দক্ষিণ ভারত। আর সে অঞ্চলের প্রাচীনতায় প্রবেশ করেই পেয়ে গেলাম এক পরমাশ্চর্য মহাকাব্যভাণ্ডার, যা পরিচিত ‘সঙ্গম সাহিত্য’ নামে। সেই অবাক দুনিয়ায় আমি ঢুকে পড়েছিলাম এক ভদ্রমহিলার হাত ধরে — বৈদেহী হার্বাট। তাঁর পাঠানো একটি কবিতার স্তবকের মধ্যে দিয়ে —
মা, বহুকাল বেঁচে থেকো তুমি
শোনো আমার কথা
ওই দেখ, দেখ ওইখানে
নীলকান্তমণির আভায় সুউচ্চ পর্বত, তার
মেঘমাশ্লিষ্ট চূড়া
মাংসখণ্ড যেন চর্বিতে ঢাকা
শুকিয়ে যাবে না মা তোমার এই বাজরার ক্ষেত
বৈদেহী অবশ্যই পাঠিয়েছিলেন ইংরেজি তরজমায়, তা থেকেই এই বাংলা তরজমা। কিন্তু স্তবকটা পড়ে আমি কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে ভারতচন্দ্র — খানাদানার খোঁজে শাস্ত্র-সাহিত্যের আনাচে কানাচে ঘোরা আমার শেষ হয়নি, পর্বত শিখরে মেঘমালা নিয়ে কবির উপমারও কোনও শেষ নেই, কিন্তু এই আশ্চর্য তুলনা আর আমার চোখে পড়েনি কোনও ভাষাতেই— পাহাড় চূড়ায় মেঘে যেন মাংসের ওপর চর্বি! এ ভাষা তামিল। প্রাচীন তামিল। আর যাঁর সৌজন্যে এ স্তবক পাওয়া কে তিনি? হার্ভার্ড তামিল চেয়ার ইনকরপোরেটেড-এর বোর্ড-এর সদস্য। হাওয়াই নিবাসী। আর এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তন্নিষ্ট একাগ্রতায় তিনি করে চলেছেন সম্পূর্ণ সঙ্গম সাহিত্যের সটীক ইংরেজি তরজমা। এই তরজমা সম্পূর্ণ বিনিপয়সায় দেখা যায় এক দুরন্ত ওয়েবসাইটে— sangamtranslationsbyvaidehi.com। বিরিয়ানি নিয়ে যখন কিছুটা মাতামাতি করছিলাম, তখন খুঁজে পাই এই তরজমা খাজানা, আর সেই সূত্রেই আমার বৈদেহীর সঙ্গে পরিচয়। কী এই ‘সঙ্গম সাহিত্য’? সে এক পারাবার। তাতে একবার ঝাঁপ দিলে খিচুড়ি রহস্যোদ্ঘাটন অ্যাডভেঞ্চার চুলোয় যাবে। তাই আমরা খানিকটা প্লেন থেকে সমুদ্দুর দেখার মতো দেখে নেব ব্যাপারটা কী, এক ঝলকে।
বিগত এক দশকে তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা জেলার কিঝাড়ি অঞ্চলে মিলেছে ২০০ পূর্বসাধারণাব্দ, অর্থাৎ সঙ্গম যুগের নগর সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ।
প্রাচীন তামিল সাহিত্যের — বলা হয় — তিন প্রতিনিধি — তোলকাপ্পিয়ম নামের একটি ব্যাকরণ, গীতিকবিতার আটটি সংকলন, একত্রে যাকে বলে এট্টুত্তোকাই, এবং দশটি দীর্ঘ কবিতা১। তামিল পরম্পরা মতে, এই প্রাচীন সাহিত্য মাদুরাই শহরে তিনটি ‘সঙ্গম’ বা অ্যাকাডেমির — বৈদেহী বলেছেন ‘কনভেনশন’ — সঙ্গে যুক্ত কবিরা রচনা করেছিলেন। সঙ্গমগুলি নাকি চলেছিল যথাক্রমে ৪৪০০, ৩৭০০ এবং ১৮০০ বছর ধরে। প্রথম সঙ্গমের কোনও পুথি বা পাঠ আর অদ্যাবধি অবশিষ্ট নেই। তোলকাপ্পিয়ম দ্বিতীয় সঙ্গমের। এবং আটটি সংকলন ও দশটি কবিতা তৃতীয় সঙ্গমের। আটটি গীতিকবিতা সংকলন হলো — কুড়ুনতোকই, নত্রিনই, অকনানুড়ু, অইঙ্কুড়ুনুড়ু, কলিত্তোকই, পুড়নানুড়ু, পতিড়ড়পত্তু এবং পরিপাটল। এগুলির বিষয় প্রেম (অকম) ও সৌর্য (পুরম), যদিও তার অনেক গূঢ়তর ব্যখ্যা দিয়েছেন বৈদেহী। এ ছাড়া রয়েছে একটি নবম সংকলনও পথুপাট্টু। বৈদেহী যুক্ত করেছেন আর একটি ছোটো সংকলনও — পরিপাদল। বৈদেহীর আমাকে পাঠানো কবিতাটি অইঙ্কুড়ুনুড়ু থেকে নেওয়া। ইতিহাসের কঠোরতর বিচারে কোন সময়কালের এই সাহিত্য সম্ভার? ১০০ থেকে ৪০০ সাধারণাব্দের মধ্যে২। মানে মোটামুটি দেড়-দু হাজার বছর প্রাচীন।
বৈদেহীর তরজমায় এই দশটি কেতাব ঘেঁটে দেখেছি — রসনা সত্যান্বেষীদের কাছে সে এক মহা উত্তেজনাময় অ্যাডভেঞ্চার। অজস্র কিসিমের খানায় ভরপুর। শুধু ভাতের মধ্যেই পেয়েছি পেয়েছি — ‘নরম করে রাঁধা ভাতের দলা উলুন্থু (যাকে বলে কালি ডাল) দিয়ে’, খাওয়ার কথা, ‘সাদা ভাত ঘি দিয়ে নিখুঁত রান্নার’ কথা, ‘মিঠা তেঁতুলের আচার দিয়ে শ্বেতশাপলা পাতায় পরিবেশিত গরম ভাতের মণ্ডের’ কথা, ‘দই দিয়ে মাখা চালগুঁড়ির’ কথা, ‘গলান মাখন দেওয়া মিঠা-তেঁতুল-ভাতের’ কথা, ‘দুধ-ভাত’, ‘কালো চোখের ভরাল মাছ দিয়ে ভাতের বড়ো বড়ো দলা’, ‘ঘি দিয়ে রাঁধা খাসির মাংস এবং ভাত আর সাদা ইঁদুরের মাংস’ (এটি অবশ্য প্যঁচার চেঁচানি থামাতে সে পাখিকে দেওয়া ঘুষ!), ‘ভাত আর মাংসের বড় বড় টুকরো’, ‘মধু আর দুধ দেওয়া ভাত’ (পায়েস নির্ঘাৎ), ‘ঘি দেওয়া গলা ভাত’, ‘সুগন্ধী ঘি /তেল দিয়ে ভেজে রাঁধা ডাল দিয়ে ভাত’, ‘সুস্বাদু ভাতের সঙ্গে কলাই মিশান’, ‘সুগন্ধী ফুলে জারিত তাড়ি দিয়ে ভাত’, মায় ধেনো মদের কথাও। কিন্তু কোত্থাও নেই চাল-ডাল গলাগলি করে গলে যাওয়া কোনও খানার কথা। তবে আলাদা করে চোখে পড়ল, ‘এক সঙ্গে রান্না করা মাংস আর ভাতের’ কথা। আর সব থেকে মজা লাগল যখন পড়লাম — ‘বেঁটে পেয়ে শুয়োরের চর্বিওয়ালা দারুণ মাংসের টুকরো এবং ঘি দিয়ে রাঁধা ভাতের’ রেসিপি! বৃহদারণ্যকের মাংসৌদন, উত্তুরে বিফ ফেলে দক্ষিণে হলো পোর্ক মাংসৌদন! আর সে মজা আরও এক কাঠি বেড়ে গেল যখন পড়লাম — ‘এবং আমাদের রাজন্ দেন ঘি আর খরগোশের চর্বিওয়ালা মাংসের টুকরো দিয়ে রাঁধা ভাত’!! দিল্লির হিলটন হোটেলে ‘হেয়ার মিট’ দেওয়া যে দুরন্ত ‘স্পাঘেতি বোলোনেজ’ খেয়েছি, এ রান্নাকে তার দোসর ‘হেয়ার মিট রিসোত্তো’ বললে ক্ষতি কী?! তবে আমার নিজভূম পশ্চিম রাঢ়ের জঙ্গল থেকে ধরা মেটে মেঠো খরগোশ খেয়ে দেখেছি বেশ ছিবড়ে!
সঙ্গম সাহিত্য ছাড়াও যে প্রচীন তামিল সাহিত্যে রয়েছে সে সময়ের সমাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি তার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিলাপ্পাদিকরম — পায়ের মল। কন্নকী ও তার স্বামী কোভালনের করুণ প্রেমের গাথা। এর বিশিষ্ট ইংরেজি তরজমাকার অ্যালেন দানিয়েলু-র মতে এ কাব্য-উপন্যাসের সময়কাল ১৭১ সাধারণাব্দের আশেপাশে। এর রচয়িতা জৈন রাজকুমার আইলঙ্গ অদিগল, আর এতে মেলে ‘ওই কালের সমাজের বিষয়ে অবাক করে দেওয়া তথ্য’। আর সে তথ্য বলছে, ‘মাংসা দিয়ে রান্না করা ভাত’ বা ‘কড়া মশলা দেওয়া শালি চালের ভাতের’ কথা থাকলেও শিলাপ্পাদিকরম রসনা-অ্যাডভেঞ্চারারদের কাছে মোটেই তেমন রোমহর্ষক নয়। খিচুড়ির পূর্বজরা তো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কাজেই প্রাচীন দক্ষিণ ভারতে আম বা খাস কোনও মেনুর তালিকাতেই যে খিচুড়ি খুব ঘটা করে উপস্থিতি ছিল না, এ কথা অনুমান করা যেতেই পারে।
(ক্রমশ… পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার)