দ্বিতীয় পর্ব
নীলাঞ্জন হাজরা— গত পর্বে আপনি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্লেষণ করেছেন। এবার আর-একটা জরুরি প্রশ্নে আসি। সেজন্য কয়েকটা পরিসংখ্যান একটু দেখা দরকার। নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক হিসাব—
২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন
মোট ভোটারসংখ্যা—৫ কোটি ৯৯ লক্ষ ৩৫ হাজার ৯৮৮
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট—২ কোটি ৮৭ লক্ষ ৩৫ হাজার ৪২০ (৪৭.৯৪ %)—জয়ী ২১৩
বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোট—২ কোটি ২৮ লক্ষ ৫০ হাজার ৭১০ (৩৮. ১৩ %)—জয়ী ৭৭
সিপিআই (এম)-এর প্রাপ্ত ভোট—২৮ লক্ষ ৩৭ হাজার ২৭৬ (৪.৭৩ %)—প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে—১৩৭
২০১৬ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন
সিপিআই (এম)-এর প্রাপ্ত ভোট—১ কোটি ৮ লক্ষ ২ হাজার ৫৮ (১৯.৭৫ %)—প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে—১৪৮—জয়ী ২৬
২০১১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন
সিপিআই (এম)-এর প্রাপ্ত ভোট—১ কোটি ৪৩ লক্ষ ৩০ হাজার ৬১ (৩০.০৮ %)—প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে—২১৩—জয়ী ৪০
এর মধ্যে আমার প্রশ্ন— পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬০-এর দশক থেকেই, নির্বাচনী রাজনীতিতে অন্তত, প্রধান বামশক্তি, বামদল হয়ে থাকা সিপিআই(এম)-কে ঘিরে। ২০১১ সাল, কার্যত বলা যায় ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই, ভোটের মেশিনে এই দলের যে ক্রমাগত মানুষের আস্থা হারাতে থাকার প্রতিফলন, এবং শেষে এবারের ছ-কোটি ভোটারের মধ্যে ২৮ লক্ষে (শরিকদের ধরলে আরও সামান্য বাড়বে নিশ্চয়ই), আর আসনের নিরিখে শূন্যতে এসে ঠেকা—স্বাধীনতার পর থেকে এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কোনো কমিউনিস্ট প্রতিনিধি থাকছেন না—এটা যদি সমাজের রাজনৈতিক মনোভাবের প্রতিফলন হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কমিউনিস্ট—আমি এখানে বাম-ঘেঁষা ইত্যাদি বলছি না—কমিউনিস্ট বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মানুষ কি মুছে গেলেন? এমত পরিস্থিতিতে এখানে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী? ইংরেজিতে যাকে বলে—Whither Left?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য—ভোট তো অবশ্যই বিরাট ভাবে কমেছে। সেই কমার প্রেক্ষাপটটা কী তা আমরা খানিকটা আলোচনা করেছি (সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব)। এটা বিচ্ছিন্নতার ফল। যেমন ধরুন, আজকে যাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিচ্ছেন তাঁদের একটা বড়ো অংশ ১০ বছর আগেও তো সিপিআই(এম)-কেই ভোট দিতেন। সিপিআই(এম)-এর কাছে গরিব মানুষের ভোটটা ছিল—গ্রামে, শহরে, কৃষক, শ্রমিক, অসংগঠিত শ্রমিক, খেটে-খাওয়া মানুষ, তাঁরা গত ১০ বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিচ্ছেন। ভুল রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এবং জনবিচ্ছিন্নতার ফলে আবার বামপন্থী ভোটারদেরই একটা অংশকেই ঠেলে দেওয়া হয়েছে বিজেপি-র দিকে। এইটা মারাত্মক।
কিন্তু অতীতে যেটা সিপিআই(এম)-এর ভোট ছিল, এবং এখনও বিজেপি-বিরোধী ভোট হিসেবে রয়েছে, আমি বলব তার অনেকটাই বামপন্থী মনোভাবাপন্ন ভোট। এমনকি, এই যে মিসগাইডেড হয়ে যে একটা অংশ চলে গিয়েছে বিজেপির দিকে, এবং ফিরেও আসতে পারে, সেটাও তাই। শুধুমাত্র একটা নির্বাচন দিয়ে তো একটা পার্টির গণভিত্তি বা একটা রাজ্যের মানুষের রাজনৈতিক চরিত্র নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। সেক্ষেত্রে আমি বলব, এটা খানিকটা ডিসইন্টিগ্রেট করেছে। এটা একটা বড়ো সংহত শক্তি ছিল, সেই সংহতিটা মার খেয়েছে। এখান থেকে এবারে এটা বামপন্থীদের আবার তুলতে হবে।
নী. হা.— আচ্ছা। এখানে একটা প্রশ্ন করি—তৃণমূল কংগ্রেসের যে রাজনীতি, তাকে কি বাম-ঘেঁষা, যাকে লেফট-অফ-সেন্টার বলে তাই বলবেন আপনি? অনেকেই মনে করছেন শুধু সাংগঠনিক ভাবেই নয়, রাজনীতির দিক থেকেও সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গে যে বামপন্থী পরিসরটা অকুপাই করেছিল, ছেয়ে ছিল বহু কাল, সেটা এখন তৃণমূল কংগ্রেস নিয়ে নিয়েছে। আপনার কী মত?
দী. ভ.— লেফট-অফ-সেন্টার হয়তো একদিক থেকে আপনি বলতে পারেন। দেখুন, ২০০৬-৭ থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান যেভাবে হয়েছে, এবং যে আন্দোলন নির্ভর করে তাঁরা ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেছেন, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পরে এই দলকে লেফট-অফ-সেন্টার বলা যায়। কিন্তু এরপরে যেটা হল পশ্চিমবঙ্গে, সেটা হল সিপিআই(এম)-এর প্রতি একটা প্রতিহিংসার মনোভাব থেকে বামপন্থার বিরোধিতাও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে। নইলে বিজেপি আজকে যে ভোটটা পেল এটাও তাদের পাওয়ার কথা নয়। এই ৭৭টা আসন, ৩৮ শতাংশ ভোট এটাও বিজেপির পাওয়ার কথা নয়। প্রশান্ত কিশোর আজকে বলছেন নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের কথা, সেটা তো নিশ্চয়ই একটা ব্যাপার। কিন্তু তা ধরে নিয়েও, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির যে এত ক্ষমতাবৃদ্ধি তার পিছনে কিন্তু সিপিআই(এম)-এর অনেক ভুল ছাড়াও তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক পদক্ষেপ দায়ী। যেমন, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে ক্ষমতার দাপট দেখা গেল, অনেকে নমিনেশনই ফাইল করতে পারলেন না, এর আগে যা দীর্ঘদিন ধরে শোনা গেছে— কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনের নির্বাচন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের ট্রাস্টি বোর্ডের নির্বাচন এসব ক্ষেত্রেই সেই একই দাপট দেখা গেছে। এখন, গণতন্ত্র বলতে তো শুধু বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচন বোঝায় না। গণতন্ত্রের যে বৃহত্তর পরিসর সেখানে ওই ক্ষমতার ধারাবাহিক দাপট কিন্তু বিজেপিকে একটা বড়ো জায়গা করে দিয়েছে।
নী. হা.— দেখুন, এটা আমার অভিজ্ঞতায় শাসকের দম্ভ। দম্ভও বলব না ঠিক, আসলে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলি খুব হিসেব করে এটা করে। আমরা আগেও বহুবার দেখেছি। সব দলই করে। সমাজের প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে দলের বশবর্তী করে ফেলতে হয় সিপিআই(এম) তার একটা কপিবুকই রেখে গেছে বলা যায়। আমার প্রশ্নটা আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের যে সামগ্রিক নীতির অভিমুখ সেই সংক্রান্ত— আমার মনে হয়, বামপন্থার একটা অন্যতম নির্ণায়ক হল, মানুষের— বিশেষত পিছিয়ে পড়া মানুষের— উন্নয়নে, সাহায্যে সক্রিয় ভাবে অংশ নেওয়া যে রাষ্ট্রের, এবং সরকারের, অপরিহার্য দায়িত্ব তা স্বীকার করা। এখন যখন সার্বিক পরিবেশটাই হল রাষ্ট্র ও সরকারের এইসব দায়িত্ব সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলার পরিবেশ, সেইখানে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু সরকারের সেই দায়িত্বটা দ্ব্যর্থহীন ভাবে স্বীকার করেছেন। ডেলিভার কতটা করা গিয়েছে তা নিয়ে অবশ্যই বড়োসড়ো প্রশ্ন আছে, কিন্তু মৌলিক ভাবে এই নীতির অভিমুখের কারণেই কী তৃণমূল কংগ্রেসকে লেফট-অফ-সেন্টার দল বলা যেতে পারে? আপনি যে ক্ষমতার আস্ফালনের কথা বলছেন, সেটা সত্ত্বেও…
দী. ভ.— আমি যেটা বলছি, এই যে ক্ষমতার দাপট, রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালানো, এটা কোনো বামপন্থী দল করলে তো সেটা বিচ্যুতি। সেটা তো আর বামপন্থা হল না। বিচ্যুতি দিয়ে তো বামপন্থা ডিফাইন করা যাবে না। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-এর যখন এটা হয়েছিল, তাঁদের বামপন্থা দুর্বল হয়েছিল। তার ফলেই তাঁরা একটা সময়ের পর আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। সেইজন্য, আমার মনে হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসকে যদি তার লেফট-অফ-সেন্টার বা সেন্ট্রিস্ট অবস্থানটা ধরে রাখতে হয় তাহলে বামপন্থীদের ওপর যে আক্রমণ চলেছে পশ্চিমবাংলায়, পার্টি অফিসগুলোর ওপরে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপরে, সেটা বন্ধ করতে হবে।
দেখুন, সারা দেশে একটা দক্ষিণপন্থী স্রোত বইছে। সার্বিক অর্থনীতি যদি দেখেন, কর্পোরেটগুলোর দাপট সেখানে ক্রমাগত বাড়ছে। এবং নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি তাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও আক্রমণাত্মক প্রতিনিধি। আমরা একটা বড়ো দক্ষিণপন্থার দিকে সরে যাওয়ার মধ্যে, রাইটওয়ার্ড শিফটের মধ্যে আছি। এবারে, ২০১১ সালে যখন সিপিআই(এম) ক্ষমতা থেকে চলে গেল, তাঁদের বহুকালের সমর্থক গরিব মানুষের ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে চলে গেল, এটা ঠিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তো একটা বড়ো দক্ষিণপন্থী শক্তিও আছে, এবং সেটাও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যেই আছে। আমি সেই জন্যই তৃণমূল কংগ্রেসকে একটা মধ্যপন্থী, সেন্ট্রিস্ট শক্তি বলব।
এবার দেখতে হবে সেই মধ্যপন্থী শক্তির অ্যাঙ্গল-টা কী থাকছে। বারবার দেখতে হবে। সেটা লেফট-অফ-সেন্টার থাকছে না রাইট-অফ-সেন্টার হয়ে যাচ্ছে। বারবার দেখতে হবে। এটা যদি দক্ষিণ দিকে ঝোঁকে, তাহলে জেনে রাখবেন তার শেষ ঠিকানা কিন্তু বিজেপি। বামপন্থীদের ওপর আক্রমণের মাধ্যমে যদি পশ্চিমবঙ্গে একটা রাইটওয়ার্ড শিফট শুরু হয়, তাহলে তা কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসে থামবে না, সেটা অবধারিত ভাবে বিজেপিতে পৌঁছোবে। পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক পরিসর যদি সংকুচিত হয় তাহলে সেটা বিজেপিকেই শক্তিশালী করবে। আমার ধারণা, কংগ্রেস, সিপিআই(এম)-এর বিচ্যুতি, জনবিচ্ছিন্নতা তো আছেই, কিন্তু বিজেপির এই ৩৮ শতাংশ ভোট পাওয়ার একটা বড়ো দায়িত্ব শাসকদল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরেও বর্তায়।
আর, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সরকারি দায়িত্ব স্বীকারের প্রশ্নে আমি বলব, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন। এমনকি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যে কর্পোরেট নীতির বিরোধিতা সেটাও তাঁরা করেছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে, কেন্দ্রীয় সরকার বেসরকারিকরণের পথে হাঁটছে, জনগণের প্রতি সমস্ত দায়িত্ব অস্বীকার করে পিছু হটছে। সেখানে জনসাধারণের কিছু অংশের কাছে কিছু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াকে অবশ্যই একটা সেন্টার-লেফ্ট অর্থনীতির দিশা বলা যেতে পারে।
নী. হা.— এইবারে আসি আপনাদের দলের প্রসঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের এই যে পরিস্থিতি আপনি এতক্ষণ ব্যাখ্যা করলেন, এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আপনারা কী ভাবছেন? আরও স্পষ্ট করে যদি বলি, সিপিআই(এম) ও বামফ্রন্টের অন্য দলগুলোর সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কী হবে, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গেই বা সম্পর্ক কী হবে, এইসব বিচার করেই তো আপনারা ভবিষ্যতে এ রাজ্যে একটা কর্মসূচি ঠিক করবেন, তার সার্বিক ভাবনাটা, ভিশনটা কী?
দী. ভ.— আমরা পশ্চিমবঙ্গেও বিগত ৫০ বছর ধরে কাজ করছি। এটা ঠিক যে, এ রাজ্যে আমাদের নির্বাচনী সাফল্য খুব কম। তার কারণ আছে। আমাদের পার্টি যখন পত্তন হয়, তখন আমরা রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে গিয়েছিলাম। সেখানে পার্টি একটা বড়ো ধাক্কা খায়। সেখান থেকে পার্টিকে আবার পুনর্গঠন করতে হয়। এবং এই পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় আমরা দীর্ঘদিন নির্বাচন লড়িনি। এবার আমার নিজের বিশ্লেষণ হল, নকশালবাড়ি আন্দোলনের যে একটা বড়ো আবেগ, বড়ো একটা ইমপ্যাক্ট, সেটাকে কিন্তু নির্বাচনী গণতন্ত্রের আঙিনায় সংহত করে নিতে পেরেছিল সিপিআই(এম)। ১৯৭৭-এর নির্বাচন যদি দেখেন, বন্দিমুক্তি আন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণআন্দোলনের যে ভোট সেই ভোটটা কিন্তু পেয়েছিল সিপিআই(এম)।
ক্ষমতায় আসার পরে গোড়ার দিকে তাঁরা অপারেশন বর্গার মাধ্যমে ভূমিসংস্কার, পঞ্চায়েত নির্বাচন চালু করা ইত্যাদির মাধ্যমে খেটে খাওয়া মানুষের সমর্থন নিজেদের পক্ষে করে ফেলতে সক্ষম হন। এরপরে আমরা যখন নির্বাচন লড়ার সিদ্ধান্ত নিই, তখন খানিকটা দেরি হয়ে গেছে—যাকে বলে উই মিস্ড দ্য বাস। সেই পরিস্থিতিতে আমরা পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী সাফল্য পাইনি। যেটুকু পাচ্ছিলাম সেখানেও আমাদের ওপর আক্রমণ শুরু করা হয়। আমার বারবার মনে পড়ে যায় ১৯৯৩ সালের বর্ধমান জেলার করন্দার কথা। এইখানে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় সিপিআই(এম)-এর প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে আমাদের সমর্থন করে অনেকে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, অনেকে ভোট দিয়েছিলেন। সেইটাকে আটকানোর জন্য, ছয়জন খেতমজুরকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হয়। করন্দা গণহত্যা১। ৩১ মে, ১৯৯৩। তো এ ধরনের নানাকারণ এ রাজ্যে আমাদের নির্বাচনী সাফল্যকে খুব ছোটো একটা জায়গায় আটকে রেখেছে।
এবার আমাদের মনে হয় যে, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির একটা বড়ো পুনর্বিন্যাস দরকার।
নী. হা.— সেটা আপনারা কীভাবে ভাবছেন?
দী. ভ.— দেখুন, এতদিন ধরে যেটা ছিল, সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বে একটা বামফ্রন্ট। সেখানে খুব বেশি বিতর্ক-টিতর্ক হত না। যেমন, সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়, ২০০৬ সালে, বামফ্রন্টের অনেক ছোটো শরিক দল সিঙ্গুরে সরকারি অবস্থানের বিরোধী ছিলেন। আমরা বারবার তাঁদের বলেছি, আপনারা অন্তত মন্ত্রীসভা থেকে বেরিয়ে আসুন। তাঁরা যদি মন্ত্রীসভা থেকে বেরিয়ে আসতেন, তাহলে ওই যে জনসমর্থন পুরোপুরি তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে চলে গেল, সেটা কিন্তু নাও যেতে পারত, বামফ্রন্টের মধ্যেই কিছু একটা শুধরোনোর ব্যবস্থা—কোর্স কারেকশন—হতে পারত। আপনি দেখবেন, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস যে ধাক্কাটা খেল, তারপরে তাঁরা কিন্তু কোর্স কারেকশন করেছেন।
নী. হা.— ঠিক এই কথাটাই বলেছেন প্রশান্ত কিশোর, কোর্স কারেকশন শব্দটাই ব্যবহার করেছেন…
দী. ভা.— সিপিআই(এম)-ও কিন্তু বারবার কোর্স কারেকশনের সুযোগ পেয়েছে, করেনি। আমার মনে আছে, সিঙ্গুরের আন্দোলন যখন চলছে তখন জ্যোতিবাবু (বসু) বলেছিলেন, ‘‘কৃষকসভা কী করছে, তারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে?’’ উনি নীতিগত ভাবে সিঙ্গুরে কারখানা করার পক্ষে ছিলেন কি ছিলেন না তা আমি জানি না, কিন্তু উনি জানতেন কৃষকের জমি এভাবে কেড়ে নেওয়া যায় না। একজন প্রশাসক হিসেবে উনি এটা বুঝেছিলেন। এটা তো একটা বিরাট বড়ো সতর্কবার্তা ছিল। একটা কোর্স কারেকশন তো হতে পারতো। তৃণমূল কংগ্রেসকে এই ক্রেডিট আমি অবশ্যই দেব, তাঁদের চোখ-কান খোলা। সিপিআই(এম) সেটা করলেন না।
নী. হা.— বরং ভয়ংকর দম্ভে একেবারে উচ্চতম নেতৃত্ব বলে বসলেন ‘ওরা ৩৫, আমরা ২৩৫!’
দী. ভা.— এই কোর্স কারেকশন না করার ফলে (মানুষের সমর্থনের) সেই জায়গাটা আর রইলো না। এখন আর নেই। ২০১১ সালে হারাটা যদি সিপিআই(এম)-এর কাছে কোভিডের ফার্স্ট ওয়েভ হয়ে থাকে, এবারের ফলাফল তার থেকে বহুগুণ বড়ো ধাক্কা—সেকেন্ড ওয়েভ! ফলে আমাদের একটা বড়ো কাজ আছে—পশ্চিমবঙ্গে বামশিবিরের পুনর্বিন্যাস এবং বামপন্থার পুনরুত্থান। এখানে আমাদের কাজ করতে হবে।
নী. হা.— কীভাবে?
দী. ভ.— সেটা করতে হবে অনেক কিছু মিলিয়ে। বিধানসভায় আজ বামপন্থীরা নেই। বামপন্থীরা বাইরে আছেন। (আইনসভার) বাইরে বামপন্থীদের যে কাজ, সেগুলো করে যেতে হবে। সংকটে মানুষের পাশে থাকা, মানুষের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে লড়া। এখানেও সিপিআই(এম) একটা ভুল করে এসেছে— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে (জনমুখী) প্রকল্পগুলো, সেখানে ডেলিভারির ক্ষেত্রে চুরি হয়েছে। ধরুন, কথার কথা বলছি, সেগুলোতে ৬০ শতাংশ ডেলিভারি হচ্ছে। ৯০ শতাংশ ডেলিভারি হচ্ছে না কেন? এই আন্দোলনটা কারা করবেন? বামপন্থীরাই তো করবেন। কিন্তু সিপিআই(এম) এই স্কিমগুলোকেই কোনো গুরুত্ব দিতে নারাজ। এটা তো বড়ো ভুল। (তৃণমূল কংগ্রেসের বিষয়ে) আপনার যাই অ্যাসেসমেন্ট থাকুক না কেন, যতই রাগ থাকুক না কেন, কিন্তু আজকে তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শাসক। এখন বামপন্থীদের একটা বড়ো কাজ হল—To hold the government accountable। সরকার যাতে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য হয় তা সুনিশ্চিত করা। কিন্তু একটা সরকারকে যদি আমরা সরকার হিসেবে মানতেই না পারি, তাহলে তো আমার মনে হয় সরকারকে খুব লঘু করে দেখা হয়। এবং জনগণকে বোকা ভাবা।
আমি তো বারবার বলি, ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ কথাটা বললেই ওই ‘হাওয়াই চটি’, ‘চালচোর’ এইসব বলতে থাকার মানে তো ওই যে ৪৮ শতাংশ ভোট তার কথা না ভাবা। ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ বলতে কেবল কয়েকজন নেতার কথা কেন ভাবছেন। ওই ৪৮ শতাংশ ভোট-দেওয়া মানুষের কথা ভাবুন। ৪৮ শতাংশ ভোট-দেওয়া মানুষের একটা কালেকশন, একটা সম্মিলিত অস্তিত্ব হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। তো সেই মানুষগুলির কথা ভাবুন। তাঁদের বিভিন্ন প্রয়োজন, আকাঙ্ক্ষা, কোথায় তাঁদের মোহভঙ্গ হচ্ছে, হতাশ হচ্ছেন, সেই থেকে তাঁদের বিক্ষোভ, সেসব ভাবুন।
সেই ৪৮ শতাংশকে আমি একেবারে বাদই দিয়েদিলাম, এক অদ্ভুত রাজনীতিতে। তাহলে বাকি রইল ৫২ শতাংশ। যে বাহান্ন শতাংশের ৩৮ শতাংশ আবার বিজেপিকে সমর্থন করেন, এবং যাঁদের একটা বড়ো অংশ কমিটেড দক্ষিণপন্থী। তাঁদের কাছে গিয়ে আমি আরও পাঁচটা তৃণমূল-বিরোধী কথা বলে আমার সমর্থক করে তুলতে পারব না। কাজেই আমাদের যে অডিয়েন্স, আমাদের বড়ো কাজ হল তাঁদের পাশে থাকা, তাঁদের লড়াইগুলি লড়া। দ্বিতীয়ত…
নী. হা.— আবার আপনাকে একটু আটকাচ্ছি, কারণ ঠিক এইখানে একটা প্রশ্ন আসছে— যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, কিন্তু আপনি এর আগে যে একটা বৃহত্তর বামপন্থী মঞ্চ তৈরির ডাক দিয়েছিলেন, আপনার কি মনে হয় পশ্চিমবঙ্গে সেটার সুযোগ আছে? সেটা সম্ভব? সেটা দরকার?
দী. ভ.— অবশ্যই। অবশ্যই দরকার। মঞ্চ বলতে… এই নির্বাচনে দু-তিনটে প্রয়োগ আমার ভালো লেগেছে। একটা হচ্ছে, এই যে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ স্লোগান এসেছিল, বা ‘বিজেপি হটাও, বাংলা বাঁচাও’—এ সমস্তগুলো ধরে মানুষের একটা সমর্থন চোখে পড়েছে। এই যে একটা নাগরিক সক্রিয়তা, তাঁদের মধ্যে অনেকেই বামপন্থী, আবার তারও মধ্যে অনেকেই নতুন প্রজন্মের, এই সক্রিয়তাটাকে ধরে রাখা দরকার। এটাকে আমাদের আরও বেশি করে সংহত করা খুব দরকার।
দ্বিতীয়ত, আমরা একটা প্রোগ্রাম করেছিলাম ‘২১-এর ডাক, মানুষের দাবি’। এটা বেশ ভালো সমর্থন পেয়েছিল। এবার, পশ্চিমবঙ্গে মানুষের দাবি-দাওয়াগুলোকে নিয়ে আমরা ধারাবাহিক, সংহত একটা আন্দোলন করতে পারি…
নী. হা.— এই ‘আমরা’ বলতে আপনি কাদের বোঝাচ্ছেন?
দী. ভ.— আমরা বলতে সবাইকে বোঝাচ্ছি। আমাদের পার্টি (সিপিআইএমএল—লিবারেশন) একটা ছোটো পার্টি। আমরা অবশ্যই আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবো। একই ভাবে আমার মনে হয় অনেক সমমনোভাবাপন্ন মানুষ আছেন… যেহেতু, ওই যে আমি বললাম একটা চার্নিং, একটা মন্থন চলছে, একটা বামপন্থী পুনর্বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে আমরা যাবো, ফলত এই মুহূর্তে অনেকেই, অনেকেই পালটাচ্ছেন। গতকাল পর্যন্ত যাঁদের সঙ্গে কোনো কথা হত না, আগামীকাল তাঁদের সঙ্গে কথা হবে। অবশ্যই হবে।
তৃতীয়ত আমি বলব, পশ্চিমবঙ্গে যে বিজেপি-র বিপদটা বাড়ছে, সেইখানে তৃণমূল কংগ্রেস একভাবে তার বিরোধিতা করছে। অন্যভাবে তার বিরোধিতা করার দায়িত্বটা আমাদের। কথার কথা বলছি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর ‘মুসলিম তুষ্টিকরণের’ অভিযোগ (বিজেপি) তোলার পর, উনি যে সত্যিই তা করেন না, সেটা দেখাতে গিয়ে উনি চণ্ডীপাঠ ইত্যাদি নানা কিছু করলেন। আমরা হলে এটা করতাম না। আমরা বলতাম, মানুষের যে রুজিরুটির প্রশ্ন, নানা সংকটের প্রশ্ন রাজনীতি তাই নিয়ে হোক। ধর্ম আলাদা থাকুক। শুধু প্রত্যেকে যাতে নিজ নিজ ধর্মপালনের স্বাধীনতা পান অন্যের ওপর আক্রমণ না করে সেটা সুনিশ্চিত করা হোক।
তারপর দেখুন, এই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস যে বিজেপি-বিরোধিতা করেছেন, তাতে একটা কথা ছিল যে, ওরা ‘বহিরাগত’, তার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের জয় হল। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, আদিত্যনাথ যোগী—এই যাঁরা সব বারবার এসেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে একটা স্লোগানের মতো ‘বহিরাগত’ কথাটা ব্যবহার করা হল, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু বিজেপি যে ৩৮ শতাংশের ভোট পেল, তাঁরা? আমরা যাঁরা বাংলার ইতিহাসটা ভালো করে জানি, এখান থেকেই তো হিন্দু মহাসভার২ শুরু। ফলে আমার মনে হয়, মতাদর্শগত ভাবে আরএসএস যে বিষ ছড়াচ্ছে পশ্চিমবাংলায়, সেই বিষ, সেই বিদ্বেষে মোকাবিলা আমাদেরই করতে হবে।
নী. হা.— এইখানে একটা প্রশ্ন করতেই হবে। সিপিআই(এম)-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় যে বিজেপি-কে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক শক্তিতে পশ্চিমবঙ্গে আটকে দিয়েছিল, তা নিয়ে একটুও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সংখ্যাগুরু হিন্দুদের একটা বড়ো অংশের মধ্যে মুসলমান-বিদ্বেষের বিষটা রয়েই গিয়েছিল। মতাদর্শগত ভাবে, যেটা আপনি বললেন, তা নির্মূল করার তেমন চেষ্টা হয়নি, বা করা যায়নি। নিজের চোখে দেখেছি, ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি কলকাতার অভিজাত সব এলাকায় মুসলমান বন্ধুরা দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বাড়ি ভাড়া পাচ্ছে না। কমিউনিস্টদের তখন পশ্চিমবঙ্গে প্রবল প্রতাপ। এখন বিজেপি সংসদে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় সে দলের বিধায়কের সংখ্যা ৭৭। এমত পরিস্থিতিতে সেই নষ্ট-না-করতে-পারা বীজ থেকে মহীরুহ দেখা দেবে এ আশঙ্কা তো প্রবল। আটকাবেন কীভাবে? কী করে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন আপনি?
এই জরুরি প্রশ্নের উত্তর ও অন্যান্য বিষয়ে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের মতামত পড়ুন সাক্ষাৎকারের তৃতীয় পর্বে
কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য একজন সুদক্ষ ও দূরদর্শী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এই মুহুর্তে বামপন্থার টালমাটাল অবস্থা থেকে বামপন্থার ভবিষ্যত দৃঢ় ও শক্তিশালী করে বামপন্থী ঐক্যর আহ্বায়ক হিসেবে তাঁকে দেখতে চাই।
লাল সেলাম।
অবশ্য পাঠ্য। পরের পর্বটির অপেক্ষয় রইলাম।
যা বুঝলাম “২১শের ডাকে” এই ইনিসিয়েটিভটির(সচেতন ভাবে ইংরেজিতে বলছি) র মধ্যে এক প্রথাগত বামপন্থার গভর্নমেন্ট ইন ওয়েটিং মানসিকতার বিকল্পে ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে যাবার চলন আছে। যেটা তরূণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করছে। এটাই এক বড়সড় পুর্নজাগরিত বাম মডেল হতে পারে যা খোলামনে ও নানা রূপে ক্ষমতাকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করবে। নতুন প্রজন্ম এই সদা পরিবর্তনশীল বামকেই চাইছে। এটা এমন একটা বড়সড় ইনিসিয়েটিভ যা মূলত হরাইজন্টাল চলনের পক্ষে।