গোটাকয়েক ঘাটের জল না খেলে বুঝি আজ উদ্ধারণপুরের ঘাটে পৌঁছোনো দায়। নইলে কাছাকাছি এলাকার মানুষজনও অজ্ঞতার আত্মবিশ্বাসে ভর করে ভুল দিকনির্দেশ দিয়ে ভিন্ন ঘাটের ঠিকানা বাতলে দেবেন কেন। এর একটা বড় কারণ এই হতে পারে যে, এ তল্লাটে ঘাটের অন্ত নেই। পথের ঠিকানা শুধোলে তাই বাঁশবনে ডোম কানা! কাটোয়া শহরে ঢুকে এ ঘাটের হদিশ খুঁজতে গেলে তাই পদে পদে বিড়ম্বনা। একেক জন একেক দিকে তর্জনি তুলে দেখাতে তৎপর। অতএব উদ্ধারণপুর ঘাটের পথে এগোতে চেয়ে তত্ত্বতালাশ করতে গেলে স্থানীয়েরা পদে পদেই নানান ঘাটের হদিশ দেয়। এই নানাজনের দেখানো পথে ঘোরাঘুরি করতে করতে আচমকা মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ভাষায় ‘শাঁখারি ঘাট দিল দরশন’। এই ঘাটেরই অদূরে নজরে পড়ে অজয় নদের জলধারা সন্তর্পণে এসে সামিল হচ্ছে ভাগীরথীর সঙ্গে। কিন্তু সে তো কাটোয়া শহরের গায়ে। একই জেলা বটে, কিন্তু আমাদের গন্তব্য তো এখান থেকে আরও ৩০-৩৫ কি.মি. পথ উজানে। উদ্ধারণপুর। কেতুগ্রাম ব্লক। নৈহাটি গ্রাম ছাড়ালেই। আর এই নৈহাটি গ্রামের সঙ্গেই উদ্ধারণপুরের নাড়ির যোগ। সে কথা পরে। পৌঁছোতে পৌঁছোতে পড়ন্ত বিকেল। তবুও ঘাট শ্মশান-যাত্রী, স্নানযাত্রীর চলাচল মুখর।
রাঢ়বঙ্গের ঐতিহ্যবাহী এই উদ্ধারণপুরের ঘাটে একদিকে যেমন কালো মাটি আর কয়লার মাখামাখি, তেমনি তাকে ঘিরে কিংবদন্তি, ইতিহাস আর সাহিত্য একজোট, একাকার। শ্মশান হিসেবেই এ ঘাটের সুপ্রাচীন প্রসিদ্ধি। সেই সুবাদেই সে জড়িয়ে নিয়েছে পূর্ববর্ধমানের সঙ্গে প্রতিবেশি আরও গোটা দুই-তিন জেলাকে। মুরশিদাবাদ জেলার যে এলাকা গঙ্গার পশ্চিম তীরে, আর বীরভূম জেলার প্রায় গোটা অঞ্চলের যত শবদেহ বেলা-অবেলায় উপনীত হত উদ্ধারণপুরে। পাঁচ থেকে দশদিনের হাঁটা পথ পেরিয়ে। শবদেহের এই ভিড়ের জন্যই লবজ হয়ে উঠেছিল-- ‘যত মড়া উদ্ধারণপুরের ঘাটে’। অবশ্য অনেক সময় অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকে পত্রপাঠ বিদেয় করার জন্যও আলংকারিক অর্থে এ কথাটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এক সময় মুর্শিদাবাদের সালার থানার বনওয়ারিবাদ রাজ পরিবারের অধীন ছিল উদ্ধারণপুর। রাজ পরিবারের সদস্যেরা গঙ্গাবাস করতে আসতেন এখানে। সেই সুবাদে মকর ও উত্তর সংক্রান্তিতে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমানের একটা বড় অংশের মানুষের উদ্ধারণপুরের গঙ্গায় স্নান করতে আসার রেওয়াজ শুরু।
পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গার এই ঘাটেই নাকি পবিত্র স্নানের টানে কেঁদুলি থেকে পদব্রজে এসে হাজির হতেন জয়দেব। কাশীধাম থেকে আসতেন ত্রৈলঙ্গস্বামী। শ্রীচৈতন্যদেবও নাকি রাঢ়দেশ পরিভ্রমণ শেষে কেতুগ্রাম থেকে ঈশানী নদীপথ ধরে উদ্ধারণপুরে এসে পৌঁছেছিলেন শান্তিপুর যাবার পথে। বৈষ্ণব এবং তন্ত্রসাধনা --উভয়ের ক্ষেত্র হিসেবেই উদ্ধারণপুরের ঘাটের অনন্যতা ঐতিহাসিক।
রাধাকৃষ্ণপুরের নাম পালটে উদ্ধারণপুর হয়ে ওঠার বিতর্কিত উৎসে রয়েছে বৈষ্ণব প্রেক্ষিত। হুগলি জেলার সপ্তগ্রামের আদি নিবাসী উদ্ধারণ দত্ত ছিলেন পার্শ্ববর্তী গ্রাম নৈহাটির জমিদারের দেওয়ান। আসল নাম দিবাকর দত্ত হলেও দীক্ষা নেবার সূত্রে তাঁর নামকরণ হয় উদ্ধারণ। কথিত রয়েছে যে, উদ্ধারণ দত্ত ছিলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর দ্বাদশ গোপালের অন্যতম গোপাল। নিজের সমস্ত পার্থিব চাহিদা বিসর্জন দিয়ে শ্রীচৈতন্যের অন্যতম পার্ষদ নিত্যানন্দের সঙ্গী হন তিনি। প্রভু নিত্যানন্দের আদেশ শিরোধার্য করে কাটোয়া থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভাগীরথী নদীর ধারে নির্মাণ করেন একটি আশ্রম। সেখান থেকেই শ্রীচৈতন্যের ভাবাদর্শ প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সেবায় উদ্ধারণ দত্তের আত্মৎসর্গের কথা যেমন পাওয়া যায় বৃন্দাবন দত্তের ‘চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থে, তেমনি রয়েছে কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ রচনাতেও। তবে সমস্যা এখানেই যে, বিতর্ক চিরকালই কিংবদন্তির পিছু ছাড়তে নারাজ। সেই কারণেই, সপ্তগ্রামের উদ্ধারণ দত্ত এবং উদ্ধারণপুরের উদ্ধারণ দত্ত একই ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে কূটকচালির অন্ত নেই।
বিতর্কের টানাপোড়েন যতোই থাক, উদ্ধারণপুর নামের উৎস যে উদ্ধারণ দত্ত, এই মতেরই পক্ষপাতী যে বেশিরভাগ মানুষ তা মালুম হয় দত্তমশাইয়ের দু’দুটি মর্মর মূর্তি থাকার কারণে। একটি রয়েছে স্নানের ঘাটে, অপরটি এই জনপদের অপর প্রান্তে। অবধূত (দুলালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়) তাঁর ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’ উপন্যাসেও দত্তমশায়ের পক্ষেই দ্বিধাহীন মত প্রকাশ করেছেন। কিংবদন্তি আর ইতিহাস যদি উদ্ধারণপুরের ঘাটকে ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ করে থাকে, তবে তাকে অনন্যতায় উদভাসিত করেছে অবধূতের কালজয়ী কলম, বীভৎস রসে টইটম্বুর এক আশ্চর্য কোলাজের পরতে পরতে গড়ে ওঠা উপন্যাসকে অবলম্বন করে। সে কাহিনির শুরু এই ভাষায়, ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট কান্নাহাসির হাট’। এই বাক্যবিন্যাস উপন্যাসের পৃষ্ঠা থেকে নিঃসারে উঠে এসেছে এই প্রাচীন ঘাটের তোরণদ্বারে। অবধূতের বয়ানে ‘ছত্রিশ জাতের মহাসমন্বয় ক্ষেত্র’ এই ঘাট, যাকে আলতো ছুঁয়ে বয়ে চলে ভাগীরথীর আবহমান জলধারা।
উপন্যাসে রয়েছে, ছত্রিশ জাতের মহামিলন ক্ষেত্র এই মহাশ্মশানে একদিকে যেমন ছিল শবদেহ ঘিরে শকুন, শেয়াল, কুকুরের দলের বেপরোয়া দাপাদাপি, অপরদিকে তেমনি ধড়িবাজ, ধর্মধ্বজী, কুচক্রী, পাপাত্মা, ফেরেব্বাজ মানুষের অহর্নিশ মতলবী আনাগোনা। আর এসব কিছুর মধ্যমণি হয়ে বিরাজ করেন তন্ত্রসাধক গোঁসাই বাবাজি। শব-পরিত্যক্ত বিছানায় গদির ওপর গদি চাপিয়ে ফুট কয়েক উঁচুতে শুয়ে-বসে চারপাশে চলমান এই জীবনের দ্রষ্টা হয়ে অধিষ্ঠিত তিনি। বহ্নিমান চিতায় অবিরত খাক হতে থাকে শবদেহ। পড়ে থাকে শুধু কালো কয়লা আর সাদা হাড়। শবদেহের শেষ সম্বল কাঁথা, কম্বল, গদি পরপর চাপিয়ে তার উপর থেকে গোঁসাই দেখেন পুড়ছে জীবন, পুড়ছে স্মৃতি, পুড়ছে কত চোরাগোপ্তা কলঙ্কের ক্ষত। ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে বহমান পুণ্যতোয়ায়। সেই পুড়ে যাওয়া ঘিরে কত কষ্ট, যন্ত্রণা, আনন্দ, বিষাদ, শোক। বিচিত্র গতি আবেগের ভাসান চিতার আগুনে, ধোঁয়ায়, নদীর নির্লিপ্ত স্রোতধারায়। শুধু এই ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা স্তব্ধ জীবন নয়, তার পেছনে বয়ে চলে যে অনন্ত জীবন, তারও দ্রষ্টা এই গোঁসাই বাবাজি। তাঁরই জবানিতে ধরা থাকে উদ্ধারণপুরের ঘাটের ইতিবৃত্ত।
কলকাতার ভবানীপুরের ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান কালিকানন্দ অবধূত শুধু তো লেখক নন, তিনি তন্ত্রসাধকও বটে। উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে তাঁর সন্ন্যাস গ্রহণ। উদ্ধারণপুরের ঘাটে গত শতকের তিনের দশকে তন্ত্রসাধনায় তাঁর অবস্থানের বাস্তবতায় কোনও ছলনা নেই। জানা যায়, সন্ন্যাস জীবনে ভৈরবী সহধর্মিনীও ছিল তাঁর। ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’(১৯৬০) উপাখ্যানে বাস্তব আর কল্পনার মিশেল যেমনই হোক, গোঁসাইবাবাজি যে অবধূত স্বয়ং তাতে কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই।
শ্মশান যে জীবন-বৈরাগ্যের নাটমঞ্চ, উদ্ধারণপুরের ঘাট তার ব্যতিক্রম নয় বটে, তবে তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু, অন্তত গোঁসাইয়ের নজর মিনার থেকে অবধূতের বীক্ষণ সেরকমই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মৃত্যুর জানলা দিয়ে না দেখলে জীবনকে সত্যরূপে দেখা যায় না’। সেই জানলার কপাট মেলে ধরেছেন তান্ত্রিক-লেখক অবধূত।
জীবনের সব লেনদেন মিটিয়ে মৃত্যুর মিছিল অনবরত যেখানে এসে থামে, সেই ‘উদ্ধারণপুরের বাতাসের সঙ্গে শ্মশান-ভস্মের মধুর মিতালি।... এপারে শিউড়ী, সাঁইথে, কাটোয়া কান্দী, ওপারে বেলডাঙা, বহরমপুর, লালগোলা, কৃষ্ণনগর -- সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে উদ্ধারণপুরের চিতাভস্ম। নামে মানুষের মাথায়, নামে ক্ষেত মজুরের বুকে, নামে সকলের তৃষ্ণার জলের আধার দীঘি সরোবরে। মিশে যায় শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে। সবার কাছে চিতাভস্মের সাদর আহবান পৌঁছে দেয় উদ্ধারণপুরের বাতাস। কেউ টের পায় না কবে কখন উদ্ধারণপুরের অমোঘ আহবান এসে পৌঁছে গেল হৃৎপিণ্ডের মধ্যে। সেই নির্মম পরোয়ান অগ্রাহ্য করার শক্তি নেই কারও’।
উদ্ধারণপুর এক প্রতীক – অমোঘ নিয়তির, জীবনের পিছুটান অগ্রাহ্য করার। দুই দেশের মাঝামাঝি যেমন থাকে ছিটমহল, তেমনি ঘর ও পারের মাঝখানে বিদায়ী আত্মার যাত্রাপথে ক্ষণিকের বিরতির পরিসর এই ঘাট। এখানকার যা কিছু দস্তুর সবই তার নিজস্ব নিয়মে চলত এককালে। বাতাসে এখনো ভেসে বেড়ায় সেসব ছমছমে, গায়ে কাঁটা দেওয়া জনশ্রুতি: ‘জ্বলন্ত চিতার ওপর মড়া উঠে বসে, খাটের উপর মড়া পাশ ফিরে শোয়, উদ্ধারণপুরের আনাচে কানাচে নরকঙ্কাল ধেইধেই করে নাচে’। শ্মশানে ঢোকার মুখে বড় নিমগাছটার ডাল ধরে কত মড়া দোল খেয়েছে। একবার এক মড়া তো উঠে বসেই রইলো পাঁচ দিন-রাত। লালগোলা থেকে লালু ফকির এসে ধুলোপড়া দিয়ে সেই মড়া নামায়। এসব ঘটনা অবিশ্বাস করলে চলবে কেন? অতন মণ্ডল নিজের চোখে এসব দেখেছে। কিন্তু এসব এখন আর ঘটে না। কেন? কারণ, সেই আমলে তো ‘এল’ (রেল) লাইন ছিল না। লোকে ‘ফস’ করে ওই ‘এল’ গাড়ি চেপে গয়ায় গিয়ে পিণ্ডি দিয়ে আসতে পারতো না। সুতরাং রেলের কৃপায় যা কিছু আষাঢ়ে, আজগুবি, অলৌকিক কেত্তন সবই ধীরে ধীরে সটকে পড়েছে। মানতেই হয়, কু-ঝিক-ঝিকের মাহাত্ম্য অপার। তাছাড়া, শ্মশানের গা ঘেঁষে এ তল্লাটে এখন দেদার লোকালয়, সারসার গৃহস্থের ঘরবাড়ি। রাস্তার এপার-ওপার। ‘তেনাদের’ দৌরাত্ম্যে অতএব বেজায় ভাঁটা!
জীবনকে পেছনে ফেলে আসা যায় কি অত সহজে? জীবন বড় নাছোড়। শ্মশানে এসেও কাম রিপু ত্যাগ করার মুরোদ নেই শবযাত্রীদের। তাই মৃতা সুন্দরীর দিকেও ফিরে ফিরে যায় কামার্ত দৃষ্টি। আর এদিকে ঘাটের কাছে মড়ার শয্যার গাদাখানেক গদির ওপর বসে জটাধারী সাঁইবাবা মানে গোঁসাই বাবাজি ঘাটে হাজির মৃতের পেছনে ফেলে আসা জীবনকে দেখতে পান। শববাহকদের কাঁধে চেপে সদ্য শ্মশানে আসা গৃহবধূর মৃত্যুরহস্য তাঁর কাছে গোপন থাকে না। সিঙ্গীমশায় তিনমহলা বাড়ির অন্ধকার কুঠুরিতে গৃহবধূকে খুন করে পাঁচমাসের সেই গর্ভবতীকে শ্মশানে নিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে যান। গুরুকন্যার গর্ভে সন্তানের জন্ম দিতে গিযে মহাপাতক হয়ে পড়েন তিনি। গলায় বাঁশ দিয়ে চেপে সেই হতভাগিনীকে হত্যা করার পর নিজেরও কি রেহাই মেলে তাঁর? কখনোই নয়। একই ঘাটে তাঁরও অন্তিম যাত্রা। আর জীবনের এরকমই সব বীভৎস রঙ্গ দেখতে দেখতে ক্লান্ত সাঁইবাবা উপলব্ধি করেন: ‘মরণের ক্ষুধাকে ফাঁকি দেবার কায়দা জানে উদ্ধারণপুরের ঘাট, কিন্তু জীবনের সুধা থেকে যে মারাত্মক নেশা জন্মায়, সে নেশার হাত থেকে কি করে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, তা যে কেউ জানে না’। শ্মশানঘাটের এই নাট্যমঞ্চে দাপিয়ে বেড়ায় কত বিচিত্র সব বর্ণের চরিত্রেরা – খন্তা ঘোষ, চরণ দাস, নিতাই দাসী, বামুনদিদি, শীলদের ভাগনী, দারোগাবাবু, সিঙ্গীগিন্নি, সুবর্ণ আরও কতো কে!
এত বৈরাগ্য, এত আত্মদর্শন, প্রজ্ঞা অর্জনের পর গোঁসাইবাবাই কি পারেন ‘জীবনের সুধা’র মারাত্মক নেশা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে? খন্তা ঘোষ আর চরণদাসকে একই চিতায় তুলে দিয়ে তিনি নিজেই অবশেষে বোষ্টুমী নিতাইদাসীর সম্মোহিনী ডাকে সাড়া দিয়ে তার হাত ধরে ফিরে আসেন জীবনের টানে। সেই টানে মিশে থাকে অমোঘ শরীরী আহ্বানও। শেষ পর্যন্ত তাঁর উপন্যাসে মোহান্ধ জীবনকেই জিতিয়ে দিয়েছেন উদ্ধারণপুর ঘাটের লিপিকার অবধূত, বিবাগী মন কে নয়। সাবাশি তাঁর সাহসকে।
আর এই জীবনেরই উদযাপন উদ্ধারণপুরে প্রতি বছর মকরসংক্রান্তিতে। ঘাটের অনতিদূরেই কাঠাচারেক জমির ওপর মেলা বসে। ওই দিনটিই বৈষ্ণবসাধক উদ্ধারণ দত্তের প্রয়াণ দিবস। ৯৪৮ বঙ্গাব্দে ৬০ বছর বয়েসে তিনি মারা যান। গত দেড়শো বছর যাবৎ অব্যাহত এই মেলা। বনওয়ারিবাদ রাজ-পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রাজা নিত্যানন্দের ছেলে জগদীন্দ্র বনওয়ারিলাল বাহাদুরের সময়ে এই মেলা শুরু। এখনও মেলার দায়িত্ব রাজপরিবারই। এই মেলায় ভিড় জমান বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ এবং নদীয়া – তিন জেলার মানুষই। উদ্ধারণপুরের স্নানের ঘাটে যেমন রয়েছে বৈষ্ণবসাধকের অবয়বে উদ্ধারণ দত্তের একটি মর্মর মূর্তি, তেমনি আবার সেই মেলার মাঠের সামনেও রযেছে তাঁর একটি সমাধি মন্দির। তার ঠিক পাশেই অবস্থান তন্ত্রসাধক কালিকানন্দ অবধূতেরও একটি মূর্তির। উদ্ধারণপুরের ঘাটের স্থপতি যদি হয়ে থাকেন উদ্ধারণ দত্ত, তবে এই ঘাটের খ্যাতি প্রতিষ্ঠা করেছেন অবধূত তাঁর কালজয়ী অনবদ্য উপন্যাসের সুবাদে। আর দুজনেরই একাগ্র দৃষ্টি সেই বিরাট মেলার মাঠের দিকে যেখানে ফি-বছর চলে হাজারো প্রাণের মেলবন্ধন।
আনন্দবাজারের লেখাটি পড়েছিলাম। এটির তথ্যভূমি আরও বিস্তৃত, আরোও জটিল। ভালো লাগল।
'উদ্ধারণপুরের ঘাট' উপন্যাসটি যদি না পড়ে থাকেন,তাহলে অবশ্যই একবার পড়ে নিতে অনুরোধ করছি আপনাকে। অন্য রকম স্বাদ পাবেন।