তৃতীয় ও শেষ পর্ব
নীলাঞ্জন হাজরা— এই পর্বে আমার প্রথম প্রশ্ন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে। সিপিআই(এম)-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় যে বিজেপি-কে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক শক্তিতে পশ্চিমবঙ্গে আটকে দিয়েছিল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সংখ্যাগুরু হিন্দুদের একটা বড়ো অংশের মধ্যে মুসলমান-বিদ্বেষের বিষটা রয়েই গিয়েছিল। মতাদর্শগত ভাবে, যেটা আপনি বলেছেন গত পর্বে, তা নির্মূল করার তেমন চেষ্টা হয়নি, বা করা যায়নি। নিজের চোখে দেখেছি, ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি কলকাতার অতি পশ সব এলাকায় মুসলমান বন্ধুরা দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বাড়ি ভাড়া পাচ্ছে না। কমিউনিস্টদের তখন পশ্চিমবঙ্গে প্রবল প্রতাপ। এখন বিজেপি সংসদে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় সে দলের বিধায়কের সংখ্যা ৭৭। এমতপরিস্থিতিতে সেই নষ্ট-না-করতে-পারা বীজ থেকে মহিরুহ দেখা দেবে এ আশঙ্কা তো প্রবল। আটকাবেন কীভাবে? কী করে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন আপনি?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য— এ রাজ্যে একটা ইতিহাস আছে—দেশভাগের ইতিহাস, ভিটে-মাটি ছেড়ে উঠে আসার, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস, আছে। এই স্মৃতিগুলো আছে। আরএসএস, বিজেপি বারবার সেই ঘা-টাকে খুঁচিয়ে দিতে চায়। এর বিরুদ্ধে, এই খুঁচিয়ে তোলার বিরুদ্ধে, এই মুহূর্তে আমাদের খুব বড়ো ভাবে প্রচার করা দরকার। প্রথম কথা হচ্ছে, ঠিক করতে হবে আমরা কী করতে চাই? অতীতে আমরা বিরাট ধাক্কা খেয়েছি— দেশ ভাগ হয়েছে, দাঙ্গা হয়েছে, প্রচুর মানুষ ভিটে-মাটি-ছাড়া হয়েছেন। আমরা কি সেইখানে ফিরে গিয়ে কোনো একটা স্কোর সেট্ল করতে, একটা হিসেবনিকেশ করে নিতে চাই? নাকি আমরা ওখান থেকে এগিয়ে যেতে চাই? আপনি সাধারণ ভাবে দেখবেন, অনেক মানুষের অনেক তিক্ত স্মৃতি আছে, কিন্তু আমরা এগিয়ে গিয়েছি। এটাই হচ্ছে জীবনের গতি। আমার মনে হয়, বিজেপি আমাদের আবার ঠেলে ওই জায়গাটায় নিয়ে যেতে চাইছে। আজকে যদি সেটা হয়— বলছে পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করে এক কোটি লোককে বের করে দেব। এক কোটি লোককে বের করে কোথায় পাঠাবে? যদি পাঁচ লক্ষ লোককেও বাংলাদেশে পাঠাতে হয় তাহলে তো আগে বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে…
নী. হা.— এগুলো তো অ্যাবসার্ড…
দী. ভ.— তার মানে হচ্ছে, গোটা পশ্চিমবঙ্গে এমন একটা স্থায়ী সামাজিক সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা, যে সোশাল কনফ্লিক্ট-টা কিন্তু আমার মনে হয়, ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ চান না।
নী. হা.— আপনার মনে হয় চান না?
দী. ভ.— চান না। তাঁদের মধ্যে প্রেজুডিস থাকতে পারে। তাঁদের অনেকের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি অনেক বিদ্বেষ থাকতে পারে, অনেক ভুল ধারণা থাকতে পারে। হয়তো তিনি পাশের বাড়িতে মুসলমান চান না, হয়তো তিনি বাড়ি ভাড়া দেবেন না, কিন্তু তিনি চান না যে পশ্চিমবাংলার চারদিকে সারাক্ষণ একটা অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়ে যাক। আমার মনে হয়, এই যে একটা নর্মাল শান্তির জায়গা আছে, বিজেপি সেটাকেও শেষ করে দেবে। বিজেপি মানে পার্মানেন্ট অশান্তি।
নী. হা.— আপনাকে একটু আটকাচ্ছি। আমাদের একটা জিনিস খুব স্পষ্ট করে খোলাখুলি বোঝা দরকার। এই যে ধরুন যিনি বিরোধী দলনেতা হলেন, তিনি নির্বাচনের সময় যে সাম্প্রদায়িক ভাষা ব্যবহার করেছেন, আমার কাছে অন্তত তা অকল্পনীয়। নির্বাচন কমিশন কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসেছিল। কিন্তু আমার কাছে তার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন আছে— আমার বাড়ি বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে, যে অঞ্চলে মুসলমান মানুষের সংখ্যা খুবই অল্প। সেইখানে, আমি দেখি আমারই বন্ধুস্থানীয়, বা আমারই মতন সাধারণ, মধ্যবিত্ত, পরিশ্রমের রোজগারে দিন গুজরান করা মানুষ— তাঁরা সমাজবিরোধী নন, অপরাধজগতের মানুষ নন, একেবারে সাধারণ মানুষ—আমার মতোই, হিন্দুধর্মাবলম্বী, তাঁদের অনেককেই আমি বলতে দেখি—সব ঠিক আছে, কিন্তু মুসলমানরা বড্ড বাড় বেড়েছে, এদের একটু টাইট দেওয়া দরকার। আমি যখন পালটা প্রশ্ন করি—তুই ক-জন মুসলমান মানুষের সঙ্গে মিশেছিস, তোর চারপাশে তো একজন মুসলমানও নেই… তো দেখি একটা অদ্ভুত ভীতি। মানে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে চলে—সারাক্ষণ একটা ভয়, একটা শত্রুপক্ষ তৈরি করে রাখা সংখ্যাগুরু শ্বেতাঙ্গ মানুষের মনে, হলিউডের যেটা একটা কাজ—কখনও কৃষ্ণাঙ্গ, কখনও কমিউনিজম, এখন ‘জেহাদি মুসলমান’—তারই একটা যেন আদল কিন্তু এই পশ্চিমবঙ্গেও আমি দেখি। এটা আছে। আমার প্রশ্ন হল—এইটাকে কীভাবে উপড়ে ফেলা যাবে? তা না হলে তো…
দী. ভ.— সেটাই বলছিলাম, যে ঠিক করতে হবে আমরা কী চাই? মুসলমানদের টাইট দেওয়ার নামে সেইসব অশান্তির দিনে ফিরে গিয়ে চারপাশে একটা অশান্তির পরিবেশ তৈরি করে কি নিজেদেরই টাইট দিয়ে ফেলতে চান?
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমাদের এখানে দেশভাগের ফলে দাঙ্গা হয়েছে, ঠিকই, কিন্তু সেটাই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের একমাত্র ইতিহাস নয়— যে স্বাধীনতা আন্দোলনে আবার আরএসএস অংশই নেয়নি। আমার মনে হয়, এই যে বিজেপিকে রুখে দেওয়া গেল, তার কারণ মানুষের মনের মধ্যে কোথাও একটা সেই চেতনাটা আছে। যে, স্বাধীনতা আন্দোলনের ওই অধ্যায়টা, যেটাকে বিজেপি বারবার চেষ্টা করছে ডমিন্যান্ট হিসেবে তুলে ধরতে, সেটাই সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস নয়। আমার মনে হয়, একটা ইতিহাস বোধ তৈরি করাও দরকার। যাতে সামগ্রিক ইতিহাসের মধ্যে কোথায় কী হল তা আমরা দেখতে পাই, বুঝতে পারি। পশ্চিমবাংলার যে স্বাধীনতার আন্দোলনের ইতিহাসের ঐতিহ্য সেটা খুব জরুরি ব্যাপার এখানে।
আবার বাংলাদেশকে যদি দেখি—বাংলাদেশ আমাদের কী শিক্ষা দেয়? যে, ধর্ম দিয়ে একটা দেশ গড়া যায় না। সেই যে চেষ্টা হয়েছিল (পাকিস্তান তৈরির মাধ্যমে) সেটা কিন্তু ভেঙে গেল। এবার দেখবেন, এখানে অনেকের মধ্যে সেই দেশভাগ নিয়ে একটা তিক্ত স্মৃতি আছে, কিন্তু শুধু তাই নেই, বাংলাদেশের যে স্মৃতি তা নিয়ে একটা আবেগও আছে। বিজেপি শুধু ওই তিক্ততাটাকেই খুঁচিয়ে তুলতে চাইছে।
আমাদের লজিক্যালি ভাবতে হবে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টাটাকে যদি রুখতে হয়, কাউন্টার করতে হয়, তাহলে আমাদের হাতে কী কী হাতিয়ার রয়েছে। একটা হচ্ছে ক্লাস, শ্রেণি— আমি আগে কৃষক, আমি আগে শ্রমিক, তারপরে হিন্দু বা মুসলমান। এই ব্যাপারটা যদি আসে তাহলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ব্যাপারটা খানিকটা পিছন দিকে চলে যায়। এই কথাটা আমি বলছি অনেক অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে, শুধুমাত্র কোনো থিওরেটিকাল আশা থেকে বলছি না। এর দুটো উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। একটা হল, বিহারের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আমাদের অনেকেই প্রচুর ভোট পেয়েছেন— আমাদের যুবসংগঠনের যিনি সভাপতি তিনি প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছেন। তার কারণটা কী? কারণ হচ্ছে, আমাদের যাঁরা সমর্থক তাঁদের ভোট আমরা পেয়েছি, আরজেডি আমাদের সমর্থন করেছিল, সে দলের ভোটও আমরা পেলাম। এর বাইরেও, যাঁরা বিজেপি এবং জনতা দল (ইউনাইটেড)-কে সাধারণ ভাবে ভোট দিয়ে থাকেন জাত-পাত ইত্যাদি নানা পরম্পরাগত কারণে তাঁরাও আমাদের ভোট দিচ্ছেন। তাঁদের এই ভোট দেওয়ার কারণ, তাঁদের কাছে এবারে কর্মসংস্থান, সম্মানজনক বেতন, কাজের নিরাপত্তা এই ব্যাপারগুলো একটা বড়ো প্রশ্ন ছিল। ফলে বিহারে যেখানে এত জাতপাতের ভাগাভাগি তাকে অগ্রাহ্য করে যুবকেরা আমাদের ভোট দিলেন।
একই উদাহরণ চোখে পড়ছে কৃষক আন্দোলনে। ওই মুজ়ফ্ফরনগর শামলি অঞ্চলের কৃষকদের, যাঁরা শুধু বিজেপি-কে ভোটই দেননি ওখানের দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, তাঁরাও কিন্তু শুনছেন যখন খাপ পঞ্চায়েতের বড়ো মিটিংয়ে দাঁড়িয়ে মহিন্দর সিং টিকায়টের ঘনিষ্ট বন্ধু মহম্মদ জোলা বলছেন— তোমরা অনেক ভুল করেছ। তোমরা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করেছ। পিন-ড্রপ-সাইলেন্স। চাবুকের মতো কথাগুলো গিয়ে কিন্তু ধাক্কা দিচ্ছে। ফলে এই শ্রেণি-চেতনার মাধ্যমে যদি শ্রেণিঐক্য গড়ে ওঠে, তাহলে সাম্প্রদায়িক মনোভাবটা হয়তো শেষ হয়ে যায় না, কিন্তু অনেক নীচে চলে যায়। এটা সম্ভব এবং এটা করা খুব প্রয়োজন। ১৯৪০-এর দশকে যদি আমরা ফিরে যাই বাংলার ইতিহাসে, তখন দাঙ্গা যেমন হয়েছে তেভাগা (কৃষক) আন্দোলনও হয়েছে। যদি তেভাগা না হত, দাঙ্গা হয়তো আরও বীভৎস হত। আজও তেমন কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন (সাম্প্রদায়িকতাকে) কাউন্টার করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আগে যেটা (প্রথম পর্বের আলোচনায়) বলেছি— জেন্ডার। জেন্ডার কিন্তু সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আটকে দিতে পারে। এটা খুব বড়ো প্রশ্ন।
তৃতীয়ত, আমাদের যে সংস্কৃতি এবং সাব-ন্যাশনালিজমই বলুন বা বাঙালি-আইডেন্টিটিই বলুন এটা একটা বড়ো জায়গা আছে। আমরা এটা এইভাবে ভেবেছি যে, বাংলার একটা প্রগতিশীল উদার ঐতিহ্য আছে। বাংলা মানেই সব ভালো, বাইরের মানেই খারাপ— এইভাবে বাংলা বনাম বহিরাগত নয়, কিন্তু বাংলার ঐতিহ্যের মধ্যে যে প্রগতিশীল উদার উপাদান আছে তার কথা বলছি। এই উপাদানগুলো অবশ্যই বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজন রুখতে পারে।
চতুর্থত, এবারে বামপন্থীদের ভোট অনেক কমে গেছে, ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘদিনের যে কমিউনিস্ট আন্দোলন, চর্চা তার একটা অভিঘাত এখনও আছে। যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন যে, পশ্চিমবঙ্গে কিছুতেই বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া যাবে না, তাঁদের পিছনে কী? তাঁদের পিছনে একটা বড়ো বামপন্থী চেতনা কাজ করেছে।
এই চারটেকে যদি সংহত করা যায় তাহলে অবশ্যই বিজেপির সাম্প্রদায়িকতাকে এখানে রুখে দেওয়া যাবে।
নী. হা.— আপনার কি মনে হয় এই যে সংহত করার কাজ, সেটা এখন পশ্চিমবঙ্গে যে মূলধারার বামপন্থা আছে তার মাধ্যমে সম্ভব হবে? নাকি, সম্পূর্ণ বিকল্প একটা বামপন্থী শক্তির উঠে আসা দরকার?
দী. ভ.— দেখুন, একটা সময় ছিল যখন অনেকেই মনে করতেন দুটো (ধারা)—একটা বিকল্প বামপন্থা, আর-একটা প্রচলিত বেশ সফল বামপন্থা। এখন বামপন্থার যে প্রচলিত সবথেকে প্রভাবশালী মডেল ছিল সেটা এত দুর্বল হয়ে গেছে যে, নানা প্রশ্ন কিন্তু তার মধ্যেও উঠে গেছে। সেইজন্য আমার মনে হয় যে, আমাদের আরও দেখতে হবে। সেইজন্যই বলছি এটা পুনর্বিন্যাসের সময়। দেখতে হবে, সিপিআই(এম)-এর যাঁরা (নেতৃত্ব) তাঁরা কী করতে চাইবেন না বা চাইবেন। সবই এখন দেখার বিষয়। এখন কিন্তু চ্যালেঞ্জটা চলে এসেছে বামপন্থার কাছেই।
নী. হা.— এবার আপনাদের দলের বিষয়ে প্রশ্ন। ১৯৭৪ সালে আপনাদের দলের জন্ম, তারপর ধীরে ধীরে সংসদীয় রাজনীতিতে আসা, নির্বাচন লড়া—শেষে ২০২০ সালে এসে, ৪৬ বছর পরে, বিহারের বিধানসভায় ১২ টা আসন, ঝাড়খণ্ডের বিধানসভায় একটা আসন। দেশের সার্বিক সংসদীয় রাজনীতির যে ইতিহাস তার বিচারে আপনাদের দলের প্রায় ৫০ বছরের ক্রিয়াকর্মের আইনসভায় এই প্রতিফলন কি খানিকটা হতাশাব্যঞ্জক নয়?
দী. ভ.— না, আমি সেটা বলব না। আমাদের গ্রোথ হয়তো অনেক জায়গাতেই খুব ধীরে হয়েছে। আমরা একটা দুর্বল জায়গাতেই আছি। সেটা তো অবশ্যই আমাদের ভাবায়, ঠিক কথা। কিন্তু উলটো দিক থেকে যদি দেখা যায়, তাহলে ওটাই আমাদের স্ট্রেংথ। স্ট্রেংথ এই কারণেই, আমরা (নির্বাচনী) সাফল্যের স্বাদ এখনও পাইনি। কাজেই আমরা ওই নির্বাচনী সাফল্যের ওপরে খুব-একটা নির্ভর করি না। অর্থাৎ একটা আপাতদুর্বল শক্তি নিয়ে একটা কর্মসূচি তৈরি করে একটা আদর্শের জন্য কী করে লড়তে হয়, সেটা আমাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমাদের দলের যদি সংস্কৃতি বলেন, তাহলে ভোটটা কেন এত কম হল, ওটা নিয়ে হইচই হবে না। কিন্তু কোনো একটা প্রশ্নে যেখানে পার্টির উচিত ছিল একটা উদ্যোগ নেওয়া, মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কিন্তু তা করা হয়নি, তাই নিয়ে দলের মধ্যে একেবারে ধুন্ধুমার হয়ে যাবে। ধরুন আমাদের যে ছাত্রসংগঠন, আইসা (অলইন্ডিয়া স্টুডেন্ট্স অ্যাসোসিয়েশন) তাঁরা যে আন্দোলনগুলো করছেন, লড়ছেন, সেটা ভোটে রূপান্তরিত হবে না, কিন্তু সেগুলো আমাদের বিরাট ভাবে উৎসাহিত করে। ফলে, আমাদের কাছে নির্বাচনী সাফল্য কম, দমন, উৎপীড়ন, জেল, গণহত্যা এইগুলো ধারাবাহিক ভাবে আমাদের সহ্য করতে হয়েছে, ফলে আমাদের দলের একটা সহনশক্তি, একটা রেজিলিয়্যান্স তৈরি হয়েছে যেটা আমার মনে হয় আজকের দিনে খুব জরুরি। কারণ আজকে সাধারণ ভাবেই গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে। সমস্ত বিরোধীদের ওপর আক্রমণ চলছে। আমাদের দলটা এমন পরিস্থিতিতে, এমন ভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে গণতন্ত্র খুব লাক্সারি। যে মানুষেরা এসেছেন, তাঁরা ভোটই দিতে পারতেন না। কাজেই আমরা খুব প্রিভিলেজের জায়গা থেকে আসছি না। ন্যূনতম গণতন্ত্র যেখানে নেই সেইখানে গণতন্ত্রের জন্য, সম্মানের জন্য লড়তে লড়তে আমরা আজকে এই জায়গাটায় এসেছি। ফলত গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সম্মান-এর মূল্যটা আমরা খুব গভীর ভাবে বুঝতে পারি। সেইজন্যই বিজেপির বিপদটা বুঝতে আমাদের দলের কোনো অসুবিধা হয়নি।
নী. হা.— এবার আর-একটা মৌলিক প্রশ্ন। ভারতে Association for Democratic Reforms নামে একটি সংস্থা আছে। তারা ভারতীয় গণতন্ত্রের নানা সমস্যা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা, তথ্যসংগ্রহ, সমীক্ষা ইত্যাদি করে। বহু বছর ধরে তারা আমাদের সাবধান করছে, মানুষের ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত এ দেশে ক্রমাগত চলে যাচ্ছে অর্থবলের গ্রাসে। কীরকম? সম্প্রতি একটি সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সিএমএস নামে একটা থিংকট্যাংক—Poll Expenditure, The 2019 Elections। এর মুখবন্ধ করেছেন প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি। ভারতে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে জেতার জন্য যে অর্থ ব্যয় করে তাকে তিনি বলছেন ‘‘…horrors of money”। তার একটা হিসেব এরকম— ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সব দল মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীরা নিজেরা খরচ করেছেন ২৪ হাজার কোটি টাকা। আর রাজনৈতিক দলগুলি সরাসরি খরচ করেছে ২০ হাজার কোটি টাকা। মানে, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলি একত্রে ভোটারদের প্রভাবিত করতে খরচ করেছে, ৪৪ হাজার কোটি টাকা! কী করে প্রভাবিত করবে? ক্যাম্পেন করে, আর পাবলিসিটি করে (অর্থাৎ সংবাদমাধ্যম মূলত ও সামাজিক মাধ্যমে কিছুটা)। এই দুই খাতে নির্বাচনী প্রচারের কয়েক মাসে খরচ হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ টাকার সিংহভাগ কোথা থেকে আসে চিহ্নিত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এর একটি ক্ষুদ্র অংশ রাজনৈতিক দলগুলিকে জনপরিসরে বাধ্যতামূলক ভাবে জানাতে হয়। এডিআর-এর একটি পৃথক রিপোর্ট দেখলে দেখা যাবে, ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে তুলনামূলক ভাবে অতি সামান্য, সিপিআই(এম) ঘোষিত ভাবে যে ৮.০১ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছিল তার ৫৫ শতাংশ দিয়েছিল নানা কর্পোরেট সংস্থা (বিজেপি পেয়েছিল ৯৬৯.৩১ কোটি টাকা, যার ৯৪ শতাংশ কর্পোরেট-অর্থ) এটা একটা ছোট্টো ঝলক, এর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব এই রিপোর্ট ও এডিআর-এর ধারাবাহিক নানা রিপোর্টে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আপনাদের দলের মতো একটি দল কীভাবে সংসদীয় রাজনীতিতে অগ্রসর হতে পারে?
দী. ভ.— আমাদের কাছে প্রশ্ন হল, আমাদের কাছে যা-যা পথ আছে, সেগুলিকে কাজে লাগাতে। এই ব্যবস্থা তো আমরা তৈরি করিনি। এটা আছে। এবং এর মধ্যেই আমাদের লড়াই করতে হবে। ছোটো করে হলেও এই পরিস্থিতিতেও কিছুটা সাফল্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে, আমার বিশ্বাস পরবর্তীকালে বৃহত্তর লড়াইয়ের পরিস্থিতেও সেটা সম্ভব। দেখুন, আমরা তো একসময় ভোট বয়কট করতাম। পরে দেখলাম সমাজের একটা বড়ো অংশের দরিদ্রতম অংশের তো আসলে ভোটই নেই, তার ভোট অন্য কেউ দিয়ে দেয়। তার সেই মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারটা আদায় করতেই পরে আমাদের অনেক বেশি সংঘাতপূর্ণ লড়াইতে যেতে হয়েছে, যখন আমরা নির্বাচনে অংশ নিতে শুরু করলাম। আমি এটা এভাবে দেখি— আম্বেডকর সংবিধান তৈরির সময় একটা কথা বলেছিলেন যে—Democracy in India is only a top-dressing on an Indian soil, which is essentially undemocratic. তার মানে, উনি বলছেন, সংবিধান আসলে একটা গ্যারান্টি নয়, একটা হাতিয়ার। এই হাতিয়ার ব্যবহার করে সংবিধানে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তার জন্য তো লড়তেই হবে, ওই অগণতান্ত্রিক জমিনটাকে গণতান্ত্রিক করে তুলতে হলে। নির্বাচন অবশ্যই বেশি বেশি করে পয়সার খেলা হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে সংবাদমাধ্যমও আছে। কাজেই পরিস্থিতি সত্যিই আমাদের বিপক্ষে, কিন্তু লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই রাস্তা বের করা ছাড়া আর কী উপায় আছে আপনি বলুন! এবং আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই মডেলের বাইরেও কিন্তু নির্বাচন লড়া সম্ভব। আমরা যেটুকু জিতেছি নির্বাচনে, তাতে তো ওই বহরের খরচ করতে হয়নি। আমার মনে হয় নির্বাচন লড়ার ক্ষেত্রেও বৃহৎ পুঁজির সাহায্যের একটা বিকল্প মডেল তৈরি করা সম্ভব।
নী. হা.— আপনাদের দলের কর্মসূচির মধ্যে আমি একটা লাইন দেখলাম, যেটা আমার মনে হল আপনাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির নিরিখে খুব গুরুত্বপূর্ণ—অপারেটিভ অংশ যাকে বলে—Peoples’ democratic revolution with agrarian revolution as its axis। এটা একটু সোজা বাংলায় বুঝিয়ে বলবেন?
দী. ভ.— অবশ্যই। সহজ বাংলায়, ভারত এখনও কৃষিপ্রধান দেশ। আমদের সমাজের বেশির ভাগটাই এখনও কৃষিনির্ভর সমাজ। ফলে গ্রামের মানুষের সংখ্যা বিপুল। এই পরিস্থিতিতে যদি আমাদের একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে এই যে কৃষিকেন্দ্রিক সমাজ, মানে শুধুমাত্র যে কৃষিকাজ বলছি তা নয়, কৃষিকাজ ঘিরে যে বৃহত্তর সমাজ রয়েছে, সেই গ্রামাঞ্চলে বড়ো পরিবর্তন আনতে হলে, ওই নীচের মাটিটায় গণতন্ত্র আনতে হবে। নইলে কিন্তু ওই টপ-ডেস্রিং ফেটে চৌচির হয়ে পড়ে যাবে। এই নীচের মাটিটায় গণতন্ত্র আনতে গেলে দরকার অ্যাগ্রারিয়ান রিভলিউশন, কৃষিভিত্তিক বিপ্লব। সেই মাটির সঙ্গে যুক্ত মানুষের ক্ষমতায়ণ, এটাই হল মূল কথা। যদি সিপিআই(এম)-এর কথা টেনে বলি, একটা সময় এসে তাঁরা বললেন ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। মানে, চলো কৃষিভিত্তির কাজ হয়ে গিয়েছে, এবার এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আজ তো সারা দেশে ভিত্তিটাই সংকটে। আমার মনে হয়, কৃষি যে ভিত্তি এ কথা বলে ছেড়ে দিলে হবে না। এই ভিত্তিটাকে শক্তিশালী করতে হবে। এটাই আমাদের দলের মূল কথা।
নী. হা.— বেশ। এবারে আর একটা জরুরি বিষয় তুলি। ১৯৪৭ সালের ভারত আর আজকের ভারতের মধ্যে একটা বড়ো তফাত হল এক বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান। তাঁদের মধ্যেও বিভাজন আছে, নিম্নমধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এইসব। কিন্তু এই যে বিপুল সংখ্যক মানুষ, তাঁদের প্রধান একটাই দাবি আজ—চাকরি চাই। এই দাবি মেটানোর ক্ষেত্রে, কিছু প্রসাধনিক পার্থক্য ছাড়া বিজেপি, কংগ্রেস এবং মূলধারার বামপন্থীদের যে ফর্মুলা, তাতে মৌলিক কোনো তফাত নেই। সহজ বাংলায়—দেশি, বিদেশি পুঁজিতে বৃহৎ শিল্প না গড়ে তুলতে পারলে এই ভয়াবহ বেকার-সমস্যা মেটানো সম্ভব নয়। বাকিটা গালগল্প, বাস্তবোচিত নয়। আপনাদের কর্মসূচি আমি যেটুকু পড়লাম তাতে ‘জব’ কথাটারই উল্লেখ নেই। ‘এমপ্লয়মেন্ট’ কথাটা একবার পেলাম ভারতীয় সমাজের চরিত্র ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। আপনারা, আমি যা জানি, এই মডেলের বিরোধী। যদি তাই হয়, তাহলে আপনাদের মতে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে কী করে?
দী. ভ.— হাতেকলমে অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিচ্ছে, একটা সময় বড়ো শিল্পে চাকরি হত, কিন্তু এখন সর্বত্র জব-লস্। বিরাট মাত্রায়। দেখবেন যাঁরা বড়ো শিল্পের পক্ষে বলছেন, তাঁরাও বলছেন বড়ো শিল্প হলে, অনেক অ্যানসিলারি হবে, পারিপার্শ্বিক ছোটো উদ্যোগ হবে, সেখানে অনেক চাকরির সুযোগ হবে। এখানে দেখুন, সিঙ্গুর নিয়ে একটা (বিতর্ক) হল, শিল্প ওখানে হবে নাকি হবে না। কিন্তু হিন্দমোটরের মতো বিশাল শিল্প যে ঠিক তার পাশেই বহুকাল ধরে ছিল, এবং উঠে গেল, কই সেটা নিয়ে তো কেউ কথা বললেন না। একদিকে একটা শিল্প হবে, তার জমি নিয়ে হইহই করব, বলব ঠিক ওইখানটায় ওই শিল্পটাই না হলে নয়, আর পাঁচটা শিল্প উঠে যাবে—তাহলে তো এই উত্তরটা আগে দিতে হবে, এই বড়ো বড়ো শিল্পগুলো কেন উঠে যাচ্ছে, কেন সরকারি উদ্যোগ তুলে দেওয়া হচ্ছে?
নী. হা.— কিন্তু আমি আমার মূল প্রশ্নটার উত্তর পেলাম না।
দী. ভ.— সে প্রশ্নের উত্তর হল, ওই কর্পোরেট শিল্পায়ন দিয়ে হবে না। এটা দিয়ে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে না। চাই অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোগ (এমএসএমই)। চিনের অভিজ্ঞতা দেখুন। সেদেশ যদি গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষের চাকরির দাবি কিছুটা মিটিয়ে থাকতে পারে, সেটার একটা বড়ো কারণ এমএসএমই সেক্টরের প্রসার।
দ্বিতীয়ত, কৃষিক্ষেত্রে আমরা যদি ইউরোপ বা মার্কিন মডেলে প্রযুক্তিকরণ, মেকানাইজেশন, করতে চাই, যেখানে বিপুল উৎপাদন হবে কিন্তু মাত্র ২ শতাংশ মানুষের জীবিকা তার উপর নির্ভরশীল হবে, সেটা এ দেশে হবে না। কৃষিতে যদি কোঅপারেটিভ বা ছোটো খামার মডেলে (উন্নতি) না করা যায়। গোটা কৃষিক্ষেত্র যদি আদানি-আম্বানিদের হাতে চলে যায়, এবং কৃষিক্ষেত্র থেকে যদি কোটি কোটি মানুষ উদ্বৃত্ত হয়ে চলে আসতে থাকেন, এখনও আসছেন, তাহলে তাঁরা যাবেন কোথায়? কৃষি আমাদের ভিত্তি বলে কৃষিক্ষেত্র থেকে বহু মানুষকে উচ্ছেদ করে দিলাম, এ দিকে শিল্পে তাঁদের জীবিকার ব্যবস্থা হল না, তা হলে তাঁদের কী হবে? দেখুন, কৃষিনির্ভর অঞ্চল, মানে গ্রামাঞ্চল মানেই বঞ্চনা— সেখানে বিদ্যুৎ নেই, হাসপাতাল নেই, স্কুল নেই, ইন্টারনেট নেই— এই চেহারা যদি থেকেই যায়, তাহলে হবে না। গ্রামের একটা অন্য কল্পনা করতে হবে।
দেখুন, ব্যাপারটা একেবারে অন্য ভাবে ভাবতে হবে। শুরু করতে হবে প্রত্যেকের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করা দিয়ে। এটা ঠিক মতো করতে গেলে কত স্কুল, কত হাসপাতাল লাগবে হিসেব করুন। সেখানেও তো চাকরি হতে পারে। মানে এ ভাবেও ভাবা যায়। তা না ভেবে বড়ো বড়ো শিল্প হবে, সেখানে প্রচুর চাকরি হবে, এটা একটা ইলিউশন। এটা বাস্তবে হয় না।
নী. হা.— এক্কেবারে শেষে, আপনার বিষয়ে দু-কথা—আপনি এই রাজনীতিতে এলেন কীভাবে? আপনার দেশ কোথায়?
দী. ভ.— আমার জন্ম গুয়াহাটিতে, ১৯৬১ সালে। আমার বাবা—বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য—রেলে চাকরি করতেন। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত কেটেছে ওখানেই। পাঁচ বছর বয়সে চলে আসি আলিপুরদুয়ার। ১৯৬৭-তে আমি ক্লাস ওয়ানে। তখন নকশালবাড়ি আন্দোলন ঘটছে। আমাদের স্কুলের দেয়ালের গায়ে মানচিত্র, স্লোগান—সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন, শ্রীকাকুলাম… এই জিনিসগুলো তখন থেকেই আমার কাছে খুব জীবন্ত। তারপর বাবার সঙ্গে একটু একটু আলোচনা করতাম। বাবা বামপন্থী ছিলেন, তবে কোনো দলের নয়। কোনোদিন আমাকে বলেননি যে এসব নিয়ে তুমি মাথা ঘামিও না। অনেক পরে একবার হাসতে হাসতে বলেছিলেন, যদি আগে বুঝতাম তুমি এটাই করবে, তখন এসব বলতাম না। তো একটা ইমপ্রেশন ছিল, খুব গভীর। তারপর ১৯৭৪ সালে চলে আসি ক্লাস এইটে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে। জরুরি অবস্থার সময়। সেই বিশাল দেয়ালের ঘেরার মধ্যেও খবরাখবর পেতাম।
নী. হা.— উচ্চমাধ্যমিক পাস করা অবধি নরেন্দ্রপুরেই?
দী. ভ.— হ্যাঁ। নরেন্দ্রপুর থেকে বেরিয়েছি ১৯৭৯-তে। বেরিয়ে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউট (আইএসআই)। ১৯৭৯-১৯৮৪। সেইসময় থেকেই আমি প্রায় ফুলটাইম পার্টির সঙ্গে যুক্ত। যদিও পরীক্ষা দিয়েছিলাম, ডিগ্রিও পেয়েছি। কিন্তু পার্টিটাই বেশি মনোযোগ দিয়ে করতাম।
নী.হা.— অনেক ধন্যবাদ।
দী.ভ.— ধন্যবাদ।
সমাপ্ত
প্রায় সাত আট মাস ধরে সিপিআইএম বাদ দিয়ে বাকি বামদলগুলোর বক্তব্য শুনছি,কাগজে পড়ছি, এর মধ্যে বিহার বিধানসভা নির্বাচন গেছে, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন গিয়ে প্রায় একমাস চলে গেল।সিপিআই এমএল,এসইউসিআই বা বাকী বামফ্রন্টের বাইরের বা ভেতরের দলগুলোর উদ্দেশ্য নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।আজকের এই নব্য উদারবাদী যুগের তিনদশক অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও তারা যে বাম আদর্শ নিয়ে ভারতবর্ষে রাজনীতি করে পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন তাতে আশায় জাগে। কিন্তু আমার মনে হয় এই আলোচনা গুলো বড্ড বেশি কাগুজে হয়ে যাচ্ছে, এবং সমাজে আমার মত ঘরে বসে আদর্শ কপচানো লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছ। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গঞ্জে এবং মফস্বল-শহরে RSS এবং বিজেপি অত্যন্ত সক্রিয়, এবং বিধানসভাতে আশিটার কাছাকাছি আসন পেয়ে এবং লোকসভাতে আঠেরোটা আসন পেয়ে রীতিমতো শক্তিশালী। আপনারা এরাজ্যে নির্বাচনী লড়াই-এ সক্রিয় না হতে পারলেও রাজনৈতিক আলোচনা এবং গণআন্দোলন তৃণমূল কংগ্রেস বনাম বামপন্থা দলগুলির মধ্যে রাখুন, মানুষকে বোঝান যে বামপন্থায় পারে প্রকৃত পরিবর্তন ঘটাতে এবং লিঙ্গ- জাত-ধর্মীয় বিদ্বেষের অবসান ঘটাতে।সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ছেড়ে মানুষের ঘরে না আসতে পারলে এই আলোচনা গুলোর কোনো উপযোগিতা ই থাকবে না। সিপিআইএম এর সমর্থক, একদম নীচু তলার কর্মীদের কাছেও এই আলোচনা গুলো তাঁদের বোঝার মতো করে পৌছানো প্রয়োজন। এইটুকুই বলার।।
মানুষ আর বামপন্থীদের মানসিক কোন যোগাযোগ নেই। বামপন্হীরা মানুষের উপকার করেন এবং দুঃখ পান মানুষ কেন আমাদের নির্বাসিতে করে না। মানুষ টিভি ও টিকটকে দেখা চরিত্রের মত দেখেন বামপন্থীদের। স্বাভাবিক নয় একটা ব্যত্যয় হিসেবে। প্রশংসা করেন বাঃ খুব ভালো কাজ করছ ভাই তোমরা। আবার মজা পান ভোট পাবে না জেনেও কাজ করছে।
এভাবে চলে না। চালাকি পোষাকী ভাষা বিদেশী শব্দ ও ব্যক্তিত্ব মার্কস লেনিন পলিট বুরো ক্লাস স্ট্রাগ্ল কন্ট্রাডিকশান লাল মলাটের বই এসব দেখে মানুষের কাছে বামপন্হীরা একটা কাল্ট।
প্রাণের যোগ নেই। দুপক্ষেই। দেশের মাটির গন্ধ যদি ভাষায় না আসে, দেশের অত্যাচার ও ক্ষুধায় হাড়গোড় ভাঙা মানুষের মনের খবর পাবেন কি করে? বামপন্থা মাটি থেকে তুলে আনতে হবে ওপর থেকে চাপিয়ে নয়। মানুষের কাছে শিখতে হবে মানুষকে ভালবাসতে হবে। নৈলে প্রহসন চলতেই থাকবে।
স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ধারণা। কিন্তু চ্যালেঞ্জ তো এটাকে তৃণমূল স্তরে কার্যকর করা। সেখানে বিরাট ফারাক। বাংলায় বাকি নেতৃত্ব তত্ত্বগত ভাবে অনেক দুর্বল যেটা কার্যক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়। ত্যাগ উদ্যমে খামতি নেই কিন্তু উদ্ভাবনী ক্ষমতার অভাব। গোষ্ঠী মানসিকতাও প্রব। দেখা যাক।
নীলাঞ্জন হাজরা মশায়কে অনেক ধন্যবাদ, কমঃ দীপঙ্কর ভট্টাচার্য্যের তিন কিস্তিতে একটি মিনিংফুল ইন্টারভিউ নেয়ার জন্যে। বলছি তার কারণ আপনার প্রশ্নগুলো সুচিন্তিত এবং আজকের সন্দর্ভে অত্যন্ত প্রাসংগিক। কিন্তু সবকিছুরই অভিমুখ আজকে বিজেপির ডিভিসিভ রাজনীতি ও এজেন্ডাকে ঠেকানোর রণকৌশলগত প্রশ্নে বামেদের অবস্থান কী হওয়া উচিত সেটা নিয়ে।
আমার জানার ইচ্ছে আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দীপংকর কী ভাবছেন সেটা নিয়ে।
যেমন, আজকে গোটাবিশ্বে বামপন্থীরা স্তালিনিস্ত লিগ্যাসি থেকে বেরিয়ে এসেছেন, ভারত বাদে। এদেশে সিপিয়াই, সিপিএম ও বিভিন্ন লেনিনবাদী গ্রুপ স্তালিনের কিছু কাজের সমালোচনা করলেও চিন্তায় বিশেষ করে সাংগঠনিক নীতিতে একেবারে স্তালিনবাদী।
তাই আমার ক'টি প্রশ্নঃ
১ দীপংকরবাবুরা কি সত্যিই মাল্টিপার্টি ডেমোক্র্যাসিতে বিশ্বাস করেন? নাকি শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বে এখনও বিশ্বাস রাখেন?
২ রাষ্ট্রের ক্রমশঃ ক্ষয় হওয়া্র সম্ভাবনায় বিশ্বাস করেন? গোটা দুনিয়ায় এবং ভারতে দিনদিন রাষ্ট্রের ক্ষমতা বাড়ছে।
৩ দলের ভেতরে এখনও কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিকতার চরম নীতিতে বিশ্বাস করেন?
৪ বিশ্বজুড়ে পুঁজির কেন্দ্রীকরণ হলেও বিপরীত মেরুতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রলেতারিয়েতের মেরুকরণ কোথায়? এখন তো ওই প্রলেতারিয়েতের সংখ্যা দিনদিন কমছে। ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রলেতারিয়েতের হারাবার জন্যে হাতের শেকল ছাড়াও অনেক কিছু আছে।
আমরা নর্থ কোরিয়ার প্রশ্ন এড়িয়ে যাই, দক্ষিণ চীন সমুদ্র নিয়ে চীনের সঙ্গে ভিয়েতনাম ও অন্যদেশের বিবাদের মত অস্বস্তিকর প্রশ্ন এড়িয়ে যাই। ভুলে যাই যে জাওনিস্ট রাষ্ট্র ইজরায়েলকে প্রথম কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছিল আমেরিকা নয়, স্তালিনের রাশিয়া। এবং প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধে ইজরায়েল হেরে যেত স্তালিনের পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মাধ্যমে অস্ত্র সাহায্য না পেলে।
এই প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে ভারতে বামপন্থার স্থায়ী রোডম্যাপ সম্ভব কি?
সাক্ষাৎকারটা ভালো। বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বাদে অন্য বিষয়ে এক মত। দীপঙ্করদারও বাংলাদেরশ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা সুখকর নয়। উনি বলছেন, "প্রথম কথা হচ্ছে, ঠিক করতে হবে আমরা কী করতে চাই? অতীতে আমরা বিরাট ধাক্কা খেয়েছি— দেশ ভাগ হয়েছে, দাঙ্গা হয়েছে, প্রচুর মানুষ ভিটে-মাটি-ছাড়া হয়েছেন। আমরা কি সেইখানে ফিরে গিয়ে কোনো একটা স্কোর সেট্ল করতে, একটা হিসেবনিকেশ করে নিতে চাই? নাকি আমরা ওখান থেকে এগিয়ে যেতে চাই? আপনি সাধারণ ভাবে দেখবেন, অনেক মানুষের অনেক তিক্ত স্মৃতি আছে, কিন্তু আমরা এগিয়ে গিয়েছি। এটাই হচ্ছে জীবনের গতি। আমার মনে হয়, বিজেপি আমাদের আবার ঠেলে ওই জায়গাটায় নিয়ে যেতে চাইছে।..." প্রথমত দেশ ভাগ বলে উনি যদি ভারত ভাগকে মিন করেন, তাহলে সেটা ভুল। ভারত দেশ নয়। যুক্তরাষ্ট্র। ভারত ভাগ হয়নি, বাংলা ভাগ হয়েছে। পঞ্জাব ভাগ হয়েছে। বাংলাভাগের ক্ষেত্রে ওনার বক্তব্যেও সুক্ষ্যভাবে পূর্ব বঙ্গের বাঙালি মুসলমানকে দায়ি করা হয়েছে। মুসলিমভীতি ওনার কথায় রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে বলা দরকার, ভিটেমাটি ছেড়ে আসতে কাউকে বাধ্য করেনি বাঙালি মুসলমান বা পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানরা। পশ্চিম পাকিস্তানি ও তাদের দালালরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছিল সার্বিকভাবে বাঙালির ওপর। বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিমের ওপর। আর পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের একাংশ উত্তর ভারতের ছায়াতলে থাকতে চান বরাবর, কেননা তারা মনে করেন ভারত একটা দেশ এবং ভারত হিন্দুদের ভূমি। এই কারণেও অনেকে এসেছেন। বাংলা ভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে জয়া চ্যাটার্জিরা এসব বিশ্লেষণ বারবার বলেছেন। তাহলে বাংলাদেশের ব্যাপারে তিক্ত স্মৃতি ব্যাপারটাই তো অবান্তর। দীপঙ্করদারা দিন শেষে প্যানইন্ডিয়ান আধুনিক হিন্দু জাতিবাদী চেতনার বাইরে বেরোতে পারেননি, এটা স্পষ্ট তাঁর কথা থেকে। তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিজেপির বাংলাদেশফোবিয়াকে মাণ্যতা দিয়েছেন ফালতু তিক্ত স্মৃতির প্রসঙ্গ টেনে। বাংলাদেশের ব্যাপারে যাদের তিক্ত স্মৃতি আছে, তারা কতটা বাঙালি তা নিয়ে আমার ডাউট আছে। আর বাংলা ও বাঙালিকে এড্রেস না করতে পারা সো-কল্ড লেফটদের সমস্যাও বটে। লিবারেশনও তার বাইরে নয়।
"তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো,
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো,
তার বেলা"। --অন্নদাশংকর রায়
"এক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে বলা দরকার, ভিটেমাটি ছেড়ে আসতে কাউকে বাধ্য করেনি বাঙালি মুসলমান বা পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানরা। পশ্চিম পাকিস্তানি ও তাদের দালালরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছিল সার্বিকভাবে বাঙালির ওপর"।
"তাহলে বাংলাদেশের ব্যাপারে তিক্ত স্মৃতি ব্যাপারটাই তো অবান্তর"।
--বেশ, বেশ। কোন সালে জন্মেছেন ভাই?
রঞ্জন বাবুর প্রশ্নগুলির উত্তরের অপেক্ষায়। তবে উনি অতনু সিংহকে চেনেন না দেখে, অত্যন্ত আশ্চর্য লাগলো।
আমি চল্লিশ বছর ধরে ছত্তিশগড়ে। ফলে এখানে বা কোলকাতার বুধমন্ডলে খুব কম লোককেই চিনি। গুরুচন্ডালির সূত্রে যে ক'জনের সঙ্গে ব্যাটেবলে হয়েছে তাদের ছাড়া।
এইটা খুবই ভালো একটা ইন্টারভ্যু।
Latin আমেরিকার মতো বাম দল লাগবে, এই সব প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টি, তাদের তত্ত্ব কথা এবং সুবিদাবাদকে মানুষ বর্জন করে দিয়েছে। 70 বছর ধরে বর্জন করছে। কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এলেই purge করে, মক ট্রায়াল করে, gulag এ পাঠিয়ে , কালচারাল revolution এর নামে খুন খারাপি করেছে। এসব সবাই জানে আজকের দিনে। বিজেপি খারাপ যেমন, এ ঘটনা গুলো ও সত্যি। কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এসে আবারও neoliberalism কেই implement করে, যেমন চিন করেছে, ভিয়েতনাম ও cuba করছে। চীন, ভিয়েতনাম, cuba কোথাও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি, capitalism ই চলছে। কী না আরো দুশো বছর পরে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে! শুধু মাঝখান থেকে একমাত্র সম্বল ভোটাধিকার টাও থাকবে না। আর প্রতিবাদ করলে ? সিম্পলি পরের দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব সব বাজে কথা, আসলে নির্বাচন ছাড়া একটানা একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করার কৌশল।