১৬১৭। ৩০ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার। খমভট উপসাগর তীরবর্তী গুজরাটের ছোট্ট শহর খমভটের ঠিক বাইরে ভোর থেকেই সে কী সাজসাজ রব।১ তুমুল হট্টগোল। মানুষের চিৎকার। থেকে থেকে হাতি, ঘোড়া, উট, খচ্চরের ডাক, গোরুর হাম্বা। মানুষ আর পশুর পায়ের চাপে কাঁচা রাস্তার থেকে ওঠা ধুলোর মেঘ উড়িয়ে সবার আগে চলেছে বলদগাড়িতে বসানো বিভিন্ন মাপের কামান। রঙিন ঝালর লাগানো উটের সারি। কমসেকম শ-তিনেক উট, পিঠে বোঝাই মালপত্তর। হরেক কিসিমের ঠেলাগাড়ি আর টানা-গাড়ির লম্বা লাইন—দু-চাকা, তিনচাকা, চারচাকা—শেষ দেখা যায় না। সেসবের ওপর ডাঁই করা কাঠের গুঁড়ি থেকে আরম্ভ করে যতরকমের আসবাবপত্তর কল্পনা করা যায়, মালাক্কা মখমলের বস্তায় বাসনকোশন, জাজিম, বিরাট বিরাট বস্তা। শত শত তাঁবুর ভাঁজ করা তিরপল, সেগুলো খাঁচানোর সরঞ্জাম। খানকুড়ি টানাগাড়ি বোঝাই শুধু দলিল-দস্তাবেজ। সঙ্গে শত শত লোক-লস্কর। এরপরে সার সার উটে-টানা ঢাকা-দেওয়া গাড়ি, পালকি, ডোলিতে চেপে মহিলার দল। ফের একদফা ঘোড়া আর হাতির সারি, তাতে সওয়ার বিচিত্র পোশাক পরা সিপাহি-সালার। সেদলের মাঝখান থেকে উড়ছে রঙিন ঝলমলে চারকোনা, তিনকোনা অসংখ্য পতাকা, বড়ো বড়ো ডাণ্ডার মাথায়, এই দফায় চলেছেন গণ্যমান্য আমির-ওমরা। আরও একদফা ঘোড়সওয়ারের সারি, এবারে যেন কাতারে কাতারে। ঘোড়ার সারির পিছনে, সবশেষে, শত শত ভৃত্যের দল, যাদের সঙ্গে খানপঞ্চাশেক তাগড়াই দুধেল গাই—কারণ বাদশাহের চাই তাজা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার। আর এই হাজার হাজার ঘোড়সওয়ারের বিন্যাসের ঠিক মাঝখানে চলমান পাহাড়ের মতো খানকুড়ি হাতি—একেবারে ঐরাবৎ। অধিকাংশই মখমলের ওপর সোনার জরির কাজ করা কাপড়ে ঢাকা, পিঠে মহার্ঘ্য আসবাব। এই জায়গাটা থেকেই ধুলোর মেঘ ভেদ করে অনেক ওপরে শীতের ঝকঝকে নীল আকাশে উড়ছে শত শত বাদশাহি অলম—দূর্বাঘাস-সবুজ রেশমের জমিনে আঁকা ঝলমলে সোনালি ডান-থাবা-তোলা সিংহ, তার কেশরের পিছন থেকে শাণিত রশ্মির ছটা ছড়িয়ে উদয় হচ্ছে সূর্য—‘শের ও খুরশিদ’ পতাকা২। আজ খমভট ছেড়ে আহমেদাবাদের পথে রওনা হলেন আলম পনাহ্ অস্-সুলতান-উল-আজ়ম জন্নত মকানি নুর-উদ্দিন মহম্মদ সালিম জাহাঙ্গির৩।
খমভট থেকে আহমেদাবাদ বাইশ কোশেরও একটু বেশি পথ৪। ৬.২৫ কোশ পার করে কোসালা গ্রামের কাছে গিয়ে থামল এই মহাকারোয়াঁ। বাদশাকে ঘিরে রয়েছে যে বিন্যাস, নিমেষে তার মধ্যে দেখা গেল তড়িৎ-গতি তৎপরতা। এই বিন্যাসেই আছে খানদশেক খচ্চর, যাদের পিঠে রঙিন ছোটো ছোটো তাঁবুর সরঞ্জাম, দুটো খচ্চরের পিঠে বাদশাহি পোশাক, একটা খচ্চরের পিঠে হরেক কিসিমের আতর আবার আর-একটার পিঠে বোঝাই তাজা সুগন্ধী ফুল— ক্লান্ত বাদশা পথিমধ্যে কোথাও একটু জিরিয়ে নিতে চাইলে, বা ঘেমে গিয়ে পোশাক বদল করতে চাইলে ঝপাঝপ খাঁচিয়ে দেওয়া যাবে এইসব ছোটো তাঁবু, সাজিয়ে দেওয়া যাবে ফুলে, ছড়িয়ে দেওয়া যাবে আতর। কান-ও-কান খবর হয়ে গেছে এইখানে থামতে চান বাদশা। কোসালা গ্রামে পড়ল বাদশাহের শিবির। আর বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে এই শিবিরেই পড়েছে তাঁর দস্তরখওয়াঁ, মানে যে মহার্ঘ্য বস্ত্র মাটিতে পেতে খানা পরিবেশিত হয়। দস্তরখওয়াঁ জুড়ে থরে থরে সাজানো সোনা, রুপো, সূক্ষ্ম কারুকাজ করা পাথর আর চিনামাটির থালা, বাটি, হাতলহীন পেয়ালায় পরিবেশিত শ-খানেক ব্যঞ্জন। তার একপাশে উদ্বিগ্ন মুখে বসে মীর বকাওয়ল, যিনি বাদশাহি মহল-ই-খুরাকপাজ়ি, মানে হেঁশেলের, সর্বেসর্বা। একটু পিছনে দ্বিগুণ উদ্বিগ্ন মুখে নিথর পরিবেশনকারী ভৃত্যের সারি। আর দস্তরখওয়ানের অন্য পাশে উপবিষ্ট আলম পনাহ্।
বাদশাহের জন্য এলাকার সেরা আরবিয়াৎ৫ মাছ ধরিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় গুজরাটি লালাজিরা। শুধু আজই, এখানেই নয়, গুজরাটের এ অঞ্চলে আসা ইস্তক সর্বত্রই তাঁর দস্তরখওয়ানে জায়গা করে নিয়েছে এই মাছ। মন্দ নয়। তবে রুইমাছের মতো তত সুস্বাদু মনে হয়নি বাদশাহের। ‘মানদণ্ডে রুই যদি হয় ১০, এটা হবে ৯, কিংবা ৮-ও হতে পারে।’৬ জাহাঙ্গির বাদশা যে রুইমাছের এমন শওকিন তা জেনে একঝলক কল্পনা করি মাটিতে অনেকটা বজ্রাসনের ভঙ্গিতে বসে একমনে কাঁটা বাছছেন তুর্কি বংশীয় মুঘল সম্রাট! বজ্রাসনের ভঙ্গিতে? আসনপিঁড়ি, মানে বাবু হয়ে বসে নয়? বিলকুল। তেমনই ছিল মুঘল রাজন্যের খেতে বসার তরিকা—হাঁটু মুড়ে, কতকটা বজ্রাসনের ভঙ্গিতেই। সেটা মালুম চলবে সঙ্গের এই অপূর্ব ছবিটা দেখলেই।
জাহাঙ্গির বাদশা ও যুবরাজ খুররমকে ভোজনে নিমন্ত্রণ করেছেন নুরজাহান (সৌজন্য ফ্রিয়ার গ্যালারি অফ আর্ট: এফ ১৯০৭.২৫৮।)
এছবি মুঘল মিনিয়েচার চিত্রকলার সেরা নিদর্শন। পেন্টিংয়ের পরিভাষায়—Opaque water colour ink and gold on paper! বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসি-র স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরের চোখ টেরিয়ে দেওয়া এশীয় চিত্রকলার সংগ্রহ ফ্রিয়ার আর্ট গ্যালারিতে সযত্নে সংরক্ষিত। এছবি আঁকা আনুমানিক ১৬৪০-৫০ সাধারণাব্দে, মানে খুররম বাদশাহের জমানাতে। আর এ ছবির লেবেলে লেখা আছে—Jahangir and Prince Khurram Entertained by Noor Jahan! ছবির বিষয়বস্তু ভেঙে বলার দরকার নেই। মন দিয়ে দেখলেই দেখা যাবে বহু কিছু। যেমন, এ ছবিতে ‘এন্টারটেন’ শব্দের অর্থ নিঃসন্দেহে ভূরিভোজে নিমন্ত্রণ—‘to invite people to eat or drink’৭ (অক্সফোর্ড অভিধান)। শুধু একটাই কথা, এ ছবি বিরল—নুরজাহান আর জাহাঙ্গিরের একত্রে আর দ্বিতীয় কোনো ছবি নেই। আমার মতো খানা-কলমচির এ ভারী পরিতোষের বিষয় যে এমন একটি বিরল মিলনকে ধরে রাখতে কোনো ডাকসাইটে অজানা মুঘল শিল্পী তাঁদের পানাহারের মুহূর্তটিকেই বেছে নিয়েছিলেন!
কিন্তু ওইসব আরবিয়াৎ মাছ-টাছ নয়, আজকের ভোজে বাদশা আটকে গিয়েছেন সম্পূর্ণ নতুন এক খানা খেয়ে। যা তাঁর দস্তরখওয়ানে কদাচ পড়েনি এর আগে। কয়েক গরস মুখে দিয়ে থেমে গিয়েছেন, মৃদু মৃদু দুলছেন, মুখে একটা রহস্যময় হাসির আভাস। মীর বকাওয়াল জানেন, খাদ্যটিকে কয়েক গরস চেখে সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে তার স্বাদ পরখ করছেন গজ়া-শওকিন আলমপনাহ্। জাত খাদ্যরসিক জাহাঙ্গির বাদশাহের এ পুরোনো অভ্যেস, এবারে রায় উচ্চারিত হবে— রুই আর আরবিয়াৎ মাছের স্বাদের মতোই সূক্ষ্ম তুল্যমূল্য বিচার। এই নতুন খানাটি আজ যে পড়েছে বাদশাহি দস্তখওয়ানে তা অবশ্য আলমপনার হুকুমেই। কিন্তু তাতে কী? খানা যদি অখাদ্য হয়ে থাকে কী ঘটতে পারে আল্লা-তালাই জানেন। জাহাঙ্গিরি ক্রোধ যে ইতিহাস ছাপিয়ে কিংবদন্তি হয়ে আছে! আর তাই মীর বকাওয়লের কলজেটা গলার কাছে এসে লাফাচ্ছে।
হেঁশেল-সর্বাধিকারীর গর্দান অবশ্য সেদিন যায়নি। তার প্রমাণ জাহাঙ্গির বাদশার নিজের হাতে লেখা পরবর্তী বাক্যগুলি—‘গুজরাটের মানুষের একটি বিশেষ খানা বাজরা খিচড়ি। ওরা একে লাদরাও বলে। অতিক্ষুদ্র এই শস্যদানা হিন্দুস্তান ছাড়া আর কোথাও মেলে না। গুজরাটে এর যেমন ফলন হয় ভারতে আর কোত্থাও তেমনটি হয় না, এবং এ শস্য সবথেকে সস্তা। কখনও এ খানা না খাওয়ায় আমি হুকুম করেছি, কিছু তৈয়ার করে আমাকে দিতে। মোটেই বিস্বাদ নয়। দিব্যি লাগল আমার। হুকুম দিলাম, সুফিয়ানা দিনে, যেদিন আমি মাংস খাওয়া থেকে নিবৃত্ত থাকি, মাংসহীন খানাই খাই কেবল, ওরা যেন প্রায়শই আমাকে এই খিচড়ি দেয়।’৮
মীর বকাওয়লের গর্দানটাই সেদিন শুধু যে বেঁচে গেল তাই নয়, আমরা প্রামাণ্যভাবে একেবারে একটি নির্দিষ্ট দিনের হদিশ পেয়ে গেলাম যেদিন সর-জ়মিন-এ-হিন্দ-এর দোর্দণ্ড প্রতাপ এক মুঘল বাদশা স্বয়ং ‘সবথেকে সস্তা’ শস্যদানা দিয়ে তৈরি, কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে একেবারেই আম আদমির, বাজরার খিচুড়ি নামক খানাটির প্রশংসা করে সরকারি ভাবে তাকে নিজের দস্তরখওয়ানে জায়গা করেদিলেন—১৬১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর! ডায়ারির মতো করে লেখা জাহাঙ্গিরনামা-তে ওই তারিখের এন্ট্রিতেই এ কথা লিখেছেন বাদশা। খিচুড়ির ক্যালেন্ডারে লাল তারিখ বইকি। কারণ, আমরা ক্রমে ক্রমে দেখব, বহু সুলতান বাদশা রাজারাজড়া নবাব জমিদারের পাতেই ঘটা করে নানা কিসিমের খিচুড়ি পড়ত বটে, কিন্তু কোনো বাদশাহের স্বজিহ্বা দিয়ে খিচুড়ির এ হেন প্রশংসা উচ্চারিত হওয়ার আর কোনো প্রামাণ্য উদাহরণ এই আদ্যোপান্ত ভারতীয় খানাটির দীর্ঘ ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই!
জাহাঙ্গির বাদশার এই ফরমানটির কথা পড়ে প্রথমেই আমার মনে ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক মনে হয়েছিল একটা কারণে—এ কেমন হল? এই প্রথম মুঘল বাদশাহি দস্তরখওয়ানে জায়গা পেল খিচুড়ি? কিন্তু সে তো অসম্ভব। কেন অসম্ভব শুধু সেরহস্যই নয়, জাহাঙ্গির বাদশার এই পসন্দিদা খিচড়ি ঘিরে রয়েছে তার থেকেও গভীরতর অনেক রহস্য। এই জাহাঙ্গিরি খিচড়ির খোঁজ এক রুদ্ধশ্বাস অ্যাডভেঞ্চার। সে খোঁজে বেরিয়ে পড়ব… পরের সপ্তাহের বিষ্যুদবারের এমন বারবেলাতেই…
ব্যাপক গল্প। খিচুড়ি নিয়ে এত গল্প জানা ছিল না। চলুক খিচুড়ি কিসসা-কাহিন।
দারুণ
অসাধারণ। রোমহর্ষক খিচুড়ি বৃত্তান্ত।
প্রাণি জগতে তৎক্ষণাৎ খাদ্যবসতু উপভুক্ত করিবার নিয়ম নাই। মার্জার গোষ্ঠীর শিকার এবং শিকারীর মধে যে কৌতুক কাল, মনুষ্য প্রজাতিতে তাহাই রন্ধন শিল্প। খিচড়ি এভাবে ইতিহাস রসে পরিসিক্ত হইয়া পরিবেশিত। শতাধিক পাচকের শিল্প রস অতিক্রম করিয়া তবে সম্রাটের ভোজ্য পাত্র।উপকূল অতিক্রম করিলে মহাদেশ।লেখক একটি রাজতব দান করিয়াছেন, রাজকন্যার অপেক্ষা।
কিন্তু arabiayat মাছ টা আসলে কি মাছ ? বাংলা বা অন্য ভারতীয় ভাষায় একে কি বলে ?
জানতে পারলে ভেজে খেতে মুঞ্চায় .
Arabiyat আমার আন্দাজ কোনো মাছের নাম নয়। জাহাঙ্গির নামটা ব্যবহার করেছেন আরব সাগরের মাছ বোঝাতে।
অনাস্বাদিতপূর্ব !
নূতন কিছু জানলাম ।জাহাঙ্গীর প্রথম খিচুড়ি খেলেছিলেন 1617র17th December ।খুব নূতন জানার আনন্দ পেলাম
ভাগ্যে আছিল খিচুড়ি জগৎ সংসারে ,
তাই লোকে পারে খেতে কব্জি ডুবায়ে এবারে!
সাহেবরা কেজরি বলে মাছ - ভাতের একটি সংমিশ্রণ খায় - অখাদ্য !!
ওহ দারুণ লেখা। কোন কথা হবে না।
দারুণ লাগছে লেখাটি...
খিচুড়ি আমার খুব প্রিয়