একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু প্রথমে আমি কিছু বুঝতে পারিনি। আমাদের বাড়ির নীচের ধাপে, যেখানে জমি কিছুটা সমতল, সেখানে আমি আর মা মিলে স্কোয়াশ আর রাই শাকের চাষবাস দেখাশোনা করি। সেই জমির শেষে দুটো গাছের মাঝে বাবা আমার জন্য একটা দোলনা বেঁধে দিয়েছেন। এটা গতবার জাঁকিয়ে শীত পড়ার আগের ঘটনা। কদমবস্তির মাসির বাড়িতে গিয়ে ওদের পুরনো জিনিসপত্র রাখার জায়গায় আমি একটা ভাঙা বেতের দোলনা দেখেছিলাম। বাড়ি ফিরে মার কাছে বায়না ধরেছিলাম দোলনার জন্য। মা আমাকে ধমক দিয়েছিল, বলেছিল ওগুলো ছোটদের। শেষে বাবা আমার জন্য দোলনা বানিয়ে দিয়েছিল। একটা দোলনা বানানো আমার বাবার কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। ছোট এক টুকরো তক্তা কোথা থেকে জোগাড় করে দুপাশে ফুটো করে তার ভেতরে শক্ত দড়ি ভরে বাবা দোলনা বানিয়ে ফেলল। বারান্দায় বসে বাবা যখন দোলনা বানাচ্ছিল, আমি পুরো ব্যাপারটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করেছি। বাবার কাজে কোনও খুঁত থাকে না। মা শুধু শুধু বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে।
বাবার পিঠে সবসময় পেটমোটা খাকি রং-এর ব্যাগ থাকে, সেটার চেন খোলার সময় আমি সামনে থাকতে পছন্দ করি। মাথাটা খোলামুখ হাঁ-এর এত কাছে নিয়ে আসি, আমার ছোট্ট মাথাটা বিরাট গর্তে প্রায় ঢুকেই যায় আর কি। বাবার ব্যাগের এই চেন খোলার শব্দ আমি অনেক দূর থেকেও শুনতে পাই। কত কী যে থাকে এই ব্যাগের ভেতরে। আমার বাবা যেন এক জাদুগর। ব্যাগের ভেতরে জাদু দেখানোর কত যে সামান থাকে। বাবা যে ক’দিন এখানে থাকেন, আমি সবসময় সতর্ক থাকি এই শব্দ শোনার জন্য। ব্যাগ খুললেই কিছু না কিছু আশ্চর্য জিনিস বেরিয়ে পড়ে। আমার বউজুর( ঠাকুরমার) মাঝে মাঝেই খুব জ্বর হয়। বাড়িতে যত কাঁথাকম্বল আছে, সব তার শরীরে চাপা দিয়ে রাখলেও থরথর করে কাঁপতে থাকে। আমার কাকা বলে যে এবার বুড়ি আর বাঁচবে না। গতবারের চেয়েও এবার বেশি ঠান্ডা পড়বে। আবহাওয়া দেখে মনে হয় এবারও বেশ বরফ পড়বে। সম্ভবত যেবার নীচে সিংলা পোখরির জল জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল, এবারও সে রকম ঠান্ডা পড়বে। এবার আর বুড়িকে বাঁচানো যাবে না। কাকা তার বুড়ি মা, আমার বউজুর কাছে গিয়ে জানতে চায় তার কী খেতে ইচ্ছে করছে। বউজু বিড়বিড় করে কী যে বলে, কিছু বোঝাই যায় না। কাকা চিৎকার করে ঘোষণা করে যে, বুড়ি মা তার কাছে সন্দেশ খেতে চেয়েছে। রাতে কাকা অনেক রক্সি খেয়ে টালমাটাল হয়ে ফিরে আসে। সকালে আমি দেখতে পাই কাকার প্যান্টের পকেট থেকে সার বেঁধে পিঁপড়ের দল মুখে সন্দেশের গুঁড়ো নিয়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করি বউজু যেন আগের বারের মত আবার ভালো হয়ে ওঠে। বউজু আবার উঠে বসে। মার কাছে রাইশাক আর গরম ভাতের জন্য ঘ্যানঘ্যান করে। বউজুর মুখে জালের মত অজস্র কাটাকুটির চিহ্ন। আরও কয়েকটা দাগ, চোখের দু’পাশে, মুখে, গলায় – বেড়ে যায়। আমি বউজুর গলা জড়িয়ে বলি – বউজু, সেই পাহাড়ি রাজকন্যা আর বজ্রের দেবতার গল্পটা বলো। বউজুর কানে হলদে সোনার মাকড়ি। বউজু বলতে শুরু করে – এক ছিল পাহাড় দেশের মেয়ে। তার খোঁপায় লালি গুরাসের ফুল, তার গলায় সাতনরী সোনার কন্ঠামালা। পরনে তার সোনারুপোর কাজ করা চৌলি-চৌবন্দি। সখীদের নিয়ে সে একদিন বিকেলবেলা পাইনঘেরা এক উপত্যকায় ঘুরে নাচছিল আর গাইছিল – লালি গুরাস বানাই ভরি চুলটি সাজাউঞ্ছ। এদিকে এক পাহাড়ি চিতা গাছের আড়াল থেকে তাক করে আছে ঠিক রাজকন্যার দিকে। তখন বজ্রের দেবতা তার ঘন কালো মেঘের পিঠে চড়ে শিকার করতে বেরিয়েছেন। এদিকে রাজকন্যা তখনও ঘুরে ঘুরে গান গাইছে। বউজু আমাকে কাঁপা কাঁপা গলায় গান শোনায়। আমি লালি গুরাস শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।
ভাইটিকা উৎসবের পর থেকেই আমি রাইশাকের খেতের পাশে দাঁড়িয়ে ওপরের যে পথটা ঘুরে ঘুরে আমাদের উঠোনের পাশ দিয়ে নীচে সিংলা বস্তির দিকে চলে গেছে, পাকদন্ডী সেই পথের দিকে তাকিয়ে বাবার অপেক্ষা করতে থাকি। তারপর এক সময় দেখতে পাই ঝুঁকে হাঁটতে হাঁটতে আমার বাবা ক্রমশ ওপরে উঠে আসছেন। কোনও বার হয়তো সিংলাবস্তির ওদিক থেকে উঠে আসা বিশাল বড় একখন্ড ঘন কুয়াশায় বাবা ঢাকা পড়ে যায়। ঝাউবনের ভেতর দিয়ে বাবা ঘুরে ঘুরে উঠে আসে। ঘন কুয়াশা হাওয়ায় ভেসে যায় লিংসিং পাহাড়ের দিকে। তখন মনে হয় এক টুকরো সাদা মেঘ পাহাড়ের দুটো থাকের মাঝে আটকে আছে। এই মেঘগুলো তার ওপরে আর দেখা যায় না। তার ওপাশে ধোঁয়া ধোঁয়া নীল পাহাড়। আমার মা-ও সেই পাহাড়ের নাম জানে না। তারপর কাঞ্চেনজোঙ্গা। পবিত্র দেবভূমি। আমার মা প্রণাম করে। বর্ষা বাদে অন্য সময় আমরা দেখতে পাই। যেন হলুদ সোনা। মা বলেছে বরফের ওপর আলো পড়ে ও রকম দেখায়।
পাশাপাশি দুটো গাছে শক্ত দড়ি বেঁধে বাবা আমার জন্য দোলনা বানিয়ে দিয়েছেন। ঠিক মাঝখানে এক টুকরো কাঠের আসন, দুপাশের মোটা দড়ির সঙ্গে বাঁধা। ফলে সেই আসনের ওপর বসে দোল খেতে আমার কোনও অসুবিধা হয় না। এমন কী, সেখানে একটা অনেক পুরনো কম্বল পেতে নেওয়ার ফলে বেশ গদির মত হয়েছে আমার বসার জায়গা।
অস্বস্তি একটা টের পাচ্ছিলাম। আমার শরীর থেকে কিছু একটা গড়িয়ে নামছিল। দোল খেয়ে যখন সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আমার জামা হাওয়ায় উড়ে যেতেই দেখলাম আমার অসম্ভব ফর্সা উরুর ডানদিকে কালচে-লাল একফোঁটা রক্ত লেগে আছে। আর কী যেন একটা অস্বস্তি গড়িয়ে নামছে আমার জানুসন্ধি থেকে। খুব ভয় পেয়েছিলাম। মাটিতে দুটো পা ঠেকিয়ে দোলনা থামাতে চাইছিলাম, কিন্তু খুব জোরে জোরে ওটা দুলছিল, ফলে বেশ ক’বার মাটিতে পা ঘষটে আমি দোলনা থামাতে পেরেছিলাম। তখন আমার গোলাপি ফুলফুল ছিটের জামা আর বাতাসে উড়ছিল না। খুব ফর্সা আমার উরুদুটো আবার ঢাকা পড়েছে। তাড়াতাড়ি বাথরুমে যেতে চাইছিলাম আমি। জামা সরিয়ে সেই কালচে ঘন একফোঁটা রক্ত আবার দেখার কথা ভাবলেই কেমন যেন ভয় করে উঠল। আর, কেন যেন মনে হল এ কথা শুধু মা কেই বলা যায়। আমার এই বারো বছরের শরীরটাকে হঠাৎ খুব অশুচি মনে হল। ঘেন্না করছিল আমার, ভয়ও। আমার কি কোনও খারাপ অসুখ হল। নীচের উপত্যকা থেকে কি কোনও অশুভ বাতাস এসে আমার গায়ে লাগল। মায়ের বারণ না শুনে আমি এক পূর্ণিমা রাতে অনেকক্ষণ দোলনায় দুলেছিলাম। সে রাতে ঘন কুয়াশার দল হাওয়ায় ভেসে নীচের ঝাউবন থেকে ক্রমাগত ওপরে আমাদের ঘরবাড়ির দিকে উঠে আসছিল। ফলে ঝকঝকে খুব গোল চাঁদের আলো একবার সোনার আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল আমাদের রাইখেতের ওপরে, আবার একটু বাদেই আলো ঝাপসা হয়ে, কেমন যেন নোংরা, ছাইছাই – গোল চাঁদকে আমি প্রায় দেখতেই পাচ্ছিলাম না। সেদিন তবে নীচের বস্তিতে বাঁশের সঙ্গে যে সাদা কাপড় টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই কাপড়ে যে মন্ত্র লেখা থাকে, দৈত্যদানো তাড়ানোর মন্ত্র, মৃত মানুষের আত্মার সদগতির জন্য, পাহাড়ি মানুষদের ওপর যাতে অমঙ্গল নেমে না আসে, যাতে ফসলে ভরে ওঠে এই উপত্যকা – সেই মন্ত্রের কিছু অক্ষর জোর বাতাসে সাদা কাপড় থেকে খসে পড়েছিল। তারপর হিম বাতাসে ভেসে কুয়াশায় মিশে ওপরে উঠে এসেছিল। প্রচন্ড শক্তিশালী সেই অক্ষরগুলো নিশ্চয় দেখেছিল আমাকে। বারো বছরের একটা মেয়ে ভরা পূর্ণিমায় দোলনায় দোল খাচ্ছে। উঠছে, নামছে। আর কখনও ধবল জ্যোৎস্না, কখনও কুয়াশা-চোয়ানো ভরাপূর্ণিমার ম্লান আলো খেলা করছে আমার সঙ্গে। যেন সেই আলোও দোলে, এগিয়ে যায়, পিছিয়ে যায়। ঘন কুয়াশা, একটু দূরে গিয়ে যা মেঘ হয়ে যায়, সেই আবরণ ছিঁড়ে ছিল আমার খেলা বা আনন্দ। অক্ষরগুলো নিশ্চয় আমাকে অভিশাপ দিয়েছিল। সমস্ত মৃত মানুষদের কথা লেখা থাকে ওই সাদা নিশানের ওপর। আমার নিশ্চয় খারাপ অসুখ হয়েছে। আমার ওই জায়গা থেকে কেন কালচে ঘন রক্ত আমার উরুতে গড়িয়ে আসবে।
গাছটার ওপারেই শুরু হয়েছে ঢালু উপত্যকা। সরু পাকদন্ডী পথ নীচে নেমে গেছে সিংলা বস্তির দিকে। একই ঢালে আমাদের ওপরে রয়েছে কদমবস্তি। ওখানে আমার মাসির বাড়ি। আমার তিন মাসি ওখানে একসঙ্গে থাকে। ওদের দুধের ব্যবসা। রোজ সকালে আমার তিনমাসি পিঠে দুধের ক্যান নিয়ে পিচরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায়। বড়াঝোরার মুখে এসে সবাই অপেক্ষা করে। অন্য বস্তি থেকেও মেয়েরা দুধ বয়ে আনে। আমাদের এখানে ছেলেরা কাজ করতে চায় না। রাতে ছাং কিংবা তোম্বা খেয়ে বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়। ঘুম থেকে উঠে ঝকমকে পোশাক, জুতো, টুপি পরে রেলস্টেশনের দিকে চলে যায়। স্টেশনে এখন গরিব ভিখারিরা থাকে। গত ভূমিকম্পে রেললাইনসহ অনেকটা জায়গায় ধস্ নেমে রেলগাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। আগে আমরা এখান থেকে রেলের বাঁশি শুনতে পেতাম। এখন আর শোনা যায় না। প্ল্যাটফর্মের ফাঁকা চত্বরে বসে ওরা সারাদিন তাস খেলে। মেয়েরা সংসার চালায়। কারও ছোট মুদিদোকান বা চা-দোকান, কারও একটু বেশি জমিতে চাষবাস, কেউ চা-বাগানে পাত্তি তোলে, কারও গোরুমোষের বাথান। সব মেয়েরা সামলায়। আমার মাসিরা তো তিনজনে মিলে ব্যবসাটা বেশ ভালোই চালাচ্ছে। বড়মাসি গতমাসে সোনালি রং-এর হাতঘড়ি কিনেছে। আমার মা বলেছে সুনমায়া পয়সা রাখতে পারবে না। আমার বাবার হাতে যে ঘড়ি, সেটার ভেতরে রং কালো আর সেটা গোল। বড়মাসির ঘড়ির ভেতরে সাদা আর চারকোণা। বাবার হাতে ঘন নীল রং-এর কালি দিয়ে লেখা আছে বি রাই। তার পাশে দুটো কুকরি, যেমন আমি একদিন বড়াঝোরার কালভার্টে দেখেছি – উই ওয়ান্ট গোর্খাল্যান্ড, তার পাশে এ রকম দুটো কুকরি, একটার ওপর একটা, কোণাকুণি।
আমার বড়মেসো ফৌজি। মেজমাসি কিছুদিন সমতলের কোথাও, কোনও নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করেছিল। এক বছর বাদে ফিরে আসার পর আমার মা বলেছিল সমতলের কামুক শেয়ালগুলো তার বোনকে নষ্ট করে দিয়েছে। সেদিন আমাদের ঘরে মা, তিনমাসি আর গুরুংকাকা দরজা বন্ধ করে অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলেছিল। আমি বাইরে কাঠের রেলিংঘেরা বারান্দায় বসে ওপরের পাহাড়ে শহরের আলো দেখছিলাম। সেদিন ছিল দীপাবলির রাত। ওপরে, নীচে সিংলা, কদমঝোরা, ঝেঁপি, কাইজালে বস্তিগুলোয় ওরা দীপ জ্বালিয়েছে। আমার ইচ্ছে করছিল দোলনায় দোল খেতে খেতে এই দৃশ্য দেখতে। কিন্তু মা আজ রাতে ঘরের বাইরে যেতে বারণ করেছিল। আজ অমাবস্যার রাত। অল্পবয়সী মেয়েদের নাকি আজ রাতে সাবধানে থাকতে হয়।
মা আমাকে সব কিছুতেই সাবধান হতে বলে। জ্যোৎস্নারাতে যখন পুবের লিংসিং পাহাড়ের সীমানা পার হয়ে আস্ত একটা গোল চাঁদ আমাদের রাইখেতের দিকে আলো ছড়িয়ে দেয়, তখনও আমার ইচ্ছে করে দোলনায় দোল খেতে খেতে চাঁদের এগিয়ে আসা, পিছিয়ে যাওয়া দেখতে। মা বারণ করে। আমাদের বয়সী মেয়েদের নাকি রাতে গাছের নীচে যাওয়া উচিত নয়। উচিত নয় পূর্ণচাঁদের আলো বেশিক্ষণ শরীরে মাখা। আসলে মা বোধহয় ভয় পায় যদি আমি দোলনা থেকে ছিটকে পড়ে যাই। দোলনা যখন সামনে এগিয়ে আসে, তখন আমাদের এই রাইশাকের খেত। কিন্তু যখন পেছনে দোল খায়, সেটা আমাদের এই সমতল জমির বাইরে চলে যায়। নীচে ঢালু উপত্যকা। একবার যদি দড়ি ছিঁড়ে আমি ছিটকে পড়ি, তা হলে গড়াতে গড়াতে একেবারে তোম্বারিয়া বস্তিতে পৌঁছে যাব। পথে কত ঝোরা, কত ঝাউবন, বড় বড় পাথর। আমি কি আর আস্ত থাকব।
সমতলের কামুক শেয়ালগুলো তার বোনকে নষ্ট করে দিয়েছে – মা একথা বেশ জোরে বলায় বারান্দা থেকে আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলাম। অন্য সবার গলার আওয়াজও আমি চিনতে পারছিলাম। ওরা উত্তেজিত, কিন্তু চাপা স্বরে কথা বলছিল। নষ্ট করে দিয়েছে – এ কথার অর্থ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম না। আমার মেজমাসি, একজন মানুষ কেমন করে নষ্ট হয়ে যায় – আমার মাথায় ঢুকছিল না। মানুষ কি সেও, নাকি সন্তালা। শাকসবজি, ফলমূল, এমন কি মাসিদের দুধও অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। সে সব ফেলে দিতে হয়। তবে কি আমার মেজমাসিকেও ফেলে দেওয়া হবে। মেজমাসি, যার নাম মনমায়া, তার চোখের নীচে কালি পড়েছে, গালের লাল আভা আর আমাদের সবার মত নেই। মাসি আমার জন্য সমতলের শহর থেকে সবুজ পাথরবসানো কানের দুল এনেছে। কিন্তু নষ্ট হওয়া মানে কি চোখের নীচে কালো হয়ে যাওয়া ? নষ্ট হওয়া মানে কি গালের লাল আভা কমে গিয়ে পাহাড়ি মানুষদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া ? আমার কেমন যেন মনে হল সমতলের মানুষদের সবার চোখের নীচে কালো দাগ আছে। ওদের কারও গালে লাল আভা থাকে না। ওরা কি রোজ আমাদের মত স্কোয়াশ আর রাইশাক খায় ? এবার বাবা এলে জিজ্ঞেস করব। বাবা নিশ্চয় জানে।
মা বলেছে ফালতু কথা। গুরুংকাকা বলেছে একবার গোর্খাল্যান্ড হয়ে গেলে কোনও চিন্তা থাকবে না। পাহাড়ের দুধ আর সমতলে পাঠানো হবে না। পাহাড়ের শিশুরা পেট ভরে দুধ খাবে। পাহাড়ের দুধ ক্যানভর্তি হয়ে সমতলে পৌঁছবে না, পাহাড়ের চা, সন্তালা, কাঠ, এলাচ ... না, কোনও সেবিকাও পাহাড় থেকে সমতলে যাবে না। সমতলের শেয়ালকুকুরগুলো ঠুকরে খায় আমাদের সন্তালা, আমাদের মাখন, আমাদের পবিত্র পাহাড়ের পাশে ফেলে যায় আলুভুজিয়ার প্যাকেট। গুরুংকাকা বলেছে একদিন না একদিন গোর্খাল্যান্ড হবেই। তখন পাহাড়ের সব বস্তি, সমস্ত শহর, যত আছে পাইনের বন, গুরাসফুলের গাছ, যত আছে থানাপুলিশহাসপাতালকাছারি, সব চা-বাগান, কমলাবাগান, যত ছোটবড় দোকান, স্কুলকলেজ – সব গোর্খাল্যান্ডের সম্পত্তি হয়ে যাবে।
বীরুও একদিন আমাকে তা-ই বলেছে। বীরবাহাদুর, গুরুংকাকার ছেলে – বলেছিল, গোর্খাল্যান্ড হামিলাই দিনুই পরছ। গোর্খাল্যান্ড আমাদের দিতেই হবে। বীরু ক্লাশ টেন-এ পড়ে। নেভি ব্লু সোয়েটার, প্যান্ট, সাদাজামা, পিঠে ব্যাগ নিয়ে বড়ঝোরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের স্কুলবাস আসে। ওখান থেকে বাসে উঠে কৈরিখোলার আনন্দ ছেত্রী মেমোরিয়াল মডেল স্কুলে পড়তে যায়। বীরু আমাকে বলেছে বড় হয়ে হয় পুলিশ হবে, না হয় শিলিগুড়ি রুটে ট্যাক্সি চালাবে। ততদিনে গোর্খাল্যান্ড হয়ে যাবে। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে একটা গাড়ি কিনবে। গোর্খাল্যান্ডের ব্যাঙ্ক থেকে যত খুশি টাকা লোন নিতে তার কোনও অসুবিধা হবে না। হয়তো তার পড়শি দীপক তামাং কিংবা তার বন্ধু প্রকাশের বাবা জ্ঞান লামা হবে সেই ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। দুজনই বি এ পাশ। প্রকাশদের মাখনের ব্যবসা। সমতলে ওরা অনেক মাখন পাঠায়। জ্ঞান লামার জীপ আছে। ওদের এলাচের ব্যবসা।
বীরু যখন এ সব কথা বলে, ওর চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। চোখের ভেতরে যেন আলো জ্বলে। তখন ওকে আমার কেমন যেন অচেনা মানুষ মনে হয়। আমি দোলনায় দোল খেতে থাকি, বীরু আমার সামনে হাতের পাতাদুটো মেলে ধরে।
হের, হের গৌরী। এই দ্যাখ, আমার হাতে এখনও রং লেগে আছে।
ছবি এঁকেছিস ? কার ? কস্কো চিত্র বনায়েছ ?
এ এ বহিনি, কে বুজদেই ন তিমি। । বোকা মেয়ে, তুই কিচ্ছু জানিস না। আমি তো কাল রাতে ফরেস্ট বাংলোর সামনের দেয়ালে বড় বড় করে লিখেছি – ওয়েলকাম টু গোর্খাল্যান্ড। কোথাও দেয়ালে লিখতে হলে সবাই আমাকে ডাকে। আমার হাতের লেখা একদম বই-এর অক্ষরের মত। কিতাব ম ছাপিয়েকো যস্তো।
আমি দোল খেতে খেতে ভাবি, বুঝতে পারি আমাকে দেখাবে বলেই বীরু ইচ্ছে করে হাত পরিষ্কার করেনি। সেই সামান্য সমতল জায়গাটুকুর মাঝে শরীরটা টানটান করে সে সৈনিকদের মত লেফট্ রাইট করতে থাকে। সাইপত্রী ফুলের (গাঁদা) একটা সারির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমার দিকে আড় চোখে তাকাল। পুলিশ হতে গেলে এসব জেনে রাখা নিশ্চয় দরকার। কিন্তু, কে জানে বীরু তো ট্যাক্সির ড্রাইভারও হতে পারে।
বীরুদাজু, গুরুংকাকা বলেছে তোকে স্নো ভ্যালির বড় স্কুলে পাঠাবে।
ফুঃ, হুন্দই ন। হতেই পারে না। স্নো ভ্যালির স্কুল থেকে পাশ করলেও যে সার্টিফিকেট, আমাদের এ সি এম এম স্কুল থেকে পাশ করলেও সেই একই সার্টিফিকেট। কোনও অন্তর নেই। তা হলে কেন শুধু শুধু নিজের জায়গা ছেড়ে যাব। এই যে উঁচুনিচু পাহাড়, কত ঝোরা, ঝাউবন, লালি গুরাসের ফুল, এই বৃষ্টি তো এই ধুপ, ওই যে দূরের পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফ, এই যে ঘন কুয়াশা – এখানেই আমার জন্ম, এখানেই আমার শিকড়।
‘শিকড়’ বলেই বীরুর কী যেন মনে পড়ল। কী যেন ভাবতে লাগল আমার দিকে তাকিয়ে। একবার মাথা চুলকে আবার বলতে শুরু করল। আমি আগের মতই দোল খাচ্ছিলাম।
একদিন সমস্ত পৃথিবী আমাদের লড়াইকে কুর্নিশ জানাবে। এখানে ছুটে আসবে। যে সমাজ নিজের শিকড়ের খবর রাখে না, তারা কোনও দিন উন্নতি করতে পারে না। বন্ধুগণ, গোর্খাল্যান্ড মেরো স্বপ্না। দুনিয়া ম মেরো জাতিকো পরিচয়। গো-র্খা-ল্যা-ন্ড দিনুই পরছ। পৃথিবীর কোনও শক্তি নেই আমাদের এই স্বপ্নকে মিথ্যে করে দেবে। সমতলের যে মানুষগুলো, যে নেতারা কোনও দিন পাহাড়ের মানুষদের দুঃখকষ্ট বুঝতে পারেনি, তাদেরও ক্ষমতা হবে না আমাদের দাবী অস্বীকার করার। উই আর নট বেগিং, উই ডিমান্ড গোর্খাল্যান্ড। আমরা পাহাড়ের সন্তান, আমরা বীর যোদ্ধার জাতি, পৃথিবীর যেখানেই যুদ্ধ হয়েছে, আমাদের বীর সৈনিকেরা সেখানেই লড়াই করেছে, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে।
আমি খুক্খুক করে হেসে উঠতেই বীরু থেমে গিয়ে বোকার মত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে ভেবেছিল আমি মনোযোগ দিয়ে তার ভাষণ শুনছি। আমি তার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু দোল খেতে খেতে আমি চাপা গলায় গানও গাইছিলাম। আসলে আমাদের কাঠের বাড়ির পাশেই একটা বেশ বড় লালি গুরাসের গাছ আছে। বছরভর থোকা থোকা লাল ফুল ফুটে থাকে। আমি শুধু লালি গুরাস-ই দেখেছি, কিন্তু মা একদিন বলেছিল অন্য রং-এরও গুরাস ফুল হয়। গোলাপি, সাদা। মা দেখেছে।
লালি গুরাসের লম্বা পাতাগুলো ঠান্ডা হাওয়ায় দুলছিল। আমি খুব চাপা গলায় গাইছিলাম – লালি গুরাস বানাই ভরি চুলটি সাজাউঞ্ছ... বীরুর কথাও শুনছিলাম। কিন্তু বীরুর কথা না শুনলেও আমার চলত। ষোলোই সেপ্টেম্বরের মিটিং-এ বিক্রম ছেত্রীর কথাগুলোই সে হাত পা নাড়িয়ে বলছিল। এর পরে সে নিশ্চয় জিন্দাবাদ ধ্বনি দিত। গাছে একটা পাহাড়ি ময়না বসেছিল। দোল খেয়ে আমি সামনে এগিয়ে যেতেই পাখিটা ভয় পেয়ে আচমকা উড়াল দিয়েছে, ওর ভয় পেয়ে ওড়া দেখে আমিও হঠাৎ হেসে ফেলেছি। এ মা, বীরু কী ভাবল।
ষোলোই সেপ্টেম্বর ওপরের কদমবস্তিতে জনসভায় মার সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। বীরু লাল প্লাস্টিকের চেয়ার সাজাচ্ছিল। আমরা একদম সামনের সারিতে বসেছিলাম। বীরুর কালো জ্যাকেটের সামনে চকচকে দুটো কুকরির ওপর আলো এসে পড়লে সেটা ঝলমল করে উঠছিল। বীরুর কপালে লাল তিলক। আবহাওয়া সেদিন খুব সুন্দর ছিল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বেশ ক’পশলা বৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু কদম বস্তির ওপর তখন কোনও মেঘ ছিল না। সূর্য পশ্চিমের পাহাড়ের দিকে সামান্য নেমেছে। ঝলমলে দুপুর ছিল সেটা। বিক্রম ছেত্রী যখন ভাষণ দিচ্ছিল, আমার মনে হচ্ছিল সিংলা পাহাড়ের ওপরে সেই গুম্ফার কোনও দেবতা, হয়তো মহাকাল মন্দির থেকে স্বয়ং তিনিই নেমে এসেছেন কদমবস্তির এই সভায়। সেই দেবতা বিক্রম ছেত্রীকে পাঠিয়েছেন আমাদের দুঃখকষ্ট দূর করার জন্য। যাও বিক্রম, শিকড়ের কথা বলো। পাহাড়ের মানুষদের আত্ম-পরিচয়ের কথা বলো। গোর্খাল্যান্ডের কথা ছড়িয়ে দাও উপত্যকাজুড়ে।
বীরু আমাদের চা-বিস্কুট দিয়েছিল। বীরু আমাকে বলেছে ভলান্টিয়ারের দলে ওর নাম উঠেছে। ট্রেনিং-এ যেতে হবে। শুধু লেফট্ রাইটের ট্রেনিং নয়, চাঁদা তোলা, গরিব মানুষদের সাহায্য করা, অন্য পার্টি সম্পর্কে লুকিয়ে খোঁজখবর রাখা – সব কিছু শিখতে হবে। তারপর সে গোর্খাল্যান্ডের পুলিশ হয়ে যাবে। ফৌজিদের মত জঙ্গুলে ছাপের পোশাক পরবে।
এসব বলার সময় বীরুর চোখের ভেতরে এক রকম আলো জ্বলে ওঠে। কিন্তু বীরুর বন্ধুদের আমার পছন্দ হয় না। দু’একজন এখনই রক্সি টানতে শুরু করেছে। গালাগালি দিয়ে কথা বলে। সেদিনই, আমার দিকে ইঙ্গিত করে বীরুর কানে কানে কিরণ রাই কী যেন বলছিল। আমি আড়চোখে একবার আমার বুকের দিকে তাকিয়েছিলাম। সাধারণ পাহাড়ি মেয়েদের মত নয়, এই বয়সেই আমার শরীর মা-মাসিদের চেয়েও ভারি হয়ে উঠেছে। অন্য সবার চোখের নড়াচড়া দেখে আমি বুঝতে পারি গুরাসকলি ফুটে উঠেছে আমার শরীরজুড়ে। এখন আর মা আমাকে ঝোরায় স্নান করতে যেতে দেয় না। এক বালতি জলে বাড়িতেই কোনও রকমে স্নান সারি। শীতকালে তো এক আধদিন তাতো (গরম) পানি দিয়ে শরীর ভিজিয়ে ভালো করে মুছে নিই। উপায় নেই, আমাদের এখানে বড় জলের অভাব। আমাদের বড় জ্বালানির অভাব। গরিবদের ঠান্ডায় ভীষণ কষ্ট হয়। সবার তো আর কয়লা কেনার পয়সা থাকে না, ফরেস্ট থেকে লুকিয়ে লাকড়ি জোগাড় করে আনে ওরা। বস্তির মেয়েরা কত দূরের ঝোরা থেকে গাগরি ভরে জল বয়ে আনে। ডোকোর ভেতরে গাগরিগুলো রেখে দড়িটা মাথায় আটকে কেউ ডোকোটা পিঠে নেয়, কেউ বাঁ দিকে ঝুলিয়ে দেয়। তারপর সেই জল নিয়ে কখনও ওপরে উঠতে হয়, কখনও নীচে নেমে যেতে হয়। গুরুংকাকা বলেছে গোর্খাল্যান্ড হয়ে গেলে প্রত্যেক বাড়িতে জলের পাইপ পৌঁছে যাবে। একটু ভাবলেই আমি স্পষ্ট কলকল শব্দ শুনতে পাই। আঃ, আমার শরীর শিরশির করে ওঠে।
বীরু দুটো হাত আমার সামনে মেলে ধরেছিল। ওর হাতে কালো রং লেগে আছে। কাল রাতে ওরা ফরেস্ট বাংলোর সামনে লিখেছে – ওয়েলকাম টু গোর্খাল্যান্ড। কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে হাত থেকে কালো রং মুছে ফেলার সময় কি ও পায়নি। আজ সকালবেলা ? বীরু কি সবাইকে জানাতে চায় গোর্খাল্যান্ড তৈরির সে-ও একজন সৈনিক।
আমি দোল খেতে খেতে বীরুর হাত দেখছিলাম। ঘন কুয়াশা উঠে আসছিল নীচের উপত্যকা থেকে। আমাদের বাড়ির নীচের ধাপে সাইপত্রী ফুলের গাছগুলো, রাইশাকের খেত ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল। কনকনে বাতাসে দুলে উঠছিল লম্বা ধুপিগাছগুলোর পাতা। দোল খেয়ে আমি যখন সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, উলটো বাতাসে আমার ফুলফুল ছিটওয়ালা জামা উড়ে গেলে ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছিল আমার খোলা উরু, তলপেট, আমার নতুন প্যান্টির ওপরে।
প্রথমে অতটা খেয়াল করিনি। দোল খাচ্ছিলাম, বীরুর কথা শুনছিলাম আর নিজের মনেই গুণগুণ করে গাইছিলাম –লালিগুরাস বানাই ভরি চুলটি সাজাউঞ্ছ ... পাখিটার ভয় পেয়ে উড়ে যাওয়া দেখে আমি হেসে ফেলেছিলাম। বীরু তার বক্তৃতার খেই হারিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বোকার মত হাসছিল। তখনও আমি আমার মত দোল খাচ্ছি। হঠাৎ বীরুর দিকে তাকাতেই দেখলাম ও আড়চোখে, লুকিয়ে আমার প্যান্টি দেখছে। উলটো হাওয়ায় আমার জামা উড়ছিল। আবার যখন দোল খেয়ে আমি পিছিয়ে যাই, আমার প্যান্টি ঢাকা পড়ে যায়। ব্যাপারটা আমি এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। তাহলে আমি বীরুর সামনে এভাবে দোল খেতাম না। বীরু হয়তো ভাবছে আমার কোনও লাজ নেই।
চোখ সরিয়ে নিল বীরু। ও কি আবার আমার সামনে এগিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছে? আমার লজ্জা করছিল। একবার ভাবলাম দোল থামিয়ে ঠিক মাঝখানে স্থির হয়ে বসে ওর সঙ্গে গল্প করি। কিন্তু তা হলে বীরু নিশ্চয় বুঝতে পারবে ওর চোখের মণির নড়াচড়া, আমার তলপেটের নীচে, দুই উরুর মাঝখানে ওর লুকিয়ে দেখা, ওর লোভ আমি বুঝতে পেরেছি। ইস, তা হলে বীরু খুব ছোট হয়ে যাবে। ওর ছোট হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে আমারই খুব লজ্জা করে উঠল। আমি সামনের দিকে খুব জোরে একটা দোল দিয়ে ডানহাতের দড়ি শক্ত করে চেপে ধরলাম। ফুলফুল ছিটওয়ালা জামার উল্টোদিকে উড়ে যাওয়া বন্ধ করব বলে বাঁ হাতের দড়ি ছেড়ে দিলাম। বাঁ হাত দিয়ে জামা চেপে আমার নতুন প্যান্টি ঢাকতে গেছি, তখন দোলনাটা বাঁদিকে ঘুরে গেল। প্রচন্ড বেগে সামনের দিকে উঠতে থাকা শরীরের ভারসাম্য রাখতে পারছিলাম না। তখন আবার বাঁ হাত দিয়ে খুঁজছিলাম বাঁ দিকের দড়ি। এক সেকেন্ডেরও কম সময়, কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার মুঠোয় শুধু ঠান্ডা বাতাস, ওই অবস্থাতেও টের পেলাম আবার আমার দুই উরুর মাঝখানে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপট এসে লাগছে। টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে মাটিতে পড়লাম আমি। বীরু দৌড়ে এসে হাওয়ায় ঝরেপড়া লালি গুরাসের মত আমাকে কুড়িয়ে নিল। ফ্রক টেনে নীচে নামানোর কথা মনেই পড়ল না।
বীরু আমাকে আদর করছিল। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখছিল কোথাও কেটেছড়ে গিয়েছে কি না। বারে বারে জানতে চাইছিল আমার কি কোথাও ব্যথা লেগেছে। আমি চুপ করে ছিলাম। কোনও কথা বলিনি। বীরু আমার হাঁটুতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। মাথায়, পিঠে। আমি চোখ বুজে ছিলাম। বীরুর সামনে পড়ে গিয়ে এক রকম লজ্জা করছিল আমার, আবার আমার জন্য বীরুর উদ্বেগ, আমার গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য অন্য একরকম সুখ পাচ্ছিলাম আমি। ভালো লাগছিল। কথা বললে যদি বীরু এখন আমাকে ছেড়ে চলে যায় – চুপ করে ছিলাম আমি। আমার বুকের ভেতরে অনেক দূরের টয়ট্রেনের শব্দ হচ্ছিল। ওর হাত আমার বুকের ফুটে-ওঠা লালিগু্রাস ছুঁয়ে যাচ্ছিল কখনও। কোথাও তেমন ব্যথা টের পাচ্ছিলাম না, শুধু তলপেটে চিনচিনে একটা ব্যথা হচ্ছিল। কিন্তু বীরুকে আমি সে কথা বলিনি। বললে হয়তো সে আমার জামা সরিয়ে ওখানে হাত বুলিয়ে দিত। ছিঃ, মা যদি জানতে পারে। তা ছাড়া, আমার শরীর শিরশির করে উঠত, আমার সুড়সুড়ি লাগত, হয়তো আমি হেসে ফেলতাম। হয়তো মোচড় দিয়ে দিয়ে উঠতাম। বীরু ভাবত আমি পছন্দ করছি না। বীরু লজ্জা পেলে আমার খারাপ লাগত।
গৌরী, খুব লেগেছে ? ও হো, লড়ি গইস ? চোট লাগেয়ো ? উঠতে পারবি না ? মেরো দুই হাত রামরোসিতো পকড়ো। আমার হাতদুটো ভালো করে ধর।
আমি ভাবছিলাম এখন মা যদি এদিকে আসে, নিশ্চয় আমাকে খুব বকবে। তখনও বীরু আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। হাঁটু ভর দিয়ে নীলডাউন হয়ে আমার মাথাটা মাটি থেকে একটু ওপরে তুলে ধরে রেখেছে। আমার শরীরের নীচের দিকটা মাটিতে, ওপরের দিকটা বীরুর কোলে। মার কথা মনে পড়তেই ভয়ে বুকের ভেতরে কেঁপে উঠল।
পারব, কিচ্ছু হয়নি আমার।
বীরুকে সামান্য ঠেলে উঠে দাঁড়ালাম। তলপেট আবার চিনচিন করে উঠল। গত বসন্তে বাবা যে ক্যাকটাস টবে বসিয়ে গেছে, হঠাৎ সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর ঠিক মাঝখানে একটা ঝুঁটি বড় হয়ে উঠেছে। ক্যাকটাসের কি ফুল হয়, জানি না। বাবা নিশ্চয় জানে। আমার বাবা সমতলের একটা স্কুলের টিচার। আমার বাবা খুব ভালো হাতের কাজ জানে। মোমবাতি, আগরবাতি, মাটির ইঁদুর, খরগোস – কী সুন্দর বানাতে পারে। আবার কুড়িয়েপাওয়া শিকড়, গাছের ডাল – এসব কেটেকুটে বাঘ, হরিণও বানাতে পারে। বাবা যেখানে থাকে, বন্ধ নিয়ে সেখানে খুব গোলমাল হয়েছে। সবাই বলে, সেটা ডুয়ার্স। গুরুংকাকা বলেছে সেটাও গোর্খাল্যান্ড হয়ে যাবে। স্কুল ছুটি হলে বাবা যে ক’দিন এখানে থাকে, প্রায় প্রত্যেকদিন গুরুংকাকার সঙ্গে বাবার ঝগড়া হয়। মার সঙ্গেও বাবার খুব ঝগড়া হয়। ছুটির দিনগুলোতে বাবা ঘরে বসে শিরিষ কাগজ দিয়ে কাঠ ঘষতে থাকে, বাটালি দিয়ে শিকড় কেটে দৌড়ে-যাওয়া হিরণ বানায়। মা গজগজ করতে থাকে। বাবা একটা দুটো কথার উত্তর দেয়। শেষে দুজনই চিৎকার করতে থাকে। আমার তখন কোথাও লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। কোথায় লুকোবো। দোলনার পেছনে ভয়ঙ্কর খাদের দিকে একটা বিপজ্জনক সরু পথ নেমে গেছে। ওখানে সাবধানে দু’ধাপ নেমে ঝোপের আড়ালে বসে থাকি। অনেক নীচে একটা ঝোরা বয়ে গেছে, তার অস্পষ্ট শব্দ শোনা যায়। পাহাড়ি ময়নার ঝাঁক উড়ে যায় পশ্চিম পাহাড়ের দিকে। সাদা কুয়াশা ভেসে যায় উত্তরের ঘন নীল পাহাড়ের দিকে। কান্না পায়। পাহাড়ি বিছে, জোঁক – এসব ভুলে যাই। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি মা বাবার ঝগড়া যেন মিটে যায়। আমার বন্ধু প্রমীলার বাবার মত যেন আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে না যায়। অনেক পরে আমি জানতে পেরেছিলাম বাবা যেখানে স্কুলে পড়ায়, ডুয়ার্সে আমার একজন অন্য মা আছে। শঙ্কর আর ভানু নামে আমার দু’জন ছোট্ট ভাই আছে। শোনার পর থেকেই খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল ওদের।
দোলনাটা তখনও অল্প অল্প দুলছে। বীরু চলে গেছে। নীচের উপত্যকা থেকে এখন আর কুয়াশা উঠে আসছে না। যেগুলো এসেছিল, বাতাসে ভেসে ওপরে চলে গেছে। দুটো পাহাড়ের মাঝে লেগে রয়েছে সাদা মেঘ হয়।
আমার ফুলফুল ছিটওয়ালা জামায় নোংরা লেগেছে। হাত দিয়ে জামার ধুলো পরিষ্কার করছিলাম আমি। নিচু হয়ে জামার ওপর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম যেখানে আমার শরীর ভয়ঙ্করভাবে ক্রমশ পাহাড়চুড়া হয়ে উঠছে, সেখানে কালো রং লেগে রয়েছে। কখন ? কখন এখানে কালো রং লেগেছে, কিছুই টের পাইনি। কাল রাতে এই কালো রং দিয়েই তো ফরেস্ট বাংলোর দেয়ালে বীরু লিখেছে – ওয়েলকাম টু গোর্খাল্যান্ড। আমার হঠাৎ মনে হল এই শরীর, শরীরে ফুটেওঠা লালিগুরাস, ঝাউপাতার মত আমার মাথার চুল, পাহাড়ি ঝোরার মত কখনও শুকনো, কখনও ভরাট আমার হাসিকান্না, শরীরের উপত্যকাজুড়ে চা-বাগান, অর্কিড-ক্যাকটাসের নার্সারি, মকাই-এর খেত – আমিই গোর্খাল্যান্ড।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামল। আমরা বুঝতে পারি এ বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকবে না। এখনই রোদ উঠবে। দোলনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবার দোলনায় উঠে বসলাম। দুহাতে দুপাশের দড়ি ধরে দোল দিলাম জোরে। রাইশাকের পাতাগুলো বৃষ্টিতে ভিজছে। স্কোয়াশের লতা জলের ভারে নুয়ে পড়ছে। দু’তিনবার জোরে দোল খাওয়ার পর টের পেলাম আমার শরীরে কোথাও একটা অস্বস্তি হচ্ছে। আমার জানুসন্ধি বেয়ে কিছু একটা গড়িয়ে নামছে। আমার অসম্ভব ফর্সা উরুতে কালচে ঘন একফোঁটা রক্ত লেগে রয়েছে। মুহূর্তে মনে হল আমার নিশ্চয় কোনও খারাপ অসুখ হয়েছে। কোনও অশুভ আত্মা ক্রমশ অধিকার করে নিয়েছে আমার শরীর। বৌদ্ধদের সাদা পতাকা থেকে অজানা ভাষায় লেখা প্রার্থনার অক্ষরগুলো আমাকে অভিশাপ দিয়েছে। কেমন যেন অশুচি মনে হল এই শরীর। পা দিয়ে মাটি আঁকড়ে দোলনা থামিয়ে দিলাম। মার কাছে যাব এখন।
একটা রুপোলি সুতো যেন এঁকেবেঁকে পড়ে আছে। আমি বাবার বাঁ হাতে নীল রং-এ লেখা বি রাই-এর ওপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। বাবা বলল – এই দ্যাখ। সোয়েটার, জামার হাতা টেনে ওপরে তুলে বাবা বলল – হের, লিটল্ মারমেইড। লিটল্ মানে ছোট, কিন্তু মারমেইড মানে আমি বুঝতে পারলাম না। বড় সড়কের পিচরাস্তা যেখানে একদম বাঁ দিকে ঘুরে সোজা দক্ষিণমুখো হয়েছে, সেখানে পথের ডানপাশে খাদের দিকে বেশ কিছুটা সমতল জায়গা রয়েছে। চারপাশে সাইপত্রী গাছে ফুল ফুটে আছে। মাঝে দুটো সবুজ রং করা কাঠের বেঞ্চ। একটা বেঞ্চে আমি আর বাবা পাশাপাশি বসেছিলাম। পুব আর পশ্চিমের পাহাড়ের উপত্যকার থাক যেখানে মিশেছে, সেখান দিয়েই বড় পিচরাস্তা উত্তরে আমাদের বড় শহর, দক্ষিণে সমতলের বড় শহরের দিকে চলে গেছে। এখান থেকে দক্ষিণে তাকালে মাঝে কোনও পাহাড়ের আড়াল পড়ে না। আমি জানতাম এগুলোকে বলে চৌতারা। দুটো পাহাড়ের মাঝে খোলা পথ পেয়ে এখান দিয়ে বাতাস খুব জোরে বয়ে যায়। বাবা বলল – ভিউ পয়েন্ট। এখানে গাড়ি থামিয়ে ট্যুরিস্টরা দাঁড়ায়, বেঞ্চে বসে। ক্যামেরা বার করে ছবি তোলে। শূন্য সিগারেটের প্যাকেট, আলুভাজার প্লাস্টিক ফেলে যায়। খালি জলের বোতল বলের মত লাথি মেরে নীচে খাদের দিকে গড়িয়ে দেয়। বাবা এসব একদম সহ্য করতে পারে না। গজগজ করে। গালাগালি দেয়। আমার সামনেই বলে – শালা হারামি, চিকনে। থুঃ। নিজেরা ভালো জল খায়, আর খালি প্লাস্টিকের বোতলটা আমাদের দিয়ে যায়।
লিটল্ মারমেইড শুনে প্রথমে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। বাবা বাঁ হাতের জামার হাতা একটু একটু করে ওপরে তুলছিল। একেবারে নয়, যেন তা হলে সব মজা মাটি হয়ে যাবে। ম্যাজিকওয়ালার মত বাবা সাবধানে, আস্তে আস্তে মারমেইডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। শেষে কনুই-এর ওপরে, যেখানে হাত ভাঁজ করলে মাংস ফুলে ওঠে, তার উলটো দিকে কাঁধের একটু নীচে একটা নীল রং-এর ছবি ফুটে উঠল। আশ্চর্য! বাবার হাতে এই ছবি এর আগে আমি কোনও দিন খেয়ালই করিনি। একটা মেয়ের ছবি। তার শরীরের ওপর দিকটা মানুষের মত, কোমর থেকে নীচের দিকটা মাছের মত। শেষে লেজের পাখনা পর্যন্ত রয়েছে। মাছের আঁশের ডিজাইন পর্যন্ত স্পষ্ট বোঝা যায়। এই তাহলে মারমেইড। এই ছবি সাবান দিয়ে ঘষলেও ওঠে না। সাধারণ কালি দিয়ে কাগজের ওপর ছবি আঁকা নয়, সুঁচ ফুটিয়ে মানুষের চামড়ার ওপরে ছবি আঁকে উলকিওয়ালা।
সেদিন চৌতারায় কাঠের বেঞ্চে বসে বাবা আমাকে লিটল্ মারমেইডের গল্প শুনিয়েছিল। আমরা বিকেল বেলায় এখানে এসে বসেছিলাম। আজকাল এই পথে খুব কম গাড়ি চলে। পাহাড়ে গন্ডগোলের জন্য বাইরের লোক আসা কমে গেছে। আমার মার সঙ্গে এই নিয়ে গুরুংকাকার খুব কথা হয়। অনেকেই এখন আর মিছিলে যেতে চাইছে না। বন্ধ্-এর কথা শুনলেই সবার মুখ গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। যে যতটা পারে খাবার, জ্বালানী জোগাড় করে রাখছে।
লিটল্ মারমেইডের গল্প শুনতে শুনতে আমার কান্না পেয়ে যায়। আমি মনে মনে সমুদ্র কেমন কল্পনা করে নিই। মৎস্যকন্যা সাঁতার কাটতে কাটতে দেখল একটা জাহাজ ডুবে যাচ্ছে। একটা মানুষ জলের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে। মৎস্যকন্যার মনে পড়ল তার বউজু বলেছিল মানুষরা জলের নীচে বেশিক্ষণ বাঁচে না। সাঁতরে তাকে পারে নিয়ে এল সে। দেখল অপরূপ এক মানুষ। আহা, এই মানুষের সঙ্গে যদি সে চিরদিন থাকতে পারত।
শুনতে শুনতে আমার বীরুর কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয় যেন সেই রাজপুত্রের মাথায় কালো টুপি, তার ওপর দুটো কুকরি। দক্ষিণে নীচে তাকিয়ে দেখলাম সামনে অস্পষ্ট সবুজ বোঝা যায়, তারপর যতদূর তাকানো যায়, কোথাও পাহাড় নেই। ধূসর একটা রং, আকাশ আর পৃথিবী কোথায় মিশেছে, বোঝাই যায় না। তার মাঝে একটা রুপোলি সুতো এঁকেবেঁকে পড়ে আছে। বাবা বলল নদী। আমাদের এই পাহাড় থেকে গড়িয়ে পাগলাঝোরা হয়ে সমতলে গিয়ে পড়েছে। তারপর আরও অনেক জঙ্গল, অনেক শহর, অনেক গ্রামের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। সেখানে যেদিকে তাকাও, শুধু জল। সবখানে জল। আমি ভাবছিলাম সমুদ্রের কাছে যারা থাকে, তাদের কী মজা। অনেক দূরের ঝোরা থেকে তাদের গাগরি ভরে জল আনতে হয় না। বাবা ইংরেজিতে যেন কী বলল। তারপর বলল সেই জল একফোঁটাও মুখে দেওয়া যায় না।
একটা জীপগাড়ি গেল। বাবাকে দেখে ড্রাইভার হাত নাড়াল। বাবাও। পাহাড়ে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসে। সূর্য পশ্চিম পাহাড়ের দিকে ঢলে পড়লেই বিকেলটা মরে যায়। আমি চাইছিলাম সন্ধ্যা নেমে আসুক। তখন নাকি দক্ষিণের সমতল শহরে আকাশের মত অজস্র তারা জ্বলে ওঠে। এই চৌতারা থেকে দেখলে মনে হয় আর একটা আকাশ ওখানে নেমে এসেছে। তারপর – আমি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
মানুষ কি অনেকদিন বাঁচে ? বউজুর কাছে গিয়ে সেই মেয়েটা জানতে চেয়েছিল।
না, আমাদের হিসেবে ওদের আয়ু খুব সামান্য। আমরা দুশোতিনশো বছর বাঁচি। জীবন শেষ হয়ে গেলে আমাদের শরীর সমুদ্রের সাদা ফেনা হয়ে যায়। কিন্তু ওদের আত্মা থাকে। শরীর ধ্বংস হয়ে গেলে ওদের আত্মা একটা সুন্দর জায়গায় চলে যায়, সেটাকে ওরা বলে স্বর্গ।
আমার কি আত্মা হতে পারে না ?
একটা উপায় আছে। যদি কোনও মানুষ তোকে ভালোবেসে বিয়ে করে। কিন্তু তাই বা কী করে হবে। মানুষ আমাদের এই ঝলমলে রুপোলি লেজওয়ালা শরীরটা পছন্দ করে না। পৃথিবীর মানুষদের দুটো অঙ্গ থাকে, যেটা দিয়ে ওরা হেঁটে বেড়ায়। ওরা বলে পা।
তারপর ? বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি জানতে চাইলাম।
লিটল্ মারমেইড চলে গেল সমুদ্রের অনেক গভীরে, যেখানে মানুষের হাড়, থপথপে কোলা ব্যাং আর বিচ্ছিরি শামুকদের তৈরি ঘরে এক ডাইনিবুড়ি থাকে। তার গলার স্বর যেন বর্ষাকালের ব্যাং-এর ডাক।
আয় রে আমার ছোট্ট মেয়ে, তোর জন্যই তো বসে আছি। তোর লেজটা খসে যাক, আর তোর দুটো ঠ্যাং গজাক – এই তো চাস ? হবে। কিন্তু তার জন্য তোকে কী দাম দিতে হবে জানিস ?
বলো কী দাম নেবে ? যা চাও তাই দেবো।
তোর গলার ওই মিঠে জলতরঙ্গের আওয়াজ আমাকে দিতে হবে, আর তুই বোবা হয়ে যাবি। রাজি আছিস ?
হ্যাঁ, রাজি।
এই নে। ভোরবেলায় সাঁতার কেটে সমুদ্রের পারে গিয়ে এটা খেয়ে নিবি। কষ্ট হবে, কিন্তু দেখবি তোর মৎস্যকন্যার লেজ আর নেই, মানুষের মত দুটো পা নিয়ে তুই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নর্তকীর চেয়েও ভালো নাচতে পারবি। কিন্তু গলায় কোনও শব্দ থাকবে না। যার জন্য এত করছিস, সে তোকে খুব ভালোবাসবে। কিন্তু সে যদি কোনও দিন অন্য কোনও মেয়েকে বিয়ে করে, তা হলে তোর হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তুই সমুদ্রের ফেনা হয়ে যাবি।
তারপর ?
এইমাত্র সূর্য পশ্চিম পাহাড়ের পেছনে চলে গেল। ছায়া পড়তেই আমাদের চারপাশের পাহাড়ের সবুজ রং কালচে নীল হয়ে গেল। ঠান্ডা বাতাস ছুটে এল উত্তরের পাহাড় থেকে। এখনও উত্তরে উঁচু চূড়ায় রোদ লেগে রয়েছে। আমাদের এখানে ছায়া। হঠাৎ যেন ঠান্ডা বেড়ে গেল।
তারপর সকালবেলা রাজপুত্র সমুদ্রের পারে দেখল অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। রাজপুত্র তাকে প্রাসাদে নিয়ে সেবাশুশ্রূষা করে সুস্থ করল। তাকে দামি গয়না আর রাজকন্যার পোশাক পরতে দিল। তার নাচ দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। সে কোনও কথা বলতে পারত না, তবু রাজপুত্র তাকে খুব ভালো বাসত। দীর্ঘদিন তারা একসঙ্গে থাকার পর একদিন শোনা গেল দূরদেশের এক দারুণ সুন্দরী রাজকন্যার সঙ্গে রাজপুত্রের বিয়ে হবে। মহারাজা এই বিয়ে স্থির করে রেখে গেছেন।
সুন্দরী বোবা মেয়ে, তুমি হবে আমাদের মিতকনে। তুমি চিরকাল আমাদের সংসারে যেমন আছ, তেমন থাকবে। রাজপুত্রের কথা শুনে বোবা মেয়েটার বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু বলতে পারল না তা হলে তার কলজে দু’টুকরো হয়ে যাবে। সমুদ্রের ফেনা হয়ে ভেসে যাবে।
আমার বুক কাঁপছিল লিটল্ মারমেইডের কথা ভেবে। এখন বাতাস আরও কনকনে। ছায়া আরও ঘন হয়েছে। বাবার হাতা গোটানোই রয়েছে। আমার ইচ্ছে করছিল জামার হাতা টেনে ছবিটা ঢেকে দিতে। দক্ষিণের সমতলে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে এখনও আগের মতই আলো রয়েছে। এখনও নদীর ধারা বোঝা যায়। আমি বাবার কাছে আরও একটু ঘন হয়ে বসলাম।
সমুদ্রের মাঝে জাহাজে বিয়ের উৎসব চলছিল। জাহাজের বাইরে রেলিং-ঘেরা বারান্দায় এসে মৎস্যকন্যা দাঁড়িয়েছিল। রাতের অন্ধকারে সবুজ জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার নিজের দেশের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তখন সে দেখতে পেল জলের গভীর থেকে তার দিদিরা তাকে দেখতে এসেছে। বোন, এই নে। একজন দিদি তার দিকে একটা ধারালো ছুরি ছুঁড়ে দিল। রাজপুত্র যখন ঘুমিয়ে থাকবে, এটা ওর বুকে বসিয়ে দিবি। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলে সেই রক্ত দিয়ে তোর পা ধুয়ে নিবি। তোর পাদুটো আবার ঝলমলে রুপোর মত লেজ হয়ে যাবে।
তারপর ? আমি বাবার কাছে আরও ঘন হয়ে বসলাম। বাবার হাত চেপে ধরলাম।
গভীর রাতে ছুরি নিয়ে রাজপুরের ঘরে ঢুকে সে দেখল রাজপুত্র ঘুমোচ্ছে। রাজপুত্রের বুকের ওপর ধারালো ছুরি তুলে বসিয়ে দেওয়ার জন্য সে হাত ওপরে তুলল। হঠাৎ তার মনে হল তার কাছে তার নিজের জীবনের চেয়েও রাজপুত্রের জীবন অনেক বেশি দামি। বাইরে এসে জলে ফেলে দিল ছুরিটা। বাতাসের ভেতর থেকে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বয়ে গেল। বোবা মেয়েটাও জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে তার শরীর মিলিয়ে সমুদ্রের সাদা ফেনা হয়ে যাচ্ছিল।
তারপর ?
তারপর ? এতক্ষণ বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গল্প বলছিল। এবার যেন বাবা আপন মনেই কথা বলতে লাগল। সমতলের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে, দক্ষিণের যেদিকে নদী বয়ে গেছে সমুদ্রের দিকে – সেদিকে তাকিয়ে বাবা আপন মনে কথা বলছিল।
বাতাসের আত্মারা ফিসফিস করে কথা বলছিল ছোট্ট এক টুকরো সাদা ফেনার সঙ্গে। বাতাস যেন তাকে কোলে করে আকাশে তুলে নিতে চাইছিল। আমাদের ছোট্ট সোনা, তুমি চিরকাল আমাদের সঙ্গে থাকবে। অন্যের জন্য তুমি নিজের জীবন দিয়েছ। তার চেয়ে বড় আর কোনও ভালোবাসা হয় না।
চৌতারায় এখন অন্ধকার। দক্ষিণের সমতল কালো হয়ে এসেছে। যেন এই-ই হল সমুদ্র। তার মাঝে একটা দুটো আলো ফুটে উঠেছে। যেন কোনও জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ভীষণ শীত করছিল আমার। বাবা আমাকে কোলের ভেতরে টেনে নিল।
তারপর ?
তারপর ? অন্ধকারেও যেন বাবার মুখে একটু হাসি আমি টের পেলাম। বাবাও আমার মত দক্ষিণের সমতল ভূমির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
রাজপুত্র যখন দূর সমুদ্রে যেতে যেতে জাহাজের বারান্দায় এসে দাঁড়াত, টের পেত তার চোখমুখঠোঁটের ওপর পাখির পালকের মত হালকা ছোঁয়া দিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। বাতাসের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাসের মত কেউ বলছে – ফেয়ারওয়েল, ফেয়ারওয়েল। বিদায় আমার রাজপুত্র। তারপর সে বাতাসে ভেসে উড়ে যাচ্ছে অনেক উঁচুতে, মেঘের দিকে।
আমরা দু’জনই দক্ষিণ দেশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এক টুকরো আকাশের মতই অজস্র তারা ঝলমল করছে অনেক দূরে, অনেক নীচে। সমতলের ওই শহরে বিছানো রয়েছে একটা কালো ওড়না। তার মাঝে কত সলমাচুমকি। উত্তরের পাহাড় থেকে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে সমতলের দিকে। তারপর সেই বাতাস কি দক্ষিণ দেশ পার হয়ে আরও দক্ষিণে যেখানে সব ঝোরা, সব নদী মিশে গিয়ে শুধু জল আর জল – সেখানেও পৌঁছয় ? আমাদের এইসব পাহাড়ি ঝোরার জল এত মিষ্টি, অথচ দক্ষিণ সমুদ্রের জল কেন যে কেউ মুখে তুলতে পারে না, কে জানে। অন্ধকার, তবু আমি আমার পা দুটো দেখার চেষ্টা করছিলাম। মাথা নীচু করে চোখের জল মুছে নিচ্ছিলাম।
বীরমান লামা তার পিঠের ওপর ভোটকম্বলটা ভালো করে টেনে নিল। কালকের চেয়ে আজ ঠান্ডা অনেক বেশি। সঙ্গে হাড় ছুঁয়ে-যাওয়া বাতাস। পবিত্র চুড়ার দিক থেকে এখন কিছুদিন কনকনে বাতাস বয়ে যাবে তাদের এই বস্তির ওপর দিয়ে। বীরমান জানে এখন রোজ ঠান্ডা একটু একটু করে বাড়বে। বস্তির ওপরে ঢালু উপত্যকায় বরফ গলতে শুরু করেছে। বাতাস থেকে তাপ টেনে নিচ্ছে বরফ। সাদা বরফ গলে আবার সবুজ উঁকি দিচ্ছে। তাপ কমে আসছে রিংচিং মঠের নীচে এই পাহাড়ি বস্তিতে। বরফ যখন পড়ে, তখন নয় – বরফ গলতে শুরু করলে বীরমান বেশি করে কাঠকুটো জোগাড় করতে শুরু করে।
তাদের এই বস্তির ওপরের উপত্যকাই শুধু নয়, পুবের তিনপাহাড়ের মাঝে সেই কতকালের পুরনো পোখরির জলও জমে বরফ হয়ে থাকে। উপত্যকায় বরফ গলতে শুরু করলেও পোখরির জল অনেক দিন জমে থাকে। তারপর কবে থেকে যেন একটা দুটো ফুল ফুটতে শুরু করে। ছোট ছোট হলুদ আর কমলা রং-এর ফুলে ভরে যায় রিংচিং মঠের নীচের উপত্যকা। একটা দুটো ফোরহুইল ল্যান্ডরোভার আসতে শুরু করে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলোর সামনে লোকজন দেখা যায়। লালনীলহলুদসবুজ রঙীন প্রজাপতির মত সেই মানুষগুলো ঘুরে বেড়ায়। পবিত্র চূড়া, লালিগুরাস, বরফের ছবি তোলে। বীরমানেরও। তারপর একদিন ওরা সবাই চলে যায়। পাকদন্ডীর পথে, পোখরির পাশে, এখানে ওখানে হাওয়ায় ওড়ে প্লাস্টিকের প্যাকেট। বাতাসে ফুলের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকে বীরমানের অচেনা কিছু গন্ধ।
বীরমান জানে এই হল সমতলের গন্ধ। ওরা ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ঘর পরিষ্কার করার জন্য বীরমান ঘরে ঢুকে সেই গন্ধটা পায়। এই ঘরে যে মানুষগুলো ছিল, তাদের ঘাম, ব্যবহার করা সুগন্ধী, তামাক, মদ, তাদের জামাজুতোর গন্ধ – সব মিলিয়ে বীরমান টের পায় ঘরের বাতাসে তখনও সমতলের গন্ধ লেগে রয়েছে। এই গন্ধ বীরমানের চিরকালের চেনা গাঢ় সবুজ হিমেল গন্ধ নয়। এই গন্ধে বীরমানের অজানা কোনও কথা থাকে। দূরত্ব থাকে এই গন্ধে। সংশয় ও সন্দেহ থাকে। যারা এসেছিল, যারা আসে, তারা এই পৃথিবীরই মানুষ বটে; কিন্তু তাদের ভাষা, পোশাক, তাদের থুতু ফেলার ভঙ্গি, লালিগুরস গাছের দিকে শূন্য সিগারেটের প্যাকেট এবং শূন্য জলের বোতল অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলার ভঙ্গি দেখে বীরমান স্পষ্ট বুঝতে পারে এরা এই চিরসবুজ অরণ্য, সাদা বরফ, পাইবনের নির্জনতাকে ভালোবাসতে আসেনি। এরা সারাদিন ক্যামেরায় ছবি তোলে, বাংলোর খাবার নিয়ে কথা শোনায়, যখন তখন বলে ওঠে – অসাধারণ, রাতে মদ খায়। বীরমান ও তার মত পাহাড়ি মানুষদের দিকে ভালোবাসা নয়, অনুচ্চারিত অবহেলা ও তাচ্ছিল্য থাকে ওদের ইশারায়। পৃথিবীর সব দেশে সেই ইঙ্গিত এক রকম। তার জন্য ভাষা জানতে হয় না। বীরমান ঠিক বুঝতে পারে।
ঘর পরিষ্কার করতে এসে এসব তার মত করে ভাবে সে। বুক ভরে একবার ভালো করে শ্বাস টানে বীরমান, তারপর তাড়াতাড়ি উত্তরের আর দক্ষিণের কাচের জানালা খুলে দেয়। পাইন বন থেকে হু হু করে ঠান্ডা বাতাস এসে এই অচেনা গন্ধ উড়িয়ে নিয়ে যায় দূর দক্ষিণ দেশে, সমতলের দিকে। বীরমান ঘর পরিষ্কার করতে শুরু করে।
বাংলোতে লোকজন আসতে শুরু করলে বীরমান নড়েচড়ে বসে। বাংলোর কুক পদমবাহাদুর মাঝে মাঝে ওকে ডেকে পাঠায়। কোনও কোনও বছর এখানে অনেক লোক আসে। অনেকে এসে ঘর না পেয়ে সারাদিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে। ছবি তোলে। পোখরি দেখতে যায়। বিকেল গড়াতেই আবার গাড়ি নিয়ে ফিরে যায়। বাংলোর সামনের ফুলবাগানে সাদা বেতের চেয়ারে বসে ট্যুরিস্ট-পার্টি চা খায়। মেয়েরা ব্যাডমিন্টন খেলে। বাচ্চাগুলো বল খেলে। এখানে ওখানে বড় বড় রঙিন ছাতা, একটু দূরে ভিউ পয়েন্টে সবুজ টিনের ছাউনি। বৃষ্টির কথা কিছু বলা যায় না। যে কোনও সময়েই ঝিরঝির বা ঝমঝম করে নামতে পারে। পাঁচ মিনিট বাদেই আবার ঝলমলে রোদ্দুর।
কোনও সিজনে এত ভিড় হয়, কুক পদমবাহাদুর একা হাতে সামলে উঠতে পারে না। বাংলোতে কেয়ার-টেকার, আরও একজন লোক থাকলেও অসুবিধা হয়। তখন পদমবাহাদুর বড় সাহেবকে বলে বীরমানকে খবর পাঠায়। বীরমান এসে কিচেনে পদমবাহাদুরের সঙ্গে হাত লাগায়। চা দিয়ে আসে, পার্টি এলে গাড়ি থেকে সামান নিয়ে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসে। ট্যুরিস্ট পার্টিকে পোখরি দেখাতে নিয়ে যায়। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ শাড়িসোয়েটারসালোয়ারটুপির একটা রঙিন মিছিল পাইন বনের ভেতর দিয়ে, খাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। সামনে বীরমান।
বেশির ভাগ বাঙালিরাই আসে। সামনের উপত্যকার পাইন বন থেকে যখন ঘন কুয়াশা ভেসে আসে, কিংবা মেঘের ঘোমটা সরিয়ে যখন উত্তরের সোনালীহলুদ পাহাড়চূড়া দেখা যায় – বীরমান লক্ষ করে ওদের চোখেমুখে কেমন মুগ্ধ আবেশ ছড়িয়ে পড়ছে। তখন বীরমানের এক রকম সুখ হয়। মনে হয় এসব আকাশ-ছোঁয়া গাছ, বাতাসে-দোল-খাওয়া ঝাউবন, বরফ-ঢাকা উপত্যকা আর ওই সোনার মুকুটপরা পবিত্র চূড়া – এসব তারই খাসতালুক। রঙিন পোশাকপরা কিছু দূরদেশি প্রজাকে সে তার মহাল দেখাতে বেরিয়েছে। বীরমান জানে এখনই ওরা বলে ঊঠবে – অসাধারাণ। ক্যামেরা বার করে ছবি তুলবে পটাপট।
বাংলোর পেছনে একটা বড় পাথরের ওপর বীরমান বসে ছিল। আজ সকালে কিছুক্ষণ বাংলোর সামনে সমতল জায়গাটুকু জুড়ে ঝলমলে রোদ খেলা করেছে। এই বাংলোর উত্তরমুখী প্রতিটি জানালা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জ স্পষ্ট দেখা যায়। উত্তরে আকাশ পরিষ্কার থাকলে ভোরবেলা সূর্যের প্রথম আলোয় কমলা-লাল রং-এ কাঞ্চনজঙ্ঘা রাঙা হয়ে ওঠে। প্রথমে সবচেয়ে উঁচু চূড়ার মাথায় রং লাগে। যেন মহাকালের মাথায় কেউ একটা আগুনের টিপ পরিয়ে দিল। তারপর সেই রং গড়াতে থাকে। তার সর্ব অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে লাল আভা। ওদিকে পুবের আকাশে সূর্য যত ওপরে ওঠে, এদিকে তত রং-বদল হতে থাকে। সোনালীহলুদ হয়ে যায় পবিত্র চূড়া। তারপর রুপোর উজ্জ্বল সাদা।
বাংলোর পেছনে একটা পাথরের ওপরে বসে কম্বলটা ভালো করে শরীরে জড়িয়ে নিল বীরমান। আজ জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়বে, বরফ গলতে শুরু করেছে। বীরমান ভাবতেই পারেনি এ রকম ওয়েদারেও এই বাংলোতে ভীড় হবে। বীরমান যদি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রোগ্রাম জানত, তবে হয়তো অবাক হত না। বীরমান যদি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে সমতলের আদিবাসী বিকাশ পরিষদের আঁতাত, সিক্সথ্ শিডিউল, জিটিএ চুক্তি, শ্যামন সেন কমিটি ইত্যাদি জানত, তবে সে বুঝতে পারত সামনের দিনগুলোতে আবার পাহাড়ে অশান্তি হতে পারে, পথঘাট বন্ধ হয়ে যেতে পারে, বাংলো বুকিং রদ হয়ে যেতে পারে – এই আশঙ্কায় কিছু ট্যুরিস্ট মাঝের সময়টা সেফ পিরিয়ড মনে করেছে। আর সেফ পিরিয়ড বুঝতে পারলেই বাঙালি সেই অঞ্চলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই ট্যুরিস্টের দল নিয়মিত খবরের কাগজ ও ভ্রমণ পত্রিকা পড়ে, চ্যানেল ডিসকাশন শোনে। পদমবাহাদুর তাকে খবর পাঠালে সে বেশ অবাক হয়েছিল।
মশাই, সিক্সথ শিডিউলটা কী জিনিস বলুন তো ?
পাহাড়ে আবার বন্ধ্ নিয়ে কথা উঠেছিল। বাংলোর উত্তরদিকে ফুলবাগানের মাঝে চারজন ট্যুরিস্ট বসে রয়েছে। তিনজন এক দলের, বিমল রায়চৌধুরী আলাদা। বিমল তার বউকে নিয়ে এসেছে। চন্দ্রাকে নিয়ে বিমল সারা বছরই ঘুরে বেড়ায়। ডাক্তার তাই বলেছে। এ ছাড়া চন্দ্রার ভালো থাকার আর কোনও রাস্তা নেই। পারিবারিক ব্যবসার দায় কর্মচারীদের ওপর ছেড়ে দিয়ে বিমল রায়চৌধুরী পাহাড়, সমুদ্র আর জঙ্গলের নির্জনে চন্দ্রাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্রথম দিকে হরিদ্বার, মথুরা, পুরী, বেনারস, দক্ষিণ ভারতের তীর্থস্থানগুলোতে যেত। কিছুদিন পরে বুঝতে পেরেছিল বেশি ভিড় দেখলে চন্দ্রার আবার সেই অসুস্থতার লক্ষণ ফিরে আসে। তা ছাড়া চন্দ্রা দেবতা নয়, নির্জনতা চায়। ঈশ্বরের কাছে চন্দ্রার আর কিছু চাওয়ার নেই। তারপর থেকে বিমল কম ট্যুরিস্ট যায়, বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলের আনকমন স্পটগুলোয় যেতে শুরু করেছিল। কাল রাতে অনেকদিন বাদে চন্দ্রাকে বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। বেশ কথা বলেছে তার সঙ্গে। কম্বল জড়িয়ে তারা দুজন অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে ছিল। বিমল মাঙ্কি ক্যাপ পরে নিয়েছিল। কনকনে বাতাস ভেসে আসছিল উত্তর থেকে। বরাবরই সে ঠান্ডায় একটু কুঁকড়ে থাকে। শীতটা এনজয় করে ঠিকই, কিন্তু সাবধানেও থাকে। এখন এই প্রায় পঞ্চাশের দোড়গোরায় এসে শীত যেন তার শরীরে আরও তাড়াতাড়ি জাঁকিয়ে বসতে চায়। চন্দ্রার কানে স্কার্ফ বাঁধা ছিল, তার ওপরেও কম্বল তুলে নিয়েছে।
আকাশ অন্ধকার। পাহাড়ও এখন সবখানে অন্ধকারে ঢাকা। কোথাও একবিন্দু আলো নেই। এখানে আশপাশের পাহাড়ি উপত্যকায় কোথাও কোনও জনবসতি নেই। কিন্তু আকশের কালো আর পাহাড়ের কালোর ভেতরে ঘনত্বের তারতম্য ছিল। আকাশের অন্ধকার কিছুটা হালকা, পাহাড় খুব জমাট অন্ধকার নিয়ে স্থির হয়ে আছে। ফলে আকাশের গায়ে পাহাড়ের আউটলাইন বোঝা যাচ্ছিল।
ইন্টারনেট আর ভ্রমণ-পত্রিকার সুবাদে আজকাল আর কারও কোনও ইনফরমেশন জোগাড় করতে অসুবিধা হয় না। বিমল কনডাকটেড্ ট্যুর পছন্দ করে না। এক গাদা আলাদা আলাদা স্বভাবের মানুষজনের সঙ্গে একসঙ্গে ঘোরা, বেড়ানোর মজাটাই মাটি হয়ে যায়। যারা নিজস্ব প্রোগ্রামের হ্যাপা সামলাতে চায় না, তারা বাধ্য হয়েই যায়। ঘুরে বেড়ানোর সমস্ত স্বাধীন ইচ্ছেগুলো অপারেটরদের হাতে বাঁধা, কোথাও প্রাইভেসি নেই, নির্জনতা নেই – চন্দ্রা তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। বিমল তার প্রোগ্রাম নিজেই তৈরি করে নেয়। তাছাড়া, চন্দ্রার খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধের ব্যাপার আছে, অন্যদের কাছে সেটা বিরক্তিকরও হতে পারে। কনডাকটেড ট্যুর বড় সাজানো গোছানো সফর। নিজের ইচ্ছে বলে কিছু থাকে না। বিমল খুব আনকমন, নির্জন, সদ্য-গড়ে-ওঠা স্পটগুলো খুঁজে বার করে। তারপর চন্দ্রাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
চন্দ্রা, তোমার ঠান্ডা লাগছে না তো ?
বারান্দার সি এফ এল ল্যাম্পের আলো চন্দ্রার মুখের বাঁ দিকে এসে পড়েছে। কিন্তু মাথায় কম্বল থাকায় শুধু তার তীক্ষ্ণ নাক আর বাঁ চোখের কিছুটা দেখা যাচ্ছিল। সামনের অন্ধকার পাহাড়ের দিকে মুখ রেখে বসে আছে চন্দ্রা। পাহাড়ে কত তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসে। একটু আগেও পশ্চিমা সূর্যের আলো এসে পড়েছিল পুব পাহাড়ের ঢালে। সূর্য আর একটু ঢলতেই পাহাড়ের সবুজ দ্রুত কালো হয়ে গেল। প্রকৃত সন্ধ্যার আগেই এখানে যেন অকাল-সন্ধ্যা নেমে এল। অন্ধকার পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল চন্দ্রা।
আর একবার চা খাবে ? দিতে বলব ? বিকেলের ওষুধটা খেয়েছিলে ?
বলো। বিকেলে চা-টা ওরা খুব ভালো দিয়েছিল।
হ্যাঁ, মনে হল আসল দার্জিলিং লিফ। কী দারুণ ফ্লেভার বেরোচ্ছিল। এই বাংলোটা বেশ ভালো, না ?
হুঁ। আমরা পোখরি দেখতে যাব না ? বীরমান বলছিল এই সামনেই। আমাদের সঙ্গে গিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসবে।
কে বীরমান ?
খিল খিল করে হেসে উঠল চন্দ্রা। পঁয়তাল্লিশের চন্দ্রার হাসি শুনলে মনে হয় আঠারো ঊনিশের কোনও সদ্য তরুণীর আনন্দঝর্ণা। মনে হয় ওপরের পাহাড় থেকে অনেক নীচে পাহাড়ি ঝোরার জল পড়ে তার বিন্দুগুলো মুক্তার মত চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। সাদা ফেনা তৈরি হচ্ছে। কুয়াশার মত জলকণা বাতাসে ভাসছে। কতদিন পরে চন্দ্রার এমন হাসি শুনল বিমল। কিন্তু , তবু কোথাও যেন তার মনে হল এই হাসির ভেতরে অস্বাভাবিক একটা সুর আচ্ছে। বিষণ্ণতার ম্লান ছায়া আচ্ছে।
কী সুন্দর ভাঙা ভাঙা বাংলায় বীরমান কথা বলে। ওই যে, বিকেলে আমাদের চা দিয়ে গেল। আমি বারান্দায় বসে ... সামনের ওই গাছে ওগুলো কী ফুল গো ? থোকা থোকা লাল – আমরা যখন গাড়িতে এখানে আসছিলাম, একটা শুকনো নদী পেরোনোর সময় দেখেছিলাম অনেকগুলো মেয়ে, ওদের খোঁপায় এই ফুল। কী কথা বলছিল, হাসছিল ... সামনের গাছটায় জানো, কতগুলো পাখি বসেছিল।
ওরা বলে লালিগুরাস। রডোডেনড্রন। কী বলেছে বীরমান ?
হ্যাঁ, ঠিক। লালিগুরাস। মনে পড়েছে। বীরমানও তাই বলেছে। রডোডেন্ড্রন ভালো না, লালিগুরাস ভালো। তুমি চা খেয়ে ঘরে গেলে, একটু বাদে বীরমান খালি কাপ নিতে এলো, আমাকে বলল – মা, পোখরি দেখতে চোলবেন না ? আমাকে মা বলেছে বীরমান। জানো, পোখরি মানে আসলে পুকুর। জলাশয়, লেক। অক্টোবরের ফার্স্ট উইকেই জল বরফ হয়ে যায়।
কতদিন বাদে এক সঙ্গে এত কথা বলল চন্দ্রা। তাহলে কি চন্দ্রা আবার আগের মত হবে ? উচ্ছ্বল, প্রাণলাবণ্যে চঞ্চল। অপর্ণাকে বিয়ে দেবার আগে যেমন ছিল সে, এমন কি অপর্ণা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর একমাস পর্যন্ত। মেয়ের বিয়ের সময় হাসি মুখে কী পরিশ্রমটাই না করেছিল চন্দ্রা। পান খেতে শুরু করেছিল। বিমল বকলে হেসে বলেছিল – শাশুড়ি হয়েছি, পান না খেলে মানায় ?
চন্দ্রা, সামনের ফেব্রুয়ারিতে কিন্নরে যাব ঠিক করেছি। তোমার খুব ভালো লাগবে।
চন্দ্রা আবার চুপ করে গেছে। একটু আগেই সে যখন বীরমানের কথা বলছিল, স্বাভাবিক মানুষের মতই ছিল তার কথা বলার ভঙ্গি। বিমলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে, কথা বলার সময় মানুষের শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ছিল তার। এখন আবার সে পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে গেছে। ঘাড় সামনের দিকে নুয়ে মাথা বুকের কাছে ঝুলে আচ্ছে। বিমল জানে এখন চন্দ্রার কানের সামনে বোমা ফাটলে কিংবা প্রচন্ড জোরে বজ্রপাত হলেও সে কিছুই টের পাবে না। তার নিজের কোন ভাবনার অতলে সে তলিয়ে গেছে। তখন তার শরীরের ভঙ্গিটা এ রকমই হয়ে যায়। বাইরের পৃথিবীর কোনও আলোড়ন সেই অতল তলে পৌঁছবে না। তাকে এখন পাথরপ্রতিমা মনে হচ্ছে।
বিমল তার বেতের চেয়ার টেনে চন্দ্রার আরও একটু পাশে গিয়ে বসল। অনেক সময় চন্দ্রা এ অবস্থায় কাত হয়ে পড়ে যায়। এ রকম ঘোর তার মিনিট পাঁচেক থাকবে। তারপর সে আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসে।
হাত বাড়িয়ে চন্দ্রার ডানদিকের কাঁধ ধরে রাখল বিমল। একটু আগেই চন্দ্রা কত কথা বলছিল। বিমলের মনে হয়েছিল চন্দ্রা বোধহয় আস্তে আস্তে আগের মত হয়ে উঠছে। অপর্ণার ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগে সে যেমন ছিল। একটু আগে সে যখন বলছিল বীরমান তাকে মা বলে ডেকেছে, তখন তার চোখের তারায় আনন্দ দেখেছিল বিমল।
সমুদ্র নয়, বিমলের ভালো লাগে পাহাড়। চন্দ্রাও পাহাড় বেশি পছন্দ করে। সমুদ্রের দিকে বিমল বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। কোথা থেকে যেন ভয় আসে। হারিয়ে যাওয়ার ভয়। মানুষ তো দিক এবং বস্তুর অবস্থান বুঝতে পারে কোনও একটা স্থির বস্তুর সাপেক্ষে। হলুদ বাড়িটার পেছনে, থানার উলটো দিকে, পার্কের বাঁ দিকে – এ ভাবে বুঝে নিতে হয়। কিন্তু যখন কোথাও কোনও দিকচিহ্ন থাকে না, তখন বুকের ভেতরে এক রকম ত্রাস তৈরি হয়। ছক-কাগজের অবস্থান বিন্দু থেকে উৎখাত হয়ে যাওয়ার আতংক। আর বড় একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন জল, ঢেউ-এর পরে ঢেউ।
বরং পাহাড় ভালো। প্রতিটি পাহাড়, প্রতিটি উপত্যকার ঢেউ আলাদা। সবুজের কত শেডবাহার। কত ফুল, কত প্রজাপতি, কত ফড়িং। ঝর্ণা, বরফ, পাইন, ঝাউ, ক্যাকটাস, কত নাম-না জানা ফুল। প্রতিটি পাহাড়কে বিমল নতুন করে আবিষ্কার করে। আর ওই বিশাল অটল ভরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কী নগন্য, তুচ্ছ মনে হয় নিজের এই অস্তিত্ত্ব।
চন্দ্রা জেগে উঠল। সোজা হয়ে বসে মাথায় ভালো করে কম্বল জড়িয়ে নিল। চন্দ্রা, ঘরে যাবে ? বিমল জিজ্ঞেস করলে মাথা নাড়ল চন্দ্রা। হুঁ, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমাকে ঘরে নিয়ে চল। চন্দ্রাকে পাখির ছানার মত বুকের ভেতরে জড়িয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের দিকে পা বাড়াল বিমল।
খুব ঘুম পাচ্ছে বলে শুতে গিয়েও চন্দ্রা ঘুমিয়েছে অনেক রাতে। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেছে। অনেক দূরে নেপালি বস্তিতে কুকুর ডাকলে চমকে উঠছিল। কিন্তু সকালে বিমলের সঙ্গেই উঠে পড়েছে। চা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। বিমল বাইরে এসে দেখল কোথাও মেঘের আনাগোনা নেই। ঝকঝকে নীল আকাশ। পাহাড়ে সবুজের বিভিন্ন শেড, দূরের নীল পাহাড় – সব খুব সতেজ দেখাচ্ছে।
ফুলবাগানে দু’সারি বেডের মাঝে দু’টো কাঠের বেঞ্চ রয়েছে। সাদা রং-এর। এখানে সাদা রং চলে, অনেকদিন উজ্জ্বল থাকে। ধুলো কম। সামান্য ধুলো পড়লেও ঝিরঝির বৃষ্টি এসে মুছে দিয়ে যায়। একটা বেঞ্চে তিনজন ট্যুরিস্ট বসে গল্প করছে। বিমল এসে ওদের পাশের বেঞ্চে বসল। তখনই তার কানে এল কেউ সিক্সথ্ শিডিউলের কথা বলছে। বিষয়টা নিয়ে ইদানীং কাগজে, টিভিতে খুব আলোচনা চলছে। বিমলও আলগা আলগা শুনেছে। আগ্রহ নিয়ে ওদের কথা শুনছিল বিমল।
প্রথমেই সিক্সথ্ শিডিউলের কথা বললে কিছু বুঝবেন না। শুনুন মিস্টার সরকার, ওদের গোর্খাল্যান্ডের দাবি কিন্তু একশ বছরের পুরনো। পাজামা, শাল, কানে মাফলার একজন বলছিল। ওদের ভেতর একজন সিগারেট টানছে। পাশে ট্রের ওপর চায়ের খালি কাপ পড়ে আছে। বিমল ওদের কথা শুনতে চাইছিল।
নাইন্টিন হান্ড্রেড সেভেনে এখানকার হিলম্যান’স্ অ্যাসোসিয়েশন এ অঞ্চলের জন্য আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছিল।
আমি তো মশাই কতকাল ধরে পাহাড় চষে বেড়াচ্ছি। কই, আগে তো কোনও দিন গোর্খাল্যান্ডের নামও শুনিনি। আপনি বলছেন একশ বছরের পুরনো।
শুনবেন কী করে। নামটা তো দিয়েছে সুভাষ ঘিসিং। বলা হয় যে, ঊনিশশো আশির পাঁচই এপ্রিল দৈববাণীর মত তার মুখ দিয়ে শব্দটা বেরিয়েছিল।
আপনি তো বেশ জানেন দাদা।
চাকরির দায়ে জানতে হয়েছে। আমাদের ছোট কাগজ, কিন্তু রাজনৈতিক সংবাদদাতা হলে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিষয়ে আপ-টু-ডেট থাকতেই হয়।
তারপর ? সিক্সথ্ শিডিউলটা কী জিনিস ? খায়, না মাথায় দেয় ?
বলছি। ঘোষবাবু, প্লিজ আর সিগারেট খাবেন না। নিজের লাং, আমাদের লাং, এখানকার বাতাস – সব পলিউট করছেন।
ও কে, ও কে। আপনি বলুন। বিমল গুরুং-এর ব্যাপারটা একটু ডিটেইলস্-এ বলবেন তো।
বিমল ছিল জি এন এল এফ-এর কাউন্সিলার। সুভাষ ঘিসিং পার্টির প্রেসিডেন্ট। বিমল গুরুং বেশ প্রভাবশালী নেতা ছিল। পার্লামেন্টে সিক্সথ শিডিউল বিল পাস হয়ে যাওয়ার পর বিমলের নেতৃত্বে দলের একটা বড় অংশ এর বিরোধিতা করল। ওদের প্রধান ইশ্যু ছিল গোর্খাল্যান্ড। দু’হাজার সাতের সাতই অক্টোবর তৈরি হয়েছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। কিন্তু তার আগে একটু ইতিহাস আছে। ঊনিশ’শ আশিতে ঘিসিং গোর্খা আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। দাবি ছিল দার্জিলিং-এর পার্বত্য অঞ্চল, ডুয়ার্স এবং শিলিগুড়িসংলগ্ন তরাই অঞ্চল নিয়ে আলাদা গোর্খাল্যান্ড দিতে হবে। আন্দোলন জঙ্গী চেহারায় চলে গেল। প্রায় বারো’শ মানুষ প্রাণ হারাল। সে তুলনায় বিমল গুরুং-এর আন্দোলন অনেক শান্ত, কিন্তু বেশি কার্যকরী হয়েছে। ঘিসিং-এর আন্দোলন শেষ হল নাইন্টিন এইট্টি এইটে, দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল তৈরির পর।
হ্যাঁ, শুনেছি। ডি জি এইচ সি।
দু’হাজার চারে ডি জি এইচ সি’র চতুর্থ নির্বাচন। কিন্তু সরকার চাইল যতদিন না সিক্সথ্ শিডিউল ট্রাইবাল কাউন্সিল তৈরি হচ্ছে, ততদিন হিল কাউন্সিলের সর্বময় কর্তৃত্ব ঘিসিং-এর হাতেই থাকুক। এবার প্রবল আপত্তি উঠল। বিমল গুরুং বেরিয়ে এল। এমনই কপাল, সেই সময়েই ইন্ডিয়ান আইডল কম্পিটিশনে প্রশান্ত তামাংকে জয়ী করার ব্যাপারে সংগঠন তৈরি করে বিরাট জনসমর্থন পেয়ে গেল বিমল। ঘিসিংকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে আর কোনও অসুবিধা রইল না। সিক্সথ্ শিডিউল নয়, উই ওয়ান্ট গোর্খাল্যান্ড – এটাই ছিল ওদের দাবি। গোর্খাদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বরাবরই ছিল। গোর্খাল্যান্ডের স্বপ্ন ওরা বরাবর দেখেছে। জিটিএ চুক্তি হয়েছে বলে মনে করবেন না ওরা গোর্খাল্যান্ডের কথা ভুলে গেছে। পিন্টেল ভিলেজে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির পর বিমল তো বলেই দিয়েছে – গোর্খাল্যান্ড আমাদের হৃদয়ে রয়েছে।
চ্যাটার্জীবাবু, কিছু মনে করবেন না, গোর্খাল্যান্ড হলেই কি ঘিদুধমধুর স্রোত বয়ে যাবে ? নামে কী আসে যায়।
মশাই, বৃটিশরা চলে যাওয়ার পর কি ভারতবর্ষজুড়ে ঘিদুধমধুর স্রোত বয়ে গিয়েছিল ? নামে অনেক কিছুই আসে যায়। শেক্সপীয়ারের কথা ধ্রুবসত্য নয়। যাগ্গে, তারপর শুনুন।
দাদা, আপনি কি দার্জিলিং-এর ইতিহাস কিছু জানেন ? বেড়াতে আসি, অথচ জায়গাটার হিস্ট্রি কিছুই জানি না, এটা ঠিক নয়।
তার আগে এক রাউন্ড চা দরকার। ওই যে, ছেলেটাকে ডাকুন তো। বীরমান, চা দাও আমাদের। তিন, না ... দাদা, চা চলবে আপনার ? বিমল হেসে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। লোকটা বেশ জানে। বিমলের শুনতে ভালোই লাগছিল। এসব কিছুই সে জানত না।
শুনুন, সতের’শ আশির আগে এ অঞ্চল ছিল সিকিমের চোগিয়ালদের। নেপালের গোর্খারা বারে বারে আক্রমণ চালিয়ে দার্জিলিং-এর পার্বত্য অঞ্চল অধিকার করার চেষ্টা করে গেছে। নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরির প্রথমে ওরা সিকিমের পুব দিকে তিস্তার পার পর্যন্ত অধিকার করে তরাইকেও ওদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। এবার আসরে নামল বৃটিশরা। নর্দার্ন ফ্রন্টিয়ারে নেপালের এই এগিয়ে যাওয়া বন্ধ করার জন্য আঠার’শ চোদ্দতে শুরু হল অ্যাংলো-গোর্খা লড়াই। গোর্খারা হেরে সুগৌলি চুক্তি করল আঠার’শ পনেরোতে। চুক্তি অনুযায়ী গোর্খারা সিকিমের যে সব অঞ্চল দখল করেছিল, সব ছেড়ে দিতে হল বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিতে। প্রধানত অঞ্চলটা ছিল মেচি আর তিস্তার মধ্যবর্তী অঞ্চল। এরপর আঠার’শ সতেরোর তেতুলিয়া চুক্তি অনুযায়ী অঞ্চলগুলো বৃটিশরা আবার ফেরত দিয়ে দিল সিকিমরাজকে। ওদের নিশ্চিত করল -- ভয় নেই, তোমাদের দেখভালের জন্য আমরা আছি।’ এরপর আঠারশ পঁয়ত্রিশে সিকিমরাজ দার্জিলিং উপহার দিল বৃটিশ কোম্পানিকে। আঠার’শ চৌষট্টির সিঞ্চুলা চুক্তিতে ভুটানডুয়ার্স, কালিম্পং কোম্পানিকে দিয়ে দিল ভুটান। বারো’শ চৌত্রিশ বর্গমাইল এরিয়া নিয়ে তৈরি হল দার্জিলিং জেলা। এই তো দার্জিলিং-এর ইতিহাস।
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এসব ইতিহাস কারও জানা ছিল না। সবাই দার্জিলিং-এ বেড়াতে আসে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছবি তোলে, গ্লেনারিজে কেককফি খায়, ম্যালে বেড়াতে যায়। এই শহরের ইতিহাস কেউ জানতে চায় না।
বীরমান চা এনেছে। সবাই চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল হালকা মেঘ রয়েছে এখন। কখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামবে, কিচ্ছু ঠিক নেই।
আসলে পাহাড়ের সরল, সাদাসিধে মানুষদের গোর্খাল্যান্ডের স্বপ্ন দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত সিক্সথ্ শিডিউলে রাজি হওয়া কেউ মেনে নিতে পারেনি। ঘিসিং-এর পতনের এটাই আসল কারণ। কুড়ি বছর ধরে রাজত্বের শেষে সবাই বুঝতে পেরেছিল এ লোকটা এল-ডোরাডোর মত মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়েছে। বিমল গুরুং ঠিক সময়ে ঠিক সুযোগ নিয়েছে। কোনও মারদাঙ্গা, জঙ্গী আন্দোলনে না গিয়েই কৌশলে কাজ হাসিল করেছে। তা ছাড়া বন্ধ, বিক্ষোভ, মিছিল, অনশন – সবাই বিরক্ত, হতাশ হয়ে পড়ছিল। বিমল, হি ইজ আ গ্রেট ফারসাইট লুকার। একদম সঠিক পথে এগিয়েছে।
চ্যাটার্জীবাবু, আপনার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। যা বক্তৃতা দিলেন।
ও কে, আপনারা সবাই শুনলেন , এটাই বড় ব্যাপার।
কিছু মনে করবেন না, সিক্সথ্ শিডিউল কেসটা কিন্তু আমি ঠিক বুঝিনি।
ওটা আমাদের সংবিধানের ভেতরের একটা ব্যাপার। জানেন তো, আমাদের সংবিধান হল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় মাপের, মানে সাইজে। মূল সংবিধানটা হাতে লেখা। শুনলে অবাক হবেন এর প্রতিটি পৃষ্ঠা অলংকরণ করা, নন্দলাল বসুর।
দারুণ ব্যাপার তো ...
আমাদের সংবিধানে কিছু ব্যাপার লিস্ট করা আছে। সরকারি আমলাদের কাজকর্মের পরিধি আর সরকারের পলিসিগুলোর শ্রেণীবিন্যাস করা আছে। এগুলোই শিডিউল। মোট বারোটা আছে। তার ভেতর ছ’নম্বরের দু’শ চুয়াল্লিশ আর দু’শ পঁচাত্তর আর্টিকেলে ট্রাইবাল এরিয়ার প্রশাসন বিষয়ে বলা আছে। স্বশাসিত জেলা বা অঞ্চলের ক্ষমতা নিয়ে – অসম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মেঘালয়, গোর্খা হিল কাউন্সিলের অন্তর্গত অঞ্চল এর ভেতরে পড়ছে। এটাই সিক্সথ্ শিডিউল। ভাববেন না আমি খুব পন্ডিত। একে ওকে জিজ্ঞেস করে, কিছুটা বইপত্র জোগাড় করে, সিনিয়ার রিপোর্টারদের তেল দিয়ে, লিডারদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে আস্তে আস্তে সব জেনেছি।
বাবা, এতক্ষণে বুঝলাম। এত সনতারিখ কীভাবে মনে রাখেন বলুন তো, মনে তো হয় না ঢপ দিচ্ছেন ...
বিমল দেখল পাহাড়ের গায়ে মেঘ জমেছে। অপর্ণার কথা মনে পড়ল। কী সুন্দর গান গাইত তার মেয়ে। মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে। তানপুরা আনা হয়েছিল চিৎপুর থেকে। কোথায় যে মেঘ জমে থাকে, কখন যে আঁধার করে আসে – কেউ বলতে পারে না।
নীল পাহাড়ের গায়ে মেঘের জড়িয়ে থাকা দেখে চন্দ্রার কথা মনে পড়ল বিমলের। সুভাষ ঘিসিং, বিমল গুরুং, হিল কাউনসিল, মোর্চা, জিটিএ – সব ভুলে গেল সে। চন্দ্রার জন্য তার বুকের ভেতরে ব্যথা জেগে উঠল। তার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। চন্দ্রা কি ঘুম থেকে উঠেছে? উঠে যদি দেখে তার পাশে বিমল নেই – অসহায় চন্দ্রার কথা ভেবে বিমল কেঁপে উঠল।
ঘরে এসে বিমল দেখল চন্দ্রা ঘুমোচ্ছে। লালকালো চেক কম্বলে শরীর ঢেকে চন্দ্রা ঘুমিয়ে আছে। ঘড়ি দেখল বিমল। সাড়ে ন’টা। বুঝতে পারল না চন্দ্রাকে ডাকবে কিনা। তখনই চন্দ্রা চোখ মেলে সামনে বিমলকে দেখে হাসল। সেই কবে যেন পড়েছিল, বিমলের হঠাৎ মনে পড়ল --- কুয়াশা গেল আকাশে আলো দিল যে পরকাশি, ধূর্জটির মুখের পরে পার্বতীর হাসি।
ওরা তিনজন পাকদন্ডী পথে নীচে নামছিল। সামনে বীরমান, পেছনে চন্দ্রা, শেষে বিমল। যেখানে পথ একটু বেশি চওড়া, ওরা দু’জন পাশাপাশি হাঁটছিল। বীরমানের সঙ্গে ওরা পোখরি দেখতে বেরিয়েছে। বিমল ভাবছিল সাবধানে নামতে হয় বটে, কিন্তু কষ্ট একটু কম হয়। হাঁপ ধরে না। ওঠার সময় চন্দ্রার হয়তো কষ্ট হবে। বিমলের হাতে বড় ছাতা। চন্দ্রা কখনও ছাতার নীচে, কখনও ছাতার বাইরে গিয়ে হাঁটছিল। চোরবাটো – শব্দটা বিমল ভাবছিল। শর্টকাট এই সব পাকদন্ডী পথগুলোকে স্থানীয় মানুষরা বলে চোরবাটো। একটু আগে বীরমানও বলছিল। লুকনো বা গোপন পথ।
বিমল ইতস্তত করছিল চন্দ্রার হাত ধরবে কিনা। খাদের কিনারা দিয়ে হাঁটার সময় ভয় করছিল বিমলের। হঠাৎ যদি চন্দ্রার মনে হয় অনেক নীচে, যেখান থেকে ঘন কুয়াশা উঠে আসছে, সেখানে বসে কেউ তাকে মা বলে ডাকছে। এ রকম হ্যাল্যুসিনেশন তো চন্দ্রার মাঝে মধ্যেই হয়। অনেক রাতে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ায়। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কান পেতে কী যেন শোনার চেষ্টা করে। চন্দ্রার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে হাঁটছিল বিমল।
বীরমান নিশ্চয় সব ট্যুরিস্টদেরই লেক দেখাতে নিয়ে যেতে চায়। নিশ্চয় কিছু এক্সট্রা রোজগার হয়। লোকাল গাইড হয়ে সঙ্গে যায়। এ পথ বাইরের লোক চিনতে পারবে না। পাইনের জঙ্গলে হারিয়েও যেতে পারে। বীরমান তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। পোখরি দেখায়, হয়তো প্রাচীন কোনও উপকথা শুনিয়ে ট্যুরিস্টদের অবাক করে দেয়। ট্রাইবালদের ভেতরে তো গল্পের শেষ নেই। দেবতা, অপদেবতা, জাতিদাঙ্গা, অর্ধেক পশু-অর্ধেক মানুষ, বিদেশিদের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই – কত গল্প।
চন্দ্রার গায়ে কালো শাল, স্কার্ফ দিয়ে কানমাথা ভালো করে ঢেকে নিয়েছে। পায়ে গরম মোজা জুতো। বিমল পুরোহাতা সোয়েটারের ওপর আবার শাল জড়িয়েছে। কানেমাথায় মাফলার। উপত্যকার ঢাল বেয়ে ওরা নামছিল। ঘুরে ঘুরে নামার ফলে খাদ এবং পাহাড়ের চড়াই ডানদিক, বাঁ দিকের স্থান পালটে যাচ্ছিল। নির্জন পথ, মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁর শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ কোথাও নেই। দীর্ঘ পাইনের মাথা দেখা যায় না। সূর্যের আলো পাওয়ার প্রতিযোগিতায় সবাই আকাশের দিকে উঠে গেছে। বাতাস ঠান্ডা, কিন্তু সঙ্গে যেন একটা ভেজা ভেজা ভাব রয়েছে। বিমল টের পেল তার গলায় খুব সামান্য ঘাম জমেছে।
একটু এগিয়ে বাঁ দিকে ঘুরেই বীরমান দাঁড়িয়ে পড়ল। ওরা একটু পিছিয়ে পড়েছিল। বীরমান হাতের ইশারায় ডাকল ওদের। পাকদন্ডী পথটা যেখানে বাঁ দিকে ঘুরেছে, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে বীরমান আঙুল তুলে সামনে, একটু নীচে দেখাল। সামনে তাকিয়ে বিমল পোখরি দেখতে পেল।
তিনদিক থেকে পাহাড়ের ঢাল নেমে এসে যেখানে মিশেছে, সেখানে একটা বড় মাপের ফুটবল মাঠের মত সমতল ভূমি। সেটাই আসলে লেক। তিন দিকের পাহাড় থেকে অজস্র ঝর্ণা গড়াতে গড়াতে শেষ পর্যন্ত এই লেকে এসে পড়েছে। অসাধারণ এই দৃশ্যের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল বিমল।
বাবু, নীচে চোলবেন না ?
চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বিমল দেখল সে নির্বাক বিস্ময়ে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে। বিমল বুঝতে পারছিল দূর থেকে, অনেক ওপর থেকে দেখা এই দৃশ্যের রহস্যময় সৌন্দর্য সামনে গেলে কুয়াশার মত উড়ে যাবে। এখান থেকে ওই পোখরিকে শুধু একটা লেক মনে হয় না। আরও একটা কেমন যেন দৈবীমায়া রয়েছে ওই দৃশ্যে। মাটির পৃথিবীর ধুলো, প্লাস্টিক, নগদ টাকা, ফলিডল এসব থেকে অনেক দূরে নির্জন গুম্ফার ঘন্টাধ্বনির চেয়েও গম্ভীর ও পবিত্র ওই দৃশ্য। সামনে গেলে ওটা আবার লৌকিক পোখরি হয়ে যাবে। দলে দলে ট্যুরিস্ট ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ছবি তোলে। বিমল জানে ওখানে একটা দু’টো দোকান বসেছে। হাওয়া এলে বাতাসে ওড়ে প্লাস্টিক, সিগারেটের শূন্য প্যাকেট। ওখানে হয়তো পাহাড়ের গায়ে লেখা আছে ওয়েলকাম টু গোর্খাল্যান্ড।
না, বীরমান। এখান থেকেই ভালো দেখাচ্ছে। তা ছাড়া অত নীচে নামলে ওঠার সময় মাজীর কষ্ট হবে।
ফেরার সময় ওরা অন্য পথে ফিরছিল। সামান্য একটু খাড়াই উঠেই পিচরাস্তা ধরেছিল ওরা। চন্দ্রা কোনও কথা বলছিল না। বীরমান বলেছিল, মাজীর কষ্ট হবে, চোরবাটো ধরে আর ফিরবে না। বড়সড়ক ধরবে। এখন আবার ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চন্দ্রার মাথার ওপর ভালো করে ছাতা ধরেছে বিমল। আর একটা ছাতা আনলে ভালো হত। বীরমানের গায়ে একটা অনেক পুরনো খয়েরি রেইনকোট। মাথায় টুপি, তার ওপরে একটা প্লাস্টিকের ঠোঙা। পথ বরাবর উত্তর থেকে ঠান্ডা বাতাস দক্ষিণে বয়ে যাচ্ছিল। পথের পাশে মাঝে মাঝে একটা দুটো কাঠের ঘর। সামনে গাঁদাফুল ফুটে আছে। কোথাও রাইশাকের খেত। কোনও বাড়ি থেকে ধোঁয়া উঠছে। নীল ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে নীল কুয়াশার সঙ্গে। খুব আস্তে আস্তে হাঁটছিল ওরা।
হঠাৎ বিমলের কাঁধ খামচে ধরল চন্দ্রা। চমকে চন্দ্রার মুখের দিকে বিমল তাকাল। কী হয়েছে চন্দ্রার। কোনও কারণে ভয় পেল নাকি। তোমার সেই গানটা মনে আছে – ফিসফিস করে বলল চন্দ্রা।
কোন গানটা ? বিমলের ভয় করছিল।
সেই যে আগমনী গানটা, কোন সিনেমায় যেন ছিল ... ইস, মনে পড়ছে না কিছুতেই। গাও না একবার।
মনে পড়ছে না গো। চল, ঘরে ফিরে নিশ্চয় মনে পড়বে। দূরের মেঘের দিকে তাকিয়ে বিমল বলল। আসলে তো ঘন কুয়াশা, দূরে গেলে মেঘ হয়ে যায়।
একটু দূরে, বাঁ দিকের পাহাড়ের ঢালে তাকিয়ে বিমল আর চন্দ্রা দু’জনই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। দুটো গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে দোলনা বানিয়ে সেখানে দুলছে একটা মেয়ে। ঠিক তখনই মেঘ সরে যাচ্ছিল। উত্তরের পবিত্র চূড়ায় বিকেলের কমলা রোদ এসে পড়েছে। মেয়েটার ঠিক পেছনেই পাহাড়ের বরফের ওপর থেকে বিকেলের সূর্যের কমলা-লাল আলো ফিরে আসছে। দূর থেকে মনে হয় রঙিন বরফের কোলে দোল খায় এক পাহাড়ি বালিকা। তার মাথায় লালিগুরাসের ফুল।
অপর্ণা – সেদিকে হাত বাড়িয়ে ডেকে উঠল চন্দ্রা। বিমল তাকে জড়িয়ে ধরে ছিল। চন্দ্রা ওপরের ধাপে মেয়েটার কাছে যেতে চাইছিল। দোল খেতে খেতে কোনও গান গাইছিল মেয়েটা। এত দূর থেকে গানের কথা বোঝা যাচ্ছিল না।
অপর্ণা ...
লালিগুরাস বানাই ভরি চুলটি সাজাউঞ্ছ ... এবার অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল গানের কথা।
শুনছ, অপর্ণা গাইছে। মেঘের কোলে মেঘ জমেছে ...
চন্দ্রা শোনো, আমার সেই গানটা মনে পড়েছে। এদিকে এসো, আমার কাছে এসো।
একটা ভিউ-পয়েন্টে ছাউনির নীচে বসে বিমল গাইছিল। সে তো জানে চন্দ্রা কোন গান শুনতে চেয়েছিল। বেঞ্চের ওপর চন্দ্রা বসে আছে। তার মাথাটা এক পাশে হেলে আছে। বিমল গাইছিল – যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা আমার বড় কেঁদেছে ...
ওয়েলকাম টু গোর্খাল্যান্ড লেখা পোস্টারের দিকে বীরমান তাকিয়েছিল বটে, কিন্তু সে বিমলের গান শুনতে শুনতে গিরি, গৌরী এবং উমা শব্দের অর্থ বুঝতে পারছিল। সে অবাক হয়ে ভাবছিল এ রকম গান তো সেও জানে।
পাহাড়ের লালিগুরাস- সমতল তাকে রডোডেন্ড্রন বলে জানে। পোখরি তো পুকুর -সমতলে।
এই আপাত দূরত্ব, সংশয়, পারস্পরিক সন্দেহ, অবহেলা, তাচ্ছিল্য... কারণ মানুষের হারিয়ে যাওয়ার ভয়- সে সর্বদাই একটা দিকচিহ্ন চায়, অবস্থানবিন্দু থেকে উৎখাতের ত্রাস তাকে তাড়া করে ফেরে।
বিরাটের সামনে, অপার্থিব সৌন্দর্যের সামনে সেই সদা সংশয়ী মানুষই নতজানু হয় - রোজকার ভয় তুচ্ছ হয়ে যায়। হয়ত সাময়িক। কুয়াশা সরে গেলেই যেমন সমস্ত রহস্য মুছে গিয়ে আবার সব দৈনন্দিনের লৌকিক।
এই ক্ষণিক দৈবী কুয়াশায় সমতলের আর পাহাড়ের গান মিলে যায়।
উপন্যাস হতে পারত। এখনও পারে।