গত অধ্যায়ে আমরা শেষ করেছিলাম, এক আশ্চর্য মধ্যযুগীয় কেতাব সুপশাস্ত্র-র দুয়ারে এসে। লেখক তৃতীয় মঙ্গরস। কিন্তু এইখানে সে গ্রন্থে প্রবেশ না করে, খিচুড়ি রহস্য থেকে অল্পক্ষণের জন্য সরে যাওয়ার লোভ সম্বরণ আমার পক্ষে অসম্ভব—সুপের লোভ।
সরে যাই সোজা বাল্মীকি রামায়ণে। বালকাণ্ড, দ্বিপঞ্চাশত ও ত্রিপঞ্চাশত স্বর্গ থেকে কিছু মণিমুক্ত। খেইটা এরকম— বিশ্বামিত্র ও তাঁর সেনা হাজির বশিষ্ঠমুনির আশ্রমে। মুনি তাঁদের আপ্যায়নে ভূরিভোজের আহ্বান জানান। রাজার কিন্তু কিন্তু ভাব, আপত্তি—একজন মুনির আশ্রমে এসে তাঁকে এভাবে চাপে ফেলা কি উচিত? কিন্তু মুনির জীবনে কোনো চাপ নেই, কারণ মুনির কাছে তো রয়েছে শবলা ওরফে কামধেনু, যাকে নির্দেশ দিলেই মেলে যা চাই। বোলাও ভূরিভোজ। সেই না দেখে বিশ্বামিত্র শবলাটি হাত করার ধান্দা ফাঁদেন। ভবি ভোলবার নয়। বশিষ্ঠ শুনিয়ে দেন কীভাবে এ গোরু যার যা ইপ্সা তাই পূর্ণ করে দিতে পারে। জমজমাট কাহিনি, আমরা ঢুকে পড়ি এই কিস্ সা গোয়ি-তে বাহান্ন পর্বের শেষ শ্লোক থেকে —
যস্য যস্য যথাকামং ষড়্ রসেষ্যভিপুজিতম
তৎসর্বং কামধূক দিব্যে অভিবর্ষ কৃতে মম।। (১-৫২-২২)
রসোন্নানেন পানেন লেঝ্যচোষ্যেণ সংয়ুতম
অন্নানাং নিচয়ং সর্বংসৃজস্ব শবলে ত্বর।। (১-৫২-২৩)
ইক্ষুমধুস্তথা লাজান মৈরেয়াঞ্চ বরাসবান্
পানানিচ মহার্হাণি ভক্ষাংচ্চোচ্চাবচাংস্তথা।। (১-৫৩-২)
উষ্ণাদ্যস্যৌদনস্যাপি রাশয়ঃ পর্বতোপমাঃ
মৃষ্টান্নানিচ সুপাশ্চ দধিকুল্যাস্তথৈব চ।। (১-৫৩-৩)
নানাস্বাদূরসানাং চ খাণ্ডবানাং তথৈবচ
ভোজনানি সুপূর্ণানি গৌড়ানি চ সহশ্রস্য।।
আহা! এই তিন শ্লোকে বাল্মীকি রামায়ণকালীন—মানে ৩০০ পূর্বসাধারণাব্দর পরবর্তীকালে১—ভোজনের কী অপূর্ব বিবরণ! শুধু বিবরণ নয়, সুআহার কী হওয়া উচিত যেন তার সংজ্ঞা। রামকৃষ্ণ মিশনে বিদ্যালাভের ফলে যেটুকু সংস্কৃত শিখতে বাধ্য হয়েছিলাম, তার বাইরে যে এ ভাষাটির আর কোনো চর্চা করিনি এ পরিতাপ আমার ঘোচার নয়। কাজেই এ অংশটা যে এখানে তুলে দিয়েছি বাংলা হরফে তা আসলে একটি নাগরি লিপির সংস্কৃত পাঠের অনুকরণে। আর তার একটা বিশেষ কারণ আছে। তাতে আসছি, তার আগে ঠিক এই শ্লোকগুলিরই পদ্যে ইংরেজি তরজমা দেখি। করেছেন খাস ইংরেজ র্যালফ টি এইচ গ্রিফিথ২, যিনি ছিলেন বেনারস কলেজের অধ্যক্ষ—
Each dainty cate, each goodly dish,
Of six-fold taste as each may wish—
All these, O cow of heavenly power,
Rain down for me in copious shower:
Viands and drink for tooth and lip,
To eat, to suck, to quaff, to sip—
Of these sufficient, and to spare,
O plenty-giving cow, prepare…
Honey she gave, and roasted grain,
Mead sweet with flowers, and sugarcane.
Each beverage of flavour rare,
And food of every sort, were there:
Hills of hot rice, and sweetened cakes,
And curdled milk and soup in lakes.
Vast beakers foaming to the brim
With sugared drink prepared for him,
And dainty sweetmeats, deftly made,
Before the hermit's guests were laid.
শব্দ ধরে ধরে দেখলে—ষড়্ রসেষ্যভিপুজিতম—ছয় রসের যে যা চায়, অভিবর্ষ কৃতে মম—আমার কৃতার্থে বর্ষণ করো, অন্নেন—খাদ্য (ইঙ্গিতে যা চিবাতে হয়, চর্ব্য), পানেন—যা পান করা যায়, লেঝ্যচোষ্যেণ—যা চাটা যায় ও চোষা যায়। ইক্ষুমধু, লাজান—সেঁকা শস্য (মুড়ি নয় তো? গদ্য তরজমায় হরিপ্রসাদ শাস্ত্রী৩ অবশ্য বলছেন ‘ক্রাশ্ড বার্লি’), মৈরেয়াঞ্চ বরাসবান— সেরা পেয়ালায় মদ (গ্রিফিথ সাহেব কেন সলজ্জ ‘বেভারেজ’ বলেই ছেড়ে দিলেন? হিন্দি তরজমায় তো ডি পি শর্মা৪ সাফ বলছেন ‘মদিরা’ আর হরিপ্রসাদ শাস্ত্রী বলছেন ‘ওয়াইন’!), পানানি—পেয়, ভক্ষাংচ্চোচ্চাবচাং—হরেক কিসিমের খানা, উষ্ণাদ্যস্যৌদনস্যাপি রাশয়ঃ পর্বতোপমাঃ—পর্বতপ্রমাণ গরম ভাত, মৃষ্ঠান্নানি—মিষ্টি পিঠে, দধি আর স্যুপের প্রপাত বা হ্রদ, খাণ্ডবানাং—মেঠাই, ভোজনানি—সুখাদ্যসকল, গৌড়ানি—গুড়, সহস্রশঃ—হাজারে হাজারে।
রুদ্ধশ্বাস! ভূরিভোজে থাকবে চর্ব্যচোষ্যলেঝ্যপেয়—খাবার তরিকার দিক থেকে খানার চারপ্রকার। আবার বিশুদ্ধ রসের বিচারে—ষড়রস, ছয় রসের খানা—ফুটনোটে বলে দিচ্ছেন গ্রিফিথ: মিষ্টি, নোনতা, কটু, তেতো, টক এবং কষাটে (astringent), শাস্ত্রী শেষেরটা নিয়ে একটু দ্বিমত—দিচ্ছেন ‘acrid’, ঝাঁঝালো। ও আর ভালো কথা, এতক্ষণ নি’মতনামার আজগুবিপনায় আমাদের চোখ ছানাবড়া হচ্ছিল, কিন্তু রামায়ণকে টেক্কা দেয় কে?—গরম ভাতের পর্বত, স্যুপ আর দইয়ের প্রপাত, পরিবেশিত পদ হাজারে হাজারে (কোথায় লাগে মহামতি আকবর বাদশার একশো পদের দস্তরখওয়ান)!!
শ্বেত কামধেনু। শিল্পী কে মুরলীধরণ। অ্যাক্রিলিক অন পেপার। ২০০১। সূত্র সাহাপিডিয়া
কিন্তু আমরা এই অত্যাশ্চর্য বিবরণে প্রবেশ করেছিলাম সুপশাস্ত্র পাঠ মুলতুবি রেখে। তাই এই বিবরণিতে আমাদের কাছে একটি বিশেষ শব্দ বিশেষ আকর্ষণীয়—সুপাশ্চ। অর্থাৎ সুপও। এখন প্রশ্ন হল সংস্কৃত ‘সুপ’ কথাটার মানে কী? খতিয়ে দেখা দরকার। খতিয়ে দেখা দরকার এই কারণেই যে এ শব্দ যেমন মজাদার তেমনই রহস্যময়। সবার আগে তবে একটি প্রামাণ্য অভিধান খোলা যাক—মনিয়ার-উইলিয়াম্স সংস্কৃত ইংরেজি অভিধান:
সুপ—Sauce, soup, broth (esp. prepared from split or ground peas with roots and salt) Lit. MBh. Lit. R. Lit. Suśr. A cook Lit. L. (f ([ī] ). g. [gaurādi] ) A vessel , pot , pan Lit. L. an arrow Lit. L.
অর্থাৎ, বাংলায় যাকে বলব ঝোলের মতো তরল সিদ্ধ খাদ্যবস্তু (যা বিবিধ মটরের সঙ্গে মূলজাত তরকারি, যেমন সাদা মুলো, মিষ্টি আলু, কিছু কিছু কচু, গাজর আর নুন দিয়ে তৈরি করতে হয়)। কিংবা পাচক। মহাভারত, রামায়ণ, আয়ুর্বেদের সুশ্রুত সংহিতায় এর উল্লেখ আছে। ‘গৌরাদি’-র জটিলতায় আমরা ঢুকব না, ব্যকরণের বিচারে এক বিশেষ গোষ্ঠীর শব্দ। কিন্তু দেখছি সুপের মানে হতে পারে পাত্র, আবার তিরও!
এবার প্রশ্ন হল এই সংস্কৃত ‘সুপ’ থেকেই কি ইংরেজদের সম্ভবত সবথেকে ব্যবহৃত খাদ্যটি এসেছে—Soup? অক্সফোর্ড অভিধানে তেমন মোটেই কোনো ইঙ্গিত নেই—Middle English from Old French soupe ‘sop, broth (poured on slices of bread)’, from late Latin suppa, of Germanic origin। বস্তুত কোনো প্রামাণ্য ইংরেজি অভিধানে বা ভাষাতত্ত্বের বইতে ইংরেজি Soup সংস্কৃত সুপ থেকে এসেছে এমনটা আমি অন্তত পাইনি। কিন্তু কী আশ্চর্য দুটি শব্দের একই উচ্চারণ একই মানে! কী করে হল? কেউ জানে না!
তবে শুধু মহাভারত, রামায়ণ বা সুশ্রুতেই নয়, ‘সুপ’ কথাটি মিলবে মনুস্মৃতিতেও। আর সেটা আমাদের এই খিচুড়ির খোঁজে ভারী মজার এক মাত্রা যোগ করবে! শ্লোকটা এরকম—
গুণাংশ্চসুপশাকাদ্যান্ পয়োদধিঘৃতংমধু
বিন্যসেতপ্রয়তঃপূর্বমূমাবেবসমাহিত।।
গঙ্গানাথ ঝা মহাশয়ের ইংরেজি তরজমার বাংলা করলে দাঁড়াবে—আনুষাঙ্গিক যা কিছু সুপ, শাক-তরকারি ইত্যাদি, দুধ, দধি, ঘি এবং মধু / অমল স্থিতধী চিত্তে তাহাকে মাটিতে স্থাপন করিতে হইবে। ভারী কৌতূহলের বিষয় এই যে, এরপরেই ঝা ‘সুপ’ কথাটিকে বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করে বলে দিচ্ছেন—‘sūpa’ is a special preparation of Mudga and other grains cooked with rice, and called ‘barānna’। মুগ, অন্যান্য শস্য ও চাউল সহযোগে পাক করা খাদ্য। যার আর-এক নাম ‘বরান্ন’! এই ব্যাখ্যা যদি ঠিক হয়, তবে তো মনুস্মৃতির এ শ্লোকে খিচুড়ির গন্ধ প্রবল। কেবল মুশকিল হল, ‘বরান্ন’ শব্দটি আমি আর কোত্থাও খুঁজে পাইনি, আর যেহেতু ঝা এর কোনো সূত্র দেননি, আমি এই মনুস্মৃতির খিচুড়িটির ওপর একটি বড়ো-সড়ো প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে রাখলাম। প্রসঙ্গত, হরিচরণেও এমন কোনো শব্দ নেই।
কিন্তু এই ‘সুপ’ প্রসঙ্গে ইমনিয়ার-উইলিয়াম্স অভিধান বলছে ‘সুপশাস্ত্র’ নামের শাস্ত্রটির কথাও—‘Work on cookery’। কিন্তু সে ওয়ার্ক তৃতীয় মঙ্গরস-র নয় ভীমসেন বলে এক ব্যক্তির। তার আবার আর-এক নাম নাকি পাকশাস্ত্র। বহু খুঁজেও অবশ্য ভীমসেন নামের কারও কোনো সুপ বা পাক কোনোটিই আমি পাইনি। কাজেই এবার মানে মানে মঙ্গরস মহাশয়ের সুপশাস্ত্রে ফিরে যাওয়াই ভালো। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!
(ক্রমশ… পরের কিস্তি আগামী বৃহস্পতিবার)
বরান্ন শব্দটা বিশ্বকোষে আছে তো! আমার পাড়ার লোককে এমন করে অবহেলা করবেন না!!
"বরান্ন (ক্লী) : বরং অন্নং। ভর্জ্জিত ধান্য, দ্বিদলকৃত শ্রেষ্ঠান্ন। শমীধান উত্তমরূপে ভাজিয়া তাহার দাইল করিতে হয়, পরে উহা জলে উত্তমরূপে পাক করিয়া সুসিদ্ধ হইল তাহাকে বরান্ন কহে। (দ্রব্যগুণ সংগ্রহঃ চক্রপাণি দত্ত)।" [বিশ্বকোষ, সপ্তদশ ভাগ; ১৩১৩ বাঃ, নগেন্দ্রনাথ বসু, সঙ্কলিত ও প্রকাশিত]
পুনশ্চঃ M. M-W. কিন্তু পরের (১৮৭২) সংস্করণে লিখেছেন, "সূপঃ cf. Old Germ, suf, sufan, saufjan; Old Norse, sup; Anglo-Sax, supan; (cf. = = confer, compare)"। ওল্ড নর্সে কিন্তু supa শব্দটা অছে, পান করা অর্থে।
হ্যাঁ,বরান্ন বিশ্বকোষে আছে।
<a href="https://ibb.co/G3KBP4J"><img src=" alt="page546-1024px-djvu" border="0"></a>
<a href="https://ibb.co/G3KBP4J"><img src=" alt="page546-1024px-djvu" border="0"></a>
সংস্কৃতেও 'সুপ' ছিল, জানানোর জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল, মূল প্রতিপাদ্য নিয়ে। ইংরেজি ‘স্যুপ’ সংস্কৃত ‘সুপ’ থেকে আসেনি, সেটি এই লেখায় কীরূপে প্রমাণিত হল ? লেখক বলেছেন, 'বস্তুত কোনো প্রামাণ্য ইংরেজি অভিধানে বা ভাষাতত্ত্বের বইতে ইংরেজি Soup সংস্কৃত সুপ থেকে এসেছে এমনটা আমি অন্তত পাইনি।' পুরো লেখায় এই নিয়ে দুইটি বাক্য ,যে ইংরাজি অভিধানে পাওয়া যায়নি,তাই দিয়ে কীভাবে প্রমাণিত হয় ,যেখানে সংস্কৃত ইংরাজির আরেক প্রামাণ্য অভিধান লেখক নিজেই দিয়ে বলছেন,সেখানে দুটির মানে একই লেখা ?
ইংরাজি থেকে সংস্কৃত বা ভাইসি ভার্সা হওয়ার সম্ভাবনা এতদ্বারা তো নাকচ করা যাচ্ছেনা। সংযোগ নাই থাকতে পারে,কিন্তু এই লেখা পড়ে সেই নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। বরং এ আরো গবেষণা দাবি করে,সময়ক্রম,আরো রেফারেন্স ইত্যাদি মিলিয়ে।
গৌণ কথা, আনুষাঙ্গিক , ইপ্সা বানানগুলি পারলে সংশোধন করে দেবেন।
সুপ নিয়ে আগ্রহী হয়ে দেখতে গিয়ে একটি গ্রুপে এই আলোচনার সন্ধান পেলাম। অনেক তথ্যসূত্র,অনেক খেই ধরানো আছে,এর থেকে আরো আলোচনা হতে পারে। লেখায় এসব প্রসঙ্গ এলে,গবেষণা আরেকটু গভীরে গেলে ভাল লাগত , ভবিষ্যতে আসার আশায় রইলাম।
@ ar / aro SOUP: আমি এ ক্ষেত্রে OXFORD-কেই প্রামাণ্য ধরেছি, তাই এই সিদ্ধান্ত।
বরান্ন হদিশ দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।