বাংলার প্রথম পাকবিধি পুস্তক বা কুকবুক পাকরাজেশ্বরঃ। কিন্তু গতদিন দেখেছিলাম, তাতে খিচুড়ি ব্যাপারটাই নেই। তাই সে কেতাবের মোহ কাটিয়ে আপাতত আমাদের ঢুকে পড়তে হবে এর ভ্রাতৃপ্রতিম দ্বিতীয় বইটিতে—ব্যঞ্জন রত্নাকর। সে কেতাবও ওই একই ‘মহতাবচন্দ বাহাদুরের অনুমত্যানুসারে ও ব্যয় দ্বারা’ প্রকাশিত, ১৮৫৮ সালে। এও আশ্চর্য যে বুলাকি দাসের আলোয়ানের পাক্কা সিকি শতক আগে প্রকাশিত হলেও এই ব্যঞ্জন সে কেতাবের মতোই অনূদিত একটি সংকলন। এর গোড়াতেই ‘গ্রন্থপরিচয়’ অধ্যায়ে পষ্ট লেখা আছে, ‘… অধুনা বর্দ্ধমানাধিপতি তদ্বিষয়ে উৎসুক হওত, পরীক্ষা করিয়া মুন্শী মহম্মদি খোশনবিশ ও শ্রীযুক্ত তারিণীচরণ গঙ্গোপাধ্যায়, মুন্শী গোলামরব্বাণী এবং শ্রীযুক্ত শ্রীনারায়ণ হাজরা দ্বারা অনুবাদিত করিলেন’। কী থেকে অনুবাদিত করিলেন? গ্রন্থপরিচয় জানাচ্ছে ‘নিয়ামৎ খাঁন’ নামক পুস্তক থেকে ‘অবিকল অনুবাদ’। আমি প্রায় নিশ্চিত এই ব্যঞ্জন রত্নাকরের এই তরজমাকারদের হাতে ছিল খওয়ান-ই-আলোয়ান-ই-নি’মত এবং সম্ভবত নুসখার কোনো না কোনো একটি পাঠের কপিও। এ বিষয়ে আমি অন্যত্র দীর্ঘ আলোচনা করেছি।১ তাই এখন সোজা ঢুকে পড়ি বর্ধমান মহারাজের খিচুড়ির হেঁশেলে। পৃষ্ঠা ১৭৪ থেকে ১৭৭, পর পর পেয়ে যাচ্ছি—কট্ খেচরান্ন, দাউদখানি খেচরান্ন, মোকম্বর খেচরান্ন, গুজরাটী খেচরান্ন, যাহাঙ্গীরি খেচরান্ন এবং জাহাঙ্গীরি নির্জল খেচরান্ন। আর তার ঠিক আগে, ১৭২ পৃষ্ঠায়, পোলাওয়ের বিভাগে ঠিক নুসখার মতোই পেয়ে যাচ্ছি খেচরান্ন পলান্ন! জাহাঙ্গির বাদশার নামে ‘য’-টি মুদ্রণপ্রমাদ বলেই ধরে নিচ্ছি। কিন্তু এটা লক্ষ করতেই হবে শাহজাহান ও আলমগির বাদশার হেঁশেলে যা চলে আসছিল ‘বে-আব’, জলহীন, খিচুড়ি বলে, ১৮৫৮ সালে এসে তাতেও জুড়ে গেল সেলিম বাদশাহের নাম!
বর্ধমানের রাজা মহতাবচন্দ বাহাদুর। প্রতিকৃতিটি আনুমানিক ১৮৬০-৬৫ সালে অঙ্কিত। সূত্র: উইকিপিডিয়া
এবার প্রথম রহস্য হল—‘খেচরান্ন’ ব্যাপারটা কী? হরিচরণ শর্ম্মা মহাশয়ের উত্তর বেশ কৌতুকময়—‘বোধহয়, খিচড়ি>খেচর’। (অর্বাচীন সংস্কৃত) দ্বিদলাদিমিশ্র পক্কতণ্ডুল।’২ এক্ষণে প্রায় নিশ্চিত হওয়া গেল, যে-সময়কালে ভারতের একাংশে মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করতেন সংস্কৃত বৈদিক ভাষা তাঁরা খেচরান্ন নামে কিছু খেতেন না। খিচড়ি নামে তো নয়ই। পূর্বোক্ত শব্দটি সংস্কৃত ক্লীবলিঙ্গ বটে, তবে সেদিনের অর্বাচীন, খিচড়ি থেকে এসেছে! আর খেচর, পাখি-র সঙ্গে এ শব্দের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এ খানা ডাল ইত্যাদি মিশিয়ে রান্নার করা চাল। প্রণম্য আভিধানিক ইঙ্গিত দিচ্ছেন আরও অনেক কিছুরই, কিন্তু সে আড্ডা আমরা দেব বাঙালির খিচুড়ি সাবড়ানোর দিনে।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে ক্লাসে ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। ছবিসৌজন্য — Visva Bharati Alumni Association
এখন প্রশ্ন হল, বর্ধমানের এই জাহাঙ্গীরি খেচরান্ন ও নুসখা এবং আলোয়ানের খিচড়ি জাহাঙ্গিরি কি এক? না। মোক্ষম তফাত রয়েছে। সেটা রেসিপিতে একনজর বুলালেই বোঝা যাবে—
জাহাঙ্গীরি খেচরান্ন (ব্যঞ্জন রত্নাকর মোতাবেক)
তণ্ডুল ও মুগের দালি — ১ সের (৯৩৩.১০ গ্রাম)৩
ঘৃত — আধসের (৪৬৬.৫৫ গ্রাম)
মাংস —১ সের (৯৩৩.১০ গ্রাম)
দারচিনি— ২ মাসা (১.৯৪ গ্রাম)
এলাচ— ২ মাসা (১.৯৪ গ্রাম)
লবঙ্গ— ২ মাসা (১.৯৪ গ্রাম)
পলাণ্ডু— ১ পোয়া (২৩৩.২৭ গ্রাম)
আদা— আধতোলা (৫.৮৩ গ্রাম)
ধনে— ৩ তোলা (৩৪.৯৮ গ্রাম)
লবণ— সাড়ে চার তোলা (৪৬.৬৪ গ্রাম)
পলাণ্ডু ঘৃতে ভর্জিতপূর্বক মাংসখণ্ড উহাতে বাঘারের পর লবণ ও ধনেবাটা দিয়া উলুতপ্লুত করণান্তে জল দিবে। আর তণ্ডুলদালি জলে ধৌতপূর্ব্বক মাংসে ক্ষেপণে সিদ্ধ হইলে বাটা গন্ধদ্রব্য দিয়া অবশিষ্ট ঘি সহ বাঘারের পর দম দিয়া নামাইবে।’
এই প্রথম জাহাঙ্গিরি খিচুড়িতে ডালের সঙ্গে চালও পেলাম। বাকি সবই কিন্তু এক—সেই পেঁয়াজভাজা, সেই মাংস এবং সেই ধনে। কিন্তু ব্যঞ্জন রত্নাকরের এই রেসিপি আমার মনে একটা গভীর সন্দেহ তৈরি করে দিয়ে গেল। এ যদি আলোয়ান ও নুসখা-র তরজমাই হবে তাহলে চার-চারজন পণ্ডিত মিলে কী করে যে খিচুড়িতে চাল নেই তাতে চাল ঢুকিয়ে দিলেন অনুবাদের ভুলে? বলা তো হচ্ছে ‘অবিকল অনুবাদ’! তাহলে কি আমারই ভুল হচ্ছে? এ কেতাব কি তবে অন্য কোনো ‘খওয়ান-এ-নি’মত’ থেকে অনুবাদ? নাকি নুসখা আর আলোয়ানের খাদ্যের উপকরণের ফারসি/ উর্দু নামের ব্যাখ্যা করে তরজমায় আমিই ভুল করছি? ‘খিচড়িমুঁগ’ মানে কি তবে, যেমন ব্যঞ্জনের চার তরজমাকার লিখছেন, ‘তণ্ডুল ও মুগের দালি’ একত্রে বোঝাচ্ছে? তার মানে কি নুসখা ও আলোয়ানের খিচড়িও পরম্পরাগত খিচড়ির মতোই চাল-ডাল মিশ্রণে তৈরি? বার বার খুঁটিয়ে পড়ি। না, তা কিছুতেই হতে পারে না। তার প্রমাণ ওই দুই কেতাবেই উল্লিখিত ‘গুজরাতি খিচড়ি’! দু-জায়গাতেই সে খিচুড়ির উপকরণের তালিকায় চাল নেই, আছে ‘খিচড়িমুঁগ’, আর দুই পাকবিধিই রান্নার একটি পর্বে এসে বলছে—পেঁয়াজ-মশলা থেকে ডাল আলাদা করে ছেঁকে নাও। এবং বলছে, চাল দিয়ে দাও। যদি ‘খিচড়িমুঁগ’ কথাটার মানে একত্রে চাল আর মুগডাল বোঝাত, তাহলে ডাল এবং চাল রান্নার আলাদা আলাদা পর্বে হাঁড়িতে দেওয়া কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না। কাজেই, না, নুসখা ও আলোয়ানের জাহাঙ্গিরি খিচড়িতে চাল নেই, স্রেফ ডাল আর মাংস। ব্যঞ্জনের তরজমাকাররা সেটা বদলেছিলেন। সজ্ঞানে। বলা ভালো বদলাতে বাধ্য হয়েছিলেন সম্ভবত। কেন? উত্তর ‘গ্রন্থপরিচয়’ দেখলেই মিলবে। তার প্রথম অনুচ্ছেদের শেষ বাক্যটি হল, ‘যেহেতু বর্দ্ধমান মহারাজ বাহাদুরের আজ্ঞাতে রন্ধনাধ্যক্ষ দ্বারা প্রত্যেক ব্যঞ্জন প্রস্তুতি হইয়াছিল, তাহাতে মহারাজ বাহাদুরের অভিপ্রায়ে কোন কোন দ্রব্যের তারতম্য করাতেও আস্বাদ পরিপাটীর ত্রুটী জন্মে নাই।’ প্রায় চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি নাটকটা—
মহারাজ বাহাদুর—তবে কী থাকছে আজ প্রধান ব্যঞ্জন, রন্ধনাধ্যক্ষ?
রন্ধনাধ্যক্ষ—মহারাজ, আজ জাহাঙ্গির বাদশাহের খাস খানা, জাহিঙ্গিরি খিচড়ি, মহারাজ!
খাদ্য পরিবেশিত হয়।
মহারাজ বাহাদুর—এটা কী? তোমার সেইজাহাঙ্গিরের খাস খানা আসবে কখন?
রন্ধনাধ্যক্ষ—ওটাই তো সেই খানা মহারাজ ‘জাহাঙ্গীরি খেচরান্ন’, একেবারে কেতাব ধরে করেছি জাহাঁপনা।
মহারাজ বাহাদুর—খিচুড়ি? এ তো শুধু ডাল? এটা খিচুড়ি? অপদার্থের দল? বোলাও যারা লিখেছে কেতাব।
তারপর কী ঘটেছিল ভেঙে বলার দরকার নেই। জাহাঙ্গীরি খেচরান্ন বিলক্ষণ জানে কী ঘটেছিল।
কিন্তু তার থেকেও একটা বড়ো বিপ্লব হল। জাহাঙ্গিরি খিচড়িতে ‘দম’ পড়ল। সে দম কীভাবে পড়া উচিত তার জন্য অবিশ্যি আমাদের অপেক্ষা করতে হবে বাংলা রন্ধনশিল্পের গুরুদের গুরুর নির্দেশের জন্য!
তবে ব্যঞ্জন রত্নাকরই পাকবিধির একমাত্র বাংলা কেতাব নয় যাতে জাহাঙ্গিরি খিচুড়ির উল্লেখ আছে। আরও একটি তাক লাগানো বাংলায় লেখা পাকপ্রণালী সংকলনে রয়েছে ‘জাহাঙ্গিরী খেচরান্ন’। সে কেতাব আসলে রান্নাবান্নার একটি সাময়িক পত্রিকার পাঁচটি খণ্ডের ‘পরিবর্ত্তিত ও পরিবর্ধিত’ রূপ, দু-মলাটের মধ্যে। পাক-প্রণালী। প্রথম প্রকাশ ১৩০৪ বঙ্গাব্দে। অর্থাৎ ১৮৯৭ সালে। অর্থাৎ ব্যঞ্জন রত্নাকর প্রকাশের ৩৯ বছর পরে। এবং আজ থেকে ১২৩ বছর আগে। লেখক / সংকলক পাকোয়ানচর্চায় আমার পরম-আরাধ্য গুরুদেব শ্রীবিপ্রদাস মুখপাধ্যায় ওরফে শ্রীবিপ্রদাস শর্ম্মা। আমার কাছে রয়েছে এর পঞ্চম সংস্করণ। মুদ্রক—‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স্, ২০১ কর্ণয়ালিস্ ষ্ট্রীট্, কলিকাতা। মূল্য ৩ টাকা।’ কিন্তু এই সংস্করণের কোনো সন-তারিখ কোথাও উল্লিখিত নেই।
এ কেতাবের মতো পাকবিধি সংকলন আর বাংলায় নেই। এ কেতাব বঙ্গীয় রেনেসাঁস-এর আয়না। কেন এবং কীভাবে, সেপ্রসঙ্গে ফিরব, পরে। ফিরতেই হবে, কারণ এ কেতাবে খিচুড়ির যে রকমফের আছে সভ্যতার আদি যুগ থেকে আজ অবধি কোনো কুকবুকে তা নেই। এর ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের শিরোনাম ‘খেচরান্ন-প্রকরণ’, যাতে আছে সতেরো প্রকার খেচরান্নের বর্ণনা! কাজেই না ফিরে গত্যন্তর নেই। কিন্তু আপাতত আমরা থামব সে তালিকার ন-নম্বরের খেচরান্নে। যার গোড়াতেই লেখা আছে, ‘জাহাঙ্গির বাদসা অত্যন্ত আদরের সহিত ব্যবহার করিতেন, তজ্জন্ন উহার নাম জাহাঙ্গিরী খেচরান্ন হইয়াছে। জল না দিয়ে ইহা পাক করিতে হয়। এই খেচরান্ন অত্যন্ত সু-খাদ্য, কিন্তু গুরুপাক।’ ফের রহস্য দেখছি—নুসখা ও আলোয়ানের জাহাঙ্গিরি খিচড়ি আরবে-আব খিচড়ি কোন্ মহাপাচকের হাতে পড়ে বিপ্রদাস মহাশয়ের সংগ্রহের ‘জাহাঙ্গিরী খেচরান্নে’ এসে একাকার হয়ে গেল? কোনো উত্তর মেলেনি। তবে এই খিচুড়ির রেসিপি দেখেই আমি যেন জাহাঙ্গির বাদশার বাজরা খিচড়ি খাওয়ার মতোই উৎফুল্ল বোধ করলাম, আগের একটা রহস্য সমাধানের জবরদস্ত ক্লু পেয়ে। কী ক্লু? তা বুঝতে মন দিয়ে রেসিপিটা পড়তে হবে—
জাহাঙ্গিরী খেচরান্ন (পাক-প্রণালী)
‘উপকরণ ও পরিমাণ। —
মাংস — একসের (৯৩৩.১০ গ্রাম)
চা’ল— আধসের (৪৬৬.৫৫ গ্রাম)
সোনামুগের ডা’ল— আধসের (৪৬৬.৫৫ গ্রাম)
ঘৃত — একসের (৯৩৩.১০ গ্রাম)
পিঁয়াজের রস — একপোয়া (২৩৩.২৭ গ্রাম)
দারুচিনিচূর্ণ — ছয় আনা (৪.৩২ গ্রাম)
লবঙ্গচূর্ণ — ছয় আনা (৪.৩২ গ্রাম)
মরীচচূর্ণ — আধতোলা (৫.৮৩ গ্রাম)
ধনে-বাটা — দেড়তোলা (১৭.৪৯ গ্রাম)
আদার রস— তিনতোলা (৩৪.৯৮ গ্রাম)
লবণ ও লঙ্কা — পরিমিত
প্রথমে মাংস থুড়িয়া, তাহাতে লঙ্কা, পিঁয়াজের রস, ধনে-বাটা, এবং লবণ মাখাইয়া চারিদণ্ড কোন পাত্রে ঢালিয়া রাখিবে। এদিকে, চা’ল ও ডা’ল ঘৃতে ভাজিয়া পূর্ব্ব-রক্ষিত মাংসের সহিত মিশ্রিত করিবে। তখন, তাহাতে সমুদায় গন্ধ-মসলা-চূর্ণ ও মরীচচূর্ণ মিশাইয়া, মৃদু তাপে স্থাপন করিবে, এবং মধ্যে মধ্যে এক এক-বার নাড়িয়া-চাড়িয়া দিবে। জ্বালে মাংসাদির রস মরিয়া আসিলে, পাক-পাত্রের চারিধারে তপ্ত অঙ্গার সাজাইয়া দিবে। এইসময় উষ্ণ ঘৃত ঢালিয়া দিয়া, পাক-পাত্রের ঢাকনি ভিজা কাপড় দ্বারা বন্ধনপূর্ব্বক, তাহার উপর আর একটি পাত্র রাখিয়া, তাহাতে তপ্ত অঙ্গার স্থাপন করিবে। পাক শেষ হইয়া আসিলে, নামাইয়া লইলে-ই জাহাঙ্গিরী খিচুড়ি পাক হইল।’
জাহাঙ্গিরী খিচুড়িতে দম। আঁচ নিভু নিভু না হওয়া পর্যন্ত দিতে হবে।
জাহাঙ্গিরী খেচরান্নের এই পাকবিধি ব্যঞ্জনের এই একই পদের পাকবিধির অনুসারী। পেঁয়াজ আর ধনের সুগন্ধময়। আর এই রেসিপি প্রমাণ করল, নুসখা-র ‘খিচড়ি মুঁগ শুস্তাহ্’ বলতে আমি যে ‘সোনামুগ’ অনুমান করেছিলাম, তা ভুল নয়। সত্যি বলতে কী হরেক জাহাঙ্গিরী খিচড়ির মধ্যে এটি সবথেকে সুস্বাদু। আর তাই জন্যেই এর পাকে আমার অভিজ্ঞতার দু-একটা কথা বলি, যদি এক-আধজন রেঁধে পরখ করতেই চান। ওই পেঁয়াজের রসে, রসে কিন্তু বাটায় নয়, মাংসটা চুবিয়ে রাখাটাই ওস্তাদের মার। ওইটাই পরবর্তীকালে মাংসের টুকরোগুলোকে এক অদ্ভুত গন্ধে সুরভিত করবে, স্বাদের থেকেও গন্ধ মিলবে চিবানোর সময়। এখানে মাংসের জল মরে আসার পরে জল দেওয়ার কথা বলা নেই। তা যে লাগবে না, তা অবশ্য আগেই বলা আছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, না দিলে পুড়ে খাক হবে। ব্যঞ্জন রত্নাকরে লক্ষ করুন, দম দেওয়ার আগে —‘উলুতপ্লুতকরনান্তে জল দিবে’! হাঁড়ির ওপরে কাঠকয়লা জ্বালিয়ে দেওয়ার পরে নিভু নিভু না হওয়া পর্যন্ত রাখুন। আমার হিসেবে পৌনে ঘণ্টা। তার মধ্যেই রান্নার হয়ে যাবে। তবে আমি পরিমাণে কম করেছিলাম। ৫০০ মাংস, ২৫০ গ্রাম করে চাল ডাল। আর ২৫০ গ্রাম ঘি। লবঙ্গ ঘিয়ে ভাজতে ভুলবেন না।
কিন্তু এক্ষণে আমি আমাদের খিচুড়ি-খোঁজ থেকে অল্পকালের জন্য সরে গিয়ে ভারতীয় প্রাচীন বিজ্ঞানের এক দুরন্ত অধ্যায়ে ঘুরে বাড়ানোর লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছি না। ফেলুদার আ্যাডভেঞ্চারের লব্জে আজ ‘স্রেফ হলিডে’! কিন্তু ফেলুদারই কথা তো—ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে, ফেলুদাকে ধান ভানতে হয়েছিল কাশীতে হলিডে করতে গিয়ে, আমরা ভানব নালন্দায়! এ রহস্যের মূলে আছে একটি শব্দ—‘দণ্ড’। এ শব্দটা পাকরাজেশ্বরেও পেয়েছিলাম। মাংস লঙ্কা, পেঁয়াজ, ধনে-বাটা, নুন দিয়ে মাখিয়ে ‘চারিদণ্ড’ ম্যারিনেট করার নির্দেশ দিচ্ছেন বিপ্রদাস। কী এই চারি দণ্ড, কতক্ষণ? আমরা কথায় কথায় বলি—দু-দণ্ড যেতে না যেতেই… কিংবা যেমন শুনি উত্তরবঙ্গের অপূর্ব লোকগানে—বন্ধু নয়নের কাজল / তিলেক দণ্ড না দেখিলে মন হয় রে পাগল! মানে সামান্য কিছুক্ষণ। কিন্তু বিপ্রদাসের চারিদণ্ড সুনির্দিষ্ট সময়ের পরিমাপ। সংক্ষেপে ফুটনোট দিয়ে বলে দিতেই পারতাম সাধারণ ভাবে একদণ্ড সমান ধরা হয় ২৪ মিনিট। চারিদণ্ড ৯৬ মিনিট, মানে মোটামুটি দেড় ঘণ্টা। কিন্তু এই দণ্ড কথাটা আমরা পেলাম কোথা থেকে? যেখান থেকে পেলাম ঘটিকা কথাটা। এখনও তো অহরহ শুনি, আজ বিকেল পাঁচ ঘটিকায় অমুক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হবে, সকলকে সাদর আমন্ত্রণ। কিন্তু কী এই ঘটিকা?
ঘটিকার খোঁজে আমাদের পেছিয়ে যেতে হবে দেড়হাজার বছর। ৫০০ সাধারণাব্দের আশেপাশে কোনো একসময়ে প্রাচীন জল-ঘড়ি, নালিকাযন্ত্র তামাদি করে দিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এক আশ্চর্য নয়া জল-ঘড়ি আবিষ্কার করে হইচই ফেলে দিলেন—একটা বাটির মতো পাত্র। তাতে ছোট্ট ফুটো। সে পাত্রকে রাখা হবে জলে ভরতি আর-একটা বড়ো পাত্রে। ফুটো দিয়ে ধীরে ধীরে জল ঢুকে শেষে ডুবে যাবে ছোটো পাত্রটা। এই হল সেই জল-ঘড়ির কার্যপদ্ধতি। চট করে মনে হতে পারে, ও মা, এতে আর আশ্চর্যের কী? আশ্চর্যের এই যে যতবার এই ছোটো পাত্রটি বড়ো জল-ভরা পাত্রে রাখা হবে, ততবার তা ডুবতে সময় নেবে কাঁটায় কাঁটায়, আজকের হিসেবে, ২৪ মিনিট! সেটা সুনিশ্চিত কীভাবে হবে? তার জন্যে চাই নিক্তি মেপে সুনির্দিষ্ট মাপের বড়ো পাত্র, যাতে একটি বিশেষ পরিমাপের জল ধরে, সুনির্দিষ্ট হতে হবে সে পাত্রের আকার, কারণ তার ওপরেই নির্ভর করবে ছোটো পাত্রের ওপর জলের চাপ। সেই চাপের ওপর এবং ছিদ্রের ব্যাসের ওপর নির্ভর করবে কী গতিতে জল ঢুকবে খালি ছোটো পাত্রে। এবং সুনির্দিষ্ট হতে হবে ছোটো পাত্রের ভর ও আকার যাতে তা জলে ভরে যেতে ও ডুবে যেতে একেবারে সুনির্দিষ্ট একটি সময় লাগে, যতবারই সেপ্রক্রিয়া করা হোক—২৪ মিনিট! এ যন্ত্র তৈয়ারে একচুল এদিক ওদিক হয়ে গেলেই বদলে যাবে সময়ের পরিমাপ। হত না। এই জল-ঘড়ির নাম ছিল ঘটিকা-যন্ত্র। কারণ পাত্রের সংস্কৃত ঘটিকা। এই ঘড়ি তৈয়ারির পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন শ্রীরমুলা রাজেশ্বর শর্মা, ২০১৮ সালে জল-ঘড়ি নিয়ে লেখা এক চিত্তাকর্ষক প্রবন্ধে: Water clock and steelyard in the Jyotiskarandaka৪ । আর এই আশ্চর্য জল-ঘড়িই সম্ভবত ব্যবহৃত হত ৫০০ সাধারণাব্দে স্থাপিত মগধ রাজ্যের আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দায়। তবেই তার বর্ণনায় মেলে ঘটিকাশালা আর ঘটিকাস্থানের উল্লেখ। ঘটিকাশালায় রাখা জল-ঘড়ি চালানোর দায়িত্বে থাকত ছাত্ররাই, আর ছোটো পাত্রটি ডুবে গেলেই বেজে উঠত ডঙ্কা, দিনে চারবার, রাতে চারবার৫, জানাচ্ছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এশীয় ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ইমেরিটাস প্রোফেসর হার্টমুট শ্কারফে। আর এই ঘটিকা বা ঘটি শব্দটি থেকেই এসেছে ঘড়ি!
কিন্তু সে তো গেল ঘটিকার কথা। দণ্ড কোথায়? দণ্ড ব্যাপারটা বুঝতে আমরা আর পাঁচটা পুথির মধ্যে উল্টাতে পারি ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় পাঠের ইমেরিটাস প্রোফেসর ও বিশিষ্ট সংস্কৃত পণ্ডিত রচার লুডোর মতে এপুরাণ রচিত ১৫০০-১৬০০ সাধারণাব্দ নাগাদ। অর্থাৎ মুঘল যুগে। সেই পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডে আছে এক শ্লোক—
পাত্রং ষট্পলসংভূতং গভীরং চতুরঙ্গুলম
স্বর্ণমাষ্কৃত ছিদ্রং দণ্ডৈশ্চ চতুরঙ্গুলৈঃ
যাবজ্জলপ্লুতং পাত্রং তত্কালং দণ্ডমেবচ।।
অস্যার্থ—ছয় পল দিয়ে তৈরি পাত্র, চার অঙ্গুলি গভীর। যাতে চার অঙ্গুলি দীর্ঘ স্বর্ণ-নির্মিত দণ্ড দিয়ে ছিদ্র করা হয়েছে। সেই পাত্র জলপূর্ণ হতে যে কাল অতিবাহিত হয় তাই দণ্ড। প্রশ্ন হল, পল কী? পল সোনা বা রুপোর ওজনের মাপ। এ মাপ বিভিন্ন সময়ে বদলেছে। ১৫০০ সাধারণাব্দ নাগাদ এ মাপ ধরা হত ৪৮ গ্রাম। ষট পল তবে ২৮৮ গ্রাম৬। কী পরমাশ্চর্য কারিগরি। জটায়ুর ভাষায়, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে মশাই। ২৮৮ গ্রাম ওজনের পাত্রে চার আঙুল সমান সোনার শিক দিয়ে ফুটো করতে হবে। তবেই তাতে জল এমন বেগে ঢুকবে যে জলে ভরে যেতে সময় লাগবে এক দণ্ড! কিন্তু একটা ছোট্ট ফাঁক আছে, সোনার শিকটা কত মোটা হবে। নিশ্চয়ই একটা প্রচলিত ওজনের মাপ ছিল, যে পরিমাণ সোনাকে গলিয়ে চার আঙুল সমান শিক বানালে যতটা মোটা হবে শিকটা, ততটাই প্রয়োজন। আলবৎ ছিল। ৫০০ সাধারণাব্দ নাগাদ, মানে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ লেখা হওয়ার পাক্কা হাজার বছর আগেই তো এই আশ্চর্য ঘড়ি আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। তা নিয়ে যুগে যুগে চলেছে নানা পরীক্ষা। সাধারণাব্দ অষ্টম শতকের জ্যোতির্বিজ্ঞানী লল্ল এক ঘড়ির কথা বলেছেন যাতে পাত্রটি তৈয়ার হত ১০ পল দিয়ে। ব্যাস আজকের হিসেবে ৯ ইঞ্চি একেবারে ওপরে, এবং নীচে তার অর্ধেক। ৩ ১/৩ ‘মাষক’ ওজনের সোনা গলিয়ে চারি অঙ্গুলি, আজকের ৩ ইঞ্চি, মাপের দণ্ড তৈরি করে তাতে ফুটো করা হত৭। ‘প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতে সময়ের বিভিন্ন একক’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে এই শ্লোক উদ্ধৃত করে ও তার ইংরেজি তরজমা করে দিয়ে কিয়োটো-র দোশিশা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাকাও হায়াশি জানাচ্ছেন, ‘সময়ের পরিমাপ হিসেবে দণ্ড শব্দটির ব্যবহার অতি বিরল৮।’ এ সবই অবশ্য অতিসরল করে লিখলাম, এই জল-ঘড়ি আসলে ইতিহাসকারদের কাছে এক বিশাল, বিস্ময়কর গবেষণার ক্ষেত্র।
কিন্তু আমাদের খোঁজের বাইরে এসব দারুণ কিস্সা, কাজেই ফিরে আসি সেই খোঁজের খুব গুরুত্বপূর্ণ অন্য একটি বিষয়ে—বিপ্রদাস শর্ম্মার পাক-প্রণালীতে এসে এই প্রথম জাহাঙ্গিরী খিচুড়িতে লঙ্কা পড়ল।
খিচুড়ি যদি সম্রাট জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে এসে থাকে এটা হিন্দু পুজো পার্বনে ভোগ রান্নার জন্য কি করে নির্বাচিত হলো ?কে আরম্ভ করলো ? খুব জানতে ইচ্ছে করে !!
@ সন্তোষ ব্যানার্জী: না। খিচুড়ি মোটেই জাহাঙ্গিরের আমলে বা মাধ্যমে আসেনি। আমি ন্যারেটিভটা ধরেছি জাহাঙ্গিরের আমল থেকে কয়েক পর্ব পরেই পিছিয়ে যাব। আমার হিসেবে শাঙ্খায়ন আরণ্যকে যে মুদ্গৌদন খাদ্যের উল্লেখ আছে সেটিই খিচুড়ির শুরু। অর্থাৎ ৭০০ পূর্বসাধারণাব্দ (BCE)এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছ।
ধন্যবাদ !!