর বুকের ভেতর হঠাৎ কোনও ধাতব ঘন্টা ঢং ঢং করে বেজে উঠেছিল।
নতুনবাজারের সেলুনে বসে ছিল পানু। সিগারেটে টান দিতে দিতে নতুনশেখা লেসন্-এর তাৎপর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করছিল। ফ্যানের হাওয়ায় রিং হয় না। আয়নায় পানু দেখল আঠারোর সি বিপজ্জনকভাবে টার্ন নিচ্ছে। ঝিলের ওদিক থেকে একটা বিরাট কুয়াশা উঠে আসছে। হলদেটে সূর্য হঠাৎ করে যেন অনেকটা পশ্চিমে ঝুলে পড়ল। গোল বলটা কমলা হয়ে আসছে। বকুলতলা, শকুন্তলা, শিবরামপুরের কোথাও আলো, কোথাও ছায়া। ঝিলের জলে কেউ আবির ছড়িয়ে দিয়েছে। কমলা বলটা দিগন্তের নিচে নেমে গেলে অপার্থিব আলো ভরে যায় কবেকার সেই বড়িশা, সরসুনা। পশ্চিমে কোনও কারখানা থেকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে। ঝিলের পাশে ঘনসবুজ ঘাস কালচে দেখায়। হঠাৎ ঘাই মারে মিরগেল। অলৌকিক সন্ধ্যা নেমে আসছে। আকাশের ছেঁড়া সাদা মেঘে একটুখানি লালরং লেগে আছে। বিপজ্জনক লাল। তখন হঠাৎ প্রাণেশের বুকের ভেতর অসম্ভব ঘন্টা বেজে উঠল।
এরপর একদিন তার নীলছবি দেখার অভিজ্ঞতা হয়। তার শরীর রোগাপটকা হলেও এক ধরণের হিমনিষ্ঠুরতার জন্য সে স্কুলে খ্যাতি অর্জন করছিল। বাড়িতেও দেখা গেল সে খুব বিপজ্জনকভাবে কাচের গ্লাস, কাপপ্লেট, কাঁসার থালা ইত্যাদি টেবিলের একদম ধারে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করছে। কিছুদিন আগেই সে তাদের বাড়ির পোষা বেড়ালের আঁচড় খেয়েছে। পরে প্রকাশ পায় যে, একটা আনকোরা ঝক্ঝকে ব্লেড হাতে নিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে পোষা বেড়ালের বিশেষ সংবেদনশীল ট্যাক্টাইল লোমগুলো কাটার চেষ্টা করেছে। তার আগে সে বিছানার চাদরের ওপর ব্লেডের ধার পরীক্ষা করেছে। তার আরও দোষ ছিল। যে কোনও মুখের ছবি, তা সে খবরের কাগজে ছাপা হোক বা ক্যালেন্ডারে হোক – কালো কালির পেন দিয়ে সে ওই মুখকে নিখুঁতভাবে পালটে দিতে পারত। এইভাবে সে ইতিহাস বই-এ বুদ্ধদেবকে মালক্ষ্মী, সৌরভ গাঙ্গুলিকে রামকৃষ্ণ পরমহংস এবং তাদের পাল ড্রেস হাউসের হালের ক্যালেন্ডারে মাকালীর মুখকে পর্তুগিজ জলদস্যু( এক চোখে কালো পট্টি, মুখে লম্বা কাটা দাগ), এবং নিচে পরমহংসদেবকে সানগ্লাস পরিয়ে, গায়ে কোট, মাথায় আম্পায়ারদের টুপি পরিয়ে এমনভাবে দাড় করায়, যে স্পষ্টই বোঝা যায়ুনি আঙুলের মুদ্রায় ওই হার্মাদকে আউট ঘোষণা করছেন।
এগুলো তার ক্লাস থ্রি-ফোরের কীর্তি। কিন্তু শিলিগুড়ি থেকে ফিরে আসার পর মাকালীর ছবির ব্যাপারে মা তাকে খুব বকেছিল। পাপপুণ্য, স্বর্গনরক ইত্যাদি বিষয়ে বোঝাতে গেলে সে এমন সব উদ্ভট প্রশ্ন করতে শুরু করে যে, তার মা-ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। মনে হয় যেন সে শেষপর্যন্ত জানতে চায়।
সে যখন সেভেনে পড়ে, একদিন ক্লাস নাইনের একটি ছেলেকে আদেশ করেছিল একটু দূরের পানদোকান থেকে সিগারেট এনে দিতে। ছেলেটির সাইকেল ছিল, তৎসত্বেও সে প্রাণেশের এই আবদার অস্বীকার করে বসল। তার সম্মানের কথা ভেবেই সে পানুর কথা অমান্য করার মত হঠকারি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পানু খুবই আশ্চর্য হয় এবং বলে যে – তোর জিওগ্রাফি পালটে দেব। ছেলেটি হেডুর কাছে কমপ্লেইন করার ভয় দেখালে পানু সত্যি ঘুষি ঝেড়ে দিল। ছেলেটার সামনের দাঁত পড়ে যায় এবং রক্ত লেগে সাদা জামা এমন দেখায় যেন রক্তারক্তি কান্ড বটে।
সমস্ত ঘটনা জানাজানি হলে প্রাণেশকে স্কুল থেকে বিদায় করার প্রস্তাব উঠল। সাইকেলওয়ালার বাবা স্কুলে পাঁচটি বেঞ্চ ডোনেশন দিয়েছিলেন। তিনি বেঞ্চ ফেরত চাইতে পারেন, তাহলে ক্লাস ফাইভের কিছু ছেলেকে মাটিতে বসতে হয়। হেডু এই আশঙ্কা প্রকাশ করলে প্রাণেশের গার্জিয়ান কল হলো। সেবার প্রাণেশ বেঁচে যায়, কিন্তু তার বাবার গোটা সাতেক বেঞ্চ খসে। এ বাজারে কুকাঠের হলেও সাতখানা বেঞ্চের দাম কম নয়।
দ্বিতীয়বার তাকে আর স্কুলে রাখা গেল না। তখন সে কেমন করে যেন এইটে উঠেছে। আগেই সে গোটা স্কুলের দাদা ছিল, এইটে উঠে তার ঘাড়ে রোঁয়া গজাল। পাশের স্কুলের একটি কিশোরীকে দেখে তার মনে হল সেম টু সেম বিপাশা। স্কুল ছুটিরপর ‘সোনামানিক’ ক্যাসেট কর্ণারের পাশে সে তৃষিত চাতকের মত দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু কোনও কিছু পাবার জন্য এ রকম ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে সে কোনও কালেই রাজি ছিল না। ধাই করে একদিন মেয়েটার হাতে একটা প্রখর চিঠি গুঁজে দিল সে। চিঠির শেষ লাইনগুলো ছিল – ফুলবাগানে কতশত ফুল ফুটেছে/মৌমাছিরা মধুর লোভে জুটেছে/ আমিও তেমন একজন মৌমাছি। রেখো আমার জন্য তোমার মধু বাছি। এবার ৮০। পুবপশ্চিমদক্ষিণ বাদে যা থাকে তাই দিও, ছু-এর আগে, ভু-এর পরে যা হয় তাই নিও।
পানুর কপাল খারাপ। দেখা গেল এ মেয়েটির বাবা কিঞ্চিত্ কর্কশ টাইপের। মোটরবাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। নাকি প্রোমোটার। মেয়েটাও সাদাসিধে। সে সোজা বাড়িতে বাবার কাছে এবং পরদিন স্কুলে বড়দির কাছে পাশের স্কুলের ক্লাস এইটের প্রাণেশ পালের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাল। কর্কশ লোকটি পরদিন ওখানেই দাঁড়িয়েছিল। তার মেয়েকে দেখে প্রাণেশের হাবভাব দেখে মাল ধরে ফেললেন। তখন সেই লম্বাচওড়া ভদ্রলোক প্রাণেশের চুলের মুঠি ধরে স্কুলে এনে হেডস্যারের সামনে ছুঁড়ে ফেলে বললেন যে, এ ছেলেকে টি সি না দিলে তিনি তার আপন ভায়রা শিক্ষামন্ত্রীকে জানিয়ে দেবেন ফাইভে ভর্তির সময় এ স্কুলে অস্বাভাবিক হারে ডোনেশন নেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্কুলঘর ভাড়া দেওয়া হয়। তিনি যেন মনে রাখেন হেডমাস্টারের টুইশন করা ক্রিমিনাল অফেন্স। এসব শুনে প্রধানশিক্ষক কেমন যেন রক্তহীন ফ্যাকাশে হয়ে পড়েন। সেদিনই বিশেষ অধিবেশনে প্রাণেশকে টিসি দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদিত হলে প্রাণেশ ফাটাপানু হওয়ার পথে কিছুটা এগিয়ে গেল।
এরপর পানুর বাবা ছেলেকে দোকানে বসানোর চেষ্টা করেছিলেন। এমন কী, পানু দু’একদিন বসেও ছিল। কিন্তু ক্যাশে হেভি গোলমাল হতে শুরু করে এবং কিছু পার্মানেন্ট মহিলা কাস্টমার অন্য দোকানে চলে যায়। পানুর বাবা তাকে দোকানে আসতে বারণ করলে ফাটাপানু হতে তার আর কোনও বাধা রইল না।
পানু যখন খুব ছোট, তখন একবার শিলিগুড়িতে ওর মামাবাড়ি বেড়াতে এসেছিল। তখন ওর বয়স ছিল নয় দশ। থানার কোয়ার্টার্সে ওর মামারা থাকত। পুলিশমামাকে দেখে পানু অবাক হয়ে গেল। বিশেষ করে যখন মামা ফুল ইউনিফর্মে থাকত, তখন ওর বিশ্বাসই হত না জীবজগতে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী এই প্রাণীটিই তার আপন মামা। ইতিপূর্বে পুলিশ সম্পর্কে যে গল্পকাহিনী সে শুনেছিল, তার ফলে তার দৃঢ় ধারণা ছিল যে পুলিশ মানুষ নয়। পুলিশ এক মহাশক্তিমান দেবতা গোছের কোনও প্রাণী। দুরন্ত শিশুদের, বদমাইশদের শাস্তি দেবার জন্য ভগবান এদের পৃথিবীতে পাঠায়। ফলে তার মনে আতঙ্ক ছিল। কিন্তু মামাকে দেখে সে খুব দোটানায় পড়ে গেল। ক্রমশ বুঝতে পারল মামা আসলে খুবই ভালোমানুষ। ফুলেশ্বরী নদীর ওপারে ডাকাত ধরার গল্প শুনতে শুনতে সে মামার কোলে উঠে বসে এবং স্পষ্টই বুঝতে পারে যে তার মামাই হল পৃথিবীর সেরা বুদ্ধিমান, শক্তিশালী লোক। টি ভি সিরিয়ালের শক্তিমান তুচ্ছ হয়ে যায় তার মামার কাছে। তার বুকের ভেতরে একজন নায়ক তৈরি হতে থাকে। এরপর যখন তার জন্মদিনে মামা তাকে একটা সাইকেল উপহার দেবে কথা হয়, তখন সেই পুলিশমামা এক মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দয়ালু মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সাব্যস্ত হয় নীল রং-এর সাইকেল কেনা হবে।
তখন একরাতে শিলিগুড়িতে একটা ঘটনা ঘটেছিল। থানার উল্টোদিকে পুরনো বাজারে হঠাৎ গভীর রাতে কীভাবে যেন আগুন লেগে যায়। তাদের বাড়ির সবাই চিৎকার শুনে উঠে পড়ে। পানুও ওঠে। সবাই মিলে থানার গেট পর্যন্ত আসতে পেরেছিল। ওখানেও আগুনের হল্কা আসছিল। সে কী আগুন ! ফটাফট শব্দ করে ফ্রেম থেকে টিন ছুটে যাচ্ছে। হুড়োহুড়ি, চিৎকার। যাদের দোকানে তখনও আগুন ধরেনি, দোকান থেকে মাল সরাবার জন্য তাদের ব্যস্ততা, যাদের সব উড়েপুড়ে গেল, তাদের কেউ মাথা চাপড়ে হাউহাউ করে কাঁদছে, কেউ চুপ করে দূর থেকে লাল-হয়ে-যাওয়া আকাশটা দেখছে। পানুর জীবনে এ রকম ঘটনা কোনও দিন ঘটেনি। তার মনের কোণে কোথায় যেন একটা কষ্ট ওই কালো ধোঁয়ার মত পাক খেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছিল। এর মাঝে খুচখাচ চুরি, লুট হচ্ছে।সাবান, বিস্কুটের টিন, চালের বস্তা, ভাঙা কাচের বয়াম – সব জলে কাদায় মাখামাখি। একটা ঝলসানো সাইকেল লোকজন লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। একজন টেনে সরাতে গেলে কেউ চিৎকার করে উঠল – গরম গরম ছোঁবেন না। লোকজনের ভীড়ের মাঝে হঠাৎ পানু মামাকে দেখতে পেল। হাতে একটা লাঠি। লোকজনকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। আগুনের আভায় কাঁধের ওপর স্টারগুলো ঝিকমিক করে উঠছে।
রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় পানু ধ্বংসলীলা দেখছিল। একটা অচেনা ভয় তাকে আবিষ্ট করে রাখে। জল ফুরিয়ে গেলে মহানন্দা নদী থেকে জল ভরে দমকলের গাড়িগুলো ঢং ঢং শব্দে এসে দাঁড়াচ্ছে। এই অন্ধকারে, দাউদাউ আগুনের এই হলুদ আভায়, ছাইওড়া বাতাসের ঘূর্ণিতে চালডালবিস্কুটসাবানের পোড়া গন্ধের মাঝে কে চোর, কে মালিক – কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। গ্রস্ত মানুষ, ধূর্ত মানুষ, বাজে মানুষের ভিড়ের মাঝে পানু ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল।
একটা দোকানে ভয়ংকর শব্দে কিছু ফাটল। দ্বিগুণ তেজে মেতে উঠল আগুন। সবাই বলল – কেরোসিনের ড্রাম। আচমকা একটা ছোট ড্রাম যেন পানুর বুকের মধ্যেও ফেটে পড়ল। ভয়ের তেল গড়িয়ে নামল তার প্রতিটি রোমকূপে, শিরায়, হৃদ্পিন্ডে। লাফিয়ে উঠে সে ঘরের দিকে দৌড়ল। তাকে তাড়া করছিল গম্ভীর ঢং ঢং আওয়াজ, গরম বাতাস, পোড়া গন্ধ।
পরদিন পানুর মামাবাড়িতে লোকে লোকারণ্য। সবাই আসছে খোঁজখবর নিতে, সান্ত্বনা দিতে। কেরোসিন তেলের দোকানে একজন ঢুকেছিল ক্যাশবাক্স হাতিয়ে কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখতে। সেকেন্ড অফিসার তক্কে তক্কে ছিলেন। ওই দোকানে রিস্ক নিয়ে ঢুকে লোকটার কলার চেপে ধরলে একটা তেলের ড্রাম ফেটে পড়েছিল। আগুন পুরোপুরি নেভানোর পর সেখানে দুটো ঝলসানো, কুঁকড়ে যাওয়া, পোড়াকাঠের মত বডি পাওয়া যায়। কয়েকটা স্টার দেখে পুলিশ অফিসারকে শনাক্ত করা গিয়েছিল। ধাতব তারাগুলো নাকি তখনও গরম ছিল।
বাড়িসুদ্ধ লোক যখন কাঁদছিল, পানুর চোখে একটা নীল সাইকেল ভাসে। গরম, ছোঁয়া যায় না।
দ্বিতীয়বার প্রাণেশের মাথা ফাটলে সে ফাটাপানু হয়। সত্যদার অ্যাডভাইস অনুযায়ী সেদিন রাতে পানু বাড়িতে না শুয়ে রেলপারের বস্তিতে লছমনের ঘরে শুতে গিয়েছিল। আপদে বিপদে সত্যদাই ওদের রক্ষাকর্তা। কয়েকটা রাত বাড়িতে না থাকার সুপরামর্শ সত্যদাই দিয়েছিল। চৌরাস্তার গন্ডগোলে পানুই যে হোতা, তার অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ছিল।
পানু সে রাতে ঘরে না শুয়ে লছমনের একচিলতে বারান্দায় খাটিয়া পেতে শুয়ে ছিল। সে রাতে পানু এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে। তার আগে অবশ্য বস্তিতে আগুন লাগলে লছমন ও আরও অনেকে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিবশে ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু দূর থেকে আগুনের শিখা দেখে, হৈ-হট্টগোল শুনে এবং ঢং ঢং শুনে তার নিদ হারাম হয়ে যায়। ভারি ইঞ্জিনের শব্দ তুলে দমকলের গাড়িগুলো এসে দূরে দাঁড়াচ্ছিল। ইট-বাঁধানো সরু গলিতে জলের পাইপ ঢুকছিল। পানুর বুকের ভেতরে তেলের ড্রাম ফেটে পড়ছিল। ভয় ছড়িয়ে পড়ে কেরোসিন তেলের মত। তার চুল ভিজে যায়, বুক ভিজে যায়, পায়ের তলা পর্যন্ত। একটা সিগারেট ধরিয়ে বুকভরে ধোঁয়া টানলে মনে হয় বুকের ভেতরে কেরোসিন এবং গরম ধোঁয়া খুব বিপজ্জনক ভাবে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে।
উঠোনের বাইরে গলি দিয়ে কেউ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। টিং টিং শব্দ তার কানে এল। এই সুযোগে কেউ কি সাইকেল চুরি করে পালাচ্ছে -- উঠে বসল পানু। তখনই সে অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে পায়। বুকের ভেতরে দুম করে একটা ড্রাম ফাটল। আর উঠোনের ধারের সেই ঝাঁকড়া নিমগাছটা একটা মানুষ হয়ে গেল। আগুনের আঁচে গাছের সমস্ত পাতা ঝলসে গেলেও দেখা যায় পাতার বদলে সমস্ত গাছটা জুড়ে ধাতুর তৈরি তারকা বাতাসে দোল খাচ্ছে। আগুনের আভায় সেগুলো ঝলমল করে ওঠে। গাছটার দুকাঁধে এবং পকেটে ফ্ল্যাপের ওপরে তো বটেই – সমস্ত কপালজুড়ে, মাথায়, বুকেপেটেপায়েকোমরে শুধু নক্ষত্র, তারা, তারকা। আসলে যা স্টার।
পানু তখন খাটিয়া ছেড়ে একটা লাফ দিয়েছিল। সে তার সমস্ত হিম নিষ্ঠূরতা পা দুটোয় চারিয়ে দেয়। এবার আর সামনের চাকা ওপরে ওঠে না। দুরন্ত বেগে বস্তির সামনে এসে একটা জ্বলন্ত ঘরে ঢুকে পড়লে লছমনও অবাক হয়ে যায়। সুসাইড করবে নাকি! পানু ভেতর থেকে বার করে আনছিল ছেঁড়া কাঁথাকানি, অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র। হোস পাইপের তীব্র জলের ধারা সেই গরম খাপরার চালে পড়লে একটা বাঁশ ভেঙে অবশেষে পানুর মাথায় পড়ে এবং দ্বিতীয়বারের জন্য তার মাথা ফাটে। এইভাবে সে ফাটাপানু হয়েছিল।