
কোনো এক বিশেষ ব্যক্তির নামাঙ্কিত চার শতাধিক বছর প্রাচীন খিচুড়ি—যেমন উদাহরণ আর দ্বিতীয়টি নেই—আসলে কী, সেরহস্যের কিছুটা সমাধান হল। এবার শুরু এ খানা কত প্রাচীন এই মহাখোঁজ। নীলাঞ্জন হাজরাভাবপ্রকাশ নিঘণ্টু-পূর্বখণ্ড-মিশ্রপ্রকরণ-কৃতান্নবর্গ
এতক্ষণ আমরা ঘোরাফেরা করছিলাম ভারতীয় ইতিহাসের সেই আলোকিত যুগে যেসময়ে প্রশাসন থেকে অর্থনীতি, চিত্রকলা থেকে স্থাপত্য, বিজ্ঞান থেকে সাহিত্য, জীবনের হরেক ক্ষেত্রে ঘটছিল নানা তাক-লাগানো কাণ্ডকারখানা, খিচুড়িও যে সে উদ্যাপনে পুরোদস্তুর হাজির ছিল তাও দেখলাম আমরা নানা হেঁশেলে পাত পেড়ে, এবং ক্রমে ক্রমে আরও বিস্তারিত ভাবে দেখব মুঘল খিচুড়ির বহর। কিন্তু প্রশ্ন হল এ খানা মোটামুটি কোন্ যুগের?
খিচুড়ির নানা হেঁশেলে যতই ঘুরেছি ততই জড়িয়ে পড়েছি এ রহস্যের জালে। ভারতের খাদ্যধারা নিয়ে যে-কোনো আধুনিক বই খুললে—যেমন কে টি আচেয়-র Story of Our Food খুললে কিংবা লিজি কলিংহ্যামের Curry খুললে—দেখা যাবে ধরেই নেওয়া হয়েছে খিচুড়ি ভারতের আমআদমির সুপ্রাচীন পরম্পরাগত খাবার। এই ধরে নেওয়াটা ঠিক কি? খতিয়ে দেখা দরকার। যদি এই ধরে নেওয়াটার ওপর আতসকাচ ফেলে দেখতে চাই — ঠিক কত প্রাচীন? তখনই বোঝা যাবে এ রহস্য কী সাংঘাতিক জটিল। প্রাচীন সংস্কৃত পুথিপুস্তকের যে বিপুল পারাবার তার প্রতিটি আঁজলা ছেনে দেখেছি এ কথা কল্পনা করারও দম আমার নেই, দাবি তো দূরস্ত্। তবু তার তীরে দু-চারটে নুড়ি কুড়োনোর সাধ্যে যা খুঁজেছি তাতে মাত্র একটি প্রাচীন সংস্কৃত মূলপাঠ পেয়েছি যার ওপর তর্জনী রেখে বলা গেলেও যেতে পারে—এই তো খিচুড়ি, কিংবা কমসেকম খিচুড়ি নামক খানাটির প্রথম কল্পনা—genesis (রান্না করা প্রত্যেকটি পদ—ব্যতিক্রমহীন ভাবে—যে কী পরমাশ্চর্য কল্পনা-সৃষ্টি তা ভেবেই আমি শিহরিত হই। কার কল্পনায় কী করে প্রথম এল, এ ঘাসের বীজ ছাড়িয়ে যদি সিদ্ধ করে নিই তবে তৈরি হয়ে যাবে অন্ন? কোন্ ইতিহাসকার পারবে সে কল্পনা মুহূর্তের পুনর্নিমাণ করতে?)। যেমন, যদি ধরে নিই বিরিয়ানির বীজ হল চাল-মাংস-ঘি এই তিন উপাদানের একত্রে পাক দেওয়া খানা—ধরে নেওয়াটা ঠিক না ভুল তা বলছি না, কারণ সে কিস্সা এখানে নয়, অন্যত্র অন্য কোনো দিন—কিন্তু যদি তাই ধরে নিই, তবে উচ্চারণ করা যেতেই পারে—‘‘যদি কেহ ইচ্ছা করে ‘আমার এমন পুত্র হউক্ যে, পণ্ডিত, প্রখ্যাত ও সভায় বিচারসমর্থ হইবে, রমণীয় বাক্য উচ্চারণ করিবে, সর্ব্ববেদ অধ্যয়ন করিবে, এবং পূর্ণায়ুপ্রাপ্ত হইবে’—তাহা হইলে তাহারা ঘৃত সংযোগে মাংসমিশ্রিত অন্ন রন্ধন করিয়া ভোজন করিবে। এই মাংস তরুণ বয়স্ক বলশালী বৃষের হইলে কিংবা অধিক বয়স্ক বৃষের হইলে (তাহারা উক্ত প্রকার সন্তান) উৎপাদনে সমর্থ হইবে।’’ বৃহদারণ্যক উপনিষদ্। ষষ্ঠ অধ্যায়। চতুর্থ ব্রাহ্মণ। ১৮ নম্বর শ্লোক!১ এ খানার নাম মাংসৌদন। এ খানাই পিশিতৌদন নামে উল্লিখিত আছে মহাভারতের সভাপর্বে, আর তারই আরও উন্নত রেসিপিতে রামায়ণে মাংসভূতৌদন নামে। পণ্ডিতদের মতে উপনিষদগুলির রচনাকাল ৭০০ থেকে ৫০০ পূর্বসাধারণাব্দ।২ এর মধ্যে প্রাচীনতমগুলির মধ্যে পড়ে বৃহদারণ্যক, কাজেই ধরা যেতে পারে তার রচনার সময় আনুমানিক ৭০০ পূর্ব সাধারণাব্দ। খিচুড়ির প্রথম পূর্বজও আমরা দেখব মোটামুটি একই সময়ের। ভারতীয় ইতিহাসের নিরিখে যা প্রাচীন বটে কিন্তু সুপ্রাচীন বলা যায় কি?
এই রহস্যভেদের খোঁজে প্রথমেই যা পাচ্ছি তা হল, খিচুড়ি শব্দটা নাকি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘খিচ্চা’ থেকে। মনিয়ার উইলিয়াম্সের বিখ্যাত সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধানের ২০০৮ সালের সংস্করণ খিচ্চা মানে জানাচ্ছে—‘a kind of dish (made of rice and pease৩&c)’।৪ আর জানাচ্ছে আর-একটি শব্দের কথা—খিচ্চি! তার মানেও একই। এই ‘খিচ্চি’ শব্দটির মানে, মনিয়ার উইলিয়াম্স জানাচ্ছে, দিমিত্রিয়োস গালানোস তাঁর অভিধানে, ওই একই দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, আশ্চর্য এই মানুষটি ভারত-প্রেমে পাগল হয়ে এথেন্স থেকে সাতাশ বছর বয়সে ১৭৮৭ সালে এসে হাজির হন বনবাদাড়ের কলিকাতায়। ছয় বছর এখানে থেকে ১৭৯৩ সালে চলে যান বারাণসী। ১৮৩৩ সালে মৃত্যু পর্যন্ত আর কোত্থাও যাননি। মূর্খ উগ্র জাতীয়তাবাদীদের পদে পদে, হ্যাঁ রান্নার পদে পদেও মনে করিয়ে দিতেই হবে, শক-হুনদল পাঠান-মোগল, আর্য-অনার্য ভাষাভাষী সকলের রক্তে-অশ্রুতে-পরিশ্রমে-আনন্দে একাকার হয়েছে আমাদের এইরকমাশ্চর্য দেশ ভারত! গালানোস দুনিয়ার প্রাচীনতম জীবন্ত শহরে তাঁর মৃত্যুর আগে আরও বহু লেখালিখির সঙ্গে রেখে গিয়েছিলেন নয় হাজারেরও বেশি শব্দার্থ দেওয়া সংস্কৃত-ইংরেজি-গ্রিক অভিধান। যাতে রয়েছে চাল-মটরের খিচ্চির কথা। তারপর? তারপর? কোনো সংস্কৃত মূলপাঠে খিচ্চাখিচ্চি নামে ‘চাল আর মটর ইত্যাদি’ দেওয়া কোনো খানার উল্লেখ কোথায়?
দেখব, কিন্তু তারও আগে এই খোঁজে একটা শূন্যস্থান পূরণ করা দরকার—এই খিচ্চা বা খিচ্চি আর খিচুড়ির মাঝের পথটা কী বা কেমন? আদৌ কি এর মাঝে কোনো পথ ছিল, নাকি খিচ্চা, খিচ্চির পরের স্টপই খিচুড়ি। আনাড়ি কানে শুনে তো তাই মনে হচ্ছে আমার। তা সুনিশ্চিত করার জন্য বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। প্রণম্য হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ম শরণম্ গচ্ছামি! এন্ট্রিটা হুবহু তুলে দিচ্ছি—খিচড়ি, -ড়ী, -চুড়ি, খিচরি, -রী: বি। ১। মিশ্রিত চাউল-ডাল-ঘৃত প্রভৃতির সিদ্ধ অন্ন বিশেষ। ২। (গৌণার্থে) বহু দ্রব্যের বা বিষয়ের সংমিশ্রণ।৫ এই এন্ট্রিতেই তৃতীয় বন্ধনীতে দেওয়া হয়েছে—‘সংকৃসর, -রা>প্রাকিসর, ‘কিসরা’।’ অস্যার্থ, সংস্কৃতে কৃসর বা কৃসরা, এবং তা থেকেই প্রাকৃতে হয়েছে কিসর বা কিসরা। আচ্ছা! তাহলে ওই দুইয়ের মাঝখানে কৃসর বা কৃসরা বসতি। আর কৃসরা পার করলেই যে খিচুড়িতে পৌঁছোনো যাবে তা সুনিশ্চিত হওয়া মাত্রই ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চারের ভাষায় যাকে বলে হাইভোল্টোজ স্পার্ক! আলোকিত হয়ে উঠল খিচুড়ির প্রাচীন ইতিহাসের এক সুনির্দিষ্ট রোমহর্ষক সফরের পথ। কিন্তু সেমুহূর্তে আমার কোনো ধারণাই ছিল না কী বিস্তীর্ণ এই কৃসর-কৃসরা জনপদ!
সেই কৃসরায় পৌঁছোনোর পথের শুরু হরিচরণ মহাশয়ের এই অভিধানের পৃষ্ঠা থেকেই। তাঁর এই খিচড়ি এন্ট্রিতে খুদি খুদি অক্ষরে দেওয়া রয়েছে আরও অনেক কিছু, যার মধ্যে একটি হল—তু ‘খিচ্চ’—কৃসরা (দেশী ১.১৩৪)। শাবাশ। এই ‘দেশী ১.১৩৪’ একঝটকায় খিচুড়িকে পিছিয়ে নিয়ে গেল হাজার বছর! কী করে? খতিয়ে দেখি। তু—তুলনীয়। দেশী, অর্থাৎ ‘দেশীনামমালা’, তার প্রথম অধ্যায়ের ১৩৪ তম এন্ট্রি। বহু খুঁজে পেতে সে কেতাবও মিলে গেল। এবং তার প্রথম অধ্যায়ের ১৩৪ তম এন্ট্রিতে যে শব্দগুলি প্রাকৃত ভাষায় অর্থ সহ উল্লিখিত, অব্যর্থভাবে তাতে মিলে গেল ‘অপূপখিচ্চেসু’ যার মানে, বন্ধুবর বিষাণ বসুর মাধ্যমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের প্রাক্তন অধ্যাপ কবি জয়া গোস্বামীর সাহায্যে জেনে গেলাম—অপূপ: পিঠে এবং খিচ্চ: যার অর্থ দেওয়া রয়েছে ‘ধান্যমিশ্রাচ’৬, অধ্যাপক গোস্বামীর মতে এ হল ‘চালের মিশ্রণে তৈরি’ কিছু। কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা হল, খিচ্চ কথাটার দেশীনামমালায় উল্লেখ। কী এই দেশীনামমালা? সম্পূর্ণ ‘দেশী’ শব্দের প্রাকৃত ভাষায় অর্থের একটি অভিধান। এর রচয়িতা ছিলেন জৈন সুপণ্ডিত, গবেষক, বৈয়াকরণ, কবি, দার্শনিক, ইতিহাসকার—আক্ষরিক অর্থেই পলিম্যাথ—আচার্য হেমচন্দ্র সূরি। তাঁর জন্ম গুজরাটের আহমেদাবাদে, ১০৮৮ সালে। জন্মের সময় হিন্দু ছিলেন, জৈন ধর্মে দীক্ষা নেন ১১৪৫ সাধারণাব্দে, কী আশ্চর্য, খমভটে! (মনে পড়ছে কি? সেই খমভট যেখান থেকে আহমেদাবাদ যাত্রার পথেই বাজরা খিচড়ি চেখে পুলকিত হয়েছিলেন জাহাঙ্গির বাদশা!) ১১৭৩-এ তাঁর মৃত্যু হয়।৭ কাজেই নিশ্চিত ভাবে একাদশ শতকে ‘খিচ্চ’ খাচ্ছিলেন ভারতবাসী, খুব সম্ভবত যাঁদের মধ্যে ছিলেন হেমচন্দ্রের স্বদেশীয় গুজরাটবাসীরাও! জাহাঙ্গির বাদশাহের সেপ্রদেশে দাপিয়ে বেড়ানোর সাড়ে চারশো বছর আগে। এবং আজ থেকে অন্তত সাড়ে আটশো বছর আগে। এই খিচ্চ বিশেষ ভাবে জৈন আহার ছিল কি না জানি না, কিন্তু এক জৈন মহাপণ্ডিতের পরিশ্রমী গবেষণায় তা চিরকালের মতো জায়গা করে নিল ইতিহাসের দস্তরখওয়ানে!
এবার দেখা দরকার কৃসরা বা কৃসর-র পথ কোথায় নিয়ে যায় আমাদের। ঢুকব সেই বিপুল জনপদে, আগামী কিস্তি থেকে!
(ক্রমশ… পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার।)
ওয়াহেদ মির্জা | 2401:4900:3829:ce2a:1be:f53f:384b:***:*** | ০৩ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:২১100891ভালো লাগলো ,শুভেচ্ছা থাকল লেখুন ,পড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকব
kk | 97.9.***.*** | ০৩ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:১০100896আমি কোথাও পড়েছিলাম (কোথায় তা এখন আর মনে নেই) যে খিচুড়ি বা খিচুরি কথাটা এসেছে খেচরান্ন থেকে। পাখীদের চালডাল মিশিয়ে খেতে দেওয়া হত বলে খেচরের অন্ন। এইসব। সেটা তাহলে ঠিক তথ্য নয়?
kk | 97.9.***.*** | ০৩ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:২৮100899ওঃ, লেখক অষ্টম পর্বে অলরেডি লিখেছেন! কোনো কারণে মিস করেছিলাম। দুঃখিত!
Amit | 121.2.***.*** | ০৪ ডিসেম্বর ২০২০ ০৬:২১100910অসাধারণ হচ্ছে এই পুরো সিরিজটা। একটা প্রশ্ন আছে। চাল বা ডাল -এই শস্য গুলো প্রথম কোথায় কোথায় চাষ বাস শুরু হয় ? কোনো তথ্য পাওয়া যায় এগুলোর অরিজিন নিয়ে ?
ম | 2601:247:4280:d10:341c:b74c:42d9:***:*** | ০৪ ডিসেম্বর ২০২০ ০৬:২৫100911কী চমৎকার!
সুস্বাদু সিরিজ।
ar | 96.23.***.*** | ০৮ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪৪101016হরিচরণ মহাশয়ের অভিধানে ঐ লাইনটার (দেশীনামমালা) দু তিন লাইন পরেই আরেকটি ""এন্ট্রী" আছে; "ম ম" বা মনসামঙ্গল থেকে। এইটা বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল থেকে উদ্ধৃত। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে বিজয় গুপ্ত পূর্ববর্তী কবিদ্বয় হরিনাথ দত্ত এবং নারায়ণ দেব কে অনুসরণ করেছিলেন। তাহলে মনে হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাহী ফরমানের অনেক আগে থেকেই বাঙ্গালার ঘরে ঘরে খিচুড়ী রান্না হয়ে আসছে!!!