নাট্যশাস্ত্রই শুধু নয় মোটেই, কৃসর বা কৃসরা খানাটির উল্লেখ অভিধান ছাড়াও বিবিধ ধরনের শাস্ত্রে রয়েছে। যেমন ধর্মশাস্ত্রে। মনুস্মৃতি বা মনুর ধর্মশাস্ত্রে। খানা-ডিটেকটিভদের কাছে মনুস্মৃতি এক রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার। একাধিক কারণে। মনুর ধর্মশাস্ত্রের যে পাঠ আধুনিক কালে মিলেছে তার রচনাকাল ধরা হয়ে থাকে ১০০ পূর্বসাধারণাব্দ১ থেকে ১০০ সাধারণাব্দের২ মধ্যে কোনো একসময়ে। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে এ এক অনিশ্চিত সন্ধিক্ষণ। যেমনটা দীর্ঘ আলোচনা করেছেন প্রণম্য ইতিহাসকার রোমিলা থাপার৩। গভীরে ফাটল ধরছে ভারতীয় সমাজের সাবেকি চরিত্রে, আর সে ফাটল ধরাচ্ছে বাণিজ্যের প্রসার। দেশের মধ্যে, কালাপানি পার করে সুদূর ইউরোপে রমরম করে ছড়িয়ে পড়ছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের দাপট। পাশাপাশি বাড়ছে কৃষিকাজ—অরণ্য সাফ করে, অনাবাদি জমিতে লাঙল চালিয়ে। মনুর ধর্মশাস্ত্রও ঘোষণা করে দিচ্ছে—প্রথম লাঙল যার, জমি তার৪।
আর এরই সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে শহুরে সভ্যতার প্রথম ছবি। তৈরি হয়ে যাচ্ছে এক নয়া আর্থ-সামাজিক লব্জ—শ্রেণি। এ শ্রেণি কিন্তু আজকের পরিভাষার ‘class’ নয়, বরং ইতিহাসবিদেরা তার তরজমা করেছেন ‘guild’। পশ্চিমি অর্থে যা গিল্ড, হুবহু ঠিক তা-ও নয়, জানাচ্ছেন থাপার। এ হল ‘পেশাদার মানুষ, ব্যবসায়ী আর কারিগরদের একটা গোষ্ঠী’৫। ছড়িয়ে পড়া শহরে শহরে গঠিত হচ্ছে এই শ্রেণি আর তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে পেশার নিয়ম-কানুন, উৎপাদিত পণ্যের মান ও মূল্য, যাতে কারিগর ও ক্রেতা দু-পক্ষের স্বার্থই রক্ষিত থাকে। সেই পণ্য খরিদ করে ব্যাবসার করনেওয়ালাদের জন্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে আর-এক নয়া লব্জ—‘বণিজ’, যাদের আমরা আজও চিনি ‘বনিয়া’ বা ‘বানিয়া’ বলে! সেই বানিয়ারা সেসব পণ্য মাল-বওয়া হরেক কিসিমের পশুর পিঠে বোঝাই করে বিশাল বিশাল দলে চলে যাচ্ছে শহর থেকে শহরে শহরে। তৈরি হয়ে যাচ্ছে হাইওয়ে। নানা সামাজিক উৎসবে দাপিয়ে উড়তে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় শ্রেণির পতাকা৬। শ্রেণির পক্ষ থেকে ধর্মীয় সংগঠনে দেওয়া হচ্ছে বিপুল অনুদান। বিশেষ করে বিভিন্ন বৌদ্ধ সংঘে, তাদের স্তূপ নির্মাণের সাহায্যে৭। সমাজের ওপর ব্রাহ্মণ্যবাদের নাভিশ্বাস-তোলা নাগপাশকে চ্যালেঞ্জ করে বেশ কয়েকশো বছর আগেই গৌতম বুদ্ধর বাণী থেকে জন্ম হয়েছে এক নয়া ধর্মের। পরবর্তী কালে যা হুহু করে ছড়িয়ে পড়েছে দেশ জুড়ে। তৈরি হয়ে গিয়েছে সেধর্মেরও সুনির্দিষ্ট আচার এবং তার প্রচার ও সুরক্ষার জন্য গড়ে উঠেছে সংঘ। এইসব বৌদ্ধ সংঘের সঙ্গে ইত্যবসরে বিগত কয়েক শতক ধরেই আবার রাজন্যবর্গের একাংশের গড়ে উঠেছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ফলত, কালে কালে তৈরি হয়ে যাচ্ছে একটা রাজন্য-শ্রেণি-সংঘ গাঁটছড়া৮।
আর এই গাঁটছড়ায় মহাচ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাচ্ছে ব্রাহ্মণদের দাপটে থাকা গোটা ব্যবস্থাটাই। কিন্তু এই নয়া ব্যবস্থাকে ওয়াক-ওভার দেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কাজেই সেই পুরোনো ব্যবস্থাটাকে আঁটোসাঁটো একটা বাঁধুনিতে পোক্ত রাখতে ব্রাহ্মণ সুপণ্ডিতরা তৈরি করে ফেলছেন বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র, যার মধ্যে ‘সবথেকে রক্ষণশীল’ হল মনুর ধর্মশাস্ত্র। যে ধর্মশাস্ত্র ব্রাহ্মণদের সুবিধাভোগের ব্যবস্থা বজায় রাখতে একদিকে যেমন মানুষের মধ্যে পদে পদে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল সে সুবিধা না দিলে হরেক কিসিমের কাজে ব্যর্থ হওয়ার ভয়, তেমনই সমাজে ব্রাহ্মণদের ‘বিশুদ্ধতা’ বজায় রাখতে ব্রাহ্মণদের জন্যও তৈরি করে দিচ্ছিল নানা অনুশাসন যা মানতেই হবে, যে অনুশাসনে বেদ অধ্যয়নই শুধু যথেষ্ট নয়, মেনে চলতে হবে শত শত বিধিনিষেধ। যে বিধি-নিষেধ অমান্য করলেই ঘটবে ভয়াবহ পরিণতি—ইহকালে এবং পরকালে।
এই গোটা ধর্মশাস্ত্রীয় ব্যবস্থাটার অন্যতম হাতিয়ার ছিল খাবার। হরেক কিসিমের খাবার। যে-কোনো কাজে সাফল্যের জন্য করতে হবে যজ্ঞ, আর তাইতে পদে পদে ব্রাহ্মণদের দিতে হবে ভূরিভোজ, নইলেই নাকি কাজ পণ্ড। এটা দান—দক্ষিণা। অনেক প্রাচীনকালে যা ছিল বহুলাংশেই স্বেচ্ছায়, মনুর ধর্মশাস্ত্রের কালে তা হয়ে গেল রীতিমতো ব্রাহ্মণদের জন্য ‘ফি’৯! আর তা দেওয়ার একটি প্রধান উপায় ছিল খাদ্য। খাবার আর নেহাত পেট ভরানোর কিংবা স্বাদের সাধ মিটানোর বস্তু রইল না, তা হয়ে গেল একটা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা কায়েম রাখার প্রচেষ্টার অন্যতম হাতিয়ার। কেমন করে ব্যবহৃত হত এই খাদ্যাস্ত্র? খোলা যাক মনুস্মৃতি১০।
মনুস্মৃতির যে মূল-সহ ইংরেজি তরজমা আমরা খুলব, তার সঙ্গে রয়েছে মেধাতিথির দীর্ঘভাষ্য। কে ইনি? নবম শতকের মহাপণ্ডিত, হয় খাস কাশ্মীরি নতুবা অন্তত কাশ্মীরবাসী। মনুস্মৃতির শ্লোক ধরে ধরে বিস্তারিত টীকা দিয়েছিলেন তিনি, যা কিনা নিজেই হয়ে উঠেছে মূল মনুস্মৃতি লিখিত হওয়ার প্রায় হাজার বছর পরেও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কীভাবে দেখছিলেন সেই শাস্ত্র তার এবং টীকাকারের সময়ের সমাজের এক ভারী কৌতূহলোদ্দীপক ছবি। এই মনুস্মৃতির তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায় জুড়ে রয়েছে ‘গৃহস্থের কর্তব্য’-বিধান। যে অংশে চোখ বুলালেই বোঝা যাবে ব্রাহ্মণকে পদে পদে নিখরচায় নানা কিসিমের খানা জোগানোর ব্যবস্থা কায়েম রাখা ছিল মান্যবর মনুর একটি প্রধান উদ্দেশ্য। যেমন, তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় বিভাগের ৮২ নম্বর শ্লোক বলে দিচ্ছে—
প্রতিদিন শ্রাদ্ধ দান করিতে হইবে খাদ্য সহকারে
অথবা জল কিংবা দুগ্ধ ও ফলমূল সহযোগে, যাহাতে পিতৃপুরূষ উৎফুল্ল থাকেন১১।
এইখানে মেধাতিথি টীকা দিচ্ছেন, খাদ্য মানে বার্লি, তিল ইত্যাদি। আর ফলমূল, দুধও চলতে পারে। আর তারপরের শ্লোকেই আমাদের বলা হচ্ছে—
এবং তাহাতে (সেই শ্রাদ্ধতে), যাহা পঞ্চযজ্ঞের অংশবিশেষ, অন্তত একজন ব্রাহ্মণকেও আহার করাইতে হইবে
এবং এই উপলক্ষে সে বৈশ্বদেবদিগের সম্মানে কোনও ব্রাহ্মণকে আহার করাইবে না।।
মেধাতিথি বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এখানে পঞ্চযজ্ঞের অন্তর্গত যে শ্রাদ্ধর কথা বলা হচ্ছে তা ‘শুধুমাত্র তর্পণ, অর্থাৎ জল-প্রদান নয়, তর্পণ এবং ব্রাহ্মণভোজন একত্রে’। আর বুঝিয়ে দিচ্ছেন খাওয়ানো দরকার একজনকে তো বটেই, ভালো হয় যদি খাওয়ানো যায় ‘যতজন ব্রাহ্মণকে সম্ভব’। আর মনে রাখতে হবে গৃহস্থকে নাকি এ কাণ্ড করতে হবে ‘প্রতিদিন’। কিন্তু ব্রাহ্মণদের সুযোগ-সুবিধায় টান পড়া ছাড়া মনুমুনির মনে আর-একটা দুশ্চিন্তাও ঢুকেছিল—ব্রাহ্মণরা এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে আর তেমন আগমার্কা ব্রাহ্মণ থাকছেন না। কাজেই তাঁদের ঘাড়ে চাপানো দরকার কঠোর বিধি-নিষেধ, যার অন্যতম খাবার। এই মনুস্মৃতির পঞ্চম অধ্যায়ের দ্বিতীয় বিভাগের শিরোনাম—নিষিদ্ধ খাদ্য। এ বিভাগে রয়েছে চোদ্দোটি শ্লোক, যার মধ্যে ১১টি শ্লোক জুড়ে আছে হারাম-খানার তালিকা, আর বাকি তিনটি সেসব খানা খেলে কী সব্বোনাশ ঘটবেই তার বর্ণনা।
এই এগারোটি শ্লোকের তরজমা পড়ে এই একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আমি দ্বিজদের জন্য নিষিদ্ধ খানার মোটামুটি যে তালিকা তৈয়ার করতে পারলাম সেটি চমৎকার—রসুন, পেঁয়াজকলি, পেঁয়াজ, মাশরুম, যে-কোনো গাছ থেকে বের হওয়া লাল রঙের আঠা, রস ইত্যাদি কিছু, সদ্য বাচ্চা-দেওয়া গোরুর দুধ, যে গোরু দু-বেলার পরিবর্তে একবেলা দুধ দেয় তার দুধ, উটের দুধ, ভেড়ার দুধ, ছাগলের দুধ, এক-ক্ষুরের পশুর (মানে ঘোড়ার) দুধ, বুনো জন্তু যেমন গোরু (হ্যাঁ মেধাতিথি তাই বলছেন, তার মানে কি তখনও বুনো গোরু ঘুরে বেড়াত ভারতে, নিদেন কাশ্মীরে? বিজ্ঞান যে বলছে ১০ হাজার ৫০০ বছর আগেই তুরস্কের আনাতোলিয়া, ইরান এইসব অঞ্চলে গোরু ‘গবাদি পশু’ হয়ে গিয়েছিল?), হাতি, বাঁদর ইত্যাদি, নারীর দুধ, টকে যাওয়া খাদ্য, (টক খাদ্যের মধ্যে দই এবং দই থেকে যা-কিছু তৈরি হয় সবই খাওয়া চলবে। এবং যা কিছু বিশুদ্ধ ফলমূল ও ফুল থেকে তৈরি হতে পারে তাও খাওয়া যাবে), সারস বা শকুনের মতো মাংসাশী পাখি (ময়ুর খাওয়া চলতে পারে কারণ ময়ুর কাঁচা মাংসও খায় আবার রান্না করা মাংসও খায়!), গাধা, খচ্চর, চড়াইপাখি, গ্রামের মোরগ, টিয়া এবং স্টার্লিং, কাঠঠোকরা, কসাইখানার মাংস, শুখা মাংস, গ্রামের শুয়োর (তার মানে বুনো শুয়োর খাওয়া চলবে, জানাচ্ছেন মেধাতিথি), মাছ (কখনও না, কেবল ভগবান এবং পিতৃপুরুষের উদ্দেশে অর্পণ করে পাঠীন আর রোহিত মাছ খাওয়া যেতে পারে। মালয়েশিয়াতে যে পাটিন মাছ পাওয়া যায়, একেবারে পাঙাস মাছের মতো, এই পাঠীন কি তাই? রোহিতই কি রুহু/ রুই?), একা ঘুরে বেড়ানো পশু, অজানা পশু ও পাখি, বাঁদর, শিয়ালের মতো পাঁচ-নখের জানোয়ার (মেধাতিথি বলছেন, তবে পাঁচ-নখের জন্তুদের মধ্যে খাওয়া যেতে পারে—শজারু, হেজহগ, কুমির, গণ্ডার এবং কচ্ছপ, আর উট ছাড়া একপাটি দাঁত আছে এমন যে-কোনো জন্তু)। আর এই নিষিদ্ধ খাদ্যের তালিকাতেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি কৃসরা—
বৃথাকৃসরাসংয়াবম্ পায়াসাপুপমেবচ
অনুপাকৃতমাংসানি দেবান্নানি হবিংষিচ।।
কৃসরা, সংয়াব যা বৃথা পাক করাইয়াছে, পায়েস ও পিঠা
মাংস, যাহা পবিত্র করা হয় নাই, হবিষ্য, যজ্ঞে প্রদত্ত খাদ্য।।
তবে মেধাতিথি জানিয়ে দিচ্ছেন কৃসরা, পায়েস, পিঠে এগুলি এমনিতে নিষিদ্ধ খাদ্য নয়। লক্ষণীয়, তাঁর মতে, ওই বৃথা শব্দটি যা ইঙ্গিত দিচ্ছে তা হল, সেই কৃসরা, পায়েস ও পিঠে খাওয়া চলবে না যা কিনা দেবতা ও পিতৃপুরুষকে অর্পিত হয়নি। আর ‘সংয়াব’ খাদ্যটির বিষয়ে মেধাতিথির টীকাটি ভারী কৌতূহলোদ্দীপক—‘সংয়াব একটি বিশেষ ধরনের খাদ্য, যাহা মাখন, চিনি, তিল এবং ওইপ্রকার দ্রব্য সহযোগে প্রস্তুত, শহরাঞ্চলে তাহা বহুল পরিচিত!’ নবম শতকের শহরাঞ্চলের হিট ফাস্ট-ফুড নাকি?!
কিন্তু আমাদের খিচুড়ি খোঁজে সে টীকার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেধাতিথির টীকার সেই অংশ যেখানে পরিষ্কার বলা হচ্ছে, ‘তিল সহযোগে চাউল পাক করিলে তাহাকে কৃসর বলে’! আর কৃসর-র সেই রেসিপিরই পক্ষে রায় দিয়ে গঙ্গানাথ ঝা জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘এই শ্লোকটি স্মৃতিতত্ত্বতে উদ্ধৃত হয়েছে… এবং তা ছন্দোগ পরিশিষ্ট উদ্ধৃত করে কৃসর-র সংজ্ঞা দিচ্ছে—চাউল ও তিল একত্রে পাক করা।’ বটে? একেবারে কৃসরার সংজ্ঞা মিলবে এই ছন্দোগ পরিশিষ্ট নামের পুস্তকে? পড়ে দেখতে হচ্ছে মশাই।
একটি বিশিষ্ট সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান জানাচ্ছে, ছন্দোগ পরিশিষ্ট আর-একটি নামে পরিচিত—কর্মপ্রদীপ১২। রচয়িতা কাত্যায়ন। আমাদের খিচুড়ির প্রাচীনতার রহস্য সমাধানে এ ভারী জরুরি ক্লু। আমি ফেলুদার শিষ্য, খতিয়ে পরখ করে না দেখে ছাড়ছি না।
এর মূল পাঠ সহ ইংরেজি তরজমা করেছেন জয়ন্ত ভট্টাচার্য১৩। খুলে যা দেখা গেল তা খুব সংক্ষেপে এই—হিন্দু ধর্মের আচার নিয়ে বিবিধ নিবন্ধে উত্তর ভারত থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত পণ্ডিতেরা কর্মপ্রদীপ শাস্ত্রটিকে উল্লেখ করছিলেন ছন্দোগ পরিশিষ্ট নামে। এতে রয়েছে সামবেদীন, অর্থাৎ যাঁরা সাম বেদ অধ্যয়ন করেছেন, তাঁদের জন্য বিভিন্ন আচারের বিধান। এটি কাত্যায়নস্মৃতি বা গোভিলস্মৃতি নামেও পরিচিত। প্রশ্ন হল কোন্ সময়কালে এটি রচিত? পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এই ছন্দোগ পরিশিষ্ট বা কর্মপ্রদীপে কোন্ কোন্ অন্যান্য শাস্ত্র ও স্মৃতির উল্লেখ রয়েছে, কোন্ কোন্ শাস্ত্রেই বা এর উল্লেখ রয়েছে, এতে উল্লিখিত দৈর্ঘ্য পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত মান—রত্নি, পঞ্চম শতকের প্রথম দশকে ভারতে আসা চিনা পরিব্রাজক ফা-শিয়েন যে শহরে দেখেছিলেন শুধু ‘শূন্যতা আর নির্জনতা’ এতে বর্ণিত সেই গয়া শহরেরই গমগমে পিণ্ডদান অনুষ্ঠান, যাজ্ঞবল্ক শাস্ত্রে এর উল্লেখ, এইসব ক্লু ধরে ধরে জয়ন্তবাবু দুঁদে গোয়েন্দার মতো এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, ছন্দোগ পরিশিষ্ট বা কর্মপ্রদীপ রচিত হয় ৫০০ থেকে ৭০০ সাধারণাব্দের মধ্যে১৪।
আর ঠিক যেমনটা স্মৃতিতত্ত্বে উল্লিখিত রয়েছে, এ শাস্ত্রের ঊনত্রিশটি অধ্যায়ের মধ্যে পঁচিশতম অধ্যায়ে আট নম্বর শ্লোক অনুষ্টুপ ছন্দে উচ্চারিত হল সেই রেসিপি যাকে আমরা নাম দিতেই পারি ‘কাত্যায়নী কৃসরা’—
শ্বাভিচ্ছলাকা শললী তথা বীরতরঃ শরঃ
তিলতণ্ডুলসম্পক্ক কৃসর সো’ভিধীয়তে।।
(শললী শজারুর কাঁটা তথা বীরতর হল শর
তিল ও তণ্ডুলএকত্রে পাক করিলে তাহাকে বলা হইবে কৃসর)
বোঝো! কৃসরা বলতে মেধাতিথি যা বুঝিয়েছেন মনুমুনিও যদি তা-ই বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে সেই পূর্বসাধারণাব্দ ১০০ বা তার আশপাশের সময়ে এ খানা ছিল তিল-চালের মিশ্র পাক। মেধাতিথির সময়ে, মানে নবম শতকেও কৃসরা বলে যে খানা চলছিল তাও ছিল তিল আর চালের মিশ্রণ। আর যদি ছন্দোগ পরিশিষ্ট ধরি, তবে পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেও কৃসরা নামে তৈয়ার হচ্ছিল মোটামুটি একই খানা। সোজা বাংলায়, ‘কৃসর’ যদি হয় খিচুড়ির পূর্বজ তবে সেই পূর্বসাধারণাব্দ ১০০ থেকে সাধারণাব্দ নবম শতক পর্যন্ত, মানে পাক্কা হাজার বছর সে খানা ছিল তিল ও চালের মিশ্রণ।
(ক্রমশ… পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার)