কিংবদন্তীর ভেতরে একরকম আখ্যানমালা আড়মোড়া ভাঙে। পাশ ফেরে, শিথান বদল করে। বালি খাতের নিচে অন্তঃসলিলা হয়ে বইতে থাকে নদী। খাতের ওপরে কান পাতলে হয়তো অস্পষ্ট শব্দ শোনা যায়। জাদুসঙ্গীতের মত একপ্রকার লোকায়ত গান ও বাজনা বয়ে যায় গোপনে। শব্দ বাজে গানের মত। ভাঙা সাঁকো, ভাঙা সারিন্দা, ধানের গোলা, লালনীল রাংতা, পাটের আঁশ ছাড়ানোর দৃশ্য, মুনিশমাইন্দরের সংলাপ --- আমের বোল আর সরষেফুলের গন্ধমাখা এইসব চিরন্তন শব্দাবলি ও দৃশ্যাবলি মরা বালির ওপর ছড়িয়ে থাকা কাশিয়ার খেতের ভেতরে ঘুরে বেড়ায়, মরাখাতের নিচে বয়ে যাওয়া জলের সঙ্গে ভেসে যায়। কোনও একদিন নদী পাশ ফেরে। আবার পশ্চিমবাহিনী হলে সেই সব আখ্যানমালার ঘুম ভাঙে। দুপারের নদীসভ্যতার পাঠক্রমে ঢুকে পড়ে হিংস্র একপাল কালো কুকুরের গল্প। অন্ধ এক নারীর আকাশে ওড়ার কিস্সা। অভিমান-কাতর এক গীদাল শুয়ে থাকে নবজলধারার পাশে। সেও অপেক্ষা করে আছে তার গল্প নিয়ে।
কখনও পূর্ণচাঁদের আলোয়, কখনও সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে একটা ঘোড়া ছুটে যায়। ঘোড়ার পিঠে দীর্ঘকায় এক পুরুষ। তার হাতে বন্দুক, আর তার কোলে নাকি এক সুন্দরী নারী বসে থাকে। ঘোড়াছুটেযাওয়া ওই পথের দুপাশ জুড়ে ছড়িয়ে যায় জমাটবাঁধা অসংখ্য ধূলিপিন্ড। প্রতিটি খন্ডের ভেতরে গল্প শোনা যায়। সেই গল্প কাঁধে তুলে নেয় কোনও পাগল কিংবা প্রেমিক। লোকজীবনের হাটেমাঠে, সিদলমাখা গরম ভাতের সঙ্গে, পালাগানের আসরে সেই গল্প শোনে জাপান ঘোষ, পূর্ণিমা বর্মন, ইছুপ মন্ডল।
আর জোতদারের সেই বাদামি ঘোড়া তার দুরন্ত গতির ও অশ্বক্ষমতার যাবতীয় প্রবাদ নিয়ে গল্পের ভেতর দিয়ে ছুটে যায়। কুয়াশার রহস্যময়তার ভেতরে ক্লপ ক্লপ শব্দের সঙ্গে মিশে থাকে কোনও নারীর শীৎকার। ঘোড়ার গল্প আবহমান কালের ইচ্ছাপূরণের কথামালা হয়ে গেলে হাটচালার নিচে কল্পপৃথিবীর জন্ম হয়। ক্রমে সেই ঘোড়া খ্যাতিমানতা অর্জন করে এবং বলা হয় যে নদীর পার ধরে যখন সে ছুটে যেত, তার শরীরের বর্ণ পালটে যেত। নীল আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরোত তার খুর থেকে। বাতাস গরম হয়ে উঠত। এইভাবে লোককাহিনীর ক্যানভাসে স্থাপিত সেই ঘোড়া বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলে রঙিন হয়ে যায়। একটা লোকপুরাণের ঘোড়া জেগে ওঠে তার সমস্ত জাদুকরি বাস্তব নিয়ে। থাকা ও না-থাকার দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে চাঁদের আলো পিছলে পড়ে তার রেশম ত্বকের ওপর। আবহমানের নদীবরাবর ক্লপ ক্লপ শব্দ বাজতে থাকে।
খন্ড খন্ড জনপদ থেকে জোতের পরিচয়জ্ঞাপক রঙিন নিশান নিয়ে মানুষের ঢল নামে হাটের দিকে। মানুষের ইতিহাসে হাট একরকম জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। হাট এক অবশ্যম্ভাবী উপাদান। হাটচালা, হাটের গান, নটি ও কুকুর, দাঙ্গা এবং গল্প বলার আসর এক হাট থেকে আর এক হাটে গড়িয়ে যায়।
আলপথের আড়ালে খোলস ছাড়ে সাপ। পুরনো খোলস হাওয়ায় উড়ে যায়। সেই বাতিল খোলসের গায়েও ছোট ছোট কথা লেখা থাকে। নির্জন প্রান্তরে সে সব কথামালা ছড়িয়ে দিয়ে ছড়ানো ফণা, বিষদাঁত, লেজের ঝাপট নিয়ে নতুন সর্পকথা ঢুকে পড়ে নতুন জনপদে। হাটের দিকে মানুষের যে ঢল নেমেছিল, সর্পকথা তাদের পাক দ্যায়। তাদের দৈনন্দিন ঘরদুয়ারের ভেতর দিয়ে জাগরণে এবং স্বপ্নে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একদিন লোকগাথার অন্তর্গত হয়।
দীর্ঘ সেই পুরুষ ঘোড়া থামিয়ে নদীর পাশে দাঁড়ায়। কাঁধ থেকে বন্দুক নামিয়ে অনেকদূরের বৈকুন্ঠপুর ফরেস্ট থেকে ভেসে আসা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে নেয় একদন্ড। তাকে আবার অন্য হাটে যেতে হবে। গল্পের ভেতরে বন্দুকসহ ঘোড়সওয়ার তার ঘোড়া নিয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায় আর বাতাসে উড়ে যাওয়া কত রকমের শব্দ জুড়ে জুড়ে তৈরি হতে থাকে ভান্ডি সিং জোতের ঘোড়াপুরাণ।
বন্দুক নিশ্চিত একজনের হাতে থাকে না। ইতিহাসের বন্দুক কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে সরে যায়, আবার সময়ের সঙ্গে পরিধি থেকে কেন্দ্রের দিকে তার সরণ হয়। শস্যশ্যামল উর্বর ভূখন্ডের দিকে, কালসর্প এবং প্রিয়দর্শিনী পরমার দিকে দৃঢ় পুরুষকার নিয়ে উপগমন হয় বিখ্যাত বন্দুকের। কিন্তু স্থিরচিত্র হয়ে থাকে বন্দুকহাতে ঘোড়সওয়ার। কথকতার ভেতরে এভাবে চলমান ও স্থির দুইপ্রকার বিষয় মিশে যায়।
কালগর্ভ থেকে অতিকথন শুরু হলে এলোমেলো বাতাসে ওড়ে প্রাক্তন আমবাগানের ঝরাপাতা। নতুন জনপদের আড়ালে বসে হাই তোলে দুই ফেরেশ্তা। কলের গানের পৃথিবীর ভাঙা কালো টুকরো সরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে মাহুতবন্ধু ও দূর বাথানের মইষাল বন্ধু। তখন নদী, সমুদ্র, অরণ্যের মায়ায় মুগ্ধ মানুষের দুচোখে জল আসে। চিরকালের চেনা সংসারে নিহিত আলোছায়াময় রহস্যময়তার ভেতরে খেলা করে আশ্চর্য কুহক জড়ানো এক সঙ্গীতধারা।
---- "সরমার সন্ততি" উপন্যাসের অংশবিশেষ। '