‘এই ভাবে তিনি জুতোর মধ্যে লুকোনো ছোরাটা এক ঝটকায় বার করে বাঘটার পেটে ঢুকিয়ে দিলেন।’ উত্তেজিত ভদ্রলোকের ছোরা-চালানো ডানহাতের ঝটকা থেকে বিয়ারের গ্লাসটাকে কোনোক্রমে সামলে লক্ষ করি, ভদ্রলোক কেবল দক্ষিণ কলকাতার একটি রেস্তোরাঁর নামজাদা শেফ ও মালিকই নন, জমাটি গপ্পোকারও বটে। আমি সে রেস্তোরাঁয় হাজির হয়েছিলাম এক সন্ধ্যায় বাকরখানি, বা উচ্চারণভেদে বাখরখানির খোঁজে। আর তার জেরেই এই রোমহর্ষক গল্প। বাঘটাকে যিনি ছোরা ভুঁসিয়ে মারলেন তাঁর নাম নাকি আগা বাকরখান। তিনি নাকি ছিলেন বাংলার নবাব মুরশিদ কুলি খাঁয়ের সেনাবাহিনীতে এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ কমান্ডার। কিন্তু আরামবাগের এক নর্তকী খানি বেগমের প্রেমে পড়ে নবাবকে ভয়ংকর চটিয়ে ছিলেন। গপ্পের উত্তেজনার ওঠা-নামার সঙ্গে স্বরগ্রামটাকে মডিউলেট করে শোনাতে থাকলেন শেফ-সাহেব, ক্রুদ্ধ মুরশিদ কুলি বাকরখানকে বাঘের খাঁচায় বন্দি এবং খানি বেগমকে হত্যার হুকুম দিয়েছিলেন। বাঘ হত্যা করে, খাঁচার তালা ভেঙে, পাহারাদারদের পরাস্ত করে প্রিয়তমাকে রক্ষা করতে ছুটলেন বাকরখান, কিন্তু হায়…
এ হেন করুণ প্রেম-কাহিনির রক্তে-অশ্রুতেই নাকি মাখা হয়েছিল প্রথম বাকরখানি রুটির ময়দা! প্রিয়াকে প্রাণে বাঁচাতে না পেরে নিজের ও প্রিয়তমার নাম পরতের পর পরতে জড়িয়ে তাড়িয়ে আগা বাকরখান প্রথম বাকরখানি তৈয়ার করিয়ে অমর করে দিয়ে গিয়েছিলেন বাকর-খানিরপ্রেম! নেট ঘাঁটলে দেখা যাবে এ কাহিনিটা খুব চলে, যদিও তার কোনো উৎস খুঁজে পাইনি। এ কাহিনির পর যা পরিবেশিত হল, তা মিষ্টি মিষ্টি বেশ দিব্যি খেতে, যদিও আমি বাকরখানির যে পরম্পরাগত রেসিপি পেয়েছি, তার থেকে অনেকটাই দূরে মনে হয়েছে। কাহিনিটাও আমার উচিত ছিল বিয়ারের সংগত হিসেবে গলাধঃকরণ করে ফেলা। কিন্তু তা না করে আমি বোরিং ইতিহাসের সন-তারিখ মনে করতে করতে সন্ধ্যাটাকেই মাটি করলাম। করলাম এই কারণেই যে বাকরখানির খোঁজটা আমার দীর্ঘকালের। সেই যে কবে অনন্ত সিংহের ‘অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম’ বইতে পড়েছিলাম, মাস্টারদার অকুতোভয় শিষ্যা-শিষ্যদের চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের সময় তাঁদের সঙ্গে মজুত সামান্য খাদ্যের মধ্যে ছিল বাকরখানি রুটি। যে রুটি আমি প্রথম চেখেছিলাম গুয়াহাটির পানবাজারের মসজিদ সংলগ্ন বাজারে। সেই থেকে ভেবেই চলেছি, এ রুটির এমন নাম হল কোথা থেকে? তাই এই গপ্পের সন-তারিখ নিয়ে মাথাব্যথা।
মুরশিদ কুলি বাংলার নবাব ছিলেন ১৭১৭ থেকে ১৭২৭ সাধারণাব্দ পর্যন্ত। বাকরখানির উদ্ভব কি তবে সেই জমানাতেই? খোঁজ করে মুরশিদ কুলির জমানায় প্রেম করে খোদ নবাবের কোপ উদ্রেক করানো কোনো আগা বাকরের খোঁজ পেলাম না। প্রায় দেড় দশক পরে, আলিবর্দি খান যখন বাংলার নবাব, পেলাম এক আগা মহম্মদ বাকর মির্জ়ার খোঁজ। তিনি ছিলেন ওডিশার নায়েব-নাজিম রুস্তম জঙ্গ্ ওরফে দ্বিতীয় মুরশিদ কুলি খানের জামাই। হয়েছিলেন বরিশালের জমিদার। নবাবের বিরুদ্ধে নানা বিদ্রোহে জড়িয়ে বেদম চটিয়েছিলেন তাঁকে। শেষে ১৭৪২ সালের যুদ্ধে বাকর মির্জ়াকে জব্দ করেও তাঁকে উমেদপুর আর সালিমাবাদ জমিদারি উপহারও দিয়েছিলেন আলি বর্দি। আর এই আগা মহম্মদ বাকর মির্জ়াই পত্তন করেছিলেন বাকরগঞ্জ। মারা যান ১৭৫৪ সালে। তবে কি এই বাকরগঞ্জেই প্রথম তৈরি হয়েছিল বাকরখানি রুটি? অসম্ভব।
তা অসম্ভব করে দিল আমার হাতে চলে আসা একটি পরমাশ্চর্য বই। নুসখা-ই-শাহজাহানি। ১৯৫৬ সালে মাদ্রাজ গভার্নমেন্ট ওরিয়েন্টাল ম্যানুসক্রিপ্ট লাইব্রেরি প্রকাশ করেছিল এই বই। মুঘল বংশের শৌখিনতম বাদশা ছিলেন অ’লা আ়জাদ আবু’ল মুজ়ফ্ফর শাহাবুদ্দিন মহম্মদ খুররম শাহজাহান। তাঁর হেঁশেলে যেসব পদ তৈয়ার হত, তারই এক রেসিপি সংকলন এই ফারসি কেতাব। কেতাবের সম্পাদক, সৈয়দ মহম্মদ ফাজি়লুল্লাহ্ জানাচ্ছেন ভূমিকায়, ‘নুসখা-ই-শাহজাহানি বইটা হঠাৎই শুরু হয়, লেখকের নাম বা সংকলনের কোনো তারিখ ছাড়াই। তবে অবশ্যই একথা বলতে হবে যে, তার গোড়ার শব্দগুলি থেকে আমরা এ ধারণা করতেই পারি, এ কেতাব এমনই একজনের লেখা, বাদশাহি পাতে কী কী খানা পড়ত সেবিষয়ে যিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন।’ তিনি আরও জানান, ‘এই বই সম্পাদনার সময় দুটি পাণ্ডুলিপি দেখা হয়েছে—গভর্নমেন্ট ওরিয়েন্টাল ম্যানুসক্রিপ্ট লাইব্রেরির কপিটির (ডিনং ৫৬) তারিখ ১২৬৩ হিজরি… দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপির কপিটি আছে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে… দুটির টেক্সটই মোটামুটি এক। পার্থক্য এই যে, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিরটার শিরোনাম নুসখা-ই-শাহজাহানি নয়, নান-ও-নমক।’
এই কেতাবের যে রেসিপি তালিকা তার গোড়াতেই লেখা রয়েছে—‘দস্তুর-এ-পুখত্যান-এ-ইতমাহ্ ব্যার দ্যাহ্ কিস্ ম্ অ্যাস্ত্’। সুখাদ্য পাকের নির্দেশাবলি দশ কিসিমের। তারপরে আমরা যে ম-ম গন্ধের দুনিয়ায় প্রবেশ করি খাদ্যরসিকদের কাছে তা বেহেস্ত। আর সেই দশ কিসিমের গোড়াতেই লেখা—কিস্ ম্ অওয়ল দর ইস্ত’মাল-এ-নানহা! প্রথম কিসিম নান-আহার সংক্রান্ত। ১৬ কিসিমের নান রুটির তালিকায় চতুর্থটির নাম—নান-ই-বাকরখানি। শাহজাহানের ইন্তেকাল হয় ১৬৬৬ সালে। মুঘল বাদশাদের দস্তরখওয়ান—মানে যে কাপড় মাটিতে বিছিয়ে তার ওপর পরিবেশিত হত খানা—তা যে কী মহার্ঘ্য ছিল, আর কী যে সাংঘাতিক ছিল বাদশাহি হেঁশেলের এলেম তার কিছুটা ধারণা মেলে মহামতি আকবর বাদশার বন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী আবু’ল ফজলের মহাকেতাব আকবরনামা-র আইন-ই-আকবরি অংশের ‘বাদশাহি হেঁশেল’ অধ্যায়ে। যেমন, আকবর বাদশা খেতেন দিনে একবার, ছিলেন অতি স্বল্পাহারী, খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে অতি অনাগ্রহী—‘আজ কী খানা পরিবেশিত হবে? এ প্রশ্ন তাঁর জিহ্বা দিয়ে কদাচ উচ্চারিত হত না,’ জানাচ্ছেন আবু’ল ফজ়ল। এ হেন স্বল্পাহারী বাদশার জন্য প্রতিবার পরিবেশিত হত একশোটি পদ! বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শেফরা করতেন সে রান্না। নানাপ্রকারের চাল আসত ভরুচ, গোয়ালিয়র, রাজোরি নিমলা থেকে। সবজি কাশ্মীর থেকে। তরমুজ, নাসপাতি, আপেল সামারকন্দ থেকে। কঠোর তত্ত্বাবধানে পালিত হত ভেড়া, ছাগল, মুরগি, হাঁস—যাতে তাদের গায়ে চর্বি কম-বেশি না হয়ে যায়। খানা পরিবেশিত হত সোনা রুপো আর চিন থেকে আমদানি করা চিনামাটির পাত্রে। ইত্যাদি, ইত্যাদি। বোঝাতে চাইছি, এ ব্যবস্থায় আনাড়িদের কোনো জায়গা ছিল না। খাদ্য-বিলাসে বিমুখ মহামতি আকবরের হেঁশেলই যদি এমনতর হয়ে থাকে জাগতিক বিলাসের পরাকাষ্ঠা শাহজাহান বাদশার আমলে তার ব্যাপ্তি কী হয়ে থাকতে পারে অনুমেয়। মোট কথা, বহু বহুপরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই কোনো আহার বাদশার দস্তরখওয়ানের যোগ্য পরিগণিত হতে পারত। আর ১৬৬৬ সালের আগেই সে মহা ইমতেহানে পাস করে গিয়েছিল বাকরখানি। শাহজাহানের জমানায়। আকবরের জমানায় কিন্তু নয়। কারণ আইন-এ ‘রুটি’ নিয়ে ছোট্ট অনুচ্ছেদে নুসখা-য় উল্লিখিত বাকরখানির রেসিপির মতো একই সামগ্রী—ময়দা, ঘি, দুধ, ডিম, নুন—দিয়ে তৈয়ার ‘বড়ো বড়ো’ রুটি এবং ‘পাতলা পাতলা’ ‘চাপাতি’-র কথা আছে বটে, বাকরখানি নেই। কাজেই ষোড়শ শতকে বাকরখানি নেই।
এর আগের জমানার ভারতীয় নবাব-বাদশাদের যে মোক্ষম রন্ধনপ্রণালীর সংকলনটি মেলে সেটির নাম ‘নি’মতনামা’। ১৪৯৫ থেকে ১৫০৫ সাধারণাব্দের মধ্যে সংকলিত বলে ধরা হয়। মালোয়া রাজ্যের সুলতান ঘিয়াসউদ্দিন শাহের (রাজত্বকাল ১৪৬৯-১৫০০) এবং তাঁর পুত্র নাসেরউদ্দিন শাহের হেঁশেলের কারবারের কথা। এ পাণ্ডুলিপি এক সম্পদ৷ সম্পদ বিভিন্ন কারণে৷ তার ভাষার জন্য—এক্কেবারে প্রথম যুগের উর্দুর অনবদ্য নিদর্শন৷ ইরানের শিরাজ় ‘তুর্কমানি’ ঘরানায় আঁকা তার ৫০ টি অমূল্য মিনিয়েচার অলংকরণের জন্য৷ আর রেসিপিগুলির জন্যে তো বটেই৷ এখানে যেমন আজগুবি রান্নার বর্ণনা আছে তেমনটা আর জিন্দেগিতে পড়িনি কোথাও। যেমন, কাকের ঘিলু আর সোনার পাত দিয়ে রান্না করা ‘বাঘড়া’-র রেসিপি। এতে আছে হরেক কিসিমের নান-পুরি-চাপাতি-ভাত (হ্যাঁ ‘ভাত’ নামেই’)-সামোসা-ডালের রেসিপি। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি বাকরখানি নেই।
শাহজাহানের জমানাতেই আমি অন্তত প্রথম বাকরখানির মোটামুটি প্রামাণ্য রেসিপি পাচ্ছি। নুসখা-ই-শাহজাহানি-র ১২৬৩ হিজরি অর্থাৎ ১৮৪৬ সাধারণাব্দের একটি অনুলিপি বা কপি থেকে। মনে রাখা দরকার, এটি মধ্যযুগীয় বা প্রাচীন পুথির ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক। মূল কেতাবটি যুগে যুগে বিভিন্ন গ্রন্থাগারের জন্য কপি করা হত, এবং প্রায়শই প্রথম কপিটি হারিয়ে যেত। তাই আজকের দক্ষ সম্পাদককে তার বিভিন্ন কপি অনুসরণ করে একটি গ্রহণযোগ্য রূপ তৈরি করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিন্তু তাতে তো নামের উৎসের ধাঁধার সমাধান হল না। ময়দা, দুধ, ঘি, ডিম দিয়ে তৈয়ার এ রুটির নাম বাকরখানি কেন?
এটার আন্দাজ পেতে হলে মধ্যযুগীয় ভারতে খানা-খাজানা নিয়ে বাদশাহি-নবাবি-সুলতানি আমির উমরা উজির নাজিরদের মহলে কী কাণ্ডটা চলত তার একটা আন্দাজ পাওয়া দরকার। আর তা পেতে পারি আমরা অওধ পাড়ি দিয়ে। লখনউ। ১৮-১৯ শতকের লখনউ। ওলটাতে হবে আব্দুল হালিম শরর-এর অনবদ্য স্মৃতিকথা ‘গুজিস্তা লখনও’। সে কেতাবের পাতায় আমরা দেখব— পেটভরানোটা নবাব-বাদশাদের মহলে খানাদানার একটি অতি নগণ্য কাজ ছিল। রক্ত না ঝরিয়ে একে অপরকে চরম অপদস্থ করার হাতিয়ার ছিল খাদ্য। আজকের বুর্জোয়া প্রতিযোগিতার দিনকালে অবিশ্বাস্য ঠেকে সে সামন্ততান্ত্রিক বিলাসিতার খানা-ছোড়াছুড়ি! শররের একটি কাহিনি এরকম—‘আমি শুনেছি দিল্লির মির্জ়া খুররম বখ্ত-এর পুত্র রাজকুমার মির্জ়া আসমান কদরকে… একবার ওয়াজিদ আলি শাহ্ আহারে নিমন্ত্রণ করেন। দস্তরখওয়ানে পরিবেশিত হল দারুণ উপাদেয়, হালকা মোরব্বা। আসমান কদর তা চেখেই ধন্দে পড়ে গেলেন, কারণ মোরব্বা তো নয়, সে তো ছিল কোর্মা, যা পাচক রেঁধেছিলেন এমন ভাবে যাতে দেখতে ঠিক মোরব্বার মতো হয়। ভারী অপদস্থ হলেন তিনি। দিল্লির এক সম্মানীয় খানা-সমঝদারকে ধাঁধায় ফেলে খুব খুশি হয়েছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ্। কয়েকদিন পরে মির্জ়া আসমান কদর খেতে আমন্ত্রণ জানালেন ওয়াজিদ আলি শাহ্-কে।… আসমান কদরের পাচক শেখ হুসেন আলি দস্তরখওয়ান ভরে দিলেন শত শত সুখাদ্যে। পুলাও, জ়র্দা, কোর্মা, কাবাব, বিরিয়ানি, চাপাতি, চাটনি, আচার, পরঠা, শিরমাল—হরেক কিসিমের খাদ্য। চাখতে গিয়ে দেখা গেল সবই চিনির তৈরি। চিনির তরকারি, চিনির ভাত, চিনির আচার, চিনির রুটি। শুনেছি থালা, দস্তরখওয়ান, হাত ধোয়ার বাটি, পেয়ালা সবই ছিল চিনির তৈরি। ওয়াজিদ আলি যতই সব চাখছেন ততই অপদস্থ হয়ে পড়ছেন।’
এ হেন সংস্কৃতিতে দস্তুর ছিল কোনো কোনো বিশেষ খানা কোনো বিশেষ ব্যক্তির হেঁশেলে সেরা রান্না হলে, তার উপর সে ব্যক্তির নামের ছাপ ফেলে দেওয়া। যেমন আমরা নুসখা-ই-শাহজাহানি-তে পেয়ে যাই ইয়াখনি পুলাও শাহজাহানি, কাবুলি ইসলামখানি পুলাও, মুহব্বতখানি পুলাও ইত্যাদি। প্রশ্ন হল তবে কি বাকরখান নামে শাহজাহানের জমানায় কেউকেটা কোনো ব্যক্তি ছিলেন? ছিলেন বইকি। জাহাঙ্গির বাদশার ভায়রাভাই ছিলেন বাকরখান, বা উচ্চারণভেদে বাকিরখান। শাহজাহানের দরবারেও অত্যন্ত গুরুত্ব ছিল তাঁর। জীবনের বিভিন্ন সময়ে আগ্রা, মুলতান, অওধ, ওডিশা, গুজরাট, এলাহাবাদে কমান্ডার বা গভর্নর ছিলেন এই বাকরখান। এমনকি ‘শাহজাহান অ্যালবাম’-এ তাঁর প্রতিকৃতি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন এই বাকরখান (সঙ্গের ছবি)।
মুঘল মিনিয়েচার চিত্রশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পঞ্চাশটি ছবির এই অ্যালবাম সংকলনের হুকুম দেন জাহাঙ্গির স্বয়ং, পরে তাতে আরও ছবি যুক্ত করেন শাহজাহান এবং শেষে তা যায় অওরঙ্গজেবের জিম্মায়। হ্যাঁ, এলেম ছিল এই বাকরখানের। কিন্তু তাঁরই হেঁশেলের আঁচেই কি প্রথম সেঁকা হয়েছিল বাকরখানি? তেমন কোনো প্রমাণ আমি পাইনি, তবু যদি বাজি রাখতেই হয়, তাঁর নামেই বাকরখানির বাজি রাখব আমি। ভালো কথা, উর্দু বা ফারসিতে যত জায়গায় এ রুটির নামটা পেয়েছি, সর্বত্র বাকর ও খানি দুটি পৃথক শব্দ, বাকর খানের মতোই। বাংলায় জুড়ে গিয়েছে কোনো কারণে।
শাহজাহানের হেঁসেল থেকেই সম্ভবত বাকরখানি লখনউতেও হাজির হয়েছিল। কেন এমনটা ভাবছি তার আন্দাজ শররের ওই কাহিনি থেকেই কিছুটা মিলতে পারে—দিল্লি থেকে উজিরনাজিরদের অওধ পাড়ি দিয়ে খানাদানা নিয়ে স্থানীয় নবাবি মহলে বড়ফট্টাই করা যে দস্তুর ছিল তা তো আমরা আসমান কদ্র আর ওয়াজিদ আলির খানা-ছোড়াছুড়ির কাহিনিতেই দেখেছি। কিন্তু ঊনবিংশ শতকের শেষ আর বিংশ শতকের গোড়ায় এসে লখনউয়ের বাকরখানি কী স্বাদ পেয়েছিল। তা জানতে আমাদের আর-একটা দুষ্প্রাপ্য বইয়ের পাতা ওলটাতে হবে—মির্জ়া জফর হুসেনের অনবদ্য খাদ্যস্মৃতিকথা—‘লখনও কা দস্তরখওয়ান’ (উত্তরপ্রদেশ উর্দু অ্যাকাডেমি, ১৯৮০), যা ২০১৬ সালে অনুদিত হয়েছে The Classic Cuisine of Lucknow: A Food Memoir নামে (Sanatkada Publications)। লখনউয়ের খানাদানা নিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি বই আছে, যার অধিকাংশই গোলমেলে গোঁজামিলে ভরা বলে মনে হয়েছে আমার। হুসেন সাহেবের এই স্মৃতিকথা সে গোত্রের নয়। কেন নয়, তা বুঝতে হলে তাঁর বংশপরিচয় একটু দেওয়া দরকার। হুসেন সাহেবের জন্ম ১৮৯৯ সালে ফয়জ়াবাদে। মারা যান ১৯৮৯-এ। বাবার দিকে তিনি ছিলেন নবাব মির্জ়া তফজ্জুল হুসেন খানের বংশধর। তফজ্জুল হুসেন লখনউয়ের নবাব শুজা উদ্-দওলার জমানায়— ১৭৫৩ থেকে ১৭৭৫ — দিল্লি ছেড়ে লখনউ পাড়ি দেন। হুসেন সাহেবের বাবা নবাব মির্জ়া দিলাওয়র হুসেন খান বিয়ে করেছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহের হাকিম অফজ়ল আলি হাকিম শিফাউদ্দওলার কন্যা আহমদি বেগমকে। কাজেই বাপ-মা দু-দিক দিয়েই হুসেন সাহেবের সরাসরি পূর্বপুরুষরা ছিলেন লখনউয়ের নবাবি মহলের অন্দরমহলের মানুষ। এই বইয়ে যা লেখা আছে তা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, এবং নিজেই জানিয়েছেন এ বইয়ের রেসিপিগুলি তাঁর তিরিশ বছরের গবেষণার ফসল। সব থেকে বড়ো কথা বইটি ঠিক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে লেখাও নয়। ১৯৭৭ সালে হুসেন সাহেব ‘আজকাল’ নামক পত্রিকায় লখনউই খানাদানা নিয়ে একটি লেখা লেখেন। সে লেখা পড়ে স্থানীয় বিদ্বৎমহল তাঁকে দিয়ে প্রায় জোর করে এ বই লেখান, এমন অমূল্য ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার আগে নথিবদ্ধ করে ফেলার তাগিদে। বহু বই লিখেছেন তিনি, যার মধ্যে অন্যতম ‘কদিম লখনওকি আখরি বহার’ (প্রাচীন লখনউয়ের শেষ বসন্ত)। সেই নিরিখে শররের যোগ্য উত্তরসূরি হুসেন। তাঁর বইয়ের ১১ নম্বর অধ্যায়ে ৬ নম্বর অনুচ্ছেদের নাম ‘বাকরখানি’। এই বাকরখানির বিষয়ে হুসেন সাহেবের গোড়ার মন্তব্যগুলি হুবহু তুলে দিলাম, ‘একটা বিষয়ে বাকরখানির প্রশংসা করে করে শেষ হয় না তা হল, শিরমাল শুরু হওয়ার পরেও বাকরখানির জন্য টান একটুও কমেনি এবং রইসদের দস্তরখওয়াঁ আর আমজনতার ভোজ উভয়েতেই তা পরিবেশিত হতে থাকল। রুটির এই ধরনটা যেমন উপাদেয় ছিল তেমনই সহজপাচ্য। মোটামুটি পনেরো-বিশ বছর পর্যন্ত নান-বানানেওয়ালারা খুব ভালো বাকরখানি বানত, কিন্তু ঘরে তৈরি বাকরখানি বহু আগেই উঠে গিয়েছিল। শিরমালের থেকে এর স্বাদ ভিন্ন হত, আর মিলত কম খরচে।’ (লখনও কা দস্তরখওয়াঁ, পৃ ১৯৪) এখন এই যে হুসেন সাহেব বলছেন ‘পনের-বিশ বছর পর্যন্ত’, এর অর্থটা ঠিক পরিষ্কার নয়। তাঁর পনের বিশ বছর বয়স পর্যন্ত? যদি তাই হয়, তাহলে যা বুঝতে পারছি বিংশ শতকের গোড়াতেই খাস বাকরখানি লখনউ থেকে উঠে গিয়েছিল। কেমন ছিল সেই খাস লখনউই বাকরখানি? হুসেন সাহেবের রন্ধনপ্রণালীর বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, নুসখা-র প্রকরণের খুব কাছাকাছি। আর তিনি একেবারে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, বাকরখানির ময়দায় ইস্ট কদাচ নয়।
খানাদানার খানদানি আদানপ্রদানের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে নিজ়ামি হেঁশেলে থেকে ছড়িয়ে পড়া হায়দরাবাদের ডাকসাইটে খাদ্যসংস্কৃতির সঙ্গে লখনউয়ের একটা গূঢ় যোগাযোগ ছিল। ১৮৫৬-তে ওয়াজিদ আলি শাহের কলকাতা-সংলগ্ন মেটিয়াবুরুজ নির্বাসনের সঙ্গে সঙ্গে অওধি জেল্লার পিদিম নিভে যায়, আর অমনি হরেক নবাবি হাভেলি থেকে পাচকরা ভাগ্যাণ্বেষণে পাড়ি দিতে থাকেন আসফজাহি দুনিয়ায়। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরাজের সঙ্গে রফা করে নিজ়ামি রমরমা তখন তুঙ্গে। ১৮৬৯ সালে তখ্ত-এ আসীন ষষ্ঠ নিজ়ামের প্রাসাদের একটা অংশ তৈরি করা হয়েছিল শুধু জামা-কাপড় রাখার জন্য, এক পোশাক দু-বার পরতেন না। আর ১৯১১ সালে সিংহাসনে বসা শেষ নিজাম মীর ওসমান আলি খান ছিলেন তাঁর জমানায় বিশ্বের সব থেকে ধনী ব্যক্তি। কাজেই ১৮৫৬-৫৭ থেকে ১৯৪৮, এই মোটামুটি একশো বছরে হেঁসেলের শান-ও-শওকতের হিসেবে নিজ়ামশাহি-র ধারে কাছে কেউ ছিল বলে মনে হয় না। কিস্সা আছে লর্ড কার্জন একবার নিজ়ামের অতিথি হয়ে আসায় তাঁকে প্রাতরাশে দেওয়া হয়েছিল ১০০-র ওপর পদ। তিনি কড়া ইংরেজ গলায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ব্রিটিশ ব্রেকফাস্টটুকু ছাড়া আর তিনি কিছুই ছোঁবেন না, মানে স্রেফ ডিম পাঁওরুটি! আর কিস্সা আছে নিজ়ামি হেঁসেলের পাকপ্রণালী যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা হত। শেষ নিজ়াম ওসমান আলি খানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মীর ইউসুফ আলি খান সালারজং তৃতীয়। তাঁর ভাইঝি কুয়াঁর রানি কুলসুম বেগম ২০১২ সালে মুম্বই মিরর পত্রিকাকে সাফ জানিয়েছেন খানদানের সরাসরি ‘দুলহন রানিদেরই’ একমাত্র হেঁসেলে প্রবেশাধিকার ছিল, যাঁরা পরিবার ছেড়ে অন্য খানদানে চলে যেতেন তাঁদের নয়।[i] নিজেদের হেঁশেল সামলে রাখলেও হায়দরাবাদের যে খানা-ঘরানা, তা কিন্তু হরেক রন্ধন সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। আর সে সংমিশ্রণ ঘটাতেন অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা ডাকসাইটে পাচকরা। শরর তাঁর গুজ়িশ্তা লখনও-তেই জানাচ্ছেন যে ‘লখনওয়ের ডাকসাইটে পাচক পীর আলিকে নিযুক্ত করা হয়েছিল নিজ়ামদের হেঁশেলে।’ এই পীর আলি খাবার তৈরির অছিলায় কী কাণ্ড ঘটাতেন তারও একটা ছোট্ট বর্ণনা দিয়েছেন শরর। নিজ়ামদের সরকারি ভোজে মাঝে সাঝেএক বিপুলাকার ‘পাই’ পরিবেশিত হত। সে পাইয়ের ঢাকনা খোলা মাত্র ভিতর থেকে উড়ে যেত একঝাঁক ছোটো ছোটো পাখি। তাই না দেখে আমন্ত্রিত ইংরেজ সাহেব-মেমদের সে কী খিল্লি! এই পাই রাঁধতেন ‘সম্ভবত পীর আলি’। আর পীর আলি হয়দরাবাদে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘সুলতানি ডাল’, যেমন মহার্ঘ্য তেমনি উপাদেয়। এইভাবেই বাকরখানিও লখনউ থেকে হায়দরাবাদের নিজামি খানদানে পাড়ি দিয়েছিল অনুমান করা কঠিন কী?
এ হেন খানদানের হরেক রেসিপি কিছুকাল আগে ফাঁস করে দিয়েছিল হায়দরাবাদের সিয়াসত প্রকাশক, উর্দু আর ইংরেজিতে একটা বই ছেপে।[ii] এ বইয়ের উর্দু অনুবাদ করেছেন হায়দারাবাদের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী আল্লামা এইজাজ় ফরুখ। তিনি ভূমিকায় জানিয়েছেন, এই কেতাব যে মূল পাণ্ডুলিপি থেকে তরজমা করা হয়েছে তা, ‘মিশ্র ভাষায় লিখিত, যাতে বিভিন্ন উপকরণের নাম রয়েছে গ্রিক, আরবি এবং ফারসিতে’। এ পাণ্ডুলিপি ষষ্ঠ নিজ়াম মীর মেহবুব আলি খানের জমানার। অর্থাৎ ১৮৬৬ থেকে ১৯১১-র মধ্যে। বহু কষ্টে এই বইটির হদিশ মিলল হায়দরাবাদের সালারজং জাদুঘরের গ্রন্থাগারে। লাইব্রেরিয়ান সোমা ঘোষের সাহায্যে দেখতে পেলাম যা-যা আমার দরকার। বইয়ের ৩১ পৃষ্ঠার শিরোনাম—নান-ই-বাকরখানি। লখনউ দিল্লির সঙ্গে মিল যথেষ্টই, কেবল দুটো তফাত, এখানে পরিষ্কার বলা হচ্ছে ময়দার লেচি বেলুনি দিয়ে বেলা যায়, হাতে ঘি মাখিয়ে চাপাতি তৈরির দরকার নেই। আর এই রেসিপি সংকলনেই একমাত্র আমি পেয়েছি বাকরখানিতে জাফরান আর কাঠবাদাম দেওয়ার কথা। কাজেই বাকরখানি যা কিনা লখনউতে আম আদমির ভোজের পাতেও দিব্যি পড়ত, হায়দরাবাদে এসে নিজেকে রাজপ্রাসাদে বন্দি করে ফেলল! ইতিহাস তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কিন্তু কাগজ-কলম কিংবা ‘gouache with gold on paper’-এ আঁকা ছবিই তো ইতিহাসের একমাত্র উপাদান নয়। নয় বলেই মাঝসপ্তাহে বন্ধুবর দীপঙ্কর দাশগুপ্তর ফোন পেলে মনটা নেচে ওঠে। জানি, নির্ঘাত কোনো নয়া হদিশ মিলেছে। ছুটেছিলাম এক শীতের ভোরে। বাকরখানির খোঁজে। হ্যাঁ, ভোরেই। কারণ বেলা দশটা গড়ালে আর তা নাও মিলতে পারে। সোজা মোমিনপুর। ক্যালকাটা হসিপটালের গেটের ঠিক উলটো দিকের গলি দিয়ে ঢুকে ছোটি বাজার। আর সেখানে পৌঁছে খোঁজ করতেই চিনিয়ে দিলেন সকলে—একটু এগিয়ে ডানদিকে ঘুরে বাঁহাতে, কে আলি বেকারি। ফুট পাঁচেক বাই ফুট চারেক সে দোকান। হরেক কিসিমের পাঁউরুটি আর বিস্কুটের জারের মাঝখানে একঝুড়ি তাজা বাকরখানি নিয়ে বসে আছেন মালিক। ‘সাইনবোর্ডটা অনেকদিন হল ঝড়ে ভেঙে গেছে। আর লাগানো হয়নি’ জানালেন মুজিবুর রহমান। আর বলেছিলেন রহমান সাহাব, ‘ময়দার গোট থেকে এ রুটি তৈয়ার করতে হবে তক্তার ওপর রেখে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। চাকি-বেলুনি ব্যবহার করা যাবে না!’ মনে পড়ে গেল মোমিনপুর থেকে মেটিয়াবুরুজের দূরত্ব সামান্যই, যে মেটিয়াবুরুজে নির্বাসিত ওয়াজিদ আলি শাহের সঙ্গে এসেছিল ডাকসাইটে রকাবদারেরাও, মানে বাওর্চিদের মধ্যেও খাসবাওর্চিরা। অবিশ্যি দিল্লি থেকে মুরশিদাবাদ হয়েও যদি বাকরখানি নাদান কলকাতা শহরে পাড়ি দিয়ে থাকে তাহলেও তা হাতে চেপে বানানোই, বেলুনিতে বেলা নয়। মোদ্দা হায়দরাবাদি হেঁশেল নয়, বরং অওধের নবাবি কিংবা দিল্লির বাদশাহি দস্তরখওয়ান থেকেই বাকরখানির কলকাতা সফর বলে মনে হয়। আর সে সফরের শেষে অন্তত আমাদের এই মোমিনপুরি বাকরখানি যেন বাকি জাঁকজমকের থেকে বহু বহু দূরে সরে গিয়েছিল তামুজিবুর রহমানের কথাতেই মালুম হল— ‘বাকরখানির ময়দা মাখতে হবে পানি দিয়ে। দুধ, ডিম, কলা দিয়ে মাখা হয় শিরমালের ময়দা!’ বাকরখানির মোক্ষম কলকাত্তাই ‘ডিক্লাস্ড’ হওয়া!
মুজিবুর রহমানের বাবা কওসর আলি এ বেকারি প্রথম খোলেন। ‘একশো বছর আগে,’ দাবি করলেন মুজিবুর সাহাব। খতিয়ে হিসেব করে পেলাম পঞ্চাশ বা ষাট বছর চলছে এ গুমটি। কোনো জাঁকজমক নেই, এক চিলতে এক গলতায় সে কী ভিড়! আর তা থেকেই ২ টাকায় একটি হাতেগরম শ্রেণিচ্যুত বাকরখানি কিনে ঠোঙায় ফুঁ দিতে দিতে খেয়ে যে আহ্লাদিত হয়েছিলাম, তাতে বাকরখানির ইতিহাসের কচকচি কোথায় তলিয়ে গিয়েছিল!
আর সেই বাকরখানি চেখে আমার পঁচাত্তর বর্ষীয়া ঢাকাই বংশোদ্ভূত মা মন্তব্য করেছিলেন—‘খেতে ভালো, কিন্তু সত্তর বছর আগে কাচের বাক্সে বাক্সে বিক্রি হওয়া যে ‘ঢাকাই বাকরখানি’ খেতাম তার স্বাদই আলাদা!’ বাকরখানির এ কিস্সা আমার মুখে শুনে, একদিন সস্নেহে শঙ্খ ঘোষ আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ঢাকাই বাকরখানি খেয়েছ কখনও? না। সেদিন তাঁর বাড়িতে বসেই প্রথম চাখলাম ঢাকাই বাকরখানি! ঢাকা থেকে কোনো অতিথি নিয়ে এসেছেন তাঁর জন্য। সে যে কী হতাশা! মাঝারি মাপের পাতলা বিস্কুটের মতো দুটো চাকতি। এটাই ঢাকাই বাকরখানি? মনের ভাব চেপে রাখায় আমার মতো অপটু আর হয় না। স্বভাবসিদ্ধ নীরবতার সঙ্গে সেদিন স্যারের বুক থেকে উঠে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস আমার নজর এড়ায়নি। একটা সংস্কৃতি, একটা সময়, একটা শৈশব হারিয়ে ফেলার দীর্ঘশ্বাস সে। সেদিনই ঠিক করেছিলাম, ঢাকার আসল বাকরখানি খুঁজতে আমাকে সে শহরে ছুটতেই হবে। আজও হল না। আর সেদিনই এক নবীনা সাংবাদিক ঢাকা থেকে এসেছিলেন কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন তাঁকে। তারপর কথায় কথায় আমাকে বললেন, ফিরে গিয়েই আমাকে পাঠাবেন ‘আসল’ ঢাকাই বাখরখানির হদিশ, এমনকি রেসিপিও। অনেকবার যোগাযোগ করেছি, কথা রাখেননি। কিন্তু খোঁজটা জারি আছে।
মুঘল বাদশার দস্তরখওয়ান থেকে, লখনউয়ের নবাব, হায়দরাবাদের নিজামের হেঁশেল হয়ে মোমিনপুরি গলির ঠোঙা পর্যন্ত বিস্তৃত বাকরখানি নিয়ে শেষ কথা বলার কে স্পর্ধা রাখে? না জানি আরও কত পরত পড়বে এ বাকরখানি কিস্সায়!
~~~~
দিল্লি
রেসিপিটি শাহজাহানের বাদশাহি হেঁসেলের রেসিপি সংকলন হিসেবে পরিচিত নুসখা-ই-শাহজাহানি থেকে নেওয়া। লেখক অজ্ঞাত।
ময়দা — এক কেজি[iii]
ঘি — ২৫০ গ্রাম
গোরুর দুধ — ২৫০ গ্রাম
মুরগির ডিম — ১টা
নুন — ২০ গ্রাম / স্বাদমতো
ময়দায় নুন মিশিয়ে নিন। একটু একটু করে কাঁচা দুধ ঢালুন আর ময়দা মাখতে থাকুন। ময়দাকে সামোসার মাপে এক মুঠো লেচি করুন। গোল গোল করে প্যাঁচ দিন। যতক্ষণ না ময়দার গায়ে বুড়বুড়ি ফুটে ওঠে। একটা কাপড়ে পেঁচিয়ে ঘণ্টাখানেক রেখে দিন।[iv] এরপর ঘি গরম করুন এবং ঠান্ডা করে নিন। ময়দায় মাখান। ঢাকা দিয়ে রেখে দিন। কিছুক্ষণ পর হাতের তালুতে ঘি মাখিয়ে হাতে চেপে চেপে পাঁচটা চাপাতি বানান। চাপাতিগুলোর নীচের পিঠে ঘি মাখান। তারপর আটা মাখার পাত্রের নীচে রেখে দিন। এরপর মায়দার গুঁড়ো পাঁচটা চাপাতির গায়েই মাখিয়ে আবার আটা মাখার পাত্রের নীচে রেখে দিন। অল্প একটু পরেই পাত্রের ঢাকনা খুলে দিন। চাপাতি একটা মাহি তাওয়ায় (তামার কানা উঁচু ফ্রায়িংপ্যান) সেঁকে অর্ধেক রান্না করে নিন। এরপর দুধের মধ্যে ডিমের সাদাটা মিশিয়ে নিন। সেটা তাড়াতাড়ি (চাপাতিগুলোর ওপর) ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিন। (আঁচে) হালকা হাওয়া দিয়ে (চাপাতি) নরম রান্না হওয়ার লক্ষণ খেয়াল করুন।
~~~~
লখনউ
(রেসিপিটি মির্জ়া জফর হুসেন (১৮৯৯-১৯৮৯) রচিত ‘লখনওকা দস্তরখওয়াঁ’ বইটির ইংরেজি তরজমা ‘The Classic Cuisine of Lucknow: A Food Memoir থেকে নেওয়া।)
ময়দা: ১ শের[v]
দুধ: ১/২ শের
ঘি: ১/২ শের
নুন: ৬ মাশা
ডিম: ১টি
অল্প দুধে ডিমের সাদা অংশ মিশিয়ে ভালো করে ফেটিয়ে রেখে দিন। ময়দায় নুন মিশিয়ে নিন। দুধ দিয়ে ময়দা মেখে সরিয়ে রাখুন। কিছুক্ষণ পরে তাতে ঘি মেশান এবং ময়দাটা আবার ভালো করে মাখুন। ভালো করে মাখা মানে ময়দা সমস্ত ঘি টেনে নেবে। মাখা ময়দা দিয়ে চারটে গোল বাকরখানি তৈরি করুন। ধারালো ছুরির ডগা দিয়ে বাকরখানিগুলোর গায়ে আঁচড় কেটে দিন। খেয়াল রাখতে হবে যেন বাকরখানিতে ফুটো না হয়ে যায়। একটা মাহি তাওয়ায় অল্প ঘি মাখান। একটা বাকরখানি তাতে রেখে ঢাকা দিয়ে দিন। তাওয়ার তলায় কিছু এবং ঢাকনার ওপরে আর-একটু বেশি জ্বলন্ত কয়লা রাখুন। এইভাবে একটা একটা করে বাকরখানিগুলি মাহি তাওয়াতে শেঁকে নিন। শেঁকা প্রায় হয়ে এলে নামানোর আগে ডিম ফেটানো দুধ ছড়িয়ে দিন।
বাকরখানির ময়দায় ইস্ট মেশানো চলবে না।
~~~~
হায়দরাবাদ
এই রেসিপি ষষ্ঠ নিজাম মীর মেহবুব আলি খানের (১৮৬৬ – ১৯১১) হেঁসেলের রেসিপি সংকলন উর্দু ও ইংরেজিতে প্রকাশিত দ্বিভাষিক বই মুতবখ-এ-আসফিয়হ্ / Asafiya Cuisines থেকে নেওয়া। (সৌজন্য: সালারজং মিউজিয়াম, হায়দরাবাদ)
ময়দা: ১ কেজি
ঘি: ৪০০ গ্রাম
বালাই: ২০০ গ্রাম (দুধ ক্রমাগত ফুটিয়ে ওপরের আস্তরণ পরতে পরতে রেখে তৈরি করা হয় বিশেষত লখনওতে। ক্রিম বলা যায়, কিন্তু আজকে বাজারে যে Sour Cream পাওয়া যায় তা নয়)।
জাফরান: ২ গ্রাম
দুধ: ২০০ গ্রাম
নুন ২৫ গ্রাম
ছোটোএলাচ: ৬ গ্রাম
কাঠবাদাম (বাটা): ১০০ গ্রাম
দুধ গরম করে ঠান্ডা করে নিন। দুধ আর ঠান্ডা জল দিয়ে ময়দা মেখে নিন। মাখা ময়দায় বালাই মিশিয়ে আবার মেখে নিন। ২০০ গ্রাম মাপের চ্যাপটা প্যাঁড়ার মতো লেচি করে সেগুলি ভিজে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখুন। কিছু পরে লেচিগুলি একটার ওপর আর একটা রেখে ঘি মাখিয়ে বেলে নিন। এমন ভাবে বেলতে হবে যাতে সমস্ত ঘি ময়দা শুষে নেয়। আবার লেচি বানান। লেচিগুলি থেকে আলাদা আলাদা রুটি বেলে নিন। রুটিগুলোর ওপর দাগ কেটে দিন। কানা উঁচু তাওয়ায় রুটিগুলি রেখে বেশ গাঢ় করে জাফরান মাখিয়ে নিন। তাওয়া ঢাকা দিয়ে ওপরে ও নীচে জ্বলন্ত কয়লা রেখে দম দিন। সোনালি হয়ে গেলে পরিবেশন করুন।[vi]
~~~~
কলকাতা
মোমিনপুরের ছোট্ট কে আলি বেকারির রেসিপি।
ময়দা: ১ কেজি
ডালডা: ৫০০ গ্রাম
তেল: ২৫০ গ্রাম
জল: প্রয়োজনমতো
নুন: স্বাদমতো
চিনি: সামান্য
নুন, চিনি, ময়দা, তেল মিশিয়ে ময়দা মেখে একঘণ্টা রেখে দিন। ছোটো ছোটো ৩০ টি লেচি বানান। লেচিগুলো কাঠের তক্তার ওপর রেখে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোলরুটির মতো বানান। বেলুনি ব্যবহার করা যাবে না। পাতা দিয়ে ঢাকা দিয়ে সারারাত রেখে দিন। রাতে রুটিগুলো ফুলে উঠবে। ভোরবেলা ট্রেতে রুটিগুলো সাজিয়ে ভাটির আগুনে ট্রে সুদ্ধ ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। মিনিট পাঁচেক সেঁকে বার করে নিতে হবে।
--
[i][i]Culinary Secrets of Hyderabad’s 7th Nizam. Anjana Vaswani. Mumbai Mirror. October 7, 2012. সূত্র:
[ii]Asafiya Cuisines / Mutbaq-e-Asafiya. Ed. Zahid Ali Khan. Siasat. Hyderabad. India. 2013.
[iii]মূল টেক্সট-এ শের ও দাম ব্যবহৃত হয়েছে। আমি সামান্য রদবদল করেছি। শাহজাহানি শের = ৪০ দাম। একদাম = ২০.৯৯ গ্রাম। তাহলে একশের দাঁড়াচ্ছে — ৪০ X ২১ = ৮৪০ গ্রাম।)
[iv]মূল টেক্সট-এ ‘দুঘড়ি’ ব্যবহার করা হয়েছে। ভারতীয় সময়ের পরম্পরাগত মাপে এক ঘড়ি মানে ২৪ মিনিট
[v]ঊনবিংশ শতকের শেষের হিসেবে শের = ৯৩৩ গ্রাম। মানে মোটামুটি এককিলো গ্রাম। ১ মাশা = ০.৯৭ গ্রাম, অর্থাৎ প্রায় ১ গ্রাম।
[vi]লক্ষ করুন যে কাঠবাদাম বাটা ও এলাচ কীভাবে ব্যবহৃত হবে তা উল্লিখিত নেই। আমার ধারণা খুব অল্প দুধে জাফরান গুলে তার মধ্যে বাটা কাঠবাদাম ও এলাচবাটা মিশিয়ে সেই পেস্টটি রুটিগুলিতে মাখাতে হবে।
অনবদ্য! যেমন লেখার হাত তেমনি গবেষণার গভীরতা!
"এই পীর আলি খাবার তৈরির অছিলায় কী কাণ্ড ঘটাতেন তারও একটা ছোট্ট বর্ণনা দিয়েছেন শরর। নিজ়ামদের সরকারি ভোজে মাঝে সাঝেএক বিপুলাকার ‘পাই’ পরিবেশিত হত। সে পাইয়ের ঢাকনা খোলা মাত্র ভিতর থেকে উড়ে যেত একঝাঁক ছোটো ছোটো পাখি। ", সেই যে,
"Sing a song of sixpence,
A pocket full of rye.
Four and twenty blackbirds,
Baked in a pie.
When the pie was opened,
The birds began to sing,
Wasn't that a dainty dish,
To set before the king"
(১৭৮০ সাল) | পাইয়ের মধ্যে জীবন্ত পাখী পুরে রাখা ও সে পাখীকে পাই কাটলে উড়ে যাওয়া এক ধরণের entremet জাতীয় খাবার | মধ্যযুগে ইউরোপে জনপ্রিয় ছিল।
সুন্দর লেখা। যাকে বলে লেখনী। মুচমুচে নোনতা আবার মিষ্টিও। মিষ্টির কথায় মনে পড়লো ঢাকার একটু দূরে ধলেশ্বীর কাছাকাছি কলাতিয়া বাজারে দু ধরনের বাকরখানি হয়। একটা মিস্টি আরেকটা নোনতা। ও এখানে বলা হয় বাকরখানি।
আমাদের শহরে অর্থাৎ অসম এর ডিব্রুগড় এ এক জন হাইলাকান্দির মুসলমান কাকু ছিলেন !!তিনি এই বাখরখানি বানিয়ে বিক্রি করতেন ! তার স্বাদ এখনো নাকে মুখে লেগে আছে ! আমরা একটা আস্ত বাখরখানি কিনতাম না , আধ টুকরো বা ৪/১ ভাগ কিনতাম ।..বিক্রি হতো ! বাবা যখন কিনতেন পুরো টাই কিনতেন ! এসব স্মৃতি হয়ে আছে !!
দুর্দান্ত লেখাটা।
সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ঢাকাই বাখরখানির কথা। কাইল্যাজিরা চাউল, ঢাকাই বাহরকানি এইসব কোনোদিন চোখে দেখব কিনা জানি না।
বাকরখানির গুরুতর তত্ত্বতালাশ পড়ে ভাল লাগলো। ইতিহাস যাত্রা বাড়তি প্রাপ্তি।
মোমিনপুরের মতোই ঢাকাই বাকরখানি পুরনো ঢাকার চান খাঁর পুলসহ অন্যান্য অঞ্চলে অলিগলি, তস্য গলিতে পাবেন সকাল সকাল। ঢাকাইয়ারা অনেকেই সকাল-বিকালের জলখাবার সারেন বাকরখানিতে। সংগে থাকবে মাংসের তরকারি, আর মালাই চা। বাকরখানি মাত্রই স্বল্প নোনতা, তবে বাচ্চাদের জন্য বানানো হয় চিনি মাখিয়ে মিষ্টি করে।
কোভিড পিরিয়ডের পর আস্বাদ গ্রহণের জন্য লেখক নীলাঞ্জন বাবুর নিমন্ত্রণ রইলো। তবে রেসিপি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নাই।
কর্পোরেট যুগে ঢাকার বড় বড় কনফেকশনারিতে বাকরখানি মিলবে প্যাকেট ও বয়ামজাত, তবে তা পুরনো ঢাকার আদি বাকরখানির সংগে স্বাদে ও আকৃতিতে পার্থক্য আছে, সন্দেহ করি, এসব বাকরখানি মেশিন মেড, হ্যান্ড মেড নয়!